যখন খুব ঝড়-বৃষ্টি হয়, আকাশের বুক চিড়ে ঝলসে ওঠে নীলচে বিদ্যুতের শিখা, তখন গুম গুম করে মেঘ ডেকে ওঠে। মেঘের আওয়াজ কান পেতে যদি শোন, শুনতে পাবে একজন গম্ভীর গলায় বলছে—'দ দ দ!' সে অনেক কালের কথা। একবার দেবতা, মানুষ আর অসুররা মিলে ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হলেন। হঠাৎ করে তারা সবাই ব্রহ্মার শরণাপন্নই বা হলেন কেন—তার একটা কারণ আছে। প্রাচীন ঋষিরা কল্পনা করেছেন, সমস্ত প্রাণীদের আদি সৃষ্টিকর্তা হলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। প্রজা মানে জীব বা পুত্র আর পতি মানে সৃষ্টিকর্তা বা পিতা। তাই কোনও সমস্যা দেখা দিলে বা আরও উন্নত হওয়ার উপায় জানতে হলে দেবতা, মানুষ ও অসুর সকলেই ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। এইরকমই একসময়ে দেবতারা প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে এলেন। দেবতারা অনেক শুভ কর্ম ও পুণ্যবলে দেবত্ব লাভ করেছেন। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, জরা, মরণ তাঁদের কষ্ট দেয় না। তাই তাঁরা পরমানন্দে থাকেন। এক অর্থে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকেই দেবতা বলা হয়। যেমন-চোখের কাজ দেখা। চোখ একটা যন্ত্র, এর মাধ্যমে আমরা সবকিছু দেখি। সব জীবেই তাই। সমস্ত জীবের মধ্যে চোখের মাধ্যমে দেখার কাজটা করাবার জন্য যে সূক্ষ্মশক্তি অর্থাৎ দর্শন-ক্ষমতা বা ইন্দ্রিয় থাকে, সেই ক্ষমতার বা ইন্দ্রিয়ের অধিপতি দেবতা হলেন ইন্দ্র। এইভাবে শ্রবণের, অর্থাৎ কানে শোনার, ঘ্রাণের, অর্থাৎ গন্ধ শোঁকার আলাদা সব দেবতা আছেন। দেবতাদের কাজই হল ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সুখ উপভোগ করা। এই সূক্ষ্ম সুখভোগে আসক্ত হয়ে পড়ার ফলে দেবতাদের বহু গুণ থাকলেও ইন্দ্রিয়সংযমের অভাবে শক্তিক্ষয় করে ফেলেন এবং প্রায়ই ক্ষমতা হারিয়ে তাঁদের দেবত্ব খোয়াতে হয়। তা ভারি লজ্জার। যদি ক্লাস টেনের ছেলেকে শাস্তি দিয়ে ক্লাস ফাইভে বসিয়ে দেওয়া হয়, এ যেন তেমনই লজ্জার। নিজেদের দুর্বলতা তাঁরা বোঝেন, কিন্তু এই অবস্থা থেকে নিজেদের উন্নত করার শক্তিও পাচ্ছেন না। অগত্যা ব্রহ্মার কাছে এলেন বিনীত ভাবে। বললেন, "পিতা, আপনি আমাদের উপদেশ করুন।"
ব্রহ্মা বললেন, "বাছা, তপস্যা ছাড়া তো উপদেশের ধারণা হবে না! সুতরাং তোমরা ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে তপস্যা কর, তবেই আমি তোমাদের উপদেশ দেব।" দেবতারা ব্রহ্মার আদেশ শিরোধার্য করে তপস্যায় ব্রতী হলেন।
