অভিরূপ লক্ষ্য করল টিকটিকিটা খুব ধীরে একেবারে গুটি গুটি পায়ে জানলার ফ্রেমের উপর দিয়ে হাঁটছে। নিশ্চয় কোথাও পোকা দেখতে পেয়েছে। ওর পেন্সিল থেমে গেল। একটু পরেই মিস আসবে পড়াতে। তার আগে ও ড্রয়িং খাতাটা নিয়ে বসেছে একটু ছবি আঁকবে বলে। মানু মাসি এসে চাউমিন-এর প্লেট রেখে গেল টেবিলে, বলল, "খেয়ে নাও বাবু, এক্ষুণি তোমার মিস এসে পড়বে।" অভির এখন চোখের পাতা ফেলবারও সময় নেই। ও রুদ্ধশ্বাসে লক্ষ্য করছে শিকারী টিকটিকিটার পরবর্তী গতিবিধি। ঠিক যা ভেবেছে তাই। জানলা আর দেওয়ালের সংযোগে বসে আছে একটা কমলা রঙের মথ। অভি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে। এক-দুই-তিন...ব্যাস! টিকটিকিটা কপ করে চেপে ধরেছে মথটাকে। ঈশ! অভি আর দেখতে পারে না। মথটার ডানা ঝটপট করছে, টিকটিকিটা কিন্তু একটুও ছাড়ছে না, চেপে ধরেই আছে, ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছে মথটা। একটু একটু করে ওটা টিকিটিকিটার মুখের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। আনমনে অভি চামচ দিয়ে চাউমিন নাড়াচাড়া করছিল। এখন আর খেতে ইচ্ছা করছে না। শয়তান টিকিটিকিটা মথটাকে মুখে ঢুকিয়ে তরতর করে আবার জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল, বোধহয় বাগানে চলে গেল। ওকে দেখতে অভি টেবিল ছেড়ে জানলার কাছে গেল। জানলার গ্রিল দিয়ে যতটা পারে মাথা বাড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করছিল, এমন সময়ে পিঠে টোকা—"এসে গেছি অভি।" রিয়া মিস এসেছে। অভি এসে চেয়ারে বসে।
"কী দেখছিলে অভি বাবু?"
"টিকটিকি। মথ শিকার করল। মিস, ওরা মথগুলোকে খেয়ে নেয় কেন? আমার একদম ভাল লাগে না।"
রিয়া হাসল। রিয়ার এবছর এম এস সি ফার্স্ট ইয়ার। করোনাকালীন লকডাউনের জন্য তার নিজেরও কলেজ যাওয়া বন্ধ। সহেলি আন্টির অনুরোধে সে অভিকে একটু আধটু পড়াবে কথা দিয়েছে। ছেলেটা ভারি শান্ত। রিয়া যা পড়া দিয়ে যায়, করেও রাখে। কিন্তু বড্ড ভীতু ছেলেটা। সবেতেই ওর ভয়। আরশোলা, টিকটিকি, মশা-মাছি, বোলতা, ইঁদুর সবের ভয়ে মরে। এমন সময় খ্রিচ খ্রিচ করে তীব্র একটা শব্দ ওঠে আর অভি টেবিলের উপর মাথা মুখ গুঁজে দেয়। রিয়া জিজ্ঞেস করে, "কী হল রে?"
"ওই ওই, দুটোয় লড়াই করছে মিস, দেখো, স্বামীজীর ফটোর পিছনে। যদি ফাইট করতে করতে আমার গায়ে পড়ে?"
"আরে দূর! এত্ত ভয় করলে চলে? তুই অভি না? অভি মানে সাহস, জানিস? ওরা বুঝি খাবে না? এই যে তুই চাউমিন খেলি, ওদের খিদে পায় না বুঝি? মথ, আরশোলা, ঝিঁঝিঁ পোকা এইসব তো ওদের খাবার। ওরা যদি পোকা না খেয়ে ফেলত, আমাদের ঘরদোর সব পোকায় গিজগিজ করত। সন্ধ্যাবেলা লাইটের সামনে কত্ত পোকা আসে, দেখতে পাস তো? ওরা অনেক পোকা খেয়ে নেয় বলে একটা ব্যালেন্স থাকে, বুঝলি? ওঠ, মুখ তোল, বই বার কর।"
অভিকে একটা অঙ্ক কষতে দিয়ে রিয়া ওর মোবাইল নিয়ে খুটখাট করে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সহেলি এসে ঘরে ধূপ রেখে যান। জিজ্ঞেস করেন, "কী রে তোর ছাত্র কী বলছে?"
