এক রবিবারে পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে শুনলাম কে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পাশেই কলাগাছের ঝোপ। কিছু না ভেবেই ঢুকে পড়লাম। দেখলাম, একটা কলাগাছের উপর বসে আছে একটা মাছরাঙা, আর পাখিটাই এত কাঁদছে! আমায় দেখে উড়ে না গিয়ে সে এসে বসল আমার কাঁধে। তারপর আমারই ভাষায় পরিস্কার বলে উঠল, “আমার ল্যাপটপটা হারিয়ে গেছে গো! তুমি কি সেটা খুঁজে দিতে পারবে?” আমি তো অবাক। আমি বললাম, “কান্না থামাও। আমার সাথে আমার বাড়ি চল, দেখছি কী করা যায়।”
কলাগাছের ঝোপ থেকে বেরোতেই দেখা একটা লোকের সাথে। সে বলল, “কি বন্ধু, মুখে চিন্তা, কপালে ভাঁজ, ব্যাপারটা কী?” এই বলতে বলতে সে তার টুপি খুলে তাতে হাত ঢুকিয়ে এক গ্লাস জল বার করে বলল, “এক গ্লাস জল খাবে নাকি?” আমাদের আর বুঝতে বাকি রইল না, যে ইনি একজন জাদুকর। জল খেয়ে আমি তাকে ঘটনাটা বললাম সবিস্তারে। সে বলল, “তুমি বরং একবার কাজিরাঙা থেকে ঘুরে এসো। সেখানেই তোমার সমস্যার সমাধান হবে।” আমি বললাম, “কিন্তু কীভাবে?”
সে আমার হাতে একটা লাল আর একটা নীল মোম রঙ দিয়ে বলল, “যেখানে চাও যেতে/ নাম সেখানের ভেবে/ লাল মোমটা ঘষে বোলো/ কোথায় তুমি যাবে।”
আরও বলল, “আসতে ফিরে বাড়ি/ লাল মোমটার পর/ নীল মোমটা ঘষেই তুমি/ পৌঁছে যাবে ঘর।”
আমি ও মাছরাঙা তাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে একটা বাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালাম। পাখিটা অধৈর্য হয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি চল। আমার ল্যাপটপটার খুব প্রয়োজন।” লাল রঙের মোমটা ঘষে কাজিরাঙার কথা ভাবতেই দেখি আমরা দু’জন জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। একটি হরিণকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, এই ছোট্ট মাছরাঙাটির সাধের ল্যাপটপটা হারিয়ে গেছে। আমরা জানতে পেরেছি, এই কাজিরাঙার জঙ্গলেই নাকি সেটা আছে। তুমি কি কিছু বলতে পারবে?” সে বলল, “তার চেয়ে বরং তোমাদের আমি একজনের কাছে নিয়ে যাই, সে হয়ত কিছু জানলেও জানতে পারে।”
সে আমাকে তার পিঠে বসিয়ে নিয়ে ছুটে চলল একটা উপত্যকার দিকে। মাছরাঙাটা তখনও আমার কাঁধে। সে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “কখনও শুনেছ কেউ হরিণের পিঠে চেপেছে?” আমি বললাম, “মাছরাঙার ল্যাপটপ হয়, তাও তো আজ প্রথম শুনলাম। তার বেলা?” এই কথা শুনেই সে চুপ করে গেলো।
উপত্যকায় পৌঁছে দেখি একটা বিশাল হাতি বসে, আর তার কানগুলোও যেন অস্বাভাবিক রকমের বড়। আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, “তুমি কি ডাম্বো?” সে বলল, “তুমি কী করে জানলে?” আমি বললাম, “বা রে! তোমায় সবাই চেনে, আর তুমি নিজেই সেটা জান না?” সে বলল, “কী জানি, তাই হবে হয়ত! আসলে আমি তো এখানেই পাকাপাকিভাবে থাকি, তাই বাইরের খবর আর বিশেষ নেওয়া হয় না।” হরিণের মুখে আমাদের সমস্যা শুনে সে বলল, “আমি জানি কে এটা চুরি করেছে! এখান থেকে একটু দূরে একটা পাহাড় আছে, সেখানে একটা বিশাল সূর্যমুখী ফুল আছে, নাম হল ‘দুষ্টু সূর্যমুখী’। ওই ল্যাপটপ, খেলনা গাড়ি, মোবাইল, ইতাদ্যি চুরি করিয়ে নিয়ে আসে। এসব দিয়ে যে ও কী করবে, ওই জানে! ওর নামে অনেক অভিযোগ শুনেছি, কিন্তু এবারের ব্যাপারটা মোটেই হাল্কাভাবে নেওয়ার মতো নয়। চল তো দেখি!”
এই বলে সে আমাকে তার পিঠে চাপিয়ে ও হরিণকে লেজে বেঁধে শুরু করল উড়তে। মাছরাঙার তো চক্ষু চড়কগাছ! সে বলল, “আমায় ধরে বসো ভাই, বড় ভয় করছে।” পাহাড়ের কাছাকাছি আসতেই দেখা গেলো সেই বিরাট ফুলটাকে। ডাম্বো বলল, “তোমরা নেমে পড়, আমি দেখছি।” এই বলে আমাদের নামিয়ে সে উড়ে চলল ফুলটার দিকে। তাকে আসতে দেখে দুষ্টু ফুলটা বলে উঠল, “আমায় মেরো না। ছেড়ে দাও! আর এরকম করব না।” কিন্তু, কে শোনে কার কথা! ডাম্বো ফুলটাকে প্রচণ্ড জোরে তার শুঁড়ে জড়িয়ে শেষমেশ ফুলটাকে শিকরসুদ্ধ উপড়ে ফেলে দিয়ে নেমে এলো নীচে। আনন্দে মাছরাঙা কী করবে ভেবে পেল না। সে দৌড়ে গিয়ে তার ল্যাপটপটা গ্যাজেটের স্তূপের মধ্যে খুঁজতে লাগলো, তারপর সেটা পেতে তার কী আনন্দ! আমি হরিণ আর ডাম্বোকে বললাম, “এবার আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে, তোমরা এবার আমাদের যেতে দাও।” মাছরাঙা বলল, “আসলে আমি এই ল্যাপটপে আমাদের স্কুল-ম্যাগাজিন বানাচ্ছিলাম, কিন্তু নিজে কোন গল্প লিখতে পারিনি। আমি আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের কথাটাই লিখব না হয়! তাহলে এটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।” আমি মাটিতে নীল মোমের আঁচড় কাটতেই দেখি, আমরা পুকুর পারে দাঁড়িয়ে। মাছরাঙা আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, “যদি কখনও কোন প্রয়োজন হয়, আমায় ডেকো, আমি সাধ্যমতো তোমার সাহায্য করব।” এই বলে সে উড়ে চলে গেলো। আমাদের এই অবাঞ্ছিত কাজিরাঙা ভ্রমনের বৃত্তান্ত জানল শুধু হরিণ, ডাম্বো, মাছরাঙা, আমি ও তোমরা, যারা আমার গল্পটা পড়লে৷
গল্প লিখেছেঃ
প্রবাহনীল দাস
ষষ্ঠ শ্রেণি, একমে একাডেমী, কালনা, পূর্ব বর্ধমান
গ্রাফিকঃ মিতিল