প্রতিটি ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে হত এমন লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো
ফুটবল বিশ্বকাপ এক বিস্ময়। শুধুমাত্র যেসব দেশ খেলে তারাই নয়, এতে অংশ নিতে সারা পৃথিবী থেকেই মানুষজন আসেন। আমিও এবার পনেরো দিনের জন্য গিয়েছিলাম কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে। ছেলেবেলা থেকেই এ স্বপ্ন অনেক বাঙালির মতন আমিও দেখেছিলাম, একবার বিশ্বকাপ দেখতে যাব। নিজের দেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে নেই। সত্যি বলতে কি প্রতিটি বিশ্বকাপে আমাদের দেশ ফুটবলে অনেক পিছিয়ে থাকার কারণে প্রায় অপ্রাসঙ্গিকই রয়ে যায়। আমরা কি কোনভাবেই এই সুবিশাল কর্মকান্ডে অংশ নিতে পারি না? বিশ্ব-ফুটবলে অবদান রাখার জন্য আমরা কিন্তু স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করতেই পারি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্বকাপ বলতে আমরা যা বুঝি তা ছাড়াও ফিফা আরও কমপক্ষে নারী-পুরুষ মিলিয়ে নানান বিভাগে আরও সতেরোটি প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। প্রতিটিতেই স্বেচ্ছাসেবক লাগে, ফিফা প্রতিবার তাঁদের আহ্বান করে। এই কাজ মানুষ করে সম্পূর্ণ পরোপকারের ইচ্ছা ও সম্মানের জন্য, এবং কোনো পারিশ্রমিক বা অর্থ এই কাজের জন্য পাওয়া যায় না। তবে একটি সার্টিফিকেট ফিফা দেয়, যা অমূল্য। এর মাধ্যমে বিশ্বকাপ সংগঠনে সেই স্বেচ্ছাসেবককে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়; যা দেখতে পেলে দেশ-ভাষা-ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে সারা পৃথিবীর মানুষ জীবনে এমন কাজে যাঁরা যুক্ত হন তাঁদের সামনে মাথা নত করেন।
আমি নিজে এই বছর ফিফার স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম। চেয়েছিলাম 'পর্দার পিছনে' দৃশ্যের অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করতে ও পৃথিবীর নানান প্রান্তের আরও কিছু সমমনস্ক, স্বতঃপ্রণোদিত, ইতিবাচক মানুষের সাথে দেখা করতে। সে সুযোগ পেলে আলাপ হত কিছু মানুষের সঙ্গে, খেলাধূলার প্রতি যাদের অনুরাগ আছে এবং মনে করে স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে খেলাধূলায় তারা আরও বিশেষভাবে অবদান রাখতে পারে। তবে প্রথমবার কিছু অনভিজ্ঞতার জন্য বাদ পড়ি। এই কাজে যাওয়ার আগে অন্য নানান সামাজিক কাজে বা খেলাধূলায় স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার অভিজ্ঞতা কাজে আসে।
যখনই দলগুলি স্টেডিয়ামে খেলার জন্য প্রস্তুতি নেয়, স্বেচ্ছাসেবকেরা চলমান ঘটনাগুলি খুব কাছ থেকে দেখতে পায়। কিক-অফের আগে খেলোয়াড়দের পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে দেখে এবং স্টেডিয়ামের সেই মায়াবী পরিবেশ স্পর্শ করতে পারে।
ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে খুবই দুর্বল দেশের দর্শকেরাও আসেন। এছাড়া নানা দেশের সাংবাদিকরা, বিখ্যাত মানুষজন এবং রাষ্ট্রনেতারাও আছেন। এবার সব মিলে প্রায় বারো লক্ষ মানুষ এসে উপস্থিত হয়েছিলেন কাতারের রাজধানী দোহায়। কাতারের জনসংখ্যা মাত্র ছাব্বিশ লক্ষ, সেখানে একটিমাত্র শহরে এত লোকের সমাগম তারা সামাল দিল কীভাবে, এ-ও এক বড় আশ্চর্যের বিষয়!