রিয়া হাসে, "সব ঠিক আছে আন্টি, অভি ইজ ডুইং ওয়েল। কিন্তু পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে বলো তো?"
সহেলি ঠোঁট উলটান, "সেই তো! দেখ না, আমাদের স্কুলের বাচ্চাগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারল না, কত প্রিপারেশন নিয়েছিল, সব বেকার...ছাত্রছাত্রীদের মন ভেঙে যাচ্ছে। অনলাইন ক্লাস নিতে আমারও আর ভাল্লাগে না, জানিস?"
"আজ খুব মেঘ করেছে, বৃষ্টি হবে, কি বলো আন্টি?"
"কী জানি! কদিন এমন ভ্যাপসা গরম, অথচ বৃষ্টির নাম নেই।"
এমন সময় বাগান থেকে কটকট করে একটা ব্যাং ডেকে ওঠে। অভি পেন্সিল ফেলে কান খাড়া করে থাকে, "মা, ওটা কী ডাকল?"
রিয়া বলে, "ও তো ব্যাং ডাকছে। বৃষ্টি হবে ঠিক, দেখিস। ওরা বুঝতে পারে।"
অভির বুক ঢিপঢিপ করে, কী বিচ্ছিরি ডাক রে বাবা! এমন সময় রিয়ার মোবাইলে শব্দ হয় পিক পিক। অভির চমক ভাঙে, দেখে মিস হাসছে ফিক ফিক। অভির চোখে প্রশ্ন, রিয়া যেন কৈফিয়ত দেয়, "জিষ্ণুদা মেসেজ করেছে। আমাজন প্রাইমে মুভি দেখতে যেতে বলছে ওদের বাড়িতে। আমাদের আরও বন্ধুরা আসবে, সব একসঙ্গে মুভি দেখা হবে।"
"তুমি আইনক্স যাবে মিস?"
"ধুর, নারে, এখন আইনক্স তো বন্ধ। আমরা ঘরেই ল্যাপটপে সিনেমা দেখি। তুই আইনক্সে গিয়েছিস?"
"হ্যাঁ, আমি-মা-বাবা গতবছর পুজোর সময় গেছিলাম। প্রোফেসর শঙ্কু দেখেছিলাম।"
কথা বলতে বলতে অভির চোখ স্থির হয়ে যায়। ফিসফিস করে বলে, "ওই দেখো মিস, কত্ত বড় একটা মাকড়সা!"
রিয়াও চমকে ওঠে, "কই কোথায়? মাকড়শা আমারও বড্ড বাজে লাগে!"
"ওই যে, আলমারির পিছন থেকে উঁকি মারছে!" বিস্ফারিত চোখে বলে অভি।
"যাক গে, বাদ দে, ওদের না ঘাঁটালে ওরা কিচ্ছু বলবে না। ওরা আমাদের সঙ্গে একসাথেই থাকে, বুঝলি তো? এই তোর আরশোলা, টিকটিকি, পিঁপড়ে, মাকড়শা, আরও কত পোকামাকড়, হয়তো ইঁদুর টিঁদুরও তোর সঙ্গে সঙ্গেই আছে সর্বদা, তুই কী খাচ্ছিস, কী করছিস সব দেখছে, হয়তো নিজেদের মধ্যে তোকে নিয়ে বলাবলিও করছে। তুই বুঝতে পারছিস না। ওসব নিয়ে ভয় পাস না। আমি আজ আসি রে। অঙ্কগুলো করে রাখিস।"
অভি আজ খুব অন্যমনস্ক। রাত্রেও খাবার টেবিলে বসে আনমনা হয়ে থাকে, মিস-এর কথাগুলোই মনে পড়ছে কেবল, এই ঘরের মধ্যে মা-বাবা-অভি আর মানু মাসি ছাড়াও কতগুলো প্রাণী রয়েছে! বাবার পাতে তড়কা-রুটি দিতে দিতে মা বলেন, "জানো, ঘরে আবার ইঁদুর ঢুকেছে। আমি কাল রাতে শব্দ পেয়েছি। গত বছর এসির ইন্সুলেটর ফোম সব কেটে দিল মনে আছে তো? এবার আবার কী সব্বোনাশ করবে কে জানে? ঘরে এত বই, জামাকাপড়, ইলেকট্রিক গ্যাজেটস! কী করি বলো তো? সেই ইঁদুরের বিস্কিট দেব আবার?"
বাবা একটু গম্ভীর হয়ে যান। বলে, "বর্ষায় ওদের গর্ত জলে ডুবে যায়, কী করবে বেচারারা? ওরাও তো খেয়ে পড়ে বাঁচতে চায়? বিষ দিয়ে একটা প্রাণীকে মেরে ফেলা, সে কেমন লাগে! সেটা ঠিক নয়!" সহেলি বলেন, "আমারও কি সাধ করে ইঁদুর মারা বিষ কিনতে ভাল লাগে? উপায় নেই বলেই তো..." মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই অভি মাকে জড়িয়ে ধরে, "মা আমার বিছানায় যদি ইঁদুর ঢুকে পড়ে?" বাবা অভির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, "ভয় পেও না বাবা, তুমি যেমন ভয় পাও, তার থেকে ওরা তোমায় বেশী ভয় পায়। ওরা ঘরের কোণে লুকিয়ে চুরিয়ে ঢোকে, আবার বেরিয়ে যায়, তোমার বিছানায় যাবে না!"
তবুও অভি নিশ্চিন্ত হতে পারে না। ভাবে রাত্রে যদি বাথরুম যেতে হয়, যদি অন্ধকারে ইঁদুরের গায়ে পা লেগে যায় আর ইঁদুরটা কামড়ে দেয়? ওকে ভয়ে বিড়বিড় করতে দেখে বাবা বলেন, "আচ্ছা, আজ আমাদের সঙ্গে ঘুমাবি আয়।" অভি নিজের বিছানা থেকে বালিশ হাতে নিয়ে বাবার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। বাবার মুখে ‘বর্ণ ফ্রি’ -র গল্প শুনতে শুনতে অভি ঘুমিয়ে পড়ে।
দুপুরবেলা অভি বাড়ির পিছনের ফল-সবজির ছোট্ট বাগানে পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দেখছিল গাছে কোন পাকা পেয়ারা আছে কি না। অনেক পেয়ারা কুশি কুশি অবস্থায় ঝরে পড়ে যায়। যেগুলো গাছে থেকে পাকে, খুব ভাল লাগে খেতে। কিন্তু পাকা পেয়ারা কাঠবিড়ালিগুলো বোধহয় খুব ভালবাসে। অভি নিজেই কতবার দেখেছে কাঠবিড়ালিকে পেয়ারা খেতে। কিন্তু অভিকে দেখলেই ও একছুটে উঁচু ডালে উঠে যায় তড়বড়িয়ে আর দূর থেকে অভিকে লক্ষ্য করে যে ও ঢিল ফিল মারবে কি না। অভি ঢিল মারবে কি? ও নিজেই ভয়ে মরে, সেটা বুঝি ওরা বুঝতে পারে না। আজকে ও উপরের ডালে দেখছিল, এমন সময় একটা কাঠবিড়ালি এসে ওর জামা ধরে দিল এক টান। অভি টাল সামলাতে না পেরে একেবারে গড়াতে গড়াতে পড়ে গেল একটা বিরাট গভীর গর্তে। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে গেল। ভীষণ আতঙ্কে ও কাঠের পুতুলের মত হয়ে সিঁটিয়ে রইল। সড়সড় করে হড়কে গর্তের মধ্যে যেখানে ও নামল, সেখানে বেশ ঝলমল করছে আলো। অভি একদম অবাক হয়ে গেল। কী সুন্দর এই জায়গাটা। ওদের বাগানে যে এমন সুন্দর একটা জায়গা আছে তা তো জানা ছিল না! ছোট ছোট ফলের গাছে আঙুরের মত থোকা থোকা লাল-নীল ফল ধরে আছে। চারিদিকে ফুলের পাহাড়। পেয়ারা গাছের কাঠবিড়ালিটা এখানেই থাকে। ও এখনও অভির জামার কোণা ধরে রেখেছে। অভি ওর দিকে তাকাতেই ও হাত বাড়িয়ে দিল, "হাই, আমি সিমরান। মুঝসে দোস্তি করোগে?" যাব্বাবা! অভি তো একদম অবাক! বলল, "সিমরান, এটা তোমাদের পাড়া? খুব সুন্দর তো!" সিমরান লাজুক হেসে বলল, "হ্যাঁ, চলো আমাদের রানীর কাছে নিয়ে যাই তোমাকে।" সিমরানের হাত ধরে অভি চলল রানীর কাছে। পথে যেতে যেতে দেখা হল আরও দুজন কাঠবিড়ালির সঙ্গে। সিমরান পরিচয় করিয়ে দিল, ওরা রুমঝুম আর সোনামণি। রুমঝুমের ঘন বুরুশের মত সোনালী লেজখানি ভারি সুন্দর। অভি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। তাই দেখে রুমঝুম গর্বের সঙ্গে বলল, "আমার লেজে নজর দিওনি বাপু!" অভি হকচকিয়ে যায়। রুমঝুম মুখ নাড়া দিয়ে বলে, "লেজের কাজ কি কম? বৃষ্টি-বাদলা, ঝড়-বাতাস, শীতের কামড় সব ঠেকাই এই লেজ দিয়ে। অসহ্য গরম পড়লে লেজ দিয়ে বেশি করে রক্ত পাম্প করে শরীরটা ঠাণ্ডা রাখি। গাছের এডাল থেকে ওডালে লাফ দিয়ে যাওয়ার সময় ব্যালেন্স রাখি এই লেজখানা দিয়েই। যখন দূরে লাফ দিই, এই লেজ আমাদের প্যারাশুট হয়ে যায়, বুঝলে? লেজ দিয়ে আমরা সঙ্কেতও পাঠাই বন্ধুদের, বিপদ থেকে সতর্ক করবার জন্যে। লেজের কদর তোমরা কী বুঝবে খোকা?" এতসব তো অভি জানত না। ও মাথা নিচু করে ভাবতে থাকে। সিমরান ওর হাত ধরে টান দেয়, "অভি, রুমঝুমের কথায় কিছু মনে কর না। ও বড্ড মেজাজী। তবে কথাগুলো ঠিকই বলেছে। তোমায় আমাদের ঘরে নিয়ে যাই, চলো, আমার দিদির ছানা হয়েছে, দেখবে?" অভির সিমরানকে খুব ভাল লাগছে। ভারি মিষ্টি তার কথাগুলো। সিমরানের সঙ্গে অভি ওদের পাতা দিয়ে ঘেরা ছোট্ট ঘরে আসে। সেখানে গাছের কচি ডাল আর পাতা দিয়ে বিছানা পেতে শোয়ানো বিচ্ছিরি দেখতে ছাল ছাড়ানো গোলাপি রঙের চারটে খুদে প্রাণি। অভি অবাক হয়ে বলে, "এগুলো কী?"
