সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
চড়িদা : ছৌ নাচের মুখোশ গ্রামের বৃত্তান্ত

মায়ের শেকড় ছিল বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড় গ্রামে। সেইসূত্রে একবার ছৌ নাচ দেখার সুযোগ এসেছিল ছেলেবেলায়। সে যাত্রা ছৌ নাচ দেখা হয়নি, নাচ শুরু হওয়ার কথা ছিল গভীর রাতে। দীর্ঘ কয়েক দশকের অপেক্ষার পর প্রথম দেখি কলকাতায়।

ছৌ নাচ সত্যিই অপূর্ব। প্রচুর শারীরিক দক্ষতা, ঝকমকে পোশাক, অসাধারণ মুখোশ, একদল গাইয়ে ও বাজনদার এবং একটি যুদ্ধজয়ের গল্প- এই হল এর মশলা। বাজনা বলতে মূলত ঢোল, শানাই আর ধামসা। সাজসজ্জায় মুখোশের ব্যবহার পুরুলিয়া ছৌ নাচকে আলাদা করে অন্য সব ছৌ নাচ থেকে।

মানভূম গবেষক দিলীপ কুমার গোস্বামীর মতে শিবের গাজনে মুখে কালি মেখে বা মুহা বা মুখোশ পরে নাচকেই ছৌ নাচের আদি রূপ বলে মনে করেছেন। এরপর অনাড়ম্বর মুখোশ সহকারে একক ছৌ বা 'এ কৈড়া ছো' নাচের উদ্ভব হয়। এ কৈড়া ছো নাচের পরে 'আলাপ ছো' বা 'মেল ছো' নাচের উদ্ভব হয়, যেখানে মুখোশ ছাড়া দুইজন বা চারজন নর্তক নাচ করতেন। এছাড়া সম্ভ্রান্ত বাড়ির নর্তকরা আড়ম্বরপূর্ণ সাজপোশাক পরে 'বাবু ছো' নামক একপ্রকার নাচের প্রচলন করেন। এই নাচে ধুয়া নামক ছোট ঝুমুর গান গাওয়া হয়ে থাকে। ১৯৩০-এর দশকে 'পালা ছো' নাচের সৃষ্টি হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ছৌ নাচের ধারক ও বাহক হল ছোটনাগপুর মালভূমি। ছৌ নাচ তিন প্রকার। ময়ূরভঞ্জ ছৌ নাচ বহন করে উড়িষ্যা ঘরানা। সরাইকেল্লা ছৌ বহন করে সাঁওতাল পরগণার সাক্ষর। পুরুলিয়া ছৌ আমাদের পশ্চিমবাংলার। মুখোশ পরে এই নাচ একমাত্র পশ্চিমবঙ্গতেই দেখা যায়। নাচের মাধ্যমে একটি গল্প বলা হয়। সাধারণত যুদ্ধজয়ের গল্প। মহিষাসুরমর্দিনী, রামায়ণ বা মহাভারত। বাঘমুন্ডির ছৌ নাচে বিজয়ীর জয়গান গাওয়া হয়, পরাজিতের প্রতি বিন্দুমাত্র দয়া করা হয়না। যেহেতু যুদ্ধ, তাই মার্শাল আর্ট আসে স্বমহিমায়। বস্তুত দক্ষিণে কলারিপায়াত্তুর চেয়ে এই বাংলার মার্শাল আর্ট কোনমতে যে কম না, এই নাচ না দেখলে বোঝা যায় না। ইউনেস্কো এই নাচকে তাদের হেরিটেজ তালিকায় স্থান দিয়েছে। পৃথিবীর প্রাচীনতম নাচের মধ্যে এই নাচ অন্যতম।

চড়িদা : ছৌ নাচের মুখোশ গ্রামের বৃত্তান্ত

ছৌ নাচ বিষয়গতভাবে মহাকাব্যিক। এই নাচে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন উপাখ্যান অভিনয় করে দেখানো হয়। কখনও কখনও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনিও অভিনীত হয়। ছৌ নাচের মূল রস হল বীর ও রুদ্র। নাচের শেষে দুষ্টের দমন ও ধর্মের জয় দেখানো হয়। গ্রামাঞ্চলে এই নাচের আসর কোনো মঞ্চে হয় না; খোলা মাঠেই আসর বসে, লোকজন চারিদিকে জড়ো হয়ে নাচ দেখে। তবে শহরাঞ্চলে সাধারণত মঞ্চেই ছৌ নাচ দেখানো হয়। নাচের শুরু হয় ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে। এরপর একজন গায়ক গণেশের বন্দনা করেন। গান শেষ হলে বাদ্যকারেরা বাজনা বাজাতে বাজাতে নাচের পরিবেশ সৃষ্টি করেন। প্রথমে গণেশের বেশধারী নর্তক নাচ শুরু করেন। তারপর অন্যান্য দেবতা, অসুর, পশু ও পাখির বেশধারী নর্তকেরা নাচের আসরে প্রবেশ করেন। প্রতিটি দৃশ্যের শুরুতে ঝুমুর গানের মাধ্যমে পালার বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দেন।

ছৌ নাচে মুখে মুখোশ থাকার ফলে মুখের অভিব্যক্তি প্রতিফলিত হয় না বলে শিল্পী অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কম্পন ও সঙ্কোচন - প্রসারণের মধ্য দিয়ে চরিত্রের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে থাকেন। ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য ছৌ নাচের অঙ্গসঞ্চালনকে মস্তক সঞ্চালন, স্কন্ধ সঞ্চালন, বক্ষ সঞ্চালন, উল্লম্ফন এবং পদক্ষেপ এই পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছেন। বাজনার তালে হাত ও পায়ের সঞ্চালনকে চাল বলা হয়ে থাকে। ছৌ নাচে দেবচাল, বীরচাল, রাক্ষসচাল, পশুচাল প্রভৃতি বিভিন্ন রকমের চাল রয়েছে। চালগুলি ডেগা, ফন্দি, উড়ামালট, উলফা, বাঁহি মলকা, মাটি দলখা প্রভৃতি বিভাগে বিভক্ত।

চড়িদা গ্রামের কথা
------------------------------

এই পুরুলিয়া ঘরানার ছৌ নাচের মুখোশের যোগান দেয় পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রাম। সেই গ্রামের কথা জানাতেই এত ভূমিকা।

এক বসন্তের দুপুরে বাঘমুন্ডি থেকে আরো দুই কিলোমিটার এগিয়ে পৌঁছালাম চড়িদা গ্রামে। পাথুরে মাটিতে বৃষ্টি পড়েনি বহুদিন, চারদিকে পুরু ধূলোর প্রলেপ। বেশ কিছু বাড়িতে হালফ্যাশানের ছোঁয়া লাগলেও বেশিরভাগ বাড়ির জানালা দরজায় আজও আলকাতরা। জানালার গরাদগুলি শিকের। বাচ্চারা সাইকেলের টায়ারকে গাড়ি বানিয়ে মহানন্দে ছুটছে। মণিহারি দোকান, মুদিখানার দোকান বা মিষ্টির দোকান সবই যেন আটকে আছে অর্ধ শতাব্দী আগে। রাস্তার পাশে আদিবাসীরা ছোলার শাক বিক্রি করছেন দুপুর আড়াইটের সময়ে। চড়া রোদ, ক্রেতা নেই। মাঝেমধ্যে নিজেরাই হাসিমুখে কাঁচা ছোলা ভেঙে খাচ্ছেন। আমার স্মার্টফোন দেখাচ্ছে ৩৮ ডিগ্রী, তবে গরমের অনুভূতি তেমন নেই ঠান্ডা হাওয়ায়। এঁরা কতক্ষণ খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকবেন ভাবতে গিয়ে মনে হল হয়ত কয়েক যুগ। যৌবনে পড়া মার্ক্স সাহেবের বাণী মনে পড়ল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা স্বজনবিচ্ছেদ ছাড়া পল্লিজীবন খুব একটা নড়েচড়ে বসেনা। সে তার নিজের ছন্দে প্রবহমান, অনেকটা এখানকার ক্ষীনকায়া নদীর মতন....

চড়িদা গ্রামে প্রায় এক-শো ঘর মুখোশশিল্পী পসরা সাজিয়ে বসেন রোজ। প্রায় তিন-শো মানুষ এই জীবিকা থেকে জীবন নির্বাহ করছেন।শিল্পগত মান অপূর্ব। আরো তারিফ করতে হয় এঁদের পুরাণের এবং পৌরাণিক চরিত্র সম্বন্ধীয় জ্ঞানের।

মুখোশ তৈরীর জন্য প্রথমে নদীর দোঁয়াশ মাটি দিয়ে একটি কাঠের ওপর ছাঁচ তৈরী করে পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট রৌদ্রে শুকিয়ে ছাঁচের নাক, মুখ, চোখ বানানো হয়। এরপর কাপড়ে ছাই রেখে তাতে ফুটো করে মুখোশের ওপর ঝেড়ে ঝেড়ে ছাই দেওয়া হয়, এতে পরে ছাঁচ থেকে মুখোশকে পৃথক করা সহজ হয়। এরপর জলে ময়দা ও তুঁত মিশিয়ে আঠা তৈরী করে মুখোশের ছাঁচে তিন থেকে চার স্তরে কাগজ লাগিয়ে দেওয়া হয়। একদিন পরে কাগজের স্তরগুলি শুকিয়ে গেলে আট-দশটি স্তরে কাগজ লাগাতে হয়। এঁটেল মাটি জল দিয়ে ঘোলা করে আট দশ দিন রেখে দেওয়া হয়, যাকে কাবিজ বলা হয়। এরপর আট থেকে দশটি স্তরে সুতীর কাপড় কাবিজের সাথে লাগিয়ে রৌদ্রে শুকিয়ে রাখা হয়। মুখোশের নাক, মুখ, চোখ, কান পালিশ করে রৌদ্রে রেখে দেওয়া হয় ও দুই দিন পরে মুখোশের অবয়ব এবং মাটির ছাঁচটি পৃথক করা হয়। এরপর মুখোশের কিনারার কাগজ ও কাপড় কেটে ভেতরের দিকে মুড়ে মুখোশটিকে দুই-আড়াই ঘন্টা উল্টো করে রৌদ্রে শুকিয়ে নিতে হয়। এরপর তেঁতুলের বীজ সেদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে সারারাত ভিজিয়ে আঠা তৈরী করে তার সাথে খড়িমাটি মিশিয়ে মুখোশের ওপর বার বার লাগিয়ে মুখোশের রঙ সাদা করা হয়। এরপর বিভিন্ন মূর্তিতে পৃথক পৃথক রঙ লাগিয়ে মুখোশের বিভিন্ন অংশ এঁকে সবশেষে চোখের মণি এঁকে রঙের কাজ শেষ করা হয়। এরপর মুখোশের কাঠামোর কাজ শুরু করা হয়। প্রথমে তার দিয়ে বাইরের কাঠামো তৈরী করে পুঁতি, মালা, কানপাশা, কলগা, পালক প্রভৃতি লাগিয়ে কাঠামোর সাজসজ্জা সম্পন্ন করা হয়। মুখোশ তৈরী হয়ে গেলে লোহার রড গরম করে চোখের ফুটো তৈরি করা হয় এবং কানের পাশে দুইটি ফুটো করে তাতে দড়ি বেঁধে দেওয়া হয়, যার সাহায্যে নর্তক মুখোশটি মুখের সাথে বেঁধে নিতে পারেন। এরপর মুখোশে সাবুর মিশ্রণ লাগিয়ে, রৌদ্রে শুকিয়ে বার্ণিশ লাগিয়ে উজ্জ্বল করে তোলা হয়।

চরিত্র অনুযায়ী মুখোশের রঙ হয়। দেবদেবীরা পান হলুদ বা কমলা রঙের মুখোশ, অসুর বা খলচরিত্ররা পায় কালো বা গাঢ় নীল রঙের মুখোশ। তাদের থাকে ভয়ানক চাউনি, দাঁত ও গোঁফ। অন্তিম পর্বে এসে শোলা, পালক, জরি ও রাংতা দিয়ে মুখোশ সাজানো হয়।  অনেক সময়ে ড্রিল মেশিন দিয়ে চোখ ও নাকের ছিদ্র তৈরি করা হয়। ব্যস। মুখোশ বিক্রির জন্য প্রস্তুত।

নিজে কৃষ্ণনাগরিক হয়েই বলছি এ শিল্প কোন অংশেই আমার শহরের মৃৎশিল্প বা বাঁকুড়ার ঘোড়ার চেয়ে কম নয়। প্রচারের অভাবে ভুগছে। গ্রামীন শিল্পীরা জানালেন কলকাতা ছাড়া শিল্পের কদর তাঁরা পাননা। নানা মেলায় গেলে সবই বিক্রি হয়ে যায়, তবে স্থানাভাবে বেশি মুখোশ নিয়ে যাওয়া যায়না। গম্ভীর সিং মুড়া সবচেয়ে নামজাদা শিল্পী। নেপাল সূত্রধরের কাজও দেশে বিদেশে বিখ্যাত। স্বাভাবিক কারনেই এখানকার মুখোশশিল্পীদের কাজ দেশ বিদেশে বন্দিত হয়েছে। হয়ত বিশ্বায়নের খেয়ায় ভর দিয়ে এই মুখোশের প্রচার আরো এগোবে। সুযোগ পেলে একবার পরিবারের সবার সঙ্গে কোনও ছুটিতে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসতে পারো।

প্রতিবেশি রাজ্য উড়িষ্যা ছৌ নাচের আকাদেমি বানিয়েছে। সেখানে ছৌ নৃত্যশিল্পীদের আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভাবা হচ্ছে। সরকারকে সর্বত্র অভিভাবকের পদ অধিকার করতেই হবে, এমন কথা আমিও ভাবিনা। বলছি না ভাতা বা আর্থিক অনুদানের কথা। তবে এই শিল্পীদের দক্ষতার মূল্যায়ন হচ্ছেনা সেটাও ঠিক। তাই নানা সরকারি উৎসব অনুষ্ঠানে নাচের দলগুলিকে ডেকে একটা দু'টো অনুষ্ঠান করার সুযোগ দিলে দোষ কি? তেমন ভাবেই সরকারি সমবায়িকা বা বিক্রয় বিপণিতে মুখোশ দুই একটি করে রাখা যেতে পারে। মানুষ জানুক। গৃহসজ্জাতে এর ব্যবহার করতে পারেন সাধারণ মানুষ। ক্ষুদ্রশিল্প দপ্তর আজকের মুঠোফোনের যুগে যদি এসব যদি ক্রেতার হাতের মুঠোয় কেনার ব্যবস্থা করে, শিল্পীরাও কিছু আয়ের মুখ দেখতে পারেন।


ছবিঃ লেখক

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা