একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়—'সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধা জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি!' কথাটা শুনলে আফসোস হয়, অগ্নিযুগের এত বঙ্গ-বিপ্লবী, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় এত বাঙ্গালি-মণীষা, তবু কেন এই গঞ্জনা সইতে হবে? তার কারণ, হয়তো স্বাধীনতা উত্তর কালে ক্রমে ভারতের অন্যান্য রাজ্য বাংলাকে পিছনে ফেলে, প্রতিভার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গিয়েছিল, বাঙালি যেন কেবল কলমপেশা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় হয়েই থেকে গেল, ক্ষমতাবানের পদলেহন, সহযাত্রীর উন্নতিতে ঈর্ষাকাতর ষড়যন্ত্র ও চা-সহযোগে তুমুল আড্ডাবাজী—এই হয়ে দাঁড়ালো বাঙ্গালির পরিচিতি।
সময়টা উনবিংশ শতাব্দির আশপাশ। বাতাসে বিপ্লবের গন্ধ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাংলার ছেলেমেয়েরা পথে নামছে, স্বদেশী আন্দোলনের এজেন্ডা হয়েছে বিদেশী জিনিস বয়কট, দেশী খদ্দের ও চরকায় বোনা বাংলার তাঁতের শাড়ির জয়গান প্রচারে তরুণ প্রজন্ম সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। কিন্তু বিদেশ থেকে বাজারে আসা পলিয়েস্টার ও সুতোর সঙ্গে অন্যান্য কৃত্রিম তন্তু মিশিয়ে তৈরি করা নরম, হালকা ও উজ্জ্বল রঙের কাপড় কচিকাচাদের মন কেড়ে নিয়েছে। শ্রীসারদা দেবী সেবছর দুর্গাপুজোর সময় জয়রামবাটিতে। আসন্ন পুজো উপলক্ষে বাড়ির মেয়েদের জন্য কাপড় কিনতে এক সেবক-সন্তানকে বাজারে পাঠিয়েছেন, সে স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থক। দেশী তাঁতের কাপড় কিনে আনল। বাড়ির মেয়েদের তা পছন্দ হয়নি। শ্রীমা সেবককে বিলাতি কাপড় আনার কথা বলতে সে সতেজে স্বদেশীয়ানার কথা বলতে থাকে। প্রখর বাস্তববুদ্ধি সম্পন্না শ্রীমা সবই বুঝলেন, কেবল বললেন, 'তারা ছেলেমানুষ, অতশত কি শুনতে চায়? তা যদি বলো, তারাও (ব্রিটিশ) তো আমার ছেলে!'' কিন্তু সেই সেবককে তিনি আর বাজারে পাঠালেন না, তিনি কারো ভাব ভঙ্গ করতেন না। অন্য আরেকজনকে ঐ কাপড় পালটে বিলাতি কাপড় কিনে আনতে বললেন।
ভারতে উৎপন্ন তুলো উৎকৃষ্ট মানের। কিন্তু সেই তুলো থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক মানসম্পন্ন বস্ত্র তৈরির উপযুক্ত প্রযুক্তি তখন ভারতের অধরাই ছিল। সেই সময়েও দেশজ কাঁচামাল ব্যবহার করে দেশীয় পদ্ধতিতে দেশী জিনিস দেশবাসীর কাছে বিক্রি করে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেছিলেন এক বাঙালি উদ্যোগপতি, ইংরাজিতে যার গাল ভরা নাম—'অন্ত্রপ্রিনিয়ার', সেই 'অন্ত্রপ্রিনিয়ারশিপ'-এ বাঘা বাঘা বিদেশী কম্পানিকেও পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন এক বঙ্গসন্তান—তাঁর নাম হেমেন্দ্রমোহন বসু।
ব্যবসা আরম্ভর গোড়ার কথা:
সম্পর্কের দিক থেকে বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলের আদরণীয় আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর ভাইপো হেমেন্দ্রর জন্ম অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার জয়সিদ্ধি গ্রামে। পিতা হরমোহন বসু ভক্তিপরায়ণ ও সত্যাশ্রয়ী। তাই আইন পড়লেও ওকালতি না করে মুন্সেফ হয়েই থাকলেন। তাঁর ভাইরা সবাই বিখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত; মেজ আনন্দমোহন ভারতের প্রথম র্যাঙ্গলার, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ছোটভাই মোহিনীমোহন বিদেশের ডিগ্রিধারী ভারতের প্রথম হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। হরমোহনের নিজের চারটি ছেলে, হেমেন্দ্রমোহন সবার বড়। হেমেন্দ্রর বয়স যখন তেত্রিশ, পিতা হঠাৎই দেহ রাখলেন। পারিবারিক সচ্ছলতা, তরুণ বয়সের উৎসাহ এবং অসামান্য মেধা ও প্রতিভার সঙ্গে স্বদেশপ্রীতি সম্বল করে তিনি একের পর এক নতুন নতুন ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
বাণিজ্য অভিযানের নেপথ্যে আছে অন্য একটি ঘটনাও। এক সময়ে, জগদীশচন্দ্রের ইচ্ছা ছিল মেডিকাল কলেজে ডাক্তারি পড়বার। ম্যালেরিয়ায় ভুগে তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। আদরের ভাইপো, মেধাবী হেমেন্দ্র কাকার ইচ্ছায় ডাক্তারি পড়তে মেডিকাল কলেজে ভর্তি হলেন। জগদীশচন্দ্র নিজে সেসময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক। গবেষণায় উৎসাহী হেমেন্দ্র অবসরে প্রেসিডেন্সির ল্যাবরেটরিতে আসতেন বটানির উপর কিছু গবেষণা করতে। একদিন অসাবধানে কোনও রাসায়ণিক তরল তাঁর চোখে ছিটকে এল। তাতে চোখ একেবারে অন্ধ হওয়ার উপক্রম। পড়াশুনো বন্ধ হয়ে গেল, চোখের চিকিৎসার জন্য ব্যান্ডেজ বেঁধে পড়ে থাকতে হল দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ মাস। অবশেষে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন, কিন্তু 'আনফিট' সাব্যস্ত হওয়ায় ডাক্তারি পড়া আর হল না। সাধারণ ছেলে হলে এই দুর্ঘটনায় ভেঙে পড়ত, হয়তো পারিবারিক পুঁজি ভাঙিয়ে বাকি জীবন নিষ্কর্মা হয়েই কাটিয়ে দিত। সেকালে এই ধরনের বিলাসী বাবু সম্প্রদায়ের অভাব ছিল না। কিন্তু হেমেন্দ্রমোহন ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। নতুন কিছু করার নেশা ছিল তাঁর রক্তে। রসায়ণের ছাত্র হেমেন্দ্রর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, দেশে গন্ধদ্রব্যের ব্যবসায় লাভ আছে। কিন্তু শুধু লাভের কথা ভেবে ব্যবসা করবেন, এমন সাধারণ স্তরের মানুষ নন তিনি। তাঁর অন্তর্নিহিত স্বদেশানুরাগ বিদেশাগত প্রসাধন সামগ্রীর বাজারের বিরুদ্ধে একহাত নেওয়ার একটা পথও খুঁজে পেল।
প্রসাধনী দ্রব্যের ব্যবসায় 'এইচ বোস' ব্র্যান্ড:
উনিশ শতকের কুড়ির দশকে চার লাইনের ছোট্ট একটি ছড়া ছড়িয়ে পড়েছিল লোকের মুখে মুখে— 'কেশে মাখ 'কুন্তলীন'/রুমালেতে 'দেলখোস'/পানে খাও 'তাম্বুলীন'/ধন্য হোক্ এইচ বোস।।' এই 'এইচ বোস'ই তৎকালীন বাংলার সফল ব্যবসায়ী হেমেন্দ্রমোহন বসু। ১৮৮০ সালে, মাত্র ২৬ বছর বয়সেই 'কুন্তলীন' কেশতৈলের কারখানা খুলেছিলেন নিজের বাড়িতে, তারপর একটানা প্রায় সত্তর বছর সেই সুগন্ধী তেল বাঙালির নিত্য ব্যবহার্য হয়ে উঠেছিল। প্রফুল্ল রায় বেঙ্গল কেমিকাল প্রতিষ্ঠার পর হয়তো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর এই সাফল্য দেখেই প্রসাধনী দ্রব্য প্রস্তুতিতে উৎসাহী হয়েছিলেন। সুবাসিত, পদ্মগন্ধ, গোলাপ, যুঁই, চন্দন, বোকে, ভায়োলেট কুন্তলীন—এই সাত রকমের কেশতৈল ছাড়াও বাজারে এনেছিলেন খাঁটি দেশী পদ্ধতিতে তৈরি আতরিন, ল্যাভেন্ডার ওয়াটার, মৃগনাভি ল্যাভেন্ডার, অ-ডি-কোলন, রোজ ও সুপিরিয়র পমেটমস, মিল্ক অফ রোজ, অপরাজিতা সেন্ট, স্পেশাল এসেন্স প্রভৃতি সুগন্ধী; টয়লেট পাউডার; রোজ কার্বলিক টুথ পাউডার; পান-মশলা 'তাম্বুলীন'; 'ক্যাস্টারীন' ক্যাস্টর অয়েল; কোকোলীন সাবান; শরবতের সিরাপ; গোলাপ দন্তমঞ্জন, ফ্লোরিডা ইত্যাদি বিবিধ দ্রব্যের বিশাল সম্ভার—এক কথায় সকালে দাঁতের মাজন থেকে শুরু করে দিনের শেষে কোষ্ঠকাঠিন্যের ওষুধ পর্যন্ত—বাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুই জোগান দিচ্ছিলেন 'এইচ বোস'। দামও রাখা হত সাধ্যের মধ্যে। বড় এক বোতল ভায়োলেট কুন্তলীনের দাম পড়ত প্রায় তিন টাকা আর দাঁতের মাজন তিন আনা। আর গুণগত মানের কথা বলতে হলে ভাইঝি পুণ্যলতা চক্রবর্তীর একটি লেখা উদ্ধৃত করতে হয়—'ছোট পিসিমারা আমাদের কাছেই একটা বাড়িতে থাকতেন।— সে বাড়ির তিন-তলায় লম্বা একটি ঘরে পিসেমশাই হেমেন্দ্রমোহন বসু (এইচ বোস) তাঁর লেবরটরি করেছিলেন; সেখানে বসে তিনি নানা রকম সুগন্ধি তৈরীর পরীক্ষা করতেন। ঘরটার দিকে গেলেই সুগন্ধ ভুরভুর করত। কত রকমের শিশি বোতল, রাশি রাশি ফুল, চোলাই করবার যন্ত্র, বড় বড় পাথরের খল ও হামানদিস্তা; এককোণে একটা সোডা তৈরীর কল, সে রকম আমরা আগে কখনও দেখিনি। হাতল টিপলেই ভুরভুর করে নল দিয়ে সোডা ওয়াটার বেরোত, সিরাপ মিশিয়ে আমাদের খেতে দিতেন, রুমালে জামায় সুগন্ধ এসেন্স দিয়ে দিতেন।'
কুন্তলীন তেলের সাফল্যের পরেই সাহস করে বাজারে আনলেন 'দেলখোস' সুগন্ধি। দেলখোসের সুগন্ধে বাঙালি এতই মজেছিল যে, হেমেন্দ্রমোহনের ৬১ নং বৌবাজার স্ট্রিটের বাড়ির নামই হয়ে গিয়েছিল 'দেলখোস হাউস'। কুন্তলীন-দেলখোসের গুণমুগ্ধদের মধ্যে ছিলেন বহু বিখ্যাত মনীষী, যেমন-আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ইন্ডিয়া কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্যার কে জি গুপ্ত, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, লালা লাজপত রায়, মতিলাল নেহরু ও আরও অনেকে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের অভিমত 'কুন্তলীন'-এর অসামান্য এক সার্টিফিকেট— 'কুন্তলীন তৈল আমরা দুইমাস কাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার কোন আত্মীয়ের বহু দিন হইতে চুল উঠিয়া যাইতেছিল। কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে তাঁহার নূতন কেশোদ্গম হইয়াছে। এই তৈল সুবাসিত, এবং ব্যবহার করিলে ইহার গন্ধ ক্রমে দুর্গন্ধে পরিণত হয় না।' জানা গেছে যে, ত্রিপুরা ও কুচবিহারের মহারাজাও কুন্তলীন তেল ব্যবহার করতেন। এই তেলে ভেজাল নেই, পরীক্ষা করে একথা বলেছেন বাঙালিকে 'বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী' মন্ত্র শেখানোর গুরু প্রফুল্লচন্দ্র রায়; ব্যবহারে কেশ বৃদ্ধি পায়—এমন অভিমত দিয়েছেন নাটোরের মহারাজা, রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ; বিলেতি প্রসাধনী দ্রব্যের সমকক্ষ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন লালা লাজপত রায় ও মতিলাল নেহেরু। দেশজুড়ে এই তেলের বহু গ্রাহক ছিল, যার প্রমাণ স্যার কে জি গুপ্তর মানিঅর্ডার—'আহ্লাদের সহিত ১৪ বোতল কুন্তলীনের মূল্য ১৪ টাকা পাঠাইতেছি। ইহা যে অতি উৎকৃষ্ট কেশ তৈল তাহা উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি।' নিজের পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে পরাধীন ভারতে বসেই হেমেন্দ্রমোহন তৈরি করতে পেরেছিলেন বাঙালির নিজস্ব এক ব্র্যান্ড, 'এইচ বোস'।
সাইকেল ও মোটরগাড়ি:
ব্যবসা যার রক্তে, তার উপর সর্বদা নতুন কিছু করার তাগিদ, সে কি একটা ব্যবসায় থেমে থাকে? তাই একের পর এক ব্যবসায় মেতেছেন, সফলও হয়েছেন, আবার বাজারের হাওয়া বুঝে সময়মতো কিছু কিছু ব্যবসা গুটিয়েও নিয়েছেন। তবে বাংলায় তথা ভারতে বহু ব্যবসার গোড়াপত্তন তাঁরই হাত ধরে। ভাই যতীন্দ্রমোহন বসুর সঙ্গে জোট বেঁধে প্রেসিডেন্সি কলেজের কাছে হ্যারিসন রোডের উপরে তৈরি করলেন বড় শোরুম, 'এইচ বোস সাইকেল কোম্পানী'। সেটাই ছিল ভারতীয় মালিকানায় প্রথম সাইকেল কম্পানি। একতলা বাড়ির সামনের দিকে 'শো রুম' আর পিছনে দেশী সাইকেল তৈরির কারখানা। ইংল্যান্ডে তৈরি রোভার সাইকেল আর ডারকাপ সাইকেলের 'সোল এজেন্সি' নিলেন হেমেন্দ্রমোহন। সাইকেল বিক্রীও করতেন, আবার সাইকেল চালাতেও শেখাতেন। সাইকেল-চালনা শিক্ষক হেমেন্দ্রমোহনের ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার।
কলকাতায় তখন মোটরগাড়ির সংখ্যা নগন্য। সাহেবদের এবং অবস্থাপন্ন স্বদেশীদের মধ্যেও মোটরগাড়ির একটা চাহিদা হেমেন্দ্রমোহনের ব্যবসায় জহুরী-চোখে ধরা পড়তে দেরী হল না। সাইকেল কম্পানি চালানোর অভিজ্ঞতার পুঁজি তো ছিলই। ১৯১২ সালে ৪৪ নং ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটি বিশাল বাড়িতে 'দি গ্রেট ইস্টার্ন মোটর ওয়ার্কস' নাম দিয়ে মোটরগাড়ির ব্যবসা খুলে বসলেন হেমেন্দ্রমোহন। বাড়ির নীচে সামনের দিকে বড় শোরুম। তার পিছনে যন্ত্রপাতি মেরামতির ব্যবস্থা। সুপারভাইজিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে পাশ করা দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার প্রিসটনকে নিযুক্ত করলেন। গাড়ি বিক্রির আগে সার্টিফিকেট হিসেবে তিনি 'অল রাইট' লিখে সই করতেন। বিক্রির জন্য স্টোনলে সিডলে ডেজি, পরিচিত অস্টিন গাড়ি আর সুদৃশ্য ল্যান্ডলেট গাড়ির এজেন্সি নিলেন হেমেন্দ্রমোহন। ব্যবসা বেশ চলতে লাগল, সাহেব ক্রেতার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি ক্রেতারাও উৎসাহ দেখাচ্ছিলসঙ্গে সঙ্গেজেন্সি।। যে প্রথম বাঙালি 'দি গ্রেট ইস্টার্ন মোটর ওয়ার্কস' থেকে জার্মানিতে তৈরি বিখ্যাত গাড়ি ডারকাপ কিনেছিলেন, তিনি হলেন স্বনামখ্যাত চিকিৎসক সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী। নিজের জন্য হেমেন্দ্রমোহন কিনেছিলেন ফ্রান্স থেকে তৈরি করে আনা ড্যারাক গাড়ি। এই গাড়ি চড়ে স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ছেলেদের নিয়ে কখনো সখনো ঘুরতে বের হতেন। মাইনে করা ড্রাইভার রেখেছিলেন হেমেন্দ্রমোহন। তাঁর রুচিতে যেমন ছিল আভিজাত্যের ছোঁয়া, তেমনই মেজাজটাও ছিল উচ্চ তারে বাঁধা। গাড়ির ব্যবসা খোলার সময়ে আমেরিকার ফোর্ড কোম্পানির এজেন্সি নেওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর বক্তব্য ছিল, 'কেউ কিনবে না, ওটা একটা 'আগলী অ্যানিমেল'!' এই স্পর্ধা তাঁকেই মানায় যিনি নিজের জন্য নতুন পথ তৈরি করেন। কিন্তু ব্যবসা ভাল চলা সত্ত্বেও দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বজুড়ে মন্দার বাজারে ১৯২০ সাল নাগাদ মোটরগাড়ির ব্যবসা বন্ধ করে দিলেন হেমেন্দ্রমোহন।
কলের গান/গ্রামোফোন—আরেক নতুন দিগন্তে:
টমাস আলভা এডিসনের যুগান্তকারী আবিষ্কারে বিশ্বের মানুষ তখন মেতে উঠেছে ফোনোগ্রাফে, যাকে এখন আমরা গ্রামোফোন বলি। এই নতুন আবিষ্কারের কথা হেমেন্দ্রমোহনের কানে পৌঁছতেই মনে নতুন ব্যবসার দিগন্ত খুলে গেল। বিদেশ থেকে এডিসনের ফোনোগ্রাফ যন্ত্র আনিয়ে ধর্মতলায় বিখ্যাত জহুরি লাভোচাঁদ-মতিচাঁদের দোকানের কাছেই 'দি টকিং মেশিন হল' নাম দিয়ে আরম্ভ করলেন নতুন ব্যবসা। যাকে বলা হত কলের (যন্ত্রের) গান, সেই গ্রামোফোন আনলেন বাংলায়। কিন্তু কেবল যন্ত্র আর রেকর্ডের ব্যবসাতেই সীমিত থাকলেন না, আপন প্রতিভা আর উদ্যোগবলে প্যারিসের বিখ্যাত চার্লস প্যাথে কম্পানি থেকে সিলিন্ডার রেকর্ডকে ডিস্ক রেকর্ডে পরিণত করিয়ে ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম 'প্যাথেফোন' যন্ত্রের প্রবর্তন করলেন। ধর্মতলায় মার্বেল হাউস নামে পরিচিত সেই বাড়ির দোতলায় হল রেকর্ড রুম। সেকালের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা গান রেকর্ড করতে আসতেন এইচ বোসের উদ্যোগে। স্বদেশপ্রেমের মতোই অসাধারণ ছিল তাঁর সঙ্গীতানুরাগ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একুশটিরও বেশি গান রেকর্ডিং হয়েছিল এই বাড়িতে, যেগুলোর মধ্যে 'লুকোচুরি', 'বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি', 'যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক', 'অয়ি ভুবন মনমোহিনী', বঙ্কিমচন্দ্র রচিত 'বন্দেমাতরম' অন্যতম। স্বরচিত 'সোনার তরী' কবিতা আবৃত্তিও রেকর্ড করা হয়েছিল। এছাড়াও রেকর্ডিং হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, প্রমদারঞ্জন রায়, লালচাঁদ বড়়াল থেকে উস্তাদ রমজান খান, পিয়ারা সাহেব, মানদাসুন্দরী দেবী, নরীসুন্দরী, কাশীবাবু, জি জি গুপ্ত, নীরোদা বাঈ প্রমুখ শিল্পীদের গান। সেকালে বিখ্যাত গায়িকারা ঘেরাটোপ গাড়িতে আসতেন, মাথায় ঘোমটা দিয়ে, রেকর্ড রুমে ঢুকে ঘোমটা সরিয়ে গান গাইতেন।
'দি টকিং মেশিন হল' সংস্থার বিজ্ঞাপন
কিন্তু এইচ বোসের গ্রামোফোনের ব্যবসায়ও গ্রহণ লাগল। চারপাশে তখন বঙ্গভঙ্গের উত্তাল ঢেউ। হেমেন্দ্রমোহনের শিবনারায়ণ দাস লেনের বাড়িতে একদিন পুলিশ এল, স্বদেশি গান সন্দেহে বহু মূল্যবান রেকর্ড ভেঙে নষ্ট করে দেওয়া হল। শহরে প্লেগ চলাকালীন ঘর জীবাণুমুক্ত করতে কর্পোরেশনের লোক বাড়ি বাড়ি হানা দিত। বাকি রেকর্ডগুলো ধ্বংস হল তাদেরই হাতে। ওদিকে রেকর্ডিং প্রযুক্তিরও আধুনিকীকরণ হচ্ছিল। সিলিন্ডার রেকর্ডের জায়গা নিচ্ছিল আধুনিক ডিস্ক। প্যাথেদের দিয়েই ডিস্ক তৈরি করিয়ে ব্যবসা বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন হেমেন্দ্রমোহন। কিন্তু প্যাথেরা তখন সিনেমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। অগত্যা হেমেন্দ্রমোহন এই ব্যবসাও তুলে দিলেন!
আরও শখ—ছবি তোলা, ছাপাখানা:
হেমেন্দ্রমোহনের অগুন্তি শখের অন্যতম একটি ছিল ছবি তোলা। বিদেশ থেকে বেশ কয়েকখানা ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলেন, নিজের ঘরেই ডার্করুম তৈরি করে ফটো ডেভেলপের ব্যবস্থা করতেন। এদেশে থ্রি ডাইমেনশন ছবির ভাবনা ও রঙিন ফিল্মের ব্যবস্থাও প্রথম তাঁরই অবদান। ছোট পুত্র নীতীন বসু, পরবর্তী কালের বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক, বাবার আনা মুভি ক্যামেরাতেই শিখেছিলেন অনেক কিছু। স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে হেমেন্দ্রমোহন পেশাদার আলোকচিত্রীর মতো বিভিন্ন জনসমাবেশের ছবি তুলতেন। বঙ্গভঙ্গের সময়ে তাঁর তোলা একাধিক ছবির মধ্যে থেকে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র ছবিই এখনো টিঁকে আছে। স্লো স্পিড ফিল্ম, ভারী ক্যামেরা, কাচের নেগেটিভ, কাঠের ট্রাইপড স্ট্যান্ড— সমস্ত সংগ্রহ করেছিলেন ভালবেসে। গ্রুপ ফটো ছাড়া পোর্ট্রেটেও হেমেন্দ্রমোহন যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। স্টিরিয়োস্কোপিক অটোক্রোম প্লেটে রবীন্দ্রনাথের ছবিও তুলেছিলেন। ১৯০৫/০৬ সাল নাগাদ স্ত্রী মৃণালিনীদেবীর একটি ছবি তুলেছিলেন, যেটি এখনও দেখতে পাওয়া যায়, তাঁর শাড়ির আঁচলে লাগানো ব্রোচে জ্বলজ্বল করছে 'বন্দেমাতরম'। হেমেন্দ্রমোহনের তোলা ছবির অসংখ্য নেগেটিভ বা স্লাইড নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আলোকচিত্র ইতিহাসের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
তাঁর ৬২ নং বৌবাজার স্ট্রীটের বাড়িতে 'কুন্তলীন প্রেস' নামে একটি ছাপাখানা খুলেছিলেন। এই প্রেসের রোটারি মেশিনে ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম মনোটাইপ ও লাইনোটাইপ প্রথা প্রবর্তন করেন। তবে এই প্রেসে ছাপার কাজই হতো, ইউ অ্যান্ড রায় সন্স থেকে ব্লক তৈরি করতেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সম্পর্কে তিনি এইচ বোসের শ্যালক। খুবই মনোগ্রাহী হত সেই প্রেসের ছাপানো ও বাঁধাই।
এই বৌবাজারেই হালকা ওজনের বহনযোগ্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির একটা দোকানও খুলেছিলেন। তাঁর উদ্ভাবনের অন্যতম একটি হল চৌকো আকারের পকেট টর্চলাইট। কী অসামান্য প্রতিভা ও কী অদম্য এক প্রাণশক্তি নিয়ে এসেছিলেন এই মানুষটি, ভাবতেই শ্রদ্ধায় নত হয় মন।
বিলাতি কায়দায় ব্যবসার বিজ্ঞাপন ও সাহিত্য-পুরস্কার প্রবর্তন:
সাহিত্যিক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত 'প্রবাহিনী' পত্রিকায় (ফাল্গুন সংখ্যা, ১৩২০ বঙ্গাব্দ) এক পৃষ্ঠা জুড়ে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল—'আজি বহিছে বসন্ত পবন সুমন্দ/তোমারই সুগন্ধ ভরি,' মাঝে ছবিতে নৌকায় দুই সখীসহ এক রাজকন্যা, তার নিচে লেখা, 'বসন্তের জ্যোৎস্নাময়ী রজনীতে কুসুম কাননে শত সহস্র জাতীয় কুসুমের সুরভিশ্বাস সুমন্দ পবনে মিশিয়া আসিয়া নরনারীর প্রাণে আনন্দের উৎস আনয়ন করে তখন কি সকলেরই মনে হয় না এই আনন্দ যদি চিরস্থায়ী হইত!' আমরা সেইজন্যই বলি এই সুখের আবেশ ও আনন্দ এসেন্স দেলখোস ব্যবহার করিয়া চিরস্থায়ী করুন। নিচে বিজ্ঞাপনদাতার পরিচয়—'এইচ বসু, ম্যানুফ্যাকচারিং পারফিউমার ৬১ নং বহুবাজার স্ট্রীট'।
কতখানি দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণ ব্যবসায়িক বুদ্ধি থাকলে এমন সুন্দর একটি বিজ্ঞাপনের পরিকল্পনা করা যায় আজ থেকে প্রায় শতাধিক বছর আগে, তা সত্যি প্রশংসনীয়। শুধু এইটুকুই নয়, সুনির্মল বসুও স্মৃতিচারণ করেছেন, 'সন্দেশ' পত্রিকার শেষের পাতায় গন্ধদ্রব্য বিক্রেতা 'এইচ বসুর' ছবিওয়ালা বিজ্ঞাপনের—একজন লোক রুমাল নেড়ে বলছে, 'বহুৎ আচ্ছা দিল খোস হো গিয়া,' ইত্যাদি।
এরপর তিনি যে অভিনব ভাবনাকে রূপ দিলেন, তা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগদর্শন উপস্থাপিত করল। তিনি একটি গল্প-প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন, সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের শর্ত উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন বের করলেন, 'গল্পের সৌন্দর্য কিছুমাত্র নষ্ট না করিয়া কৌশলে কুন্তলীন এবং এসেন্স দেলখোসের অবতারণা করিতে হইবে, অথচ কোন প্রকারে ইহাদের বিজ্ঞাপন বিবেচিত না হয়।' রীতিমতো বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর ১৩০৩ বঙ্গাব্দ থেকে এই গল্প-পুস্তিকা প্রকাশের আয়োজন হল এবং ১৩৩৪ সালের আগের কয়েকবছর নানা কারণে পুস্তিকা প্রকাশিত হয়নি, এরপর ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত এই পুস্তিকা প্রকাশের ধারা অব্যাহত ছিল। প্রথম বছর মোট ১০ টি পুরস্কারের প্রথম পুরস্কারের মূল্য ৩০ টাকা, তারপর ২৫, ১৫ এইভাবে সর্বনিম্ন পাঁচ টাকা ধার্য করা হয়েছিল। প্রথম বছর 'নিরুদ্দেশের কাহিনী' নামে একটি গল্প লিখে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন স্বয়ং জগদীশচন্দ্র বসু, যদিও তিনি ছদ্মনামে লিখেছিলেন, পরে তা জানা যায়। প্রথম সংখ্যা সে-বছর পুজোর আগেই প্রকাশিত হয়েছিল এবং কুন্তলীন গ্রাহকরা তা বিনামূল্যে পেলেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত গল্প 'মন্দির'ও পুরস্কৃত হয়েছিল কুন্তলীন পুরস্কারের সম্মানে। কুন্তলীন পুরস্কার পুস্তিকার জন্য রবীন্দ্রনাথ 'কর্মফল' গল্পটি লিখে সাম্মানিক পেয়েছিলেন ৩০০ টাকা। এইভাবে এইচ বোস ব্যবসা বৃদ্ধির ছলে কার্যত বাংলার তরুণ প্রতিভাদের সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করবার জন্য গল্প লেখককে নগদ টাকা ও তাঁর গন্ধদ্রব্য পুরস্কার দিয়ে, দামী কাগজে যত্নে ছাপা পুস্তিকা বিনামূল্যে বিতরণ করে বিপুল অর্থব্যয় করতেন। আকাশবাণী কলকাতা থেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকাশ্য সরস উক্তি, 'তেলে-জলে কখনও মেশে না, কিন্তু তবুও একথা মানতেই হয় যে অন্তত একটি তেল আমাদের সাহিত্যরূপ জলের সঙ্গে নিতান্ত নিগূঢ় ভাবেই মিশে আছে। সেটি কুন্তলীন।'
শেষের কথা:
জগতে কেউই চিরকাল থাকে না। এমন কর্মবীর মানুষটির জীবন-প্রদীপের শিখাও নির্বাপিত হল, তবে বড় অকালে, মাত্র বাহান্ন বছরে পা দিয়েই। সৌখিন মানুষ ছিলেন। দার্জিলিং-এ ছিল নিজের চা-বাগিচা। চা-পানের অভ্যাস ছিল। তার জন্য খাস চীনদেশ থেকে আনিয়েছিলেন সুদৃশ্য মূল্যবান দুধ-সাদা পেয়ালা-পিরিচ। ইংল্যান্ড থেকে আসত পিকফ্রিন বিস্কিট, প্যারিস থেকে ক্যাডবেরি ফ্রাই। পান খেয়ে এহেন সৌখিন মানুষের দাঁতে বিশ্রী ছোপ ধরেছিল। তাই অর্থব্যয় করে দাঁতের আধুনিক বিলাতি চিকিৎসা 'স্কেপ' করিয়েছিলেন। দুদিন পর থেকে দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া আরম্ভ হল, যা আর বন্ধ হল না। অসহ্য যন্ত্রণায় প্রবল জ্বরে বেহুঁশ হয়ে ভুল বকতে লাগলেন। সোমবার, ২৮ আগস্ট, ১৯১৬ তিনি ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন, রেখে গেলেন ভাবী প্রজন্মের জন্য কর্মোদ্দীপনা পূর্ণ জীবনের এক অনির্বাণ আদর্শ। পরাধীন ভারতে বাংলা তথা বাঙালি জাতি নিয়েছিল নবজাগরণের অগ্রদূতের ভূমিকা। বাংলার সেই স্বর্ণযুগের ইতিহাসে বিপ্লবী, বিজ্ঞানী, ধর্মাচার্য ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে বাণিজ্য-সাম্রাজ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এইচ বোসের নাম—যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বপ্নকে সার্থকও করেছিলেন। যারা সাহসে ভর দিয়ে নতুন কিছু আরম্ভ করতে চায়, তাদের কাছে তাঁর জীবন অফুরান প্রেরণার উৎস।
তথ্য-ঋণ (১) বারিদবরণ ঘোষ সম্পাদিত কুন্তলীন গল্প-শতক, আনন্দ পাবলিশার্স। (২) The Unsung Swadeshi Entrepreneur Whose Record Discs Helped Defeat the British Raj; by Sayantani Nath; (https://www.thebetterindia.com) (৩) 127 years ago, the Bengali entrepreneur who had implemented business across spectrum; by Indrajit Sen; (https://www.getbengal.com)
ছবিঃ উইকিপিডিয়া
গ্রাফিকঃ মিতিল