আমাদের চারপাশে কত মানুষ দেখি আমরা, কেউ অনেক লেখাপড়া জানে, কেউ লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। কেউ খুব বড় কাজ করে, অনেক লোক তাকে মান্যিগণ্যি করে, আবার কেউ হয়তো রাস্তায় ঝাড়ু দেয়, লোকে তাকে তেমন আমলই দেয় না। এইসব নানারকম মানুষ নিয়েই আমাদের সমাজ। আর আমরা লোকের টাকাপয়সা, বাড়িগাড়ি দেখলে তাদের মান দিই, যাদের কিছু নেই, তাদের তত সম্মান করি না। কিন্তু ভগবানের চোখে এইসমস্ত ছোট-বড়, গরীব-ধনী, পণ্ডিত-মূর্খ কোনও ভেদাভেদ নেই। তিনি কেবল প্রাণের খাঁটি ভক্তি দেখেন। সূর্য যেমন বাগানের ঘাসের মধ্যে ফুটে থাকা সবচেয়ে ছোট ফুলটাকেও আলো দেয়, আবার সবচেয়ে সুন্দর বড় গোলাপ ফুলটাকেও সমান ভাবে আলো দেয়, ভগবানের করুণা ঠিক তেমনই কোন বাছ-বিচার করে না। যে তাঁর সত্যিকারের ভক্ত, তাকে তিনি খুব ভালবাসেন। ভগবানের এমন ভালবাসার কথা বলতে গেলে চোকামেলার কথা মনে পড়ে। সে আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগেকার কথা। এখন যে মহারাষ্ট্র রাজ্য, তার সোলাপুর জেলায় চন্দ্রভাগা নদীর তীরে পান্ধারপুর নামে একটি নগর ছিল। সেই নগরে ছিল ভগবান শ্রী পাণ্ডুরঙ্গর মন্দির। শ্রীকৃষ্ণেরই এক রূপ হলেন পাণ্ডুরঙ্গ। নগরের সবাই পাণ্ডুরঙ্গকে ভক্তি করে। তার মধ্যে সমাজের উঁচুতলার মানুষ যেমন ছিলেন, তেমনই ছিল কামার, কুমোর, ছুতোর, ধোপা, তাঁতি ও মুচি প্রভৃতি যারা সমাজের নিচুতলার মানুষ। চোকামেলা জাতিতে ছিল মাহার, যাদের কাজ ছিল জমিদারদের ফসল-ক্ষেতে পাহাড়া দেওয়া। সমাজে এরা ছিল অস্পৃশ্য। ভগবানের মন্দিরে প্রবেশের অধিকারও তাদের ছিল না। চোকামেলা প্রথমে পান্ধারপুরের পাশের গ্রাম, মঙ্গলবেদায় থাকত। বৌ সয়রাবাই আর একমাত্র ছেলে কারমামেলাকে নিয়ে ছিল তার ছোট্ট সংসার। সংসারে অভাব থাকলেও পরম ভক্ত চোকামেলা ও সয়রাবাই ভগবানের নামগান করে আনন্দেই দিন কাটাত। ভোরবেলায় উঠে নদীতে স্নান সেরে গলায় তুলসীর মালা আর কপালে গোপীচন্দনের তিলক এঁকে সে বিঠ্ঠল ভগবানের মন্দিরের সামনে চলে আসত, মন্দিরের পূজারীরা তাকে ভিতরে ঢুকতে দিত না, তাই সে মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়েই বিঠ্ঠলজীকে গান শোনাত। মুখে মুখে রচনা করত ছোট ছোত গীত, এগুলোকে মারাঠী ভাষায় বলা হয় অভঙ্গা। একবার সে পান্ধারপুর তীর্থ দর্শন করতে এসে সন্ত কবি নামদেবকে কীর্তন গাইতে শুনল। সেই গান তার এত ভাল লাগল যে, সে নামদেবের শিষ্য হয়ে গেল। নামদেবের কাছেই সে পাণ্ডুরঙ্গর কথা জানতে পারল। তখন সে ঠিক করল, এখন থেকে পান্ধারপুরে এসেই বাস করবে, নামদেবের সান্নিধ্যেও থাকা যাবে। দেওয়াল গাঁথার কাজ নিয়ে সে পান্ধারপুরে চলে এল সপরিবার, চন্দ্রভাগা নদীর তীরে কুটির বেঁধে থাকতে আরম্ভ করল। এখানেও তার রোজকার অভ্যাস মত সকাল সকাল চলে যায় পাণ্ডুরঙ্গর মন্দিরে। কিন্তু এখানেও তাকে মন্দিরে ঢুকতে দেয় না। সে মন্দিরের পাঁচিলের বাইরে দাঁড়িয়ে পাণ্ডুরঙ্গকে গান শোনায়, তারপর কাজে চলে যায়। নদীর ধারে যে বস্তিতে সে থাকে, সেখানকার প্রতিবেশিরা চোকামেলার মত ধার্মিক নয়। তারা সারাদিনের কাজের শেষে বাসায় ফিরে নেশা করে, হৈ হল্লা করে, অশ্লীল ভাষায় একে অপরের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে, খায়দায় আর ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের জীবন ভগবানের ভক্তিতে পবিত্র হয়নি। চোকামেলা তাদের বোঝাত, “ভগবানকে ডাকো, তিনিই আমাদের আসল বন্ধু। তিনি সব দুঃখকষ্ট দূর করে দেবেন। মন আনন্দে ভরে দেবেন।” তারা চোকামেলার কথা শুনে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করত। কিন্তু দিনের পর দিন তার অপূর্ব গান শুনে, তার সরল সুন্দর জীবন দেখে দেখে তারা চোকামেলাকে শ্রদ্ধা করতে আরম্ভ করল। তখন এক এক করে তারাও চোকামেলার সঙ্গে মন্দিরে যেতে লাগল। সে যখন মন্দিরের পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে গান ধরে, তারাও তার সঙ্গে গলা মেলায়। এমন করে ক্রমে কীর্তনের একটা বড় দল গড়ে উঠল। মন্দিরের পুরোহিতরা ভাবল, “এ তো আচ্ছা জ্বালা হল। মন্দিরে ঢুকতে পায় না, তবু ছোটলোকগুলো বাইরে দাঁড়িয়ে কীর্তন করে, খোল-মৃদঙ্গ বাজায়, এ অনাচার তো আর সহ্য হয় না!” পূজারীরা একদিন ওদের বলল, “এখানে দাঁড়িয়ে গান গাওয়া চলবে না। মন্দিরের বাইরে এরকম জমায়েত করলে রাজাকে নালিশ জানাব।”
চোকামেলা ভোরবেলায় আর মন্দিরে যায় না। মনে মনে ভাবল সে, “ভালই হল। এখন থেকে ঘরে বসেই ঠাকুরজীকে গান শোনাব।” সে ঘরে বসে চোখ বন্ধ করে একমনে তন্ময় হয়ে পাণ্ডুরঙ্গর রূপ ধ্যান করে, আর বিভোর হয়ে তাঁকে গান শোনায়। এইভাবে কয়েকদিন কাটল। পাণ্ডুরঙ্গর তো চোকামেলার গান শুনে শুনে নেশা ধরে গেছে। রোজ সকালে ঘুম থেকে তুলে পূজারীরা তাঁকে মালা চন্দনে সাজিয়ে যখন আরতী করে, পাণ্ডুরঙ্গ কান খাড়া করে থাকে, কখন চোকামেলা গান করবে। কিন্তু অনেক দিন হয়ে গেল, তার গান শোনা যাচ্ছে না। তিনি তো অন্তর্যামী, জানতে পারলেন যে, সে এখন ঘরে বসেই গান করছে। পাণ্ডুরঙ্গর ইচ্ছা হল, চোকামেলার ঘরে গিয়ে তার সামনে বসে গান শুনবেন। ইচ্ছামাত্রই তিনি চোকামেলার সামনে উপস্থিত হলেন। সে চোখ বুজে আপন মনে গান গাইছিল, চোখ খুলে হঠাৎ সামনে পাণ্ডুরঙ্গকে দেখে আনন্দে হেসে কেঁদে একসা হল, বলল, “প্রভু! আমার মত দীন হীনের উপরে তোমার এত কৃপা!” পাণ্ডুরঙ্গ তার ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে বললেন, “তোমার গান শুনতে আমি বড় ভালবাসি। আমাকে রোজ গান শোনাও তুমি, আমিও তোমাকে কিছু উপহার দিতে চাই। বলো, তুমি কী চাও?” চোকামেলা একটুও না ভেবে বলল, “প্রভু, তোমার মন্দিরে ওরা আমাকে ঢুকতে দেয় না। আমার খুব ইচ্ছা হয় তোমার ঘরটা দেখি!” ভগবান বললেন, “নিশ্চয় দেখবে। আমি তোমার ঘরে এলাম, তুমিও আমার ঘরে চলো,” এই বলে এক মুহূর্তে চোকামেলাকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলেন। ভগবান আর ভক্ত বসে গল্প করে সারা রাত কাটিয়ে দিলেন। ভোর হল। মন্দিরের প্রধান পূজারী এসে গর্ভগৃহের দরজা খুলে দেখেন সেখানে চোকামেলা বলে আছে। তিনি তো রেগে আগুন হয়ে গেলেন, “তোর এতবড় আস্পর্ধা, অস্পৃশ্য হয়ে তুই ভগবানের গর্ভমন্দিরে ঢুকেছিস?”
চোকামেলা কতবার বলল, “মন্দিরের দরজা তো বাইরে থেকে বন্ধ ছিল, আমি কেমন করে নিজের ইচ্ছায় ঢুকব? আমাকে স্বয়ং পাণ্ডুরঙ্গ নিয়ে এসেছেন!” তার কথা কেউ বিশ্বাস করল না। ভগবান নিজে ঐ বস্তিতে গিয়ে তাকে নিয়ে এসেছেন, একথা তারা বিশ্বাস করবে কীভাবে? চোকামেলা কাঁদল, তাঁদের পায়ে পড়ল, কিন্তু তারা রাজার কাছে তার নামে নালিশ করল। রাজাও পুরোহিতদের কথায় বিশ্বাস করে ভাবলেন, নিশ্চয় চোকামেলা কোন চালাকি করেছে। তিনি তাকে নগর থেকে বহিষ্কারের আদেশ দিলেন। চোকামেলা কী আর করে? বৌ ছেলেকে নিয়ে নদীর ওপারে গিয়ে বাস করতে লাগল। মনের দুঃখে কাঁদে আর গান করে। পাণ্ডুরঙ্গ সবই জানতে পারলেন। তিনি তো তাঁর ভক্তকে দুঃখের আগুনে পুড়িয়ে আরও খাঁটি করবেন, আর অন্য সবাইকে একটা শিক্ষা দেবেন। চোকামেলা বৈষ্ণব রীতি মেনে একাদশীর উপবাস করত। সারাদিন অভুক্ত থেকে প্রভুর নামগান করে দ্বাদশীর দিন পুজো সেরে ঠাকুরকে ভোগ নিবেদন করে তারপর প্রসাদ ভোজন করে উপবাস ভঙ্গ করে সে। এখন থেকে প্রত্যেক দ্বাদশীর দিন তার ঘরে একজন অতিথি আসেন, তার সঙ্গে তিনিও উপবাস রাখেন, আর দুজন একসঙ্গে দ্বাদশীর দিন ভোজন করেন। ঐ অতিথি আর কেউ নন, স্বয়ং পাণ্ডুরঙ্গ। চোকামেলার বৌ আর ছেলে ছাড়া একথা আর কেউ জানে না।
একদিন নদীর ঘাটে একটা বিশেষ কাজে এসে পাণ্ডুরঙ্গর মন্দিরের একজন পুরোহিত দেখলেন, চোকামেলা তার বৌকে খুব চিৎকার করে বকাঝকা করছে। পুরোহিতের কৌতুহল হল, ব্যাপারটা কী? তিনি চোকামেলাকে যতদূর চিনতেন, সে ভারি শান্তশিষ্ট মানুষ ছিল। হঠাৎ এমন কী হল যে সে এইভাবে চেঁচামেচি করছে? তিনি একটু কাছাকাছি গিয়ে কান খাড়া করে শুনলেন, চোকামেলা তার বৌকে বলছে, “ঠাকুরের সেবা করতে গিয়ে এত অসাবধান হলে চলে? পাণ্ডুরঙ্গর গায়ে আজ তুই দই ফেলে দিলি, তাঁর অমন সুন্দর পোশাকে দাগ ধরে গেল। ফের যদি এমন অমনযোগী হয়ে কাজ করেছিস তো আমি তোকে মেরেই ফেলব!” পুরোহিত তো শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ব্যাটা বলে কী? পাণ্ডুরঙ্গর জামায় নাকি ওর বৌ দই ফেলে দিয়েছে? তার মানে ব্যাটা কি বলতে চায় যে, ঠাকুরজী তার ঘরে এসে খাবার খেয়েছেন? নাহ, লোকটাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েও দেখছি লাভ হয়নি। মাথা খারাপ হয়ে গেছে, এখন উল্টোপাল্টা কথা বলছে। একে আরও কঠোর শাস্তি দিতে হবে! যাই, প্রধান পুরোহিতকে কথাটা বলি গিয়ে!” এই ভেবে তিনি গিয়ে প্রধান পুরোহিতকে সমস্ত ঘটনা বললেন। শুনে তো তিনি সাংঘাতিক রেগে গেলেন। সোজা চলে গেলেন রাজার কাছে। রাজা শুনে বললেন, “এখনই পেয়াদা পাঠিয়ে ব্যাটাকে ধরে আনো আর জেলে পুরে দাও!”
চোকামেলাকে রাজার পেয়াদা এসে বেঁধে নিয়ে গেল। তাকে জেলে বন্দী করে রাখল। চোকামেলা জেলখানায় বসে চোখের জলে ভাসতে লাগল আর পাণ্ডুরঙ্গকে গানে গানে কেঁদে মনের দুঃখ জানাতে লাগল। এদিকে প্রধান পুরোহিত ঠাকুরকে দুপুরবেলা ভোগ দিতে এসে দেখলেন, বিগ্রহের কাপড়ে দই মাখামাখি হয়ে আছে। তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। এ কী করে সম্ভব? তিনি নিজে হাতে শুভ্র বসন পরিয়েছেন ঠাকুরজীকে, গর্ভগৃহে নিজহাতে তালা লাগিয়ে ঠাকুরের ভোগের ব্যবস্থা করতে গেছেন। বিগ্রহের বসনে দই লাগল কোথা থেকে? তাঁর কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল। মিথ্যেই তাঁরা চোকামেলাকে নানা ভাবে অত্যাচার করে চলেছেন। সে একটি কথাও বানিয়ে বলেনি, যা বলেছে, সব বর্ণে বর্ণে সত্য। সে এক পরম ভক্ত, স্বয়ং পাণ্ডুরঙ্গ তার সঙ্গে আহার করেন। পূজারী অনুতাপে কাঁদতে কাঁদতে বিগ্রহের চরণে মাথা কুটতে লাগলেন। তিনি আর দেরি না করে রাজার কাছে ছুটে গিয়ে সব কথা বললেন, রাজাও ভারি অনুতপ্ত হলেন আর তখনই প্রহরীদের আদেশ করলেন চোকামেলাকে মুক্তি দিতে।
সেকালে সমাজে জাতপাতের বাছবিচার থাকার জন্য চোকামেলার মত আরও অনেকেই মন্দিরে ঢোকার অনুমতি পেত না। কিন্তু ভগবান নিজে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, দেখো, ভক্তের কোন জাত নেই। এরপর ধীরে ধীরে সামাজিক এই কুপ্রথাগুলো দূর হতে শুরু করল। ব্রাহ্মণ ও উঁচু জাতের লোকের মতই নিচু জাতের লোকেরাও মন্দিরে গিয়ে ভগবানকে দর্শন করার অধিকার পেল। জীবনের বাকি দিনগুলো চোকামেলা ভগবানের নামগানেই মানুষকে মাতিয়ে রাখল, এই ভাবে সে তার প্রিয় দেবতার সেবাই করে চলল। তাকে দেখে, তার গান শুনে কত অসাধু লোক সাধু হয়ে গেল, কত অবিশ্বাসী মানুষ ভগবানের ভক্ত হয়ে গেল। একশরও বেশি গান রচনা করেছে চোকামেলা, পরে সেসব নানা ভাষায় অনুবাদও হয়েছে। লোকে বলে গান গাইতে গাইতে দেওয়াল গাঁথার কাজ করতে করতেই ভাবে বিভোর চোকামেলা একদিন নাকি একটা দেওয়াল ভেঙে পড়ায় ইটের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল, এইভাবেই তার নশ্বর দেহের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু তাঁর আত্মা নাকি আজও পান্ধারপুরে পাণ্ডুরঙ্গর মন্দিরের সামনে গান গেয়ে বেড়ায়। সে গাইত—
গাঁটে ভরা আখ তার রসটি মধুর,
বাঁকা ধনু তীর ছোঁড়ে সোজা কতদূর!
আঁকাবাঁকা নদীপথ, বাঁকা নয় জল,
নড়বড়ে চোকা তার বিশ্বাস অচল।
বাইরের চেহারায় ভুলো নাকো মন,
খোঁজ নিজ অন্তরে অরূপ রতন।*
[*The sugarcane is crooked,
but not its juice.
The bow is curved,
not the arrow.
The river is bent,
but not its water.
Chokha is twisted,
not his faith.
Why are you drawn
to the shape of the thing.]
ছবিঃ অঙ্কুশ চক্রবর্তী