বারোটা রঙিন, ফুরফুরে স্বপ্নের মত গপ্পো নিয়ে সাজানো বইটির নাম 'আশ্চর্য কৌটো"। গপ্পোগুলি লিখেছেন গৌরী ধর্মপাল। এই বইটি পড়া শেষ করে মনে হল - নামের রেশ ধরে, এই বই নিজেই এক আশ্চর্য বই।
আশ্চর্য কেন? তাহলে বলি শোনো। এই বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে নানারকমের পশু, পাখি, পোকামাকড়, তাঁতী, দরজি, কাঠুরে, বণিক থেকে রাজা- রানী- রাজার কন্যে — সব্বাইকে নিয়ে গপ্পো। গপ্পোগুলিকে রূপকথাই বলা চলে, যদিও একেকটা গপ্পে রূপকথার সঙ্গে মিলে মিশে গেছে লোককথা রং আর উপকথার সুর। মিলেমিশে প্রতিটি হয়ে উঠেছে একেবারে আলাদা স্বাদের, আলাদা স্বরের — সহজ বাংলার ভাষায়, বাংলার খোকাখুকুদের জন্য নিজস্ব রূপকথা।
গৌরী ধর্মপালের ছোটদের জন্য লেখা বইগুলিতে ( বড়দের বই-এর কথা বলছিই না এখানে) তাঁর ভাষার ব্যবহার নিয়ে আলাদা করে একটা ছোটখাটো প্রবন্ধ লেখা যায়। কিন্তু এখানে সেই কাজ আমি করছি না। আমার থেকে ঢের ভালোভাবে ,'মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্র' বইয়ের ভূমিকায় সে বিষয়ে লিখে দিয়েছেন স্বয়ং লীলা মজুমদার। খুঁজে নিয়ে পড়ে দেখো বরং।
আমি শুধু বলতে পারি, এত নরম, মিষ্টি, হালকা, ভোরের আলোর মত, ফুলের সুগন্ধের মত, বৃষ্টির আওয়াজের মত, নদীর বয়ে চলার মত, মায়ের আদরের মত— বাংলা লেখা কিন্তু মোটেও সহজ কাজ নয়। কিন্তু সেই কাজটি অবলীলায়, হেসে হেসে করে ফেলেছিলেন গৌরী ধর্মপাল — একাধিক ভাষায় পান্ডিত্য না থাকলে , আর নিজের বড় হয়ে যাওয়া মনের মধ্যে একটা শিশুমন বাঁচিয়ে না রাখলে, এমন করে হয়ত লেখা যায়না।
এই বইয়ের কাহিনিগুলি নিছক মনভোলানো, ঘুম পাড়ানো গপ্পো নয়, খুব সহজে, একেবারে আলতো পালকের ছোঁয়ার মত ছুঁয়ে দিয়ে দিয়ে, লেখিকা আমাদের কত কীই না শিখিয়ে দিলেন! কী কী শিখিয়ে দিলেন? - সেই তালিকা তো অ-নে-ক লম্বা! বলি শোনো —
'পলকা' গল্পে, পলকা নামের বাচ্চা ফড়িংকে খুকুর কাঁচের বোতল থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য তার বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগ দেয় লাল পিঁপড়ে, উচ্চিংড়ে, গুবরে, উইপোকাদের পরিবার। তাদের সবার নামের কীই না বাহার! লাল পিঁপড়েদের নাম হল লালু, লালি, লালিমা, লাল্টু, লালচে; আর উচ্চিংড়েদের? — উচ্ছে, তুচ্ছ, ইচ্ছে, হ্যাঁচ্চো...আবার গুবরে পোকার ছেলেপুলেদের নাম হল বাবরি, চাবড়া, ধ্যাবড়া! তবে আমার সবথেকে পছন্দ হয়েছে উইঠাকুর্দা নিতুই-নব আর উই ঠাকুমা ছুঁই -ছুঁই এর বাড়ির কাজের মেয়েটির নাম — '... তার নামটা এত লম্বা যে তার নিজেরই মনে থাকেনা, কাজ করতে করতে বার বার মুখস্থ করে নেয়। নামটা হল —
ফিনাইলে আর ডেটলে-নিত্যি-মুছি-ভুঁ ই-
কাচের বাদন সাবান জলে কিংবা ভিমে ধুই
মাইনে কেন পাইনে তবু বল দিকিনি তুই...
ফড়িং ছানা উদ্ধার হওয়ার গল্পের সঙ্গে সঙ্গে কেমন হাসতে হাসতে সহজ -কঠিন বাংলা শব্দ শিখিয়ে দিলেন গৌরবুড়ী!