বিভিন্ন দেশের জার্সি পরে স্বেচ্ছাসেবকের দল
খুব সহজে মনে হতে পারে পুলিশ বা প্রশাসন দিয়ে, এবং সেটা আংশিকভাবে সত্য। যেমন, শহরের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন বা পুলিশের বড় ভূমিকা অবশ্যই থাকে। সকাল থেকেই হেলিকপ্টারে চলে আকাশপথে নজরদারি। স্টেডিয়ামে ঢোকার আগে টিকিট চেকিং পয়েন্টে বিমানবন্দরের মতনই সব কিছু পরীক্ষা করা হয়। ভেতরে ঘোড়া পুলিশও থাকে হঠাৎ দাঙ্গা বাঁধলে তা আটকানোর জন্য, অগ্নিকান্ড বা কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে তা সামাল দেওয়ারও আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকে।
এ সবই হল, কিন্তু এর বাইরেও তো কত কাজ থাকে! যেমন, এত বিপুল সংখ্যক মানুষ যে অজানা জায়গায় উপস্থিত হলেন তাঁরা কিভাবে শহরের নানান জায়গায় যাবেন? কে তাঁদের চেনাবে পথঘাট? মাঠে খেলা শুরুর আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ রোজ যেসব বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হয় সেগুলো করা হবে কী করে? হঠাৎ এত অতিথি তো এলেন, কিন্তু তারপর! শহরে তো এত দ্রুত গাড়িচালক, কলের মিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, গাড়িঘোড়ার ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, নার্স তো একটিও বাড়ছে না। তাহলে সামাল দেওয়া হবে কীভাবে? খেলার প্রথম রাউন্ডে প্রতিদিনই প্রায় চারটি ম্যাচ হয় ও আড়াই লাখ লোক খেলা দেখেন। এই বছরই বাস যোগাড় হয়েছে মাত্র হাজার পাঁচ। মেট্রোরেল দিয়েই বা কত সামাল দেওয়া যায়? এই বছর থেকে ফিফা অনলাইন টিকিট চালু করেছিল। অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষকেই মোবাইলে ফিফা অ্যাপ্লিকেশনে আসা টিকিট দেখিয়ে ঢুকতে হয়েছে। সবাই যে মোবাইল ব্যবহারে দক্ষ এমন তো নয়, তেমন মানুষজনের অভিজ্ঞ কারুর সাহায্য লাগে। অনেকে আবার স্টেডিয়ামে হাজার হাজার সিটের মধ্যে নিজের সিট চিনতে না পেরে অন্যের সিটে বসে পড়েন। তাঁদের ঠিক সিটে বসাতে হয়। খেলা শেষ হওয়ামাত্র মধ্যরাতে সমস্ত স্টেডিয়াম দ্রুত খালি করে দর্শকদের বাস-মেট্রো, পার্কিং পয়েন্ট বা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে পৌঁছে দিতে হয়। এখানেই প্রতিবছর নিঃসাড়ে পুরো কর্মকান্ডটি সযত্নে সফল করতে সাহায্য করেন প্রায় লাখখানেক স্বেচ্ছাসেবক।
বিশ্বকাপের টিকিটের আবেদনপত্র এই বছর গ্রহণ করা শুরু হয় লটারির মাধ্যমে এবং খেলার বহু মাস আগে। এমনকি সব দল তখনও যোগ্যতাই অর্জন করেনি। লটারি পর্ব মেটার পরেই ফিফা স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার আবেদন গ্রহণ করা শুরু করে। ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত নাগরিক, সবারই প্রয়োজনীয়তা থাকে। অল্পবয়সীরা তাদের শারীরিক শক্তি, উৎসাহ ও প্রাণোচ্ছলতায় অনেক এগিয়ে থাকে। এবার কাতারের ফ্যান ভিলেজ, বাসস্ট্যান্ড, মেট্রো, দর্শনীয় জায়গা, এয়ারপোর্ট, স্টেডিয়াম, হোটেল সর্বত্র থিকথিক করছিল হাসিমুখে এসব অল্পবয়সী FIFA VOLUNTEER TEAM।
নাইজেরিয় স্বেচ্ছাসেবক বাবাগানা ওকাউই
কাতারের নিজেদের জনসংখ্যা লাখ চার/পাঁচ। কাতারের মানুষদের মাথা-পিছু আয় আমাদের ছাব্বিশগুণ। তারা যে খুব মিশুকে এমনও না। তাই উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকরা কাতারের নাগরিক না হলেও, এখানে থাকা আফ্রিকা এবং এশিয়ারই ছেলেমেয়েরা। কোথায় কীভাবে যাবেন, কী করবেন, তারা উদয়াস্ত পৃথিবীর মানুষকে বুঝিয়েছে অক্লান্তভাবে। মানুষের মিলনমেলায় জনপ্রিয় সুরে বা নানান বিচিত্র নাচে তারা বলে চলেছে - Metro this way বা Bus stop this way। লাজুক মানুষজন বুঝলে নিজেরা গিয়েও জিজ্ঞেস করছে কী সাহায্য লাগবে। তারা না জানলে সিনিয়রকে ফোন করে, কিন্তু দায় সারে না কিছুতেই। এটা তারা কিন্তু কোন পারিশ্রমিকের জন্য করেনি। যদিও জল ও খাবারের ব্যবস্থা ছিল, তবে তা নগন্য।
তবে যারা কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত তাঁদেরও ভীষণ প্রয়োজন। সবাই আমরা যা যা কাজ করি, সবই এখানে কম-বেশি লাগে। দায়িত্ব পান হোটেল, হাসপাতাল, অফিসের কাজ, প্রেস সামালানোর কাজ আর নানান মিস্ত্রিদের তদারকির কাজ। কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবকের কাজ সারারাতেরও হয়। যেহেতু একটি দেশের নাগরিকেরাই সেই দেশ বিষয়ে সব থেকে বেশি জানেন, তাই আবেদনের সময় স্বাগতিক দেশের নাগরিকেরা অগ্রাধিকার পান। তবে অন্য দেশের মানুষদেরও নেওয়া ।
স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে লেখক
আমি পড়েছিলাম কলম্বিয়ার এক স্বেচ্ছাসেবকের কথা, রাশিয়া বিশ্বকাপে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সাহায্য করেছিলেন। তিনি বলছিলেন, আমার কাজ চেঞ্জিং রুমে সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখা। আমি দলের ফটোগ্রাফারদের নিয়ে স্ট্যান্ডে যাই এবং ফুটবল দলের সহায়তার জন্য নিযুক্ত কর্মীদের যে কোন সমস্যার জন্য উপস্থিত থাকি। এই ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ লিখলে সম্ভবত একটি বই হয়ে যাবে। আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এবার এক স্বেচ্ছাসেবকের, নাম উইলসন রিচার্ডস। এক হোটেলের খাবারের গুণমান পরীক্ষার দায়িত্বে আছেন তিনি এবং সেখানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত ফটোগ্রাফার এড্রিয়ান ডেনিসের সঙ্গে। শুধু ফুটবলই নয় অলিম্পিকেও আমাদের বেশ কিছু চেনা ছবির ফটোগ্রাফার কিন্তু এই এড্রিয়ান ডেনিস। এমন মানুষজনের সঙ্গে আলাপ সম্ভবত আমাদের জ্ঞানের দিগন্তকে অনেকটা বিস্তৃত করে দেয়। ইচ্ছামতীর যে সব পাঠক বন্ধু আঠেরোয় পা দিয়েছেন বা পেরিয়ে এসেছেন, তাঁরা আগামী দিনে এভাবে বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার অংশ হয়ে উঠতে চাইলে, এই লিংকে গিয়ে নিজেদের নথিভুক্ত করে রাখতে পারেন https://volunteer.fifa.com/login। আর বাকিদের শুধু কয়েক বছরের অপেক্ষা!
ছবিঃ লেখক