শ্রীকৃষ্ণের ছেলেবেলার বন্ধু সুদাম। তাঁরা বড় গরীব। কৃষ্ণ তো মথুরায় রাজা হয়েছেন। কিন্তু সুদামের দারিদ্র্য আর ঘোচে না। তার স্ত্রী একবার বললেন, "ওগো, তোমার বন্ধু তো মথুরার রাজা, তাঁকে বলে আমাদের সংসারে একটু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতে পারো না?" সুদাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলেন, "ছেলেবেলায় একসাথে খেলাধুলো করেছি, সর-ননী কাড়াকাড়ি করে খেয়েছি, এমনকি তারসাথে যে হাতাহাতি মারামারিও হয়েছে! সেই প্রাণের বন্ধু কানাইয়ের কাছে টাকা চাইব? ছি, ছি, এ আমি পারব না! তবে তাকে রাজবেশে দেখতে বড় সাধ হয়! একবার ঘুরে আসি মথুরায়, কি বলো? তুমি বরং কানাইয়ের প্রিয় কিছু খাবার তৈরি করে দাও, খালি হাতে তো আর রাজদর্শনে যাওয়া চলে না!"
কিন্তু দরিদ্র-পরিবারে তেমন কিছুই ছিল না, তাই সুদামের স্ত্রী একটু চালভাজা পুঁটলিতে বেঁধে স্বামীর হাতে দিয়ে বললেন, "তোমার সখাকে বোলো, তার বৌদিদি নিজে হাতে এই চালভাজা তৈরি করে পাঠিয়েছে।"
তিনদিন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত অবশ দেহে, ধূলিধূসরিত অঙ্গে সুদাম পৌঁছালেন মথুরার রাজদুয়ারে, কিন্তু তার মলিন বেশভূষা দেখে সেপাই তাকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিলনা। তিনি যতই বলেন, "কানাই আমার বন্ধু," সেপাই গর্জন করে বলে-"কৌন কানাই? ভাগো হিঁয়াসে।" সুদাম হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে রাজবাড়ির অনতিদূরে এক গাছের তলায় বসে থাকলেন।
ওদিকে রাজসভায় বসে শ্রীকৃষ্ণ চঞ্চল হয়ে উঠলেন। মন্ত্রীকে বললেন, "আমার প্রাণের সখা এসেছে, সে ভিতরে প্রবেশ করতে পারছে না, তাকে আদর করে ভিতরে নিয়ে আসুন।" মন্ত্রী বাইরে এসে সেপাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। সেপাই বলল, "না না, রাজার বন্ধু কেউ তো আসেনি, তবে ঐ ময়লা কাপড় পরা লোকটা সকালে এসে ভিতরে ঢুকতে চাইছিল, আমি তাকে বের করে দিয়েছি।" বুদ্ধিমান মন্ত্রী কিছু আন্দাজ করতে পেরে সুদামকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, "চলো, আমাদের মহারাজ তোমাকে ডাকছেন।"
কুণ্ঠিত সুদাম চালভাজার পুঁটলিটা কাপড়ের খুঁটে লুকিয়ে ধূলা পা নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে প্রবেশ করলেন রাজদরবারে। কৃষ্ণ সুদামকে দেখামাত্র রাজ-সিংহাসন থেকে নেমে এসে বাল্যবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। তারপর তাকে ধরে এনে জোর করে সিংহাসনে বসালেন, রানী রুক্মিণীকে বললেন, "দেখছ না, সখা আমার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে! পাখা কর!" রুক্মিণী নিজেহাতে সুদামকে পাখার বাতাস করতে লাগলেন, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং সখার পা ধুইয়েদিলেন-সুদামের কোনো আপত্তি শুনলেনই না। রাজপ্রাসাদের জাঁকজমক দেখে সুদাম আর সেই চালভাজার পুঁটলি বেরই করলেন না।
কিছু পরে কৃষ্ণ তাঁর কানের কাছে মুখ রেখে বললেন, "বৌদিদি আমার জন্য নিজে হাতে তৈরি করে যেটা পাঠিয়েছে, সেটা বুঝি তুমি আমায় না দিয়ে একলা খাবে মনে করেছ? শিগগির বের করো!"
সুদাম আনন্দাশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। বন্ধুর যত্নআত্তিতে কয়েকদিন কাটিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। দূর থেকেই দেখলেন, তার ভাঙ্গা কুঁড়ের জায়গায় বিশাল প্রাসাদ।কাছাকাছি যেতেই তার স্ত্রী ছুটে এসে উত্তেজিত ভাবে বলতে লাগলেন, "মহা আশ্চর্য ব্যাপার! তুমি যাবার পরেই কোথা থেকে সব রাজমিস্ত্রীর দল এসে বলল, রাজার আদেশে নাকি এখানে কুঁড়েঘরে বাস করা চলবে না! তারাই দিনরাত্রি এক করে এই প্রাসাদ তুলেছে!" সুদামের দারিদ্র্য ঘুচে গেল।
ভগবানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাই লাভজনক। তার চেয়ে ভাল বন্ধু ত্রিভুবনে আর নেই।
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সুমনা সাহা
- ক্যাটfগরি: পুরাণকথা
প্রাণীবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা; শিক্ষিকা হিসেবে কাজ বিভিন্ন স্কুলে। বর্তমানে একমাত্র নেশা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা। 'উদ্বোধন' (রামকৃষ্ণ মিশনের একমাত্র সাংস্কৃতিক বাংলা মাসিক পত্রিকা) পত্রিকার 'চিরন্তনী' বিভাগের পুরাণ-কাহিনীর নিয়মিত লেখিকা । এছাড়াও রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠের অন্যান্য পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন এবং বই অনুবাদের সঙ্গে যুক্ত।