এমনভাবেই 'ময়নামতী' গল্পে আমরা জেনে যাই বাংলার নানারকমের নকশিকাঁথার নাম ; 'লালবাড়িটার ঘুলঘুলিতে' গল্পে চড়ুই-গিন্নির সংগে চড়ুই-কত্তার জন্য ওষুধ খোঁজার ফাঁকে, বাংলার নিজস্ব খাবার বড়ি আর বড়ি দেওয়ার আচার-উপায় এর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের বড়ির নাম জেনে যাই আমরা। এক সময়ে বাংলার মেয়েরা চরকায় সুতো কেটে, তাঁতীদের যোগান দিয়ে নিজেদের হাতখরচ এবং পরনের কাপড় যোগাড় করতেন। 'গাগুনির চরকা' কাহিনির পরতে পরতে মিশে রয়েছে সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের গল্প, সঙ্গে রয়েছে বাংলার তাঁতশিল্প আর মসলিন শাড়ির কথা।
ঠিক এমনভাবেই সবকটি গল্পের মধ্যে, সরাসরি কিছু না বলে, শুধুমাত্র একদু' কথায়, লেখিকা তাঁর ছোট্ট পাঠক-পাঠিকাদের শিখিয়েছেন একে অপরকে ভালোবাসার মন্ত্র, দিয়েছেন সহিষ্ণুতা আর অল্পে খুশি থাকার পাঠ। 'ফুল্লরার পুতুল' গল্পে তাই ফুল্লরার নতুন বন্ধুরা তার কাগজের পুতুলের মাথা ফাটিয়ে দিলেও, পালক লাগিয়ে সেটা মেরামত করে দেয়, আর ফুল্লরা ভাবে ' আগের চেয়ে ঢের ঢের সুন্দর দেখাচ্ছে পুতুলটাকে'। 'রাজকন্যা ও কইমাছ' গল্পে রাজকন্যা যখন বুঝতে পারে যে কইমাছদের খেতে হলে আগে তাদের মেরে ফেলতে হবে, তখন সে কেঁদেকেটে খাওয়ার বদলে তাদের পোষার আবদার জানায়।
ছোট্ট ছোট্ট তুলির টানে এই বই-এর অনেকটা জুড়েই রয়ে গেছে ছোট্ট ছোট্ট মেয়েদের আর মেয়েদের জীবনকে কেন্দ্র করে হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ-আনন্দ-রোমাঞ্চে ভরা গল্প — খুকু, ময়নামতী, গাগুনি, ফুল্লরা, রাজকন্যা, কঙ্কণা এরা সবাই গল্পের প্রধান চরিত্র; প্রচলিত রূপকথার রাজকন্যাদের মত বন্দিনী নয় বা রাজপুত্রের অপেক্ষায় থাকে না। নিজেরাই ভুল কাজ বা ঠিক কাজ করে, আবার বাবা মাকে তাঁদের কাজে সাহায্য করে।
'এক যে ছিল মানুষ ' গল্পে কোবরেজ বুড়ো খোঁড়া কাঠুরে একটা তেলের শিশি দেয়, যেটা মেখে তার পা ঠিক হয়ে যায়। গল্পের শেষে আমরা জানতে পারি, সেই শিশির তেল ফুরোয় না। তাদের বিরাট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কারোর হাতে পায়ে লাগলে তার কালো বৌ সেই তেল তাকেও দেয়। এই গল্পে 'কালো বৌ' কে নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছিল সবল, সফল কাঠুরে —
রংটি চিকন শ্যামলা কালো
দেখতে তো ভালোই শুনতে আরও ভালো
'ময়নামতী' গল্পে ময়না আর তার মাকে সারাবছরের খাবার, কাপড় আর অন্যান্য সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করে দেয় গ্রামের মানুষ, কারণ ময়নার মা তাদের সবার জন্য শীতের কাঁথা বানিয়ে দেয়। এই গল্পের শেষে খুব আলতো করে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বার্তা দেন লেখিকা -' কেবল প্রত্যেক বছর পুজোর সময় মহালয়ার দিন সবথেকে সেরা একজোড়া শাঁখা বেছে নিয়ে শাঁখারিমামা যখন ময়নাদের বাড়ি গিয়ে হাঁক দেয়,ও ময়না, আছিস নাকি?তখন ময়নার মা বেরিয়ে এসে বলে, এবছরটা থাক দাদা, আসছে বছর দিও। '
এই বইয়ের একটু বড় দুটি গল্প 'ভুবনডাঙার জাতখেলুড়ে' আর 'আশ্চর্য কৌটো' শুধু ছোট্টদেরই নয়, বড়দের জন্যেও ভাবনার খোরাক যোগায়। 'ভুবনডাঙার জাতখেলুড়ে' গল্পে বুড়ো কারিগরের সঙ্গে সঙ্গে পাঠককেও খুঁজে নিতে হয়, বুঝে নিতে হয় তার বাবার বলে যাওয়া তিন পংক্তির অর্থঃ
রূপের কাটি শোনার কাটি
ভুবনডাঙার পাবন মাটি —
এ তিন না হলে সবই মাটি ।
এই তিনটি সূত্রের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সৃষ্টির চাবিকাঠি। যে এই তিনের ছোঁয়া পায়, তার কাছে সব সৃষ্টিই আলোর মত,বাতাসের মত অনাবিল হয়ে যায় — সে হয়ে ওঠে জাতখেলুড়ে — ঠিক যেমন ছিলেন লেখিকা নিজেই।
ছোটদের সঙ্গে সঙ্গে বড়দেরও ভালো লাগার মত এই বইটি শিশু সাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশিত। বইটির প্রচ্ছদশিল্পী দেবব্রত ঘোষ এবং অলংকরণ করেছেন নভেন্দু সেন।
বইঃ
আশ্চর্য কৌটো
গৌরী ধর্মপাল
শিশু সাহিত্য সংসদ
মূল্যঃ ১২৫/-