বন্ধুরা,সম্প্রতি প্রায় তিন সপ্তাহ কোভিড রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হলাম। ভাল আছি, খুব বড় কোন জটিল সমস্যা না হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। জোর দিয়ে বলি –অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই কিন্তু সাহসের সঙ্গে করেছি এবং জিতেছি। তাই মনে হয়েছে যে - আমার প্রস্তুতির অভিজ্ঞতা আমার ছোট ছোট বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করে নেওয়া উচিত। বিশ্বাস কর শুধুমাত্র প্রস্তুতি ছিল বলেই খুব কম চিকিৎসা পরিষেবার সাহায্যেই সুস্থ হয়েছি।
এই রোগ থেকে এখনো পর্যন্ত সরাসরি আরোগ্যলাভের দিশা চিকিৎসা বিজ্ঞান দিতে পারে নি। আমার লেখাতেও স্বাভাবিকভাবেই তেমন কোন দিশা তোমরা পাবে না। তবে যেটা পাবে সেটা হচ্ছে কিছু সূত্র। যা সাধারণ মানুষকে রোগের সঙ্গে লড়াইয়ে দিতে পারে অনেকটা সাহস আর তোমাদের কিছুটা প্রস্তুতি। আমি যেহেতু বিপদমুক্ত, আমার অভিজ্ঞতা থেকে সাহস নিও। তবে এ অভিজ্ঞতা কিন্ত শেয়ার করছি সাধারণ-সুস্থ মানুষের জন্য। কোনো জটিল অসুখ আছে কিংবা বয়স্ক মানুষদের জন্য কিন্তু এই লেখা নয়।
আমি কোনোদিন ভাবি নি যে আমার কোভিড হবে না। বরং সত্যি বলতে কি, জানতাম হবে। যেহেতু আমি জরুরী পরিষেবা ক্ষেত্রের কর্মী তাই আমার কোভিড হওয়ার সম্ভাবনা অনেকের চেয়ে বেশি।
সমস্ত সাবধানতা নেওয়া সত্বেও আক্রান্ত হয়েছি আমি। আমি যে অসাবধান ছিলাম এমন কিন্তু একেবারেই নয়। সহকর্মীদের তুলনায় অনেক বেশি সাবধান থাকতাম। অনেক বেশি সময় মাস্ক পরেছি। বেশি স্যানিটাইজার ব্যবহার করতাম। যথেষ্ট মাত্রায় গ্লাভস ব্যবহার করেছি এবং যথেষ্ট মাত্রায় ওষুধ সমেত প্রস্তুত ছিলাম। তাও জানতাম এই রোগ আমার জীবনে যেকোনোদিন আসবে, যেহেতু আমাকে রোজই কাজে যেতে হয়।
সরকার লকডাউন করে, খাবার জোগান দিয়ে, ওষুধের যোগান ঠিক রেখে আমাদের সাহায্য করছে । কিন্তু সেটাই সব নয়। আমাদেরও নিজেদের খেয়াল রাখতে হবে।
মানুষের মূলধন কিন্ত সাহস। আমার এই সাহস ছিল যে আমি কোভিড আক্রান্ত হলেও মরব না।
করোনা মোকাবিলায় আমার প্রস্তুতি
- ধূমপান বর্জন করেছি তিনমাস আগে কোভিডের সঙ্গে লড়তে হতে পারে ভেবে। তোমরাও আশপাশের সবাইকেই বারণ কর।
- কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইতে সবাই শরীরচর্চা রপ্ত কর– বিভিন্ন জার্নাল এবং খবরের মাধ্যমে জানতে পারি যে এই রোগে ফুসফুসে আক্রান্ত হতে পারে, তাই আমি এক-দেড় ঘন্টার মতন মর্নিং ওয়ার্ক করার অভ্যাস রপ্ত করি। এছাড়াও জোরে শ্বাস টানা এবং ছাড়ার অভ্যাস (breathing exercise) রপ্ত করলে ভাল হয়, এই রোগে এই অভ্যাস থাকা খুবই প্রয়োজন।
- যেকোনো মুহূর্ত থেকেই কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আগামী দশ-পনেরো দিন চলার মতন খাবার ঘরে মজুত রাখা দরকার- যেমন - ডিম, মাছ, চাল, ডাল, তেল, নুন, চিনি। এছাড়া কিছু শুকনো ফল, বাদাম, ফলের রস ও রাখা যেতে পারে। কেউ করোনা আক্রান্ত হলে, অসুখের কারণে তার মুখের স্বাদগ্রন্থিগুলো কাজ করে না, ফলে খিদে কমে যায়।তখন এইসব খাবার দেওয়া উচিত।
