খেলাঘরখেলাঘর

“বুড়ো হাড়ে, পাহাড়ে!”যদিও হাড় এখনও সবারই শক্ত-পোক্ত, তাও, স্লোগানের মতন দেবাঞ্জনের মুখের কথাটা দিয়েই যাত্রা শুরু। স্কুল-কলেজের সেই উদ্দামতা তো আর নেই, সেই তুলনামুলক ভাবে বলাই যেতে পারে – “বুড়ো-হাড়!”উষ্ণীষের মেয়ে হয়েছে এক বছর হল। ছোট্ট “গিনি”-কে ফেলে বেরোয়েনি ও কোনোদিন। তাও, মেয়েকে মা’র কাছে রেখে বাবা পালালেন স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে। ১লা ডিসেম্বর, ২০১১। আমি, দেবাঞ্জন আর উষ্ণীষ। তিনে মিলে স্কুলের দিন গুলো রোমন্থণ করতে করতে বেরিয়ে পড়লাম সিকিমের উদ্দেশ্যে।সিকিম – আমার অতি প্রিয়, অন্তরের খুব কাছাকাছি এক জায়গা। কত বার যে ফিরে ফিরে এসেছি এখানে। এক এক সময়ে এক এক রূপে দেখেছি, তবু মন ভরেনি। বলেছি আবার আসব, এসেওছি। এই বছরেই এই নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার আসা। তবে এবারে যেখানে যাচ্ছি সেখানে এই প্রথমবার।২রা ডিসেম্বরনিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস পৌঁছল সোয়া সাতটায়। নেমেই চোখ সার্থক করলাম কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শনে। ঝকঝকে আকাশ। মন ভাল হয়ে গেল। শিলিগুড়িতে এসে একটা হোটেলে চট-জলদি তৈরী হয়েই বেরিয়ে পড়া রংপো-র দিকে। তেঞ্জিং-নোরগে বাস স্ট্যান্ডের ঠিক উলটো দিকেই সারি সারি গ্যাংটকের শেয়ার জীপ দাঁড়িয়ে। দরদাম করে একটা টাটা ভিক্টা বুক করে বেরিয়ে পড়লাম তিন জনে। টোটকা : বলে রাখি, পাহাড়ি রাস্তায়ে চলার আগে অল্প কিছু খাওয়া আর সঙ্গে কোল্ড-ড্রিঙ্কসের একটা বোতল রাখা ভাল। পেট খালি থাকলে বা বেশী ভর্তি থাকলে অসুবিধে হয় অনভ্যস্তদের। আর কোল্ড-ড্রিঙ্কস পাহাড়ি রাস্তায় বমি ভাব কমায়ে।গাড়ি চলল মহানন্দা অভয়ারণ্যের বুক চিরে। খানিক বাদেই সঙ্গী হল তিস্তা। তার সঙ্গে এঁকে-বেঁকে পথ চলা। রাস্তার অবস্থা কিছু জায়গায়ে খুব খারাপ। তাই সেবক, তিস্তাবাজার, মেল্লি হয়ে রংপো পৌঁছোতে আমাদের একটা বাজল। এখান থেকে আমাদের অন্য গাড়ি ঠিক করা ছিল। সোম তামাং আমাদের পথ-প্রদর্শক, বাহনচালক। সে রংপো-র বড় পেট্রোল পাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল নিজের বোলেরো গাড়ি নিয়ে। জুলুক থেকে সক্কাল-সক্কাল বেরিয়ে সে এসেছে আমাদের নিতে। জুলুক - পূর্ব সিকিমের অভ্যন্তরে এক ছোট্ট গ্রাম। সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে, এবং