
সেই কত বছর আগে সুমেরিয়ানরা নাম রেখেছিল দ্য ল্যান্ড অফ মাগান । ওমানের ভূগোল বলতে বোঝায় আল হাজ্জর পর্বত, মরুভূমি সমুদ্রের উপকূলভূমি আর ধোফার পর্বত । আর চোখের আরাম বলতে কিছু খেজুর গাছ আর ওয়াদি । এমন দেশে ইতিহাসের গল্প খুঁজতে যাওয়া একটু কষ্টকর । কিন্তু মরুভূমিতেও রহস্যময় ইতিহাস থাকে। সেই ইতিহাসের রহস্য খুঁজতেই বেরিয়ে পড়লাম ইবরির পথে। আজকের গল্পের বিষয় সেই ওমানের আরেক রহস্যময় অতি প্রাচীন স্থাপত্য বি-হাইভ টুম্ব ।

রাস্তা থেকে যেভাবে দেখা যায় বি-হাইভ টুম্বস্
রাজধানী মাসকাট শহর থেকে প্রায় তিনশ কিমি দূরে হাজ্জার পাহাড়ের কোলে ছোটো এক জনপদ ইবরি । ইবরি থেকে পাহাড়ি গলি ধরে এগিয়ে গেলেই একটা বোর্ডে লেখা আছে আল আইন আর্কিওলজিক্যাল সাইট । এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে চিহ্নিত। জায়গাটা খুবই নির্জন । এমন এক নির্জন জায়গায় আমরা এসেছি প্রাচীন স্থাপত্য দেখতে যার পোষাকি নাম বি-হাইভ টুম্ব । এই বি-হাইভ টুম্বগুলি সম্পর্কে ওমানের বাইরের মানুষ খুব বেশী জানে না এমনকি ওমানিরাও বেশী জনে না ।এই স্থাপত্যগুলি আসলে বৃত্তাকার গম্বুজাকৃতির ছোটো ঘর যা ওমানের আল আইন, হলবান আর জাইলা অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে । এর মধ্যে আল আইনের বি-হাইভ টুম্বগুলির কাছে গুগুল ম্যপের সাহায্যে পৌছোনো কিছুটা সহজ ।

পাকা রাস্তার ধারে গাড়ি রেখে পাশের কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে গিয়ে একটু চড়াই ভেঙে উঠলেই চোখে পড়ে সারি সারি আধভাঙা ভাঙা বি-হাইভ টুম্ব । এই টুম্বগুলো খুবই সরলীকৃত ভাবে স্থানীয় ফ্ল্যাট স্টোনকে বৃত্তাকারে অগোছালোভাবে কিন্তু অংক মেনে গম্বুজের আকারে সাজিয়ে বানানো হয়েছে । এর উচ্চতা প্রায় সাত আট ফিট এবং এর ব্যাস পাঁচ ছয় ফিট । প্রায় একুশ বাইশটা টুম্ব একটি উঁচু টিলার উপর একসাথে বনানো হয়েছে ।

বি-হাইভ টুম্ব এর ভেতরে
টুম্বগুলোর ভিতরে একটি কক্ষ এবং তাতে প্রবেশ করার জন্য একটাই ত্রিভূজাকৃতি প্রবেশ পথ ।এই প্রবেশ দ্বারের উচ্চতা এতোটাই কম যে একজন মাঝরি গড়নের মানুষের পক্ষে হামাগুডি় দিয়ে ঢোকাও সম্ভব নয় । ছাদের অংশ দুটো লম্বা ফ্ল্যাট স্টোন দিয়ে ক্রস করে ঢাকা। ।মেঝেটাও অমসৃন পাথুরে । আল আইনের এই টুম্বগুলোতে দেওয়ালে বা মেঝেতে মর্টারের ব্যবহার হয়নি । কিন্তু অন্যান্য জায়গায় মর্টারের ব্যবহার দেখা গেছে ।
জাইলার বি-হাইভ টুম্ব এর উচ্চতা একটু বেশী এবং ছাদের অংশ খোলা। এই টুম্ব কে কিবাইকিবের টুম্বও বলা হয়। যদিও কিবাইকিব(Kibaykib) শব্দটা আরবি শব্দ নয় তবুও কেন একে কিবাইকিবের টুম্ব বলা হয় কেউ জানে না । স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী বহু বছর আগে কিবাইকিব নামে এক জননেতা এই অঞ্চলের রক্ষাকর্তা ছিল । সে এই অঞ্চল দিয়ে যাতায়াতকারী সব ভিনদেশী যাত্রীদের কাছে করও আদায় করত। তাই তার নামে এই টুম্ব ।
এখন প্রশ্ন হলো এই রকম গোল গম্বুজ পাথরের টুম্বগুলি এই নির্জন মরুভূমি ঘেরা পাহাড়ি টিলাতে কে বা কারা বানালো এবং কেনই বা বানালো ? ইতিহাসের প্রমাণ খুঁজে যা পাওয়া গেল তা হলো, প্রায় তিন চার হাজার বছর আগে ব্রোঞ্জ যুগে এই অঞ্চলে উম আন নার সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করত যা বর্তমান আবু ধাবি, দুবাই এবং ওমানের উত্তর পূর্ব দিকে কেন্দ্রিত ছিল । এই সম্প্রদায়ের মানুষরা হরপ্পা(সিন্ধু সভ্যতা) এবং মেসোপটেমিয়ার(সুমেরীয় সভ্যতা) মধ্যে বানিজ্যিক মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করত । মনে করা হয় যে এই সম্প্রদায়ের মানুষরা মৃত মানুষের সমাধির জন্য বা কখনও ধর্মাচরণের জন্য এই ধরনের বি-হাইভ টুম্ব বানিয়ে থাকত । দুবাই আবু ধাবির বি-হাইভ টুম্বগুলোতে মৃত মানুষের অবশেষ পাওয়া গেছে বলে। কিন্তু ওমানের বি-হাইভ টুম্বগুলোতে কোনো মানুষের অবশেষ পাওয়া যায়নি । রহস্যটা সেখানেই । তাহলে এগুলো কি আদৌ টুম্ব নাকি এগুলো বনানোর পিছনে অন্য কোনো কারণ ছিল ? এখানকার মিউজিয়ামে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই টুম্ব গুলো তৈরির সম্ভাব্য কারণ গুলি হলো:
১) অঞ্চল চিহ্নিত করা
২) মৃত ব্যক্তির কবর
৩) দূরের তীর্থযাত্রীদের বিশ্রামস্থল
৪) উদ্বাস্তুদের অস্থায়ী বাসস্থান
কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ধারণা এগুলো কোনোটাই কারণ নয় । এইরকম একটা নির্জন পাহাড়ি অঞ্চলে চার হজার বছর আগে একটা অসম প্রতিকূল ভূখন্ডে এইরকম বি-হাইভ টুম্ব বানানোর অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল । সেটা যদি তারামন্ডল বা সৌরমন্ডলের কোনো গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য বানানো হয়ে থাকে তাহলে অবাক হবো না । প্রমাণ হিসাবে বলা যায় ব্রোঞ্জ যুগের অনেক স্থাপত্য যেমন ব্রিটেনের মাউন্ড ইন দ্য ডার্ক গ্রোভ অথবা ইস্রায়েলের রুজম এল হিরির টুম্বও একই উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিল ।


বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মিত প্রায় একই আকারের স্থাপত্য
এবার প্রশ্ন হলো যে পৃথিবীতে শুধু এই নার সম্প্রদায়ের মানুষরাই কি এই বি-হাইভ টুম্ব বানিয়েছিল নাকি অন্যান্য দেশের লোকেরাও বানিয়েছিল ? মজার কথা হলো বি-হাইভ টুম্ব পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও পাওয়া গেছে ।সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু বি-হাইভ টুম্ব যেমন মায়সিনের টুম্ব অফ অ্যাগমেমনন, ক্রেটের মায়েসেনিয়ান স্টাইলোস টুম্ব ,সারদানিয়ার নুরাজে থোলোস, ইটালির এট্রাসকান নেক্রোপলিস অফ চেভেত্তেরি, বুলগেরিয়ার কাযানলাক টুম্ব, সুদানের ডংগোলার বি-হাইভ টুম্ব, চীনের ওয়েস্ট জিয়া ইমপেরিয়াল টুম্ব; এছাড়া উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকাতেও বি-হাইভ জাতীয় টুম্ব এর সন্ধান পাওয়া গেছে । আমাদের দেশে এইরকম টুম্ব আমি দেখিনি। কিন্তু বর্ধমানের সাত দেউল দেখার পর কেন জানিনা মনে হয়েছে যে এই মন্দিরের আকারে বি-হাইভ টুম্ব গঠনরীতির অনুপ্রেরণা রয়েছে। অবশ্য এটা ইতিহাসের বিচারে সত্যি নাও হতে পারে ।
এই অদ্ভুত বি-হাইভ টুম্ব নিয়ে যতই ইতিহাস খুঁজতে গেলাম ততই মনে হলো পৃথিবীতে কত রকমের রহস্যই না লুকিয়ে আছে। তার কতটুকুই বা আমরা জানি। আর যা জানি সেটাও কি ঠিক জানি? ওমানের অখ্যাত পাহাড়ে যারা এই স্থাপত্যগুলি বানিয়েছিল তারা কি জানত যে গ্রীস, সুদান, চীন, আমেরিকা এইসব দেশের মানুষও একই ধরণের স্থাপত্য বানাত? পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থেকেও তারা কি পরস্পর পরস্পরকে চিনত? আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়েও পাওয়া হলো না ।তাই নতুন করে আবার কোনো রহস্যের সন্ধানে আমার পথ চলা অব্যাহত রইল।
সঙ্গে রইল আমাদের বি-হাইভ টুম্ব ভ্রমণের ছোট্ট ভিডিও।
তথ্য ঋণ
১)উইকিপিডিয়া
২)মাসকাট মিউজিয়াম
৩)Strange Phenomenon of Beehive Shaped Tomb around the World by Brien Foerster
৪)The Secrets Buried in the Tomb of Kibaykib by Siham Al Saidi and Titash Chakraborty
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন টুম্ব এর ছবি ঋণ
ফেসবুক, পিন্টারেস্ট