- বাড়ির বড়রা চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে কিছু দরকারি ওষুধ বাড়িতে রেখে দিতে পারেন। আমি তেমন কিছু ওষুধ বাড়িতে রেখে দিয়েছিলাম।
এত সব করেও আমি কোভিড আক্রান্ত হলাম। সেরে যদিও উঠেছি তবুও আমি কিছু ভুল করেছি। এবার আমার ভুলগুলো তুলে ধরব
আমার ভুলগুলি
- কোভিডে অসুস্থ হয়ে পড়ার দিন কয়েক আগে আমার জুতো ছিঁড়ে যায়। উচিত ছিল হয়ত কোন অনলাইন শপিং মাধ্যম থেকে জিনিস কিনে নেওয়া। কিন্তু আমি শপিং মলে গিয়েছিলাম।
- অসুস্থ হয়ে পড়ার পর প্রথম তিনদিন আমি ডাক্তারের কাছে যেতে পারিনি। ডাক্তার দেখাতে যেতে পারিনি, উঠতে পারছিলাম না। নিজে নিজে ওষুধ খেয়েছি, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
- ডাক্তারবাবু আমাকে অনেক টেস্ট করতে দেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল ইসিজি, লিভার ফাংশন টেস্ট এবং রক্তের অন্যান্য আনুষঙ্গিক টেস্ট। কোভিড টেস্ট ছাড়া কোনোটাই আমি করিনি। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে আমি ইসিজি করাতে যেতে পারতাম না। সৌভাগ্যবশত বেঁচে গিয়েছি কিন্তু এমন ভুল বাঞ্ছনীয় নয়।
- কোভিডের টেস্ট সম্বন্ধে কোন স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। আশপাশে কোথায় কোভিড টেস্ট সহজে হচ্ছে জেনে রাখা অবশ্যই উচিত ছিল।
- হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ডাক্তার বললে তবেই খাওয়া উচিত। এইসব ওষুধ খাওয়ার আগে ইসিজি অবশ্যই করতে হয়। আমি না করেই তিন দিন খেয়েছিলাম, যা প্রাণঘাতী হতে পারত। এমন ভুল কারোর করা উচিৎ নয়।
- কিনছি কিনব করেও অক্সিমিটার কেনা হয়নি সংক্রমন হওয়ার আগে। এমন ভুল করবে না।
- অক্সিমিটারে অক্সিজেন লেভেল প্রায় তিন দিন ৯০ এর ওপরে-নীচে ঘোরাফেরা করছিল। অর্থাৎ ৮৮ থেকে ৯৩ পর্যন্ত। আমি কোন ডাক্তারকে জানাই নি শ্বাসকষ্ট ছিল না বলে। বাজে ভুল ছিল সেটা।
- ক্রেডিট কার্ডের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি আজকাল। বাড়ীতে বেশি টাকা ছিল না। হাতে এত কম পুঁজি নিয়ে এই অসুখের মোকাবিলা করা বড় ঝুঁকিপূর্ণ।
- বিপদ হলে কে কোথায় কী যোগাযোগ করবে জানে না। সকলেরই প্রতি মুহূর্তে রোগ নির্বিশেষে এই প্রস্তুতি সম্পূর্ণ রাখা উচিত। বড়দের বল সব জরুরি তথ্য কোথাও লিখে রাখতে।
আমাদের সবার কী কী অভ্যাস করা উচিৎ
- কেউ অসুস্থ হলে সময় নষ্ট করবে না। মানুষ কোভিড হয়েছে কি হয়নি এটা ভেবে মূল্যবান ২/৩ দিন নষ্ট করছেন।
- বাড়িতে থার্মোমিটারের সঙ্গে একটা পাল্স অক্সিমিটার রাখা উচিত।
- গরম জলের বাষ্প টানা এবং গরম জল দিয়ে গার্গ্ল্ করার অভ্যাস রাখা দরকার।
- নিজের কাজ নিজে করার অভ্যাস করা দরকার। বাইরে থেকে কাজে সাহায্য করতে আসেন যাঁরা, তাঁদের থেকেও রোগ ছড়াতে পারে।
পাল্স্ অক্সিমিটার কী কাজে লাগবে?
পাল্স্ অক্সিমিটার দিয়ে মানুষের দেহের ভেতরে অক্সিজেনের মাত্রা বোঝা যায়। সর্দি কাশির লক্ষণ থাকলেই পাল্স্ অক্সিমিটার দিয়ে সকাল দুপুর ও রাতে রোগীর দেহের অক্সিজেনের মাত্রা দেখা দরকার। অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল ৯০ এর নীচে গেলেই কিন্তু চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে এবং দরকারে হাসপাতালেও ভর্তি হতে পারে। কারণ শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে সমস্যা জটিল হয়ে যায়। কোভিড সংক্রমণের পরিণত দশায় ফুসফুসে জমতে থাকা অর্ধতরল বস্তুটি পরিমাণে বাড়ে ও ঘনতর হয়। তখন লড়াই কঠিন হয়। তাই অন্য রোগ থাকলে অধিক সতর্কতা আবশ্যক।
সাধারণ মানুষের যে ভুলগুলি বা ভুল ধারণা থেকে দূরে থাকা উচিৎ
- বিশ্বাস করো, এই রোগ মানেই সব শেষ নয়। সুস্থ হতে সবারই লক্ষ লক্ষ টাকাও লাগে না।
- করোনায় সাধারণ মানুষদের সবারই শ্বাসকষ্ট হয় না।
- কোভিড-১৯ কোনো সাধারণ সর্দি-কাশি বা ফ্লু নয়। এই অসুখ কোনো অ্যান্টিবায়োটিক, ভিটামিন, আদা, লেবু, জিংক ইত্যাদি কিছুতেই সারে না। এই ওষুধ বা খাবারগুলি সবই বিভিন্নভাবে (পরোক্ষে) আমাদের শরীরকে লড়াইটা করার শক্তি যোগায়।
- কোভিড পজিটিভ হয়েছে মানেই তাকে অ্যামবুল্যান্সে 'তুলে' হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় না –আমার ক্ষেত্রে ফোনে তিনদিন খবরাখবর নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সরকারি বিভাগ থেকে। সুস্থ আছি ও গৃহবন্দী জেনে তাঁরা আশ্বস্ত হয়েছেন।
- মনে রাখতে হবে আমরা অতিমারির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এই অসুখটা কারোর একা বা কিছুমাত্র জনের হচ্ছে না। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের হচ্ছে।
- আগেভাগেই টেস্ট করতে আগ্রহী হওয়াr দরকার নেই। কোভিড টেস্টের লাইনে দাঁড়ালে সেখান থেকেও কিন্ত রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বড়দের বল, ওঁরা এখনই খবর নিয়ে রাখুন কাছে কোথায় টেস্ট করা হচ্ছে। কপি লাগে প্রেসক্রিপশন ও আধার কার্ডের। আর নাম, ঠিকানা, বয়স ইত্যাদি।
- বেসরকারি নামী ল্যাবগুলির কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে সময় লাগে। হোম কালেকশন করেন অনেকে। কিন্তু যিনি আসবেন তিনি সঠিক ভাবে swab collection করতে জানেন কিনা আগে নিশ্চিত হতে হবে আমাদের।
কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভয় পাবে না আগে থেকে। ইতিহাস বলছে, অতিমারিতে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। অল্পবয়সী, শক্তসমর্থ ডাক্তারবাবু, নার্স, সরকারি অফিসার, দিদিমণি, পুলিশ ইন্স্পেকটর যেমন চলে গেলেন, তেমনই অশীতিপর বৃদ্ধও তো বেঁচে ফিরলেন কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে !
কোনো কোভিড আক্রান্তর জন্য কিছু করতে চাও! কী করতে পারো ?
- করোনা নিয়ে জোকস ও মিম শেয়ার না করা।
- ভাল হয়, আক্রান্তকে একটি ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে দিলে। সে হোক ভিডিও কনফারেন্সীর মাধ্যমে, তাও উপকার।
- ফোন করে জেনে ফোনে বলে দাও সহজে-সস্তায়-কাছে কী ভাবে সে টেস্ট করতে পারে। অথবা ভাল জায়গা থেকে হোম কালেকশন- এর চেয়ে বড় সাহায্য হয়না।
- দরকারি খাবার-ওষুধ-পথ্য, রোগীর বাড়ির দরজায় পৌঁছে দিয়ে এসে।
- কোন রোগাক্রান্ত মানুষকে ঘৃণা করতে নেই। জান, এই কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইতে সবচেয়ে বড় অন্তরায় আমাদের মন! আমাদের মনে আছে এর প্রতি ভয়, রোগীকে এড়িয়ে চলার ভাবনা। এগুলি আমাদের সবার কাটিয়ে ওঠা দরকার।
ছবিঃ শিল্পী ঘোষ