গোপাল প্রধান নামক এক জুলুক-বাসীর তাগিদে, জায়গাটা কিঞ্চিত পরিচিতি পেয়েছে। এই গোপাল প্রধানই জুলুক-কে বিশ্বের সামনে এনেছিলেন “হোম স্টে” শুরু করে। এখন ওনাকে ওই দিককার লোকেরা সবাই এক নামে চেনে। রংলি সময় কম। তাই গাড়ি চলল চটজলদি রংলি-র দিকে। রংপো ছাড়াতেই রাস্তা খুব খারাপ, কিন্তু চারিদিকের দৃশ্য খুব সুন্দর হয়ে উঠলো। অপরূপা রংপো-চু নদী আমাদের সঙ্গী। তার পাশ ধরে রোরাথাং পেরিয়ে রংলি পৌঁছে গেলাম দেড় ঘন্টারও আগে। তিনটের মধ্যে না পৌঁছলে এখানকার পারমিট অফিস বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আর হাজার চেষ্টা করলেও কেউ নিয়ে যাবে না জুলুক। রংপো ফিরে যেতে হবে সেদিন। আবার পরের দিন শুরু করতে হবে যাত্রা।রংলি-র পরেই রাস্তা ঘুরপাক খেতে খেতে ওপরে উঠতে থাকল। একজন আর্মি অফিসার আমাদের গাড়িতেই উঠে বসলেন; তাঁকে জুলুক যেতে হবে সেদিনই। সিকিমে তার তিন বছরের পোস্টিং ছিল, আর কদিন পরেই ট্রান্সফার হবেন রাজস্থানে। পদমচেন ছাড়িয়ে জুলুক পৌঁছলাম যখন, তখন অন্ধকার নেমে গেছে। পদমচেনে সূর্যাস্ত প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে গাড়ি থেকে নেমেই। ঠক্‌ঠক্‌ করতে করতে হোটেলের রুমে ঢুকলাম। জল বরফের থেকেও বুঝি ঠান্ডা! পুষ্পা নামের একটা ছেলে গরম চা এনে দিল, খেয়ে একটু তৃপ্তি পেলাম সবাই। আসতে আসতে সয়ে এল শীত। রাতটা যা হোক করে কাটিয়ে দিলাম জুলুকের অন্ধকার পাহাড়ের মধ্যে।৩রা ডিসেম্বরসকাল হল, কিন্তু সূর্য উঠল না আকাশে। অভ্যাসবসত, আমাদের আসার খবর আগাম পেয়ে গিয়ে পৃথিবীর সব মেঘ একত্রিত হল জুলুকে। জুলুক থেকে সবাই এক অবিস্মরণীয় সুর্যোদয় দেখতে যায় কিছুদুরের “সানরাইজ পয়েন্ট”-এ। কিন্তু এই সকালটা সবাই আরাম করে ঘুমোলো লেপের তলায়। সকাল ৯টার পর থেকে তো দশ হাত দুরের জিনিস আর দেখা যাচ্ছে না, এত মেঘ আর কুয়াশা। আমরা ধীরে সুস্থে সাড়ে দশটার সময় বেরোলামজুলুক ছাড়িয়ে কুপুপ-এর পথে। ভাবলাম যদি খানিক পরে আরও উচ্চতায় উঠলে একটু পরিস্কার আকাশ পাওয়া যাবে। হল তার উলটো। জুলুক ছাড়াতেই বিখ্যাত “বত্তিস মোড়”। পরপর ৩২টা হেয়ারপিন বেন্ড রয়েছে প্রায় ১২কি,মি রাস্তা ধরে। এবং এখানকার সব থেকে অনন্য দৃশ্য হল যে এই ৩২ মোড়ের পরে পুরো রাস্তাটা এক সঙ্গে দেখা যায়ে পাহাড়ের গা বেয়ে কেমন এঁকে বেঁকে উঠে এসেছে। আমাদের অবস্থা একদম অন্যরকম। আমি সোম তামাং-এর পাশে বসা অবস্থায় রাস্তার দিকে তাকাচ্ছি আর ভাবছি, সোম গাড়িটা কি দেখে চালাচ্ছে? কিচ্ছু তো দেখাই যাচ্ছে না সামনে!!! শুধু মেঘের রাজ্য। ওই ৩২টা হেয়ারপিন বেন্ড তথা সেদিনের বাকি রাস্তাটাও যে কি ভাবে কি দেখে সোম গাড়ি চালাল ওই জানে! আমার কাছে অপার বিস্ময়! খানিক বাদে রাস্তায় বেশ কিছু লোকজনের দেখা পাওয়া গেল। ওরা রাস্তা সারানোর কাজ করে। সকাল থেকে এসেছে, তখন খাবার বানাচ্ছে রাস্তার পাশেই। সবার মুখেই হাসি, ছবি তুললে তাদের কোনো দ্বিধা নেই। রাস্তার আশেপাশে বরফ দেখতে পাচ্ছি ছাড়া-ছাড়া। তখন তাপমাত্রা শূন্যের নীচে, আর আমরা গাড়ি থেকে নেমে জড়ভরত হয়ে গেছি। বিনা পয়সায় ওরা আমাদের চা খাওয়ালো। তারপরে গাড়ি চলল বটে কিন্তু আমরা কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিলাম না মেঘের জন্যে। রাস্তা উঠেই চলেছে, কিন্তু রাস্তার অবস্থা ভাল মিলিটারিদের যাতায়াত বেশি বলে। আদি বাবা মন্দির পৌঁছলাম আরও এক ঘন্টার মধ্যে। চারিদিকে সাদা বরফ, সাদা মেঘ। উচ্চতা ১৪,০০০ ফিট মতন হবে। এই বাবা কোনও হিন্দু ভগবান নন। ইনি খাঁটি মিলিটারির লোক ছিলেন। বহু প্রচলিত হলেও বলে রাখি, (বাবা) হরভজন সিং ২৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট-এ ছিলেন। একদিন টুকুলা থেকে ডেংচুক লা যাবার পথে তিনি পা ফসকে নদীর জলে পড়ে স্রোতে ভেসে মারা যান। একদিন কারুর স্বপ্নে এসে তিনি দেখা দিয়ে বলেন তাঁর সমাধি-র ব্যবস্থা করতে। সেই সমাধিই আজকের এই আদি বাবা মন্দির। বাবা মন্দিরে ভক্তদের জন্যে প্রসাদের ব্যবস্থা আছে। গরম গরম চা ফিল্টারে রাখা রয়েছে, যে খাবে পাশে রাখা গেলাশে করে ফিল্টার থেকে ঢেলে নিলেই হল। তারপর গেলাশ ধুয়ে রেখে দিতে হবে যথাস্থানে, শুধু এইটুকুই শর্ত।বাবা মন্দিরে প্রণাম ঠুকে এগোলাম, কিছুটা এগোতেই টুকলা ভ্যালি-তে (১৪,৫০০ ফিট) পৌঁছলাম। এখানে শুধু রাস্তাটাই বরফ বর্জিত, বাকি সর্বত্র পুরু বরফে ঢাকা। আরও ১৩ কিমি দূরে কূপুপ। কিন্তু বুঝলাম কিছুই দেখা যাবে না। তাই টুকলা ভ্যালিতে বরফ ছোঁড়াছুঁড়ি করে ণাথাং-এর দিকে চললাম, যেখানে আমাদের রাত্রিবাসের বুকিং।