মানুষ ব্রহ্মার বড় আদরের সৃষ্টি! প্রবল তার অনুসন্ধিৎসা! আকাশ পাতাল সেঁচে সে সদাই নিত্য নতুন আবিষ্কার করে চলেছে, অজানাকে দেখার আগ্রহে পাড়ি দিচ্ছে গ্রহে-উপগ্রহে, সাগরবক্ষে। অদেখাকে দেখার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহার-জঙ্গলের আনাচে কানাচে। কিন্তু এতকিছুর পরেও তার হৃদয় মরুভূমির মতো শুষ্ক, অতৃপ্তির তৃষ্ণা মরীচিকার মতো তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্লান্ত করে তুলছে। ধন, মান যা পায় কৃপণের মতো সে সঞ্চয় করে। জীবন ক্ষণিকের, পদ্মপাতায় জলের মতো টলটল করছে। জানে না, সঞ্চিত ধন কার ভোগে লাগবে। তবুও প্রাণভরে দিতে পারে না। দানে তার মন কুণ্ঠিত হয়। চাওয়া ও পাওয়া—এই তার প্রিয়, দেওয়া নয়। তবুও দিতে হয়। নিজে স্বেচ্ছায় না দিলে প্রকৃতি ছিনিয়ে নেয়। তাই তার মনে শান্তি নেই। তাই সে এসেছে শান্তি ও আনন্দের সন্ধানে পিতার কাছে, বিনীত প্রার্থনা জানিয়েছে, "পিতা, আমাদের উপদেশ করুন!" তাদেরও একই কথা বললেন প্রজাপতি। "তপস্যা কর, ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে তপস্যা না করলে উপদেশ ধারণ করার শক্তি লাভ করবে না তোমরা। অনেক বছর তপস্যা করার পর আবার ফিরে এস আমার কাছে। তখন উপদেশ দেব।" মানুষ ফিরে গেল, আরম্ভ করল কঠোর তপস্যা।
এরপর এল অসুরকুল। তারাও ব্রহ্মার সৃষ্ট সন্তান। তারাও অনেক উন্নতি করেছে। ভোগ ও ঐশ্বর্যের শিখরে পৌঁছে গেছে। কিন্তু সেই সমস্ত ঐশ্বর্য তারা সংগ্রহ করেছে অপরকে অত্যাচার করে। সীমাহীন তাদের লোভ, ক্রোধ ও দম্ভ। অন্তরের সেই কু-ভাবের তাড়নায় তারা একের পর এক নিষ্ঠুর কাজ করেছে, দয়াহীন নিষ্ঠুর প্রাণে অবলীলায় হত্যা করেছে নির্মমভাবে, বইয়ে দিয়েছে রক্তের স্রোত, আর অপরের দুঃখ ও অপমানের স্তূপের উপর বসেছে রাজমুকুট পরে। তাই তারা পায় না শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভালবাসা। কেবল ভয়মেশানো আনুগত্যের বোঝা বয়ে তারাও ক্লান্ত। তারাও চায় শান্তির সন্ধান। পিতার কাছে তাদের দাবী, "আমাদের কিছু উপদেশ দান করুন।" ব্রহ্মার একই উত্তর, "ব্রহ্মচর্য পালন কর, তপস্যা কর বৎস! তবেই না উপদেশে ফল হবে, উপদেশের বাণী গৃহীত হবে অন্তরে!" অনেক মন্দের মধ্যে তাদের একটি গুণ আছে, তাদের আছে আসুরিক ধৃতি। যেটা ধরবে, তার শেষ না দেখে ছাড়বে না—তাতে মাথা কাটা গেলে যাক্। অতএব, অসুররাও ঘোর তপস্যায় রত হল।
জগতে যতরকম মানুষের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা-আলাপ-পরিচয় হয়, তাদের সবাইকে মোটামুটি তিনটে দলে ভাগ করা যায়। এই তিনটে দলের নাম উত্তম, মধ্যম আর অধম। হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ গীতায়ও এমন কথা আছে। তিন গুণের কম-বেশী থাকা-না থাকা অনুসারে মানুষের স্বভাবও হয় তিন ধরনের। এই তিন গুণ হল সত্ব, রজ ও তমো গুণ। এই ত্রিগুণ অনুসারে মানুষের আহার, বিহার, যজ্ঞ, দান, শ্রদ্ধা, তপস্যাও তিন রকমের হয়। যাঁর মধ্যে সত্ব গুণের ভাগ বেশী থাকে, তিনি সাত্বিক প্রকৃতির মানুষ, এদের আমরা বলি দেব-মানব বা দেবতুল্য ব্যক্তি বা দেবতা। তাঁরা উত্তম। রজোগুণ যাদের বেশী থাকে, তারা রাজসিক প্রকৃতির, তাদের স্বভাব ভাল-মন্দ মিশিয়ে। তাঁদের মধ্যে অহংকার, অভিমান, লোভ, রাগ যেমন থাকে, আবার তাঁরা দান-ধ্যান পুণ্য কর্মও করেন—কিন্তু তাঁদের কর্ম নিঃস্বার্থ হয় না। ভালো কাজের বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আকাংক্ষা তাদের থাকে। এরাই সংখ্যায় বেশী, এঁরা হলেন মধ্যম, মানে সাধারণ মানুষ। আর যাদের মধ্যে তমোগুণ খুব বেশী থাকে, তারা তামসিক প্রকৃতির মানুষ, এরা হলেন অধম শ্রেণির, এদেরই পুরাণের গল্পে রাক্ষস বা অসুর বলা হয়েছে। এদের মধ্যে অজ্ঞান, মোহ, আলস্য এইসবের খুব বাড়াবাড়ি দেখা যায়। এরা বেশী বেশী খায়, বেশী বেশী খুমায়, এদের রাগ বেশী, মায়াদয়া কম। এদের দ্বারা কোন সৃজনশীল ও মহৎ কাজ হয় না, বরং মূঢ়তা ও আসুরী ভাব দ্বারা এরা শুভকর্ম পণ্ড করেন।
আমাদের দেশের পুরাণের গল্পগুলোতে আমরা দেবতা, মানুষ ও অসুরের রূপকে এই তিন গুণের মানুষের দেখা পাই। আকাশ আর সাগরের মাঝখানে যেমন পৃথিবী, তেমনই দেবতা ও অসুরের মাঝামাঝি হল মানুষ, তাই তার ভিতরে সদাই চলে ভালোদিক ও মন্দদিকের মধ্যে টানাটানি, অর্থাৎ, 'সু-ভাব' ও 'কু-ভাব'-এর দ্বন্দ্ব।
ব্রহ্মার আদেশে দেবতা, মানুষ, অসুর সকলেই তপস্যা করতে লাগলো অনেক অনেক বছর ধরে। পৃথিবীর বুকে পার হয়ে গেল অনেক অনেক শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত। ব্রহ্মচর্য ও তপস্যার ফলস্বরূপ দেব-মানব-অসুর সকলেরই মন তাদের নিজ নিজ আধার অনুসারে অন্তর্মুখ হল। বৃষ্টি যেমন রুক্ষ শুষ্ক মাটিকে নরম করে তাকে বীজ বোনার অনুকূল করে তোলে, তেমন ভাবেই তপস্যায় তাদের মন উপদেশ ধারণের উপযুক্ত হয়ে উঠল। এবার দেবতা, মানব ও অসুররা এলেন ব্রহ্মার উপদেশ প্রার্থী হয়ে—আরও বিনীত হয়ে, নম্র হয়ে। নিজেদের ভিতরের অপূর্ণতাগুলোকে পূর্ণতা দিতে চান, মন্দ থেকে ভালোয়, আলো থেকে আরও আলোর সন্ধান পেতে চান। যা ছিলেন, তাতে তৃপ্তি নেই—অল্পেতে সুখ নেই, আরও উন্নত হওয়ার লক্ষ্যে আব্রহ্মকীট নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে। 'নাল্পে সুখমস্তি, ভূমৈব সুখম্'। শ্রদ্ধাবনত হয়ে তাঁরা বললেন, "পিতা, আমরা দীর্ঘকাল ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে তপস্যা করেছি। এখন কি আমরা আপনার উপদেশ ধারণার উপযুক্ত হতে পেরেছি?" ব্রহ্মা চোখ তুলে তাকালেন তাঁর সৃষ্ট সন্তানদের দিকে, প্রসন্ন হলেন, বললেন, "হ্যাঁ, এখন তোমরা উপদেশ গ্রহণের যোগ্য হয়েছ! আমি তোমাদের উপদেশ দান করব, আমার উপদেশ পালন করে ধন্য কর নিজেদের জীবন।" তারপর বজ্রনির্ঘোষে ধ্বনিত হল একটি অক্ষর—"দ।" আকাশে-বাতাসে, গ্রহ-নক্ষত্রে ধ্বনিত হল সেই মেঘমন্দ্রিত স্বর—"দ—দ—দ!"
দেবতাদের দিকে চেয়ে ব্রহ্মা জিজ্ঞেস করলেন, "বুঝেছ?"
"বুঝেছি পিতা! আপনি বলেছেন, 'দম্যত!' অর্থাৎ দমন কর, ইন্দ্রিয় দমন না করলে চরম শান্তি ও সিদ্ধিলাভ হয় না, তাই তো প্রভু?"
ব্রহ্মা স্মিত হেসে বললেন, "ঠিকই বুঝেছ!"
এবার তিনি মানুষকে জিজ্ঞেস করলেন, "আমার উপদেশ বুঝেছ তো বৎস?"
মানুষও করজোড়ে বলল, "বুঝেছি প্রভু! আপনি বললেন, 'দত্ত।' অর্থাৎ দান কর, এইই শান্তির উপায়, তাই তো?"
ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হলেন, "একেবারে সঠিক বুঝেছ!"
এবার অসুরদের পালা। তাদের কাছেও ব্রহ্মা জানতে চাইলেন, "বুঝেছ আমার উপদেশ?"
অসুররা আনন্দিত হয়ে বলল, "প্রভু, আপনি বললেন, 'দয়ধ্বম্', অর্থাৎ দয়া কর।"
ব্রহ্মা খুশী হয়ে বললেন, "সার্থক হয়েছে তোমাদের তপস্যা!"
ব্রহ্মার এই উপদেশ নদীর স্রোতে, সাগর কল্লোলে, অরণ্যের স্তব্ধতায়, পর্বতের মৌন-মহানতায়, বাতাসের গতিতে সদাই ধ্বনিত হচ্ছে—দ, দ, দ। হে অমৃতের সন্তানগণ! তোমরা ইন্দ্রিয় দমন কর, সংযমের থেকে পবিত্র আর কিছুই নেই। অসংযম ধ্বংসের কারণ। তোমরা দান কর, প্রকৃতির অকৃপণ দানে পৃথিবী বাসযোগ্য হয়। দান মানুষকে মহৎ করে, উন্নত করে। ভিখারির সুখ কোথায়? স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, "দাও দাও আর ফিরে নাহি চাও, যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যায়!" আমাদের কোনও অভাব নেই, থাকতে পারেও না। অনন্ত আমাদের অন্তরে। হে মানব, তোমরা দয়া অবলম্বন কর। দয়া পরম ধর্ম। যার দয়া নেই, সে পশু। দয়া অবলম্বন করে পশুপ্রবৃত্তিকে জয় করে মানুষ হও, দানের মাধ্যমে মানুষ থেকে দেবতা হয়ে ওঠ, আর ইন্দ্রিয়সংযম দ্বারা দেবতাদেরও ছাড়িয়ে যাও। এই 'দ' হল সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ উপদেশ। তাই মেঘের ডাক মন দিয়ে শুনলে আজও শোনা যায়, ব্রহ্মা আমাদের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন—'দ দ দ!'
(তথ্যসূত্র— বৃহদারণ্যক উপনিষদ-এর পঞ্চম অধ্যায়, দ্বিতীয় ব্রাহ্মণ অবলম্বনে রচিত)
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি