এখন ছোটদের জন্য যে ছবি হয়, তাতে অন্ততঃ বিদেশে , আর বিস্ময়ের অজানা রাজপুরীর খোঁজ করা হয়না।কেননা ইন্টারনেট এসে, কম্পিউটার এর নানা সফ্ট্ওয়ারের প্রয়োগে পৃথিবী অনেক ছোট হয়ে গেছে। এখন ছোটরাও জানে, ভূগোলের আনাচে কানাচে কি আছে, অথবাইতিহাসের আশ্চর্য রহস্য কোথায় কোথায়। কিন্তু ছোটদের কৌতূহল যেহেতু অপরিমিত, সুতরাং কৃত্রিম রোমাঞ্চ বা উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মাধ্যমে, স্পেশ্যাল এফেক্টস এর সূত্রে অথবা অ্যানিমেশন চিত্রের মাধ্যমে। এই স্পেশ্যাল এফেক্টস যে কিভাবে গল্প বলার কায়দাটাকেই পালটে দিল, তা 'স্টার ওয়ার্স'- এর পর থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক দিন থেকে দেখলে এই প্রবণতা পুরোনো যুগের ছবির মতই বিস্ময়ের নির্মাণ করে - যেমন টাইটানিক ছবিতে জাহাজ ডুবে যাওয়া, বা ট্যুইস্টার ছবিতে ঝড়। জুরাসিক পার্ক জাতীয় ছবিতে যে গল্প বলা হয়েছে, তাতে গল্পের থেকে কিন্তু কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সাহায্যে তৈরি ডাইনোসরদের দেখতে আমাদের বেশি ভাল লেগেছে। আজকের ছোটরা এমনকি জীবজন্তুর গল্পও, যেমন 'লায়ন কিং' বা 'জাংগল বুক', চলচ্চিত্রের দৃশ্যের সাহায্যে দেখার চাইতে অনেক বেশি মজা পায় অ্যানিমেশনের কারসাজিতে। দশক দুয়েক আগে, রবিবার যখন ভারতীয় দূরদর্শন মোগলির নানা আজব কান্ড দেখাত, বাড়িতে ছোটরা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বড়দের চুপ করিয়ে রাখত, নয়ত নিজেরাই খুশিতে হইচই করে মনে করাত - আজ রোববার, আজ পড়া নেই।
বিদেশের অনুকরণে এখন ভারতেও টু-ডি বা থ্রি-ডি অ্যানিমেশনে 'হনুমান' বা 'ছোটা ভীম' - রামায়ণ মহাভারতের এইরকম কিছু আখ্যান পরিবেশন হচ্ছে এবং তাও ক্রমশঃ জনপ্রিয় হচ্ছে।
ছোটরা আসলে নিজেদের স্বপ্নের উড়ান পরিবারের ছোট গন্ডির মধ্যে ছোট ফ্ল্যাটে না পেয়ে পৌরাণিক রূপকথার মিনিয়েচারকে আরো বিস্তৃতি ও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চায়। তাতে অবশ্য সমস্যা মিটবে না। আসলে ছোটদের কোথায় রাখা হবে, পরিবার ও সমাজের কোন এলাকায়, সেটাই বড়রা এখনো ঠিক করে উঠতে পারল না।
ভারতীয় সমাজ আধুনিক হয়েছে। শিশুরা এখন জীবনের আলাদা অংশ, তাদের আশা-আকাঙ্খা যে আলাদা রকমের সেটুকু আমরা বুঝি, কিন্তু ফেলে আসা সামন্ত তান্ত্রিক যৌথ পরিবারের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এসে তাকে মানুষ রূপে স্বতন্ত্র ভাবার সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে নেই। এমন ছবি বিদেশে অনেক আছে, যেখানে বাচ্চারা উড়ান ও ইতিহাসের বাইরে তাদের রোজকার পৃথিবীতেই স্বচ্ছন্দ।
বাংলার শিশুরা আগে 'বুড়ো-আংলা' পড়ত। এখন আর পড়ে না। তার কারণ, সে জানে, সুবচনীর হাঁসটি সত্যিই খোঁড়া। সে উড়তে পারে না। তাকে ওড়ানোর জন্য নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে কোন সিনেমার জাদুকর এসে উপস্থিত হবেন। আগের যুগে সত্যজিৎ রায় যে কাজটা বেশ দক্ষতার সাথেই পেরেছিলেন।
-সমাপ্ত-
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
অধ্যাপক
চলচ্চিত্র বিদ্যা বিভাগ
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়