টুকলা থেকে ণাথাং-এর রাস্তা খুব কঠিন উৎরাই। তাই ওই রাস্তায় শুধু মিলিটারি গাড়ি ছাড়া কিছু উঠতে পারে না, শুধু সাবধানে নামা সম্ভব। রাস্তায় বেশ কিছু মহিলা আমাদের গাড়িতে চড়ে বসলেন। তারা কাজে এসেছিলেন এদিকে, আবার নেমে যাবেন জুলুক-এ। সেই জনা ছয়েক মধ্যবয়স্ক-স্বল্পবয়স্ক মহিলাদের সঙ্গে আঁটোসাঁটো হয়ে বসে ণাথাং অবধি এলাম। তখন মাত্র সাড়ে বারোটা বাজে। কাঠের গোটা পঞ্চাশ বাড়ি নিয়ে ছোটো এক জনপদ এই ণাথাং। এখানে এত শীত, যে আমাদের গাড়ি এখানে রাখা যাবে না। সারারাচ থাকলে পরের দিন আর চালুই হবে না গাড়ি। তাই মালপত্র নামিয়ে, বাকি মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে সোম তামাং আমাদের ডিপ্‌-ফ্রিজে মাছ রাখার মতন ণাথাং-এ রেখে ফিরে গেল জুলুক। ণাথাং দফতর বাংলো আমরা তিনজন একটা ১৯২০ সালে তৈরী “দফতর বাংলো”-র সামনে কঙ্কালের মতন দাঁড়িয়ে, এমন সময়ে ভেতর থেকে এক সুন্দরী তন্বী এসে সিকিমি টানে কিন্তু স্পষ্ট ইংরেজিতে বলল, "You are from Calcutta? Mr. Banerjee? Please come inside."  আমরা খানিক নিজেদের মুখের দিকে চেয়ে মালপত্র হাতে করে বরফ মাড়িয়ে ভেতরে গেলাম। ইংরেজরা এখানেও এসে ঘাঁটি গেড়েছিল ভেবে অবাক লাগছিল। বাংলোটি ১৯২০ সালে তৈরী হলেও, এটি সাম্প্রতিককালে সিকিম সরকার জীর্ণসংস্কারন করেছে, তাই এখন ঝাঁ-চকচকে। তিনটে ঘর। দুপাশের দু-টো রুমে অ্যাটাচ্‌ড্‌ টয়লেট, মাঝের টায়ে নেই। এত উঁচুতে এত সুদূরে এত ভাল থাকার ব্যবস্থা আভাবনীয়। ঘরে ‘ফায়ার প্লেস’-এর বন্দোবস্তও আছে। বাংলো-র লাগোয়া কিচেন কাম ডাইনিং হল, ওরফে একটা ছোটো পৃথক ঘর। সেখানে গেলাম, আর সেই পাহাড়ি যুবতির হাতের গরম ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিয়ে মনে হল স্বর্গে এসে অমৃতপান। ক্লান্তি ও শীত দুই কমলো। মেয়েটির নাম পেমা শেরপা। দফতর বাংলো এই বছরের মে মাস থেকে ট্যুরিস্টদের জন্যে খোলা হয়েছে এবং পেমা এখানকার সম্পূর্ণ দ্বায়িত্ব নিয়েছে। ট্যুরিস্টদের আপ্যায়ন করা, দুপুরের খাবার বানানো, চা - গরম জলের বায়না সামলানো, ফায়ার প্লেসে আগুন ধরানো, সন্ধ্যের পাকোড়া ভাজা, রাতের খাবার বানানো, কম্বলে সেঁধিয়ে দেওয়া ট্যুরিস্টদের সান্ধ্য আড্ডা থেকে ডেকে তুলে খেতে দাওয়া, এবং রাতে অতিরিক্ত কম্বলের যোগান দেওয়া অবধি সব কাজ নিজেই করে মেয়েটা। শুধু ফায়ার প্লেসে কাঠটা বোধ-হয় অন্য কেউ এনে দিয়েছিল। শিক্ষিত মেয়ে, রংপো-রংলিতে পড়াশুনা করেছে কলেজ অবধি, তারপর কল-সেন্টারের ট্রেনিং করেছিল। ণাথাং বাংলো না হলে হয়ত পেমা এখানে থাকতও না। কিন্তু এখানেই সে ভাল আছে। নিজের বাড়িতে থেকে কাজ পাশের হোটেলে, ক্ষতি কোথায়? পেমা শেরপা শেষ দুপুরে বরফ পড়তে শুরু করল। প্রথমে মিহি, তারপরে ঝিরিঝিরি, তারও পরে বেশ জোরে। ১৪ই নভেম্বরের পরে এই ৩রা ডিসেম্বরে প্রথম বরফ পড়ল। এর মধ্যে আকাশ একদম পরিস্কার ছিল। কিন্তু ঠান্ডা বেশী বলে অনেক জায়গাতেই বরফ গলতে পারেনি। এখন আবার সেই পুরনো বরফের ওপর নতুন সাদা বরফ জমতে শুরু করল। রাস্তা, বাড়ির চাল, গাছের ডাল, সব ঝুরো বরফে ঢাকতে শুরু করল। দুপুরের খাবার খেয়ে দেবাঞ্জন তো ঘুম দিয়েছিল। ওকে আমি আর ঊষ্ণীষ ডাকলাম বরফ পড়া দেখবার জন্যে। ও আলসেমি ছেড়ে উঠতে পারল না আর ওই ঠান্ডায়। জানলা দিয়ে একটু বাইরে তাকিয়ে নিয়ে বলল, “আরেকটু জোরে পড়লে আমাকে ডাকিস!” ঊষ্ণীষও একটু বিশ্রাম নিতে শুয়ে পড়ল, আর আমি বেরোলাম ক্যামেরা হাতে ণাথাং-এর ঘুমন্তপুরীর ছবি তুলতে। ঘুমন্তপুরী ণাথাং ণাথাং-এ বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের একত্রিত বাস। এখানে যেমন কৃষ্ণ মন্দিরও আছে, সেরকম বৌদ্ধ গুম্ফাও রয়েছে। এখানে শেরপা-তামাং-ভুটিয়া এবং রাই-ছেত্রি-প্রধান সবাই একত্রে বসবাস করে। আর আছে মিলিটারি লোকেরা। ণাথাং একটা উপত্যকা। চারদিকে উঁচু পাহাড়ের দেওয়াল হিমালয়ের তুষার-মেরুর হাত থেকে কিছুটা রক্ষা করে। এখানে ইয়াক চরে বেড়ায়ে নিজের মনে। ফাঁকা রাস্তায়ে একা ঘুরে বেড়াতে দেখলে বেঁটে বেঁটে কুকুর গুলো ঘেউ ঘেউ করে। কাঠের বাড়ির সামনের দরজা এখানে মাটি থেকে কোমর অবধি, ওপরের বাকিটা ফাঁকা - এর কারণ আমার জানা হয়নি। আমি মনাস্টরিতে গেলাম, তবে বেশীক্ষন থাকলাম না। অন্ধকার প্রায়ে বিকেলে সেখানে প্রাণ-বর্জিত। ণাথাং ভ্যালিতে তখন ক্রমাগত বরফ-পাতের জন্যে প্রচন্ড কুয়াশার ব্যাপারটা কিছুটা পরিস্কার হয়েছে। দেখতে পাচ্ছিলাম গ্রামটাকে ঘিরে রেখেছে বরফাবৃত পাহাড়। একটা সরু লোহার সাঁকো পেরিয়ে যাওয়া যায় কৃষ্ণ মন্দিরের দিকে। কিছুটা এগোনোর পরে দেখলাম বাড়ি ঘর শেষ, সামনে খালি মাঠ, অন্ধকার হয়ে আসছে, আর মেঘের জন্যে ভাল দেখাও যাচ্ছে না কোন দিকে মন্দির। তার চেয়ে বাংলোয়ে ফিরে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে হল। ণাথাং বাংলোয়ে এসে বাকিদের কুঁড়ে হয়ে শুয়ে থাকার জন্যে গালাগালি দিলাম বটে কিন্তু গরম গরম পাকোড়া আর ব্ল্যাক কফি খেয়ে কম্বলের তলায়ে ঢুকেই কাঁপুনি শুরু হল। তখন বুঝলাম দেবাঞ্জন কেন শুয়ে পড়ার পর আর উঠতে পারেনি। রাতে খেতে যাওয়াটা মনে হচ্ছিল অনেক জন্মের পাপের শাস্তি! দুপুর ১২টার সময় যে জায়গায়ে -৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা থাকে, সেখানে রাত ৯টায়ে যে কি অবস্থা তা ভেবেই মনে হচ্ছিল উপোস করা এর চেয়ে ঢের ভাল! তবে খাবার জুটল দারুন। গরম গরম ডাল ভাত মাংস খেয়ে বেশ চাঙ্গা লাগল শরীর। দফতর বাংলো-র পেছন দিকে দাঁড়িয়ে ণাথাং উপত্যকা চাঁদের আলো ছাড়াই বেশ দেখা যাচ্ছিল বরফের আভায়। ৪ঠা ডিসেম্বরখুব সকালে উঠে লাভ ছিল না কারন আকাশের মেঘ কাটেনি। তাই ৭টা অবধি শুয়েই থাকলাম। সোম তামাং কে বলা ছিল যদি আকাশ পরিস্কার থাকে, তাহলে যেন ভোরের দিকেই চলে আসে ণাথাং-এ। এল না দেখে বুঝলাম সর্বত্রই একই অবস্থা। পেমা আমাদের এক প্রস্থ চা দিয়ে জলখাবারের ব্যবস্থা করতে লাগল। তার মধ্যে মধ্যে আরও চা-এর বায়না যখনই করেছি তখনই পেয়েছি। পেমা শেরপার আতিথেয়তায়ে কোনো খুঁত নেই। গল্প করতে করতে তৈরী হয়ে গেলাম সাড়ে আট্‌টার মধ্যে। সোম এসে গেল ওই সময়েই। আমরা আবার মালপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বরফাবৃত ণাথাং ছাড়িয়ে কূপুপ-এর উদ্দেশ্যে। সোম তামাং আগের দিনের থেকে অনেকটাই পরিস্কার আবহাওয়া। যদিও আকাশে নীলের চিহ্ণ কোত্থাও নেই। গাড়ি আবার ঘুরে এসে পৌঁছোলো আদি বাবা মন্দিরের সামনে। আগের দিনের বরফ পড়ার ফলাফল চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। আগের দিন দেখেছিলাম রাস্তার দুধারে বরফ, আর এইদিন দেখলাম রাস্তার আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই, পুরোটাই সাদা। তার ওপর দিয়েই ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে সোম তামাং গাড়ি চালাচ্ছে আর মাঝে মাঝে বলছে “টায়ার স্কিড্‌ কর রাহা হ্যায়”। আমি চুপচাপ ভিডিও ক্যামেরা চালু রেখে বসে আছি। টুকলা ভ্যালী-র পর থেকে গাড়ি আবার নিম্ন-গামী। এক সময় হাতি লেক-এ পৌঁছলাম। দারুন সুন্দর লেক, রাস্তা থেকেই দেখতে হয়, পাহাড়ের ধাপ বেয়ে কাছে যাবার ছাড়পত্র নেই। মিলিটারির এলাকা, কোনো ব্যতিক্রম হবে না নিয়মের। দেখলাম একশোর ওপর “রেড বিল্‌ড্‌চাফ” উড়ে যাচ্ছে লেকের ওপর দিয়ে। ওখানকার লোকেরা বলে “চাইনিজ কাউআ”। কুচকুচে কালো শরীরে লাল ঠোঁট। হাতি লেক আর ১ কিমি যেতেই কূপুপ গ্রামে পৌঁছোলাম। পুলিশ চেকপোস্টের পাশে একটা বোর্ডের গায়ে লেখা ১৩,৯০০ ফিট। কয়েকটা দানবাকৃতির ঘোড়া নিজের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গোটা কয়েক ঘর নিয়ে এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। লোকজন বিশেষ কেউ নেই রাস্তায়। কিছু বাড়ির অ্যাসবেস্টসের ছাত থেকে চুঁইয়ে পড়া জল ঠান্ডায় বরফে পরিনত হয়েছিল, দেখলাম সেগুলো গলতে শুরু করেছে। বুঝলাম, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রাও শূণ্যের গন্ডি ছাড়িয়ে বাড়তে শুরু করেছে। কুপুপ উপত্যকা একটা দোকানে ঢুকে কফি খেলাম। দেবাঞ্জন একটা চাইনিজ কম্বল কিনে ফেলল ৮০০ টাকা দিয়ে। এখানে এবং আসে পাশে চায়নার লোকেরা এসে মার্কেট বসায় জুলাই থেকে নভেম্বর। তখন সেই মার্কেট থেকে জিনিস পত্র কিনলে এই ৮০০ টাকার চাদর হয়ত ৪০০ টাকেতেও পাওয়া যেতে পারে। আপাতত এবারের যাত্রা আমাদের এই কূপুপ অবধি। আর ৫৮ কিমি দূরে গ্যাংটক শহর। সেই রাস্তা গেছে আমাদের পরিচিত ছাঙ্গু লেকের পাশ দিয়ে। আমাদের সেই দিকে যাবার ছাড়পত্র বানানো নেই। তাই আমরা অপূর্ব এই কূপুপ উপত্যকার ছবি ক্যামেরা বন্দি করে ফিরে চললাম। বরফের মোড়কে ঢাকা রইল পূর্ব সিকিমের সু-উচ্চ হিমালায়ের গহন অন্তর। চলার পথে ক্রমশ হারিয়ে গেল বরফের শুভ্রতা, গাছপালা বাড়তে শুরু করল, ৩২ মোড় পেরিয়ে নেমে এলাম জুলুকে। জুলুকের এক শিশু তখন বেলা সাড়ে বারোটা। সামান্য চায়ের বিরতি, আবার পথ চলা। রংলি-র একটু পরে রোড়াথাং-এর ব্রীজের ওপর দিয়ে রংপো-চু পেরিয়ে রংপো-র দিকের রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরলাম। রেণক হয়ে রেশীতে পৌছে আমরা সিকিমের সীমান্ত পেরিয়ে গেলাম। রেশী শুনেছিলাম খুব সুন্দর জায়গা, কিন্তু ওই অপার্থিব ণাথাং-এর স্মৃতি এই জায়গার সৌন্দর্যকে খর্ব করে দিচ্ছে মনে হল। পরে কোনো একদিন মস্তিস্ক-প্রক্ষালক যন্ত্র দিয়ে মাথা পরিস্কার করে এখানে এসে এখানকার আঘ্রাণ নিতে হবে।এর পরে আমরা সিকিমের সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আরও কিছু দ্রষ্টব্য জায়াগায়ে ঘুরেছিলাম। তবে সে গল্প না হয় এখন তোলা থাকল।৬ই ডিসেম্বরনিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে এসে ট্রেন ধরার আগে একবার সব মালপত্র মিলিয়ে নেওয়া হল যে সব কিছু ঠিক ঠাক নিয়ে আসা হয়েছে কিনা। খাবার কিনে নিলাম ষ্টেশন থেকেই। ট্রেন ছাড়ল। হটাৎ দেবাঞ্জন সার্টের পকেট প্যান্টের পকেট হাতড়াতে লাগল! চমকে গিয়ে বললাম, “কিছু ফেলে এলি নাকি?”দেবাঞ্জন খোঁজা থামিয়ে হেসে বলল, “মন-টা খুঁজছি। পাচ্ছি না। মনে হয়, সিকিমেই ফেলে এসেছি!”লেখা ও ছবিঃঋতম ব্যানার্জিকলকাতা {tortags,426,1}