ওমান সম্পর্কে খুব বেশী তথ্য পৃথিবীর কাছে নেই। ওমান কখনোই ভ্রমণবিলাসীদের আকর্ষণ করে না।কারণ, এই দেশের বেশিরভাগ অংশই রুক্ষ পাথুরে মরুভূমি। এর উত্তর পূর্ব দিকে আল হজ্জর পাহাড় শৃঙ্খলা আর দক্ষিনে আরব সাগরের ধার ঘেঁষে ধোফার পাহাড়ি অঞ্চল। দেশটাকে কিছুটা মঙ্গল গ্রহের সঙ্গে তুলনা করা যায়। হয়তো এই কারণে অস্ট্রিয়ার মহাকাশ সংস্থা মঙ্গল গ্রহের পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ওমানের মারমুল অঞ্চলকে বেছে নিয়েছিল।এ হেন দেশে যখন কর্মসূত্রে থাকতে এলাম অনেকেই প্রশ্ন করেছেন ভারতবর্ষ ছেড়ে ওমানের মতো দেশে থাকা কি সম্ভব? আমরা যারা গ্রন্থাগারিক তাদের কাছে নতুন দেশ মানেই যেন নতুন একটা বই। এই নতুন বই পড়ার লোভ সামলাই কী করে! এইরকম একটু লোভ নিয়ে কয়েকদিনের ছুটি পেয়েই বেরিয়ে পড়লাম এ দেশের দক্ষিণ দিকে, ওমানের সবচেয়ে সবুজ শহর সালালার উদ্দেশ্যে।
হাসিক-সালালা রোড, আমাদের যাত্রা শুরু
প্রায় ন’শো কিমি এই পুরো যাত্রাপথের সবচেয়ে সুন্দর অংশ ছিল হাসিক থেকে সালালা যাবার পথ। আরব সাগরের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে আর ধোফার পাহাড় শ্রেণীর রংবেরঙের বিভিন্ন আকারের পাথুরে কারুকার্য দেখতে দেখতে পথ চলা। এই জায়গাটা ভূতত্ববিদদের স্বর্গ হতে পারে। ওমানের পুরাতাত্বিক মানচিত্রেও হাসিকের নাম পাওয়া যায়। সালালা পৌঁছনোর পর সালালার তিন মূল আকর্ষণ হলো সুমহুরাম, ওয়াদি দারবাত, মুঘসেইল সমুদ্র তট। আমার এই লেখার বিষয় সুমহুরাম এর আয়নায় প্রাচীন ওমানকে ফিরে দেখা।
পথে দুপাশে পাথর ক্ষয়ে নানা বিচিত্র প্রাকৃতিক ভাস্কর্য
এক প্রাচীন বন্দর
ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট রূপে স্বীকৃত সুমহুরাম
খোর রোরি,আরব সাগরের কোলে মিষ্টি জলের হ্রদ
সুমহুরাম প্রাক ইসলামিক যুগের এক ছোট প্রাকৃতিক বন্দর। সালালা থেকে এর দূরত্ব ৪১ কিমি। বর্তমানে এটি ইউনেসকো ওয়ারল্ড হেরিটেজ সাইট এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। বন্দরটি তৈরী হয় সমুদ্রের ধারে প্রায় আঠাশ মিটার উঁচু একটি টিলার উপর।পুরাতত্ববিদদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্ট জন্মের পঞ্চম শতক পর্যন্ত (3rd century BC- 5th century AD) প্রায় আটশ বছর এই বন্দরের গৌরব অক্ষুন্ন ছিল। বন্দরের এক পাশে নোনা জলের আরব সাগর আর তার মুখে মিষ্টি জলের হ্রদ যার নাম 'খোর রোড়ি' (Khor Rori) । আরবি ভাষায় খোর মানে মুখ। এই শব্দটা আমরাও মুখ হিসাবে ব্যবহার করি যেমন ঘুষখোর, আদমখোর ইত্যাদি।
মরুভূমির মাঝে সবুজের সমারোহ, ওয়াদি দরবাত
একটু দূরে ওয়াদি দরবাত (Wādī Darbāt) থেকে বৃষ্টির জল ঝরনা ও নদীর মতো বয়ে এসে খোর রোড়িতে জমা হয়ে হ্রদের সৃষ্টি করে। জলের রংটা যেন সবুজ আর নীলের সুন্দর যুগলবন্দি। আরব সাগর আর খোর রোড়ির এই সংযোগস্থল এক অদ্ভূত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। শোনা যায় এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে একসময় মুগ্ধ হয়েছিলেন বিখ্যাত ভূপর্যটক মার্কোপোলো ,ইবন বতুতা এমনকি চীনের বিখ্যাত নৌ সেনাধ্যক্ষ জেং হে ।সুমহুরাম এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় প্রথম শতাব্দীতে (AD 59–62) জনৈক গ্রিক নাবিকের লেখা পেরিপ্লাস মারিস এরিথ্রাই(Periplus Maris Erythrai/ Periplus of the Erythraean Sea)তে যাকে 'মস্খা লিমেন'(Moscha Limen) নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত যে প্রাক ইসলাম যুগে সুমহুরাম এক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বন্দর হিসাবে পরিচিত ছিল। খননকার্যে পাওয়া জিনিসপত্র থেকে এ ও প্রমাণ হয় যে এই বন্দরের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু সভ্যতা, মিশর এমনকি সুদূর চীনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।
বন্দর স্থাপত্য
সুমহুরাম বন্দর শহরের ধ্বংসাবশেষ
এত কিছু জানার পর স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে অতীতে কেমন ছিল এই বন্দর সজ্জা? যদিও আজকের ধ্বংসস্তুপে ছড়িয়ে থাকা চুনাপাথরের ভগ্ন দেওয়াল, কিছু সিঁড়ির ধাপ আর ভাঙা এক সাগর দ্বার দেখে বন্দরের স্থাপত্য খুব বেশি অনুমান করা যায় না তবুও প্রত্নতত্ত্ববিদদের আপ্রাণ চেষ্টায় যা পাওয়া যায় তা ভাবলে অবাক হতে হয়। পুরো বন্দরটি প্রায় দুই থেকে তিন মিটার চওড়া দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। প্রায় এক হেক্টর এলাকা জুড়ে তৈরী এই বন্দরটি ছিল কিছুটা ত্রিভুজের মতো। বন্দরের বাড়ি ঘরের দেওয়াল ছিল প্রায় পাঁচ মিটার উঁচু। বন্দরে প্রবেশ করার জন্য একটি সুরক্ষিত তোরণ ছিল। আবার সমুদ্রের দিকে অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট একটি দ্বার ছিল যেখান দিয়ে আমদানি-রপ্তানি যোগ্য মাল আনা নেওয়া হতো। বন্দরের দুই পাশে পাহারা দেবার জন্য উঁচু মিনারও ছিল। বন্দরের ভেতরে সাধারণ মানুষের থাকার জন্য আলাদা জায়গা, বানিজ্যিক কার্যকলাপের জন্য আলাদা জায়গা চিহ্নিত ছিল। বন্দরের ভেতরে এক বা একাধিক মন্দির ছিল। আমদানী রপ্তানি যোগ্য মাল রাখার জন্য ছোট বড় অনেক গুদাম ঘর ছিল। শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বন্দরের ভেতরে চলাচলের রাস্তা কিছুটা আঁকাবাঁকা নক্শায় (zigzag pattern) পরিকল্পনা করা হয়েছিল এবং অনেক সিঁড়ির ব্যবহার করা হয়েছিল। পানীয় জলের জন্য কুয়োর ব্যবস্থা ছিল। বন্দরের ঘরবাড়ি গুলো স্থানীয় চুনাপাথরের তৈরি ছিল এবং বাড়ির দেয়াল মর্টার/ সুরকির প্রলেপ দিয়ে ঢাকা ছিল।
হাদরামি জনগোষ্ঠী
প্রাচীন বস্তুর ওপর মাসনাদ বর্ণমালায় লেখা ইয়েমেনি লিপি
এই তো গেল বন্দরের নক্শা। কিন্তু কারা এই বন্দরে থাকত? কেমন ছিল তাদের রোজনামচা? প্রাচীনকালে, এই অঞ্চলটি হাদরামউত (Hadhramaut) নামে পরিচিত ছিল। এখানকার জনগোষ্ঠীরা তাই হাদরামি (Hadhrami) নামে পরিচিত। সুমহুরাম এর প্রধান ফটকের পাশে পাওয়া মাসনাদ বর্ণমালায় (Musnad alphabet) লেখা ইয়েমেনি লিপি থেকে জানা যায় এই বন্দরের নাম সুমহুরাম। এখান থেকে পাওয়া ব্রোঞ্জের পাত্রের লেখা ইয়েমেনি লিপি থেকে এও জানা যায় যে এই সুমহুরাম হাদরামি (Hadhrami) জনগোষ্ঠীর নেতা ছিলেন। সম্ভবত তিনিই এই বন্দরের প্রতিষ্ঠাতা। যেহেতু সালালা অঞ্চল ইয়েমেন সংলগ্ন তাই এই বন্দরে ইয়েমেনি হাদরামি জনগোষ্ঠীর বসবাস খুব স্বাভাবিক।
বাঁ দিকে ফ্লুয়েক গাছ; ডান দিকে এই গাছ থেকে নিষ্কাশিত
এই বন্দর পত্তনের মূল কারণ হলো পার্শ্ববর্তী নেজেদ (Nejd) অঞ্চলে যে উৎকৃষ্টমানের ফ্র্যাংকিন্সেন্স (Frankincense) প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হতো তার বাণিজ্যিক লাভ ওঠানো। ফ্র্যাংকিন্সেন্স মূলতঃ এক ধরনের গাছের সুগন্ধি আঠা বা রেজিন। এই গাছ বসওয়েলিয়া(Boswellia) প্রজাতির যার আঞ্চলিক নাম ফ্লুয়েক গাছ(Fluek tree) এবং ধোফার অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এর ব্যবহার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে হলেও মরুভূমি অঞ্চলে জল ঠান্ডা রাখার জন্য, পোকামাকড় থেকে বাঁচার জন্য, ব্যথার ওষুধ হিসাবে এর ব্যবহার খুবই জনপ্রিয় ।
প্রাচীন ফ্র্যাংকিন্সেন্স বাণিজ্য পথ
ওমানের ফ্র্যাংকিন্সেন্স-এর চাহিদা মিশর, ব্যাবিলন, গ্রীস, রোম এমনকি চীনেও অনেক বেশী ছিল। ফ্র্যাংকিন্সেন্স-এর উল্লেখ আমরা পাই যিশুর জন্মের কাহিনিতে, যেখানে প্রাচ্যের তিন প্রবীন সদ্যোজাত শিশুকে উপহার দেন সোনা, মাহ্র্ আর ফ্রাংকেনসেন্স। ফ্র্যাংকিন্সেন্স বাণিজ্যের উপর হাদরামি জনগোষ্ঠীর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি যার কেন্দ্র ছিল এই বন্দর।
কাম্বারি — এই অঞ্চলের প্রাচীন সেলাই করা নৌকা
এই জনগোষ্ঠী নৌবিদ্যায় ভীষণ পারদর্শী ছিল। এমনকি নৌকা তৈরিতেও পারদর্শী ছিল। এরা বিশেষ করে কামাবারি নৌকা তৈরি করত। এছাড়া মাছ ধরা, সমুদ্রের নীচ থেকে মুক্তো তোলা এসব কাজও করত।
ধর্ম
(ঘড়ির কাঁটার দিকে)- ঐতিহাসিকদের কল্পনায় চন্দ্রদেবতার মন্দির, পাথরের গায়ে চাঁদের প্রতীক, সিংহের মূর্তি, সাপের প্রতীক
হাদরামিদের প্রধান উপাস্য দেবতা ছিল সেমেটিক চন্দ্রদেবতা সিন । সুমহুরাম বন্দরে দেবতা সিন (Syn) এর মন্দির পাওয়া গেছে। এছাড়া এখানে মন্দিরে ব্রোঞ্জের সিংহ মূর্তি এবং চুনাপাথরের সাপের অলংকরণ পাওয়া গেছে। যা থেকে অনুমান করা যায় যে এখানে কোনো নাগ দেবতা বা কোনো সিংহবাহিনী সেমেটিক দেবী আল উজ্জা-র (Al-ʻUzzā) পুজো হতো। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রাক ইসলামী যুগে আরবের মানুষদের সেমাইটস (Semites) বলা হতো। হাদরামিরা এই সেমাইটসদের একটি শাখা। আদি পুরুষ নোয়ার তিন ছেলে যথাক্রমে হ্যাম, সেম আর জাফেথ। এর মধ্যে সেম এর বংশধর বলা হতো সেমাইটস। আর হ্যাম এর বংশধরদের(হেমাইটস)বাস ছিল আফ্রিকা এবং জাফেথ-এর বংশধরদের বাস ছিল ইয়োরোপ। কিছুটা আমাদের দেশের সূর্যবংশী-চন্দ্রবংশীদের মতো যারা রাজা মনুর দুই ছেলে মেয়ের( ইক্ষ্বাকু ও ইলা)বংশধর। এই সেমাইটসরা বহুমূর্তি পুজোয় বিশ্বাস করতো। প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ সেই কথাই বলে। সুমহুরাম-এ ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত যে ধুনুচি গুলো পাওয়া গেছে তাতে চন্দ্র দেবতা সিন-এর প্রতীক হিসাবে অর্ধ চন্দ্র এবং সূর্যের অলংকরণ রয়েছে। এই চাঁদের দেবতা সিন এতোই জাগ্রত ছিলেন যে এই বন্দরের তিনিই ছিলেন রক্ষাকর্তা। চাঁদের প্রতি আরবদের এই বিশ্বাস আজও অটুট আছে।
ভারত যোগ
আরিকামেদুর পুঁতি
সুমহুরাম এর সঙ্গে ভারতবর্ষের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল গভীর। এখানে যে পুঁতির মালা পাওয়া গেছে তার পুঁতিগুলি ছিল দক্ষিনভারতের আরিকামেদু-র তৈরি পুঁতি। তাছাড়া অ্যাগেট এবং কারনেলিয়ানএর তৈরি পুঁতি গুলি এসেছিল ব্যরিগাজা বা ভরুচ, উজ্জয়িনী এবং কম্বে অঞ্চল থেকে। এছাড়াও এখানে একটি ভগ্ন শলভঞ্জিকা ( প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যে নারীমূর্তি/ যক্ষী মূর্তি ), প্রথম শতাব্দীর কুষাণ সম্রাট কনিষ্ক এবং ক্ষত্রপ রাজা অভিরাকার মুদ্রা, তামিল ব্রাহ্মী লিপি খোদিত ভারতীয় মৃৎপাত্র-এর অংশবিশেষ ইত্যাদি পাওয়া গেছে যা থেকে সহজেই প্রমাণ হয় যে ভারতীয়দের সঙ্গে শুধু যোগাযোগই ছিল না কিছু ভারতীয় হয়তো এখানে বসবাসও করত।
শেষ কথা
সুমহুরাম এর আনাচ কানাচ ঘুরে প্রাচীন ওমানের অনেক তথ্য যেমন জানা গেল তার সাথে এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য এক আলাদা পাওনা। আজ সব ভারতীয়রা হয়তো সুমহুরাম-এর নাম নাও জানতে পারে কিন্তু প্রায় দুহাজার বছর আগেও এইখানে ভারতীয়দের উপস্থিতি ছিল। মজার বিষয় হলো আজও এই হাদরামউত জাতির মানুষ ভারতীয় হিসাবে হায়দ্রাবাদ, মুম্বাই, আহমেদাবাদ শহরে বসবাস করে। এরা সুদুর অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে ভারতবর্ষে পরিযায়ী হিসাবে এসেছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মে বালির আস্তরণ জমতে শুরু হয় এই বন্দরের মুখে। বন্দর ধীরে ধীরে নৌকো চলাচলের অযোগ্য হয়ে ওঠে। বন্দরের কার্যক্ষমতা কমতে কমতে বন্দর একসময় হারিয়ে যায় কালের অতলে।
তথ্য ঋণ
*Sumhuram Archeological Gallery
* Museum of Frankincense ,Salalah
* Southern Arabia by Theodore Bent
* Traces of Indian Community in the city of Sumhuram by Silvia Lischi
* উইকিপিডিয়া
ছবি ও ভিডিওঃ লেখক