সিমরান আদুরে গলায় বলে, "দিদির ছেলেমেয়েরা! কী সুন্দর হয়েছে ছানাগুলো। ঠিক আমার দিদির মত সুন্দর। জন্মের সময় আমাদের গায়ে লোম হয় না যে। সেইজন্য লোমহীন এমন গোলাপি চামড়া ঢাকা ওদের গা, ওদের দাঁতও নেই, ওরা চোখেও দেখতে পায় না। এখন শুধু মায়ের বুকের দুধ খায়। ঠিক তোমাদের মতই। তবে তোমাদের থেকে আমরা অনেক তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাই। তখন গাছের ফল টল খাই। অবিশ্যি এখন আর তেমন গাছই বা কই, ফলও যেটুকু থাকে, তোমরাই সব নিয়ে নাও। আমরা কী খাব বলো তো? আমাদের বংশের লোকজন কত কমে গেছে, জানো?" অভির খুব দুঃখ লাগে। ও সিমরানের হাত ধরে বলে, এবার থেকে রোজ সকালে আমার পড়ার টেবিলের সামনের জানলায় তোমার জন্য বাদাম আর ফলের টুকরো রেখে দেব আমার ভাগের থেকে, কেমন? নিয়ে যেও। আমাকে এবার বাড়ি যেতে হবে। মা নয়তো চিন্তা করবেন। চলো, আমায় এগিয়ে দেবে।" সিমরান ঘন ঘন মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে, "সে কক্ষনো হবে না! আমাদের রানীর সঙ্গে দেখা না করে তুমি যেতেই পারবে না। রানী-মা শুনলে ভারি রাগ করবেন। অতিথিকে যদি যত্নআত্তি না করে ফেরৎ পাঠাই, বকুনি শুনতে হবে আমাকে!" অভিকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সিমরান ওর হাত ধরে হিড় হিড় করে টান দিয়ে ছুট লাগায়। যেতে যেতে বাগানের মধ্যে থেকে বিশ্রী কটকট করে একটা শব্দ ওঠে। অভি চিনতে পারে, এটা ব্যাঙের ডাক। ওর খুব ভয় লাগে। ও সিমরানের হাতটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে। সিমরান মিষ্টি হেসে বলে, "গিরিজা-দাদার ডাক শুনে ভয় পেও না। ও ডাকছে ওর বৌকে, ওদের গুষ্টির মেয়েরা ডাকতে পারে না। বৌদি ঐ জলার ধারে আছে, গিরিজা দাদার ডাক শুনে হাজির হবে। ঐ দেখ, গিরিজা-দাদার ডাক থেমে গেছে, তোমার ছায়া দেখেছে দূর থেকে, তাই ভয় পেয়েছে। দূরের জিনিস ভাল দেখতে পায় কিনা? দেখো, জলের মধ্যে শরীরটা ডুবিয়ে দিয়ে বসে আছে, শুধু চোখ দুটো বেরিয়ে আছে আর প্যাটপ্যাট করে আমাদেরই দেখছে। একটা মজা দেখবে? গিরিজা দাদা কিন্তু খুব কাছের জিনিস দেখতে পায় না। চলো আমরা পা টিপে টিপে ওর এক্কেবারে ঘাড়ের কাছে গিয়ে পিছন থেকে ‘ধাপ্পা’ বলে ভয় দেখাই!" সিমরানের চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক। অভি গিরিজা-দাদার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতেই দেখতে পেল মুখ থেকে কাঠির মত জিভটা পুচুক করে বেরিয়ে এল এবং একটা ফড়িং সমেত আবার মুখের ভিতরে ঢুকে গেল। অভি টিকটিকিকে শিকার ধরতে দেখেছে, কিন্তু কোনদিন ব্যাঙের শিকার ধরা দেখেনি। আজ দেখে অবাক হয়ে গেল।
সিমরানের হাত ধরে অভি একটা পরিষ্কার মত জায়গায় এসেছে। ও অবাক হয়ে দেখল, একটা ফিনফিনে পাতলা আর নরম ঘাগরা পরে সিংহাসনের মত উঁচু একটা ঢিপির উপর বসে আছে বিরাট বড় একটা মাকড়সা। ওর মুখটা অনেকটা রিয়া মিসের মত। কেউ কোন কথা বলছে না। সবাই হাতে জিনিসপত্র নিয়ে যাতায়াত করছে। কেউ পাতা নিয়ে যাচ্ছে, কেউ পোকা নিয়ে যাচ্ছে, কেউ বা ফড়িং ধরে চলেছে। সিমরান সামনে গিয়ে লেজটা পিঠের উপর রেখে বলে, "রানী-মা, আমার বন্ধু অভি এসেছে।" রানী তার আটখানা পায়ের সামনের দুটো পা জোড়া দিয়ে তুড়ি বাজাতেই সামনে এসে গেল একটা ইয়া বড় টিকটিকি। অভি ভয়ে শিউড়ে উঠল। রানীমা বলল, "গিরিধারী, এই খোকার খাতিরদারি কর!" "যে আজ্ঞে রানী-মা," এই বলে গিরিধারী নামক সেই বড় টিকটিকি অভিকে ডাকল। সিমরান বলল, "কোন ভয় নেই, যাও গিরিধারী-কাকার সঙ্গে, আমি আছি বাইরে। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব।" গিরিধারী অভিকে নিয়ে একটা সরু খোপে ঢুকল। ওকে বসিয়ে বলল, "খোকা, তুমি আমাদের অতিথি। আরাম করে বসো।" তারপর গলা তুলে ডাকল, "এই বংশীধারী, মানুষ দাদা এসেছে, দাদাকে ভিতরে নিয়ে যা।" একটা রোগা লিকলিকে ছোট টিকটিকি এসে অভিকে ডাকল। অভি দেখল, ওর নাকে একটা ছোট্ট পাতার মাস্ক রয়েছে। ও সাহস করে জিজ্ঞেস করল, "তোমরাও মাস্ক পড়ো বংশীধারী?" বংশীধারী উত্তর দেবে কি? তার আগেই দুটো হাঁচি দিল আর ওর নাকে আটকানো শুষনি পাতার মাস্ক ভিজে উঠল। একজন হেঁড়ে গলায় বলল, "আর মাস্ক! সর্দিকাশিতেই তো ছেলেটা জেরবার হয়ে গেল!" "তোমাদেরও সর্দি করে?" অভির বিস্মিত প্রশ্ন শুনে সেই হেঁড়ে গলার টিকটিকি বলে উঠল, "সর্দি কাশি নিউমোনিয়া সবই হয়রে বাবা! টিকটিকি বলে কি অসুখ করতে নেই? আমাদের ঘর থেকে তাড়ানোর জন্য তোমরা কত কাণ্ডই না কর! চাদ্দিকে ন্যাপথালিন দিয়ে রাখো। ঐ বিকট গন্ধ আমরা মোটে সহ্য করতে পারি না। তোমার বন্ধু গোগোলদের বাড়িতে ভাঙা ডিমের খোসা রাখে, পিঁয়াজ-রসুনের কোয়ার মালা গেঁথে কাপবোর্ডের পিছনে রেখে দেয়, ওর মা কোথায় পড়েছে যে এগুলোর গন্ধ আমরা সহ্য করতে পারি না! আশ্চর্য বটে! আমাদের বাড়ি থেকে তাড়ালে পোকামাকড়ের জ্বালায় ঘরে বাস করতে পারবে তোমরা? সেদিন বুবুলদের বাড়িতে একটা বোতলে জলের মধ্যে গোলমরিচ আর লঙ্কাগুঁড়ি মিশিয়ে আমার মেয়েটার গায়ে স্প্রে করে দিয়েছে। বেচারি আর পোকা খেতে বাইরে যেতে চাইছে না! বলে, মা তুমি যাও! শোন কথা! আমার বয়স হয়েছে। হাড়গোড় ব্যথা, দেওয়াল বেয়ে যাতায়াত করতে আর আগের মত জোর পাই নে! শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হয়েছে।" বংশীধারী একটা চকচকে কদম পাতায় করে জেলির মত খানিকটা মধু নিয়ে এসেছে, বলে, "অভি-দাদা, খাও।" এখন আর অভির ভয় করছে না। বংশীধারী শোঁশোঁ শব্দ করে শ্বাস নিতে নিতে বললে, "আমার ঠাকুমার রান্না খেয়ে দেখ!" ঠাকুমা-টিকটিকি বংশীধারীকে বলে, "হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়িও না আর দাদুভাই, এরপর নিউমোনিয়া হলে প্রাণে বাঁচবে না!" বংশীধারী লক্ষ্মী ছেলের মত ঝিরিঝিরি সজনে পাতার চাদর গায়ে দিয়ে ঠাকুমার পাশে শুয়ে পড়ে।
বাইরে বেরিয়ে অভি দেখে সিমরান ছুটোছুটি করে খেলছে। অভিকে দেখেই বলে, "চলো, বাড়ি যাবে তো?" বাড়িতে ঢোকার আগে অভি বলে, "কাল সকালে দেখা হচ্ছে তাহলে? বাদাম খেতে এসো কিন্তু!" সিমরান হেসে বলে, "তোমার বন্ধুদের আমাদের হয়ে একটু বলো ভাই। আমাদের বড় কষ্ট। খাবারদাবার পাই না ঠিকঠাক। তারপর ছেলেপিলেরা ঢ্যালা মারে। ডোবা খানা পুকুর সব বুজিয়ে ফেলছ তোমরা, গিরিজা দাদাদের তো থাকবার জায়গা নেই। গিরিধারী কাকাদের বংশও ধীরে ধীরে কমে আসছে। ওরা তোমাদের ঘরে খাবার খুঁজতেই যায়, এই সন্ধ্যাবেলা আলোর সামনে যেসমস্ত পোকামাকড় আসে, সেসবই খায় ওরা। কিন্তু রোজ খায় না। একদিন পেট ভরে খেলে একদিন খাওয়া বন্ধ। আমরা তবু বছর দশেক বাঁচি, ওদের আয়ু তো মোটে পাঁচ বছরের মত। তারপর বয়স হয়ে গেলে দেওয়াল চড়তেও পারে না। হাত-পা বেঁকে যায়। ওদের ভারি কষ্ট। বিদেশে আমাদের জন্য বড় খাঁচা করে দেয়, বংশীধারীদের জন্য লম্বা ড্রামের মত খাঁচা বানিয়ে দেয়, খাবার দাবার সব দেয়। খাঁচায় বন্দী দশায় শত্তুরের ভয় নেই, আর ওষুধপত্রও জলে গুলে দেয়, তাই আয়ু বেড়ে যায়। সব তো দেখলে নিজে চোখে। আমাদের খাওয়াদাওয়ার সমস্যা, থাকার জায়গার সমস্যা। দেখো না তোমরা বন্ধুরা মিলে আমাদের অবস্থা যদি একটু ফেরাতে পারো!" সিমরানের চোখে মিনতি ফুটে ওঠে। অভি বলে, "আমরা এখন ফ্রেন্ডস! কথা দিচ্ছি, তোমাদের সুখসুবিধার কথা ভাবব!"
ঢং ঢং করে ঘড়ির ঘণ্টায় অভির ঘুম ভেঙে যায়। মা জানলার পর্দা সরিয়ে দিয়েছেন। পেয়ারা পাতার ফাঁক দিয়ে আসা সুন্দর রোদ্দুরে সমস্ত ঘর ভরে গেছে। পেয়ারা গাছের কোটর থেকে সিমরান উঁকি দিয়ে বলে, "অভি টুকি!" অভি বিছানায় উঠে বসে। দেওয়ালে গিরিধারী কাকাকে দেখেই চিনতে পারে। অভিকে দেখে সামনের পা-টা নাড়ায়। অভির মনে হয়, নিশ্চয় ‘গুডমর্নিং’ বলল। ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে অভি ডাইনিং টেবিলে বসে জলখাবার খেতে। খাওয়া হয়ে গেলে একটা ছোট প্লেটে করে অল্প বাদাম আর গাজরের টুকরো নিয়ে পড়ার টেবিলের জানলার সামনে রাখে। একটা ছোট কাপে করে জল রাখে বইয়ের আলমারির পিছনে। বন্ধুকে দেওয়া প্রমিস তো রাখতেই হবে! সহেলি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, ছেলেটার হল কী? অভি বীরপুরুষের মত মা-কে বলে, "আমি বড় হয়ে গেছি মা, আর ভয় পাই না!" মনে মনে ভাবে, "আজকেই গোগোল আর বুবুলকে বলতে হবে ঘরে-বাইরের বন্ধুদের কথা।"
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি