সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
একটা জেদী মেয়ের গল্প

চলো, আজ একটা হার না মানা মেয়ের জয়ের গল্প শুনব। মেয়েটার নাম অরুণিমা সিন্‌হা।

তার বাড়ি ছিল উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্মৌ নগরী থেকে ২০০ কিমি দূরে আম্বেদকরনগর বলে একটা শহরে। বাবা সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার, মা স্বাস্থ্যদপ্তরের কর্মী। তিন বছর বয়সে বাবাকে হারালেও মা, দিদি, ভাই, এদের ছত্রছায়ায় সেই মেয়ে মোটামুটি হেসেখেলেই বড় হচ্ছিল। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলোয় উৎসাহ ছিল, জাতীয় স্তরে ভলিবলও খেলেছে সে। একটু বড় হতে পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর চাকরি খোঁজার সময় এল। ২০১১ সালে সি আই এস এফ (CISF) এ চাকরির ব্যাপারে ডাক পেল অরুণিমা।

এরপর এল সেই দিনটা। চাকরি-সংক্রান্ত একটা কাজেই পদ্মাবৎ এক্সপ্রেসের অসংরক্ষিত কামরায় উঠে মেয়েটা দিল্লি যাচ্ছিল। প্রচণ্ড ভিড় সেই কামরায় হঠাৎই চার-পাঁচজন ডাকাত এসে হাজির হয়। তারা অরুণিমার গলা থেকে সোনার হার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে সে রুখে দাঁড়ায়, বাধা পেয়ে ডাকাতরা রাগের বশে তাকে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে রেললাইনে ফেলে দেয়। রেললাইনে প'ড়ে বাঁ পা-টাকে লাইনের ওপর থেকে সরানোর আগেই আরেকটা ট্রেন চলে যায় সেই পায়ের ওপর দিয়ে।

তারপর সারা রাত অরুণিমা ছিন্নভিন্ন বাঁ-পা নিয়ে রেললাইনের ওপরেই পড়ে রইল। সকালে রেললাইনের ধারে প্রাতঃকৃত্য সারতে আসা লোকজন তাকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি করল। সেখানে তার বাঁ-পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে বাদ দিতে হল, ডান পায়ের টুকরো হয়ে যাওয়া হাড়গুলোকে জুড়ে রাখতে সেখানে বসানো হল রড। এরপর কিছুদিন হৈ-চৈ, সহানুভূতি, তারপর ধীরে ধীরে লোকে অরুণিমাকে ভুলে যেতে লাগল।

অরুণিমা কিন্তু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্রথমে মনে মনে ভেঙে পড়লেও আস্তে আস্তে নিজেকে গুছিয়ে নিতে লাগল। একটা নকল পা আর আরেকটা রড-বসানো পা, এই সম্বল নিয়ে সে মনে মনে ঠিক করল মাউণ্ট এভারেস্ট জয় করবে। তার ইচ্ছেটা অদম্য, কারণ, হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই সে যোগাযোগ করল ভারতের প্রথম এভারেস্ট-বিজয়িনী পর্বতারোহী বাচেন্দ্রী পালের সঙ্গে। উত্তরকাশীর নেহরু ইন্সটিটিউট অফ মাউণ্টেনিয়ারিং থেকে আঠেরো মাসের ট্রেনিং নিল সে। কৃত্রিম পা নিয়ে পাহাড়ে চড়ার যেসব মারাত্মক সমস্যা, সেগুলোকে কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য মনোবলের সাহায্যে জয় করতে লাগল অরুণিমা।

২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে টাটা গ্রুপ-প্রযোজিত ইকো-এভারেস্ট অভিযানের দলের সদস্য অরুণিমা তার হিমালয় যাত্রা শুরু করলেন, বাহান্ন দিন পরে, ২০১৩ সালের ২১শে মে তিনি পৌঁছালেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শিখরে। ভারতের অরুণিমা সিন্‌হার নাম লেখা রইল ইতিহাসের পাতায়, তিনি হলেন বিশ্বের প্রথম মহিলা, যিনি কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাহায্যে মাউণ্ট এভারেস্ট জয় করেছেন।

একটা জেদী মেয়ের গল্প

ভাগ্যলিখন ইত্যাদির দোহাই দিয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে না থেকে যাঁরা জেতার অদম্য ইচ্ছে আর চেষ্টাকে প্রাধান্য দেন, ঈশ্বর এবং ভাগ্য তাঁদেরই সাহায্য করেন, অরুণিমা এই তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাই আকস্মিক দুর্ঘটনায় জীবনের ছন্দ কেটে গেলেও নিজের মনের জোর আর চেষ্টাকে সম্বল করে তিনি সাফল্যের শিখরে পৌঁছে গেলেন। এরপর শুরু হল তাঁর জয়যাত্রা।

প্রতিটি মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে দেশের জাতীয় পতাকা ওড়াবেন, এই হল তাঁর নতুন লক্ষ্য। আফ্রিকার মাউণ্ট কিলিমাঞ্জারো (২০১৪ সালে), অস্ট্রেলিয়ার মাউণ্ট কোসিউজকো (২০১৫ সালে), দক্ষিণ আমেরিকার মাউণ্ট আকঙ্কাগুয়া (২০১৫ সালে), ইউরোপের মাউণ্ট এলব্রুস (২০১৪ সালে)-সহ পর্যন্ত ছ'টি শৃঙ্গ জয় করেছে সে, আণ্টার্কটিকা আর উত্তর আমেরিকা অভিযান এখনও বাকি।

একটা জেদী মেয়ের গল্প

অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকারের কাছ থেকে অরুণিমা ২০১৫ সালে 'পদ্মশ্রী'পুরস্কার লাভ করেন। এভারেস্ট-জয় এবং তার নেপথ্যের অভিজ্ঞতা নিয়ে অরুণিমা সিন্‌হার লেখা বই 'Born Again on the Mountain' (বর্ন এগেইন অন দ্য মাউন্টেন) প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ সালে। অরুণিমার অভিজ্ঞতা জানতে হলে এবং তাঁর জেদ আর লড়াই থেকে কিছু শিখতে চাইলে বইটা পড়ে দেখতে পারো।

পর্বতারোহণের পাশাপাশি অরুণিমা আরও একটা ব্রতে নিজেকে সামিল করেছেন। বিশেষভাবে সক্ষম ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি তৈরি করেছেন খেলাধুলো শেখার স্কুল, 'শহীদ চন্দ্রশেখর আজাদ দিব্যাঙ্গ খেল অ্যাকাডেমি' এবং কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গবেষণা কেন্দ্র। উত্তরপ্রদেশের এই সংস্থা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ, বিশেষত বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের প্রয়োজনে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন খেলার প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অন্যান্য সমাজকল্যাণমূলক কাজেও এই সংস্থা এগিয়ে আসে।

এই হল অরুণিমা সিন্‌হার কাহিনি, যা আরেকবার প্রমাণ করে, ভাগ্যে কি লেখা আছে, তা নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি নিজে কি চাও, সেটা আগে বুঝে নাও, তারপর সেই লক্ষ্যে অবিচল থেকে নিজের সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে থাকো, সাফল্য তোমার হাত ধরবেই। অন্ধকার চিরস্থায়ী নয়, তোমার চেষ্টা তোমায় আলোয় ফেরাবে।


ছবিঃ
অরুণিমা সিন্‌হা ডট কম
অ্যালাইন থট্‌স্‌ ডট কম

ভূতপূর্ব ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে সাংসারিক কাজের মাঝে সু্যোগ পেলেই পড়া আর লেখার আনন্দে মাতার চেষ্টায় থাকেন। সেই গোত্রের মানুষ, যারা আর কিছু না পেলে ঠোঙ্গায় ছাপা খবরও মন দিয়ে পড়েন। সারাদিনের অনেকটা সময় কাটে মেয়ে কুটুনের সঙ্গে; তার কীর্তিকলাপ মাঝেমধ্যে লিখতে চেষ্টা করেন;বর্তমানে ধানবাদের বাসিন্দা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা