জীবনে প্রথমবার আরাকু ভ্যালি গিয়ে বোডা কেভ দেখেছিলাম। সেই প্রথম গুহা দেখা। তারপর নৈনীতাল গিয়ে পাতাল ভৈরব গুহা দেখেছি আর দেখেছি রীড ফ্লুট কেভ চীনের গুলিন প্রদেশে।প্রথম বার প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহা দেখার আদিম অনুভুতিটা কোনোদিনও ভুলতে পারিনি। তাই যখন ওমানের হুটা কেভ এর নাম শুনলাম দুদিনের ঈদের ছুটি পেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সেই গুহার খোঁজে। ওমানের রাজধানী মাসকাট থেকে নিজের গাড়িতে হুটা কেভ যেতে সময় লাগে দেড় ঘন্টা।আল হামরা( Al Hamra )জেলার আল হজ্জর পাহাড় শৃঙ্খলার মধ্যে হুটা কেভ অবস্থিত।যাওয়ার পথে পড়ে একটি ছোট ঐতিহাসিক শহর নিজওয়া(Nijwa)।
হুটা কেভ(Huta Cave )সম্পর্কে লেখার আগে উত্তর পূর্ব ওমানের আল হজ্জর (Al Hajar) পাহাড় সম্পর্কে কিছু জানিয়ে রাখি। ত্রিশ লক্ষ বছর আগে আরব পেনিনসুলা আর ইউরেশিয়ান পেনিনসুলার টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে তৈরী হয় এই পাহাড় শৃঙ্খলা। এখানে তামার খনিজ অ্যাফিওলাইট(Aphiolite )এর আধিক্য বেশী। ওমান সংলগ্ন ফুজেইরা অন্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অনেক copper smelting site আছে। এই তামার জন্য সুমেরীয় লিপিতে(Cuneiform )ওমানকে ল্যান্ড অফ মাগান (land of Magan)বলে উল্লেখ করা আছে।
এবার হুটা কেভ প্রসঙ্গে আসি। এই গুহাটি তৈরী হয় দু লক্ষ বছর আগে। স্থানীয় হুটা গ্রামের নামে গুহার নামকরন। প্রায় পাঁচ কিমি লম্বা গুহা। এই গুহাতে স্ট্যালাকসাইট, স্ট্যালাগমাইট আর জলের পুল ছাড়াও আছে বিশেষ প্রজাতির চামচিকে যা ওমান ছাড়া শুধুমাত্র ইরান এবং আফগানিস্তানে পাওয়া যায়। আর আছে মাকড়সা এবং খুব ছোট প্রজাতির গুহার অন্ধ মাছ বা blind cave fish। প্রসঙ্গত বলে রাখি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রজাতির অন্ধ গুহার মাছ পাওয়া গেছে মেঘালয়ের Chympe গুহায়।
আমরা যখন হুটা কেভ পৌঁছলাম তখন দুপুর সাড়ে এগারোটা বাজে। বাইরের তাপমাত্রা তখন চল্লিশ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই । গায়ের চামড়া প্রায় পুড়ে যাছ্ছে। টিকিট কাউন্টারে গিয়ে মাথা পিছু সাত রিয়াল দিয়ে টিকিট কাটতে হলো। তারপর একটি ছোট্ট ট্রেনে করে গুহার ভেতর পৌছলাম। গুহার ভেতরের ঠান্ডা তাপমাত্রায় বাইরের দবদাহ থেকে অনেকটা রেহাই পাওয়া গেল। গুহার ভেতরে একজন ওমানি গাইড ইংরেজিতে আমাদের গুহা সম্পর্কে অনেক কিছু জানাল। গুহাটি পাঁচ কিমি লম্বা হলেও শুধুমাত্র ৮৬০ মিটার পর্যন্ত সাধারন দর্শক যেতে পারে। পুরো গুহা দেখার জন্য ৮ ঘন্টার এক বিশেষ ট্যুরের ব্যবস্থা আছে। গুহার ভেতরের ছাদে কার্বন মিশ্রিত জল চুনাপথরের গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়ে অনেক গর্ত সৃষ্টি করেছে। জলই গুহার সমস্ত কলাকৃতির আসল কারিগর। প্রকৃতির এই অসাধারন পাথরের কলাকৃতির দিকে তাকিয়ে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হলো। প্রচুর ছবি ক্যামেরাবন্দি করলাম।
গুহা থেকে যখন ফিরলাম তখন দুপুর একটা বাজে। ভীষন ক্ষিদে পেয়েছিল। রিসেপশনের কফি শপ থেকে একটা স্যান্ডউইচ কিনে আবার ঢুকে পড়লাম জিওলজিক্যাল মিউজিয়ামে। এই ছোট্ট সংগ্হশালায় রয়েছে ওমানে প্রাপ্ত নানা রকমের পাথর এবং জীবাশ্ম। তার মধ্যে ট্রাইলোবাইট গ্যাস্ট্রোপড আর কোরালের জীবাশ্ম গুলো আমার বিশেষ দৃস্টি আকর্ষন করল। এই জীবাশ্ম গুলো দেখে প্রমান হয় যে পৃথিবীর এই অংশটি এক সময় সমুদ্রের তলায় অবস্থিত ছিল যা আজকে শুধুই রুক্ষ এক মরুভূমি। ওমান সম্পর্কে এমন অনেক মজার তথ্য জানার পর যখন ঘড়ির দিকে তাকালাম তখন দুপুর দুটো বাজে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। মনটা তখনও গুহার আদিম রূপেই মজেছিল।
ছবিঃ লেখক