ছবি,ছায়াছবি, চলচ্চিত্র, ফিল্ম বা সিনেমা, যে নামেই ডাকো - এই মাধ্যমের একটা মায়া আছে। এ যেন এক আধুনিক রূপকথা। যন্ত্রের সাহায্যে অবাস্তব কে বাস্তব সাজিয়ে দিলে যে ম্যাজিক তৈরি হয়, তাকেই তো সিনেমা বলে! না হলে আর কেন ছোট বড় সবাই সিনেমা হলে যেত ছবি দেখতে? আমি অতীতের কথাই বলছি। কেননা আমাদের ছোটবেলাতেও তো টিভি ছিলনা। এখনকার মত আলো ঝলমলে বৈঠকখানায় বসে গল্প করতে করতে টিভি দেখা, আর অন্ধকারে রুদ্ধশ্বাসে বিশাল পর্দার সামনে জমজমাট কাহিনির টানাপোড়েনে জুড়ে থাকা আরেক জিনিষ।
এরকমই ছিল আমাদের ছোটবেলা। কমলালেবু কি বাদাম হাতে আমরা মামা বা পিসেমশাইয়ের সঙ্গে সাহেবপাড়ায় মেট্রো বা এলিটে ভীড় জমাতাম 'বেনহুর' দেখব বলে। 'বেনহুর' গল্পটা পড়েছ কি? বা দেখেছ? ১৮৮০ সালে লেখা লিউ ওয়ালেসের উপন্যাস বেনহুরঃ এ টেল অব দ্য ক্রাইস্ট অবলম্বনে এই ছবিটি ১৯৫৯ সালে তৈরি করেন বিখ্যাত চিত্র পরিচালক উইলিয়াম ওয়াইলার।
ছবির পোস্টার
এই গল্প অবলম্বনে এই নিয়ে তৃতীয়বার ছবিটি তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু এই ছবিটির সঙ্গে আগের দুইটি প্রচেষ্টার কোন তুলনাই চলে না। এই ছবিটা ছিল এক অসাধারন ছবি, যেখানে এক অসাধারন গল্প বলা হয়েছিল। কি নেই সে গল্পে? বন্ধুতা-শত্রুতা, রাজনীতি-ধর্ম, খেলা-বাজি, দ্বন্দ্ব-মিল, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আশা-নিরাশা, আনন্দ-দুঃখ, ভালবাসা-হিংসা - মানুষের জীবনের সব রকম অনুভূতির ছোট ছোট গল্প ছড়িয়ে আছে এই বিশাল গল্পের মধ্যে;
বেনহুর এর ভূমিকায় চার্লটন হেস্টন
মেসালাহ্ চরিত্রে স্টিফেন বয়েড
আছে যীশুখ্রীষ্টের গল্প;
আছে রোম সাম্রাজ্যের গল্প;
আছে মানবসভ্যতার গল্প।
আর তাই এই গল্পটা, বা সেই গল্প নিয়ে তৈরি এই ছবিটা, আমাদের কাছে কখনও পুরোনো হয়না।
কি সেই রহস্যটা কি, যা যুগে যুগে বেনহুরের মত বানানো গল্পের সঙ্গে আমাদের বেঁধে রাখে? আসলে যেকোন ছবি বা ফিল্মের মধ্যে কোন অতীত বা ভবিষ্যত থাকেনা। যেকোন গল্পই আমাদের কাছে সে মূহুর্তের গল্প। তাই বেনহুর যখন শিকল বাঁধা অবস্থায় দাঁড় টানতে থাকে, বা মেসালা যখন রথের দৌড়ে অংশ নেয়, আমরাও মনে মনে দৌড়াই। আমাদেরও গায়ে যেন কৃতদাসের মত ঘামের দানা ফুটে ওঠে।
হলিউড যে সারা বিশ্বকে প্রথম থেকেই জিতে নিল, তার প্রধান কারন এই যে, সেই ছবিগুলির মধ্যে আমরা মিশে যেতে পারি। নিজেদের সনাক্ত করতে পারি। আর কোথাও মনের গোপনে আমরা চাই-যে ভালরা জিতে যাক, আর খারাপরা হেরে যাক। আমরা যে আসলে নিজেদের জীবনেও সেইরকমই ঘটনা চাই। হলিউড ধ্রূপদী ছবি আমাদের এই ইচ্ছাকেই পূরণ করে। এ যেন এক ইচ্ছাপূরণের ম্যাজিক।
কিভাবে এই ইচ্ছাপূরণ হয়? কিভাবে গল্প বলে হলিউডের ধ্রূপদী ছবি? দেখা যাবে, প্রত্যেকটা ছবিরই একটা শুরু, একটা নাটকীয় মধ্যভাগ, ও একটা সুন্দর সমাপ্তি থাকে। এর ফলে, আমরা যারা দর্শক, আমাদের ওপর কোন চাপ থাকে না। আমরা জানি, বেনহুর শেষ পর্যন্ত বন্দীদশা কাটাতে পারবেই। সে তার মা আর বোনের কাছে ফিরতে পারবে, তার বাড়ি-ঘর ফিরে পাবে। যখন রথ চালানোর প্রতিযোগিতা হয়, আমরা টানটান হয়ে বসে দেখি বেনহুরের রথের চাকা প্রায় খুলে যাচ্ছে, কিন্তু তখনও আমরা মনে মনে জানি এবং আশা করতে থাকি যে, বেনহুর ঠিক জিতে যাবে।
এইভাবেই, হলিউডের কোন ছবিই আমাদের মধ্যে কোন আলাদা করে দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেনা। ছবির শুরুতে যত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, সবগুলির সুন্দর সমাধান হয়ে যায়। ঠিক যেন, কঠিন পরীক্ষা বা পরিশ্রমের শেষে এক সুন্দর ফলাফল। একেই ভারি ভাষায় নিষ্পত্তি বা closure বলে।
তাই বলে এইরকম ভাবে গল্প বলা সহজ কথা নয়। বিভিন্ন আলাদা আলাদা দৃশ্যগুলিকে যেমন তেমন ভাবে জুড়ে দিলেই এইরকম মসৃন ভাবে গল্প বলা যায়না। ছবির বিভিন্ন শট বা দৃশ্যগুলিকে জোড়ারও নিয়ম আছে, যাকে বলে continuity। সেই নিয়ম মেনে তৈরি করা ছবি দেখলে মনে হয় - ঠিকই তো, এই ঘটনার পরেই তো ওই ঘটনা দেখানো উচিত।
ছোটবেলায় বেনহুর দেখে এরকম ভাবে অবাক হওয়ায়, বিস্ময়ে, মুগ্ধতায় তলিয়ে গেছিলাম। সব যুগেই এইরকম হয়। আজকের দিনে, তুমি যখন 'হ্যারি পটার' বা 'তারে জমিন পর' দেখ, তখন তুমিও ঠিক একইরকম অবাক হয়ে যাও, তাই না?
একদিন থেকে দেখতে গেলে, 'বেনহুর' কিন্তু প্রায় স্বপ্নের কারখানা থেকে তৈরি হওয়া এক শিল্প। আসলে '৬০ এর দশকের শেষে , বিখ্যাত এমজিএম কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিল। তারা বেপরোয়া হয়ে, শেষ চেষ্টা হিসাবে, ১৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে 'বেনহুর' তৈরি করে। আর কি আশ্চর্য, 'বেনহুর', ঠিক যেন নোয়া'র নৌকার মত তাদেরকে বাঁচিয়ে দেয় ৭৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত দিয়ে !
'বেনহুর'-এর সাফল্য অবিশ্বাস্য। অস্কারের ইতিহাসে এই ছবি প্রথম 'সেরা ছবি' সহ মোট১১টা পুরষ্কার পায়, যা পরে 'টাইটানিক' এবং ' লর্ড অফ দ্য রিংস' ছবি ছাড়া আর কেউই ছুঁতে পারেনি।
বেনহুর ছবিটি , তার গল্পের দৌড়ের বাজির মত, নিজেই যেন এক বাজির খেলা। প্রথমে জনপ্রিয় অভিনেতা বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার কে নাম ভূমিকায় অভিনয় করতে বলা হয়। তিনি রাজি হলেন না। তখন পল নিউম্যান এর দরজায় কড়া নাড়া হয়। তিনিও সাড়া দেন নি। অবশেষে চার্লটন হেস্টন রাজি হয়ে যান। পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন বিখ্যাত পরিচালক উইলিয়াম ওয়াইলার। তাঁর ছবি করার বৈশিষ্ট হচ্ছে লম্বা লম্বা শট। অথচ, বেনহুরের সবচেয়ে বিখ্যাত দৃশ্য -রথের দৌড়, তিনি পরিচালনাই করেননি। ওই দৃশ্য পরিচালনা করেন অ্যাণ্ড্রিউ মারটন নামে একজন অখ্যাত নির্দেশক। আর আরো অবাক কথা, যে এই সিকোয়েন্স মোটেই হলিউডে তৈরি নয়। রোমের বিখ্যাট চিনেচিত্তা স্টুডিওতে তৈরি। এই পুরো সিকোয়েন্স চিত্রায়িত করতে সবশুদ্ধ সময় লেগেছিল তিন মাস। সেট এর মাপ ই ছিল ৭৩হাজার বর্গ মিটার। ১৮টা রথ বানানো হয়েছিল। ১৫,০০০ এক্সট্রা নিয়োগ করা হয়। বেনহুর রূপী চার্লটন হেস্টন কে একমাস সময় দেওয়া হয় রথ চালানো শেখার জন্য। মেসালা রূপী স্টিফেন বয়েড অবশ্য তার অর্ধেক সময় নেন শিখতে।
বেনহুর ছবির বিখ্যাত রথের দৌড়এর দৃশ্য
এইবারে বুঝলে তো, গত সংখ্যায় কেন বলেছিলাম, কারখানায় যেমন ভাবে কোন পন্য বানানো হয়, ঠিক তেমনভাবেই হলিউডের প্রথম যুগে ছবি বানানো হত। 'বেনহুর' যদি না দেখে থাকো, তাহলে অবশ্যই দেখে নাও। ক্লাসিক বা ধ্রূপদী হলিউড সিনেমার এক অসামান্য নিদর্শন এই ছবিটা।
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
অধ্যাপক, চলচ্চিত্র বিদ্যা বিভাগ
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
ছবিঃ
উইকিপিডিয়া
সারেগামা হোম ভিডিও