মইস্যার মনসার থানে
নদীমাতৃক দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম বৃহত জেলা মেদিনীপুর । সেখানে যেমন আছে নদীর জলে পুষ্ট সবুজ গভীর জঙ্গল ঠিক তেমনি আছে ঐ জঙ্গলের স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে অগুন্তি সরীসৃপের পরিবার । ছোট বড় নদীর জল , ঝোপঝাড়ে বেড়ে ওঠা এই সরীসৃপদের মধ্যে বাংলার বিখ্যাত সব সাপেরা গড়ে তুলেছে এক সুন্দর ইকোসিস্টেম । তাদের খুব পছন্দের জায়গা পশ্চিমবাংলার এই স্থানটি । ঘন জঙ্গলের মধ্যে সূর্যালোক প্রবেশ করেনা, বানভাসি শ্রাবণ-ভাদ্রের থৈ থৈ নদীর দুকুল ছাপিয়ে জল ও চলে আসে সেই জঙ্গলে আর মনের সুখে দিন যাপন করে শঙ্খচূড়, কালনাগিনী, গোখরো, খরিস, চন্দ্রবোড়া সমেত আরো নানা অজানা সাপেরা । এদিকে এই বিশাল জেলায় আছে অঢেল চাষযোগ্য জমি । তাই কৃষকেরা রোজ মা মনসাকে স্মরণ করে ক্ষেতে যায় চাষ করতে । শীতে একটু আরাম । সাপেরা তখন হাইবারনেট করে, গর্তের নীচে শীতঘুম দেয় কিন্তু প্রচন্ড গরমের দাবদাহে বাইরে চলে আসে । বর্ষায় দেখায় উদ্দাম নৃত্য। চাষীবৌ কুঁড়ের ধারে পথ চেয়ে বসে ভাবে স্বামীর কথা । বর্ষার হাঁটুজলে ধানচারা লাগাতে গিয়ে যদি সাপে কাটে তার স্বামীকে ।
সে জানে সাপকে নাকি জ্বালাতন না করলে সে কিচ্ছু করেনা কিন্তু তার ল্যাজে পা পড়ে গেলে সে ভয়ানক রেগে যায় । আর বিষধর সাপ হলে তো আর কথাই নেই ! কৃষক যখন আর হাল দিতে পারেনা বৌ তার চেলেমেয়েকে নিয়ে মাঠে যায় । গিয়ে আবার ঐ এক চিন্তা ঘোরে মাথার মধ্যে । সেবার সাপে কেটেছিল গ্রামের একটা বাচ্চা ছেলেকে । ঝাড়ফুঁক করল ওঝা এসে । আয়ুর্বেদিক ডাক্তার এসে বিষ বের করে ওষুধ লাগিয়ে দিল । অনেক কষ্টে মা মনসার দয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে গেল ছেলেটা । সন্ধ্যেবেলা কুঁড়েঘরের দাওয়ায় বসে মেয়েরা মনসার ভাসান গীত গাইল । এইভাবে কাটে সব চাষীদের জীবন । ওরা ধান বোনে আমাদের জন্য কিন্তু সেই ধান বোনার পেছনে কত ভয় মেশানো কাহিনী থাকে তা তো আমরা জানিওনা । সেবার ধানের গোলায় সাপ ঢুকে সে কি বিপত্তি । আরেকবার মাটির ঘরের চালে লাউয়ের মাচা থেকে লাউ আনতে গিয়ে একটা সবুজ লাউডগা তো বাচ্চা একটা চাষীবৌয়ের হাতে জড়িয়ে সে কি কান্ড! মেয়েটা তো ভয়েই অজ্ঞান । ভাগ্যি লাউডগা সাপের বিষ নেই ! একটু বেশি বৃষ্টি হলে ঘর-উঠোন যখন জলে জলময় হয় তখন দু-একটা জলঢোঁড়া ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে । মাটির ঘরে না আছে ইলেকট্রিক না আছে পাকা ছাদ । বেশি বৃষ্টি হলে দু'একটা চিতি সাপকে চুপচাপ মশারীর দড়ির সাথে জড়িয়েও থাকতে দেখেছে ওরা । খোলস ছেড়ে সাপেরা যখন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে তখন কত বিচিত্র রংয়ের খোলস দেখে গ্রামের লোকে । আবার সেই ভয় মনের মধ্যে পুষে রেখে দিনের পর দিন বুক বেঁধে কাটায় ওরা !
অথচ সাপের ভয় থাকলে কি হবে এই মেদিনীপুরই ছিল ভারতের ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনের মুখ্য কেন্দ্র । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ক্ষুদিরাম বসুর মত মানুষের জন্মস্থান এই মেদিনীপুর । কংসাবতী, সুবর্ণরেখা, শিলাবতী প্রভৃতি নদীর জলে পুষ্ট, ধনধান্য-পুষ্প-ভরা এই জেলার মাটি । কুরুম্ভেরা, গোপগড়, কর্ণাগড়, ময়নাগড়, বর্গভীমা, খড়গেশ্বর, হিড়িম্বেশ্বরী, পাথরার মত মন্দিরময় । ঝাড়গ্রামের মত স্বাস্থ্যকর ট্যুরিষ্ট স্পট আছে এখানে । পূর্ব মেদিনীপুরে আছে দীঘার সমুদ্র সৈকত । বঙ্গোপসাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে আরো আরো ট্যুরিষ্ট কেন্দ্র হয়েছে তাজপুর, মন্দারমণি আর চন্দনেশ্বরে ।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জকপুরের কাছে এমন এক জঙ্গল আছে যাকে গ্রামের মানুষেরা মনসার জঙ্গল বলে । ঐ জঙ্গলের দক্ষিণ পাশে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তারিত এক গভীর খাল ছিল । বর্ষার সময় অতিবৃষ্টিতে ঐ খাল দিয়ে খড়গপুর সহ পশ্চিমের উঁচু জায়গায় বৃষ্টির জল হৈ হৈ করে বয়ে যেত পুব দিকে আর বন্যার আকারে জমেই থাকত সেখানে । শরতের কাশফুলের রমরমায় খালপাড় তখন মেতে উঠত পুজোর আনন্দে । এখানকার কৃষকেরা মনের আনন্দে ধানচাষ করে আরভাদু পরব উদ্যাপন করে মনের আনন্দে কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটু অশান্তি সর্বক্ষণের ...ঐ সর্পকুলে বসবাসের জন্য । মা মনসাকে সর্বদা স্মরনে-মননে রাখে । শ্রাবণ-ভাদ্রের শনি-মঙ্গলবারে মনসার পুজো দেয় । শুধু সাপের কারণেই নয় মনসাকে তারা কৃষিদেবী রূপেও মানে । তাদের রুজি-রোজগার, সম্বচ্ছরের খোরাকি সব ঐ ধান চাষকে ঘিরে । পর্যাপ্ত বর্ষায় প্রচুর ধানে মাঠঘাট যাতে সবুজে ভরে ওঠে, তাই সমস্ত চাষীরা একজোট হয়ে ঐ জঙ্গলের কোনো এক ধারে মা মনসার আরাধনা করে চলে বছরের পর বছর ধরে । পাকা ধান তোলার সময় প্রত্যেকে এক আঁটি করে পাকা ধান মাথায় করে মা মনসার থানে রেখে এসে মা'কে মিনতি জানায়: "মা গো, আমরা ছাপোষা মানুষ, দিন আনি দিন খাই, পেটের দায়ে চাষ করছি, আমাদের অপরাধ মার্জনা কোরো, সম্বচ্ছর সন্তানদের দুধেভাতে রেখো, পরের বছর যেন আবার চাষ করে তোমাকে ফসল দিয়ে পুজো দিতে পারি মা "
প্রায় চারশো বছর আগে জকপুরের জমিদার যোগেশ্বর রায় একদিন ভোর রাতে মা মনসার স্বপ্নাদেশ পেলেন । তিনি স্পষ্ট দেখেন, চতুর্ভুজা মা মনসা হাত নেড়ে নেড়ে তাকে বলছেন, ঐ জঙ্গলেই মা আছেন । জমিদার যেন মায়ের পুজোর প্রচার করেন ।
ভয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে জমিদার কাঁপতে কাঁপতে ঘটি ঘটি জল খেয়ে স্ত্রীকে ডেকে বলেন সব কথা । মূহুর্তের মধ্যে কাকভোরে জমিদার বাড়িতে যে যেখানে ছিল হাজির হয়ে যায় । ঐ জঙ্গলের সাপের কথা সকলের জানা । মা মনসার থান বলে জঙ্গলে যে স্থানটিতে স্থানীয় মানুষ পুজো করে সেখানে এক মস্ত উইঢিপি । তার নীচে কিলবিল করে অসংখ্য সাপ । একথা সকলে প্রত্যক্ষ করেছে । সূর্যোদয়ের পরেই সেদিন জমিদার সদলবলে ঐ স্থানে গিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে মায়ের নিয়মিত পুজোর আদেশ দেন । ক্রমে কাঠুরেরা কুঠার আর হাঁসুয়া দিয়ে ভয়ে ভয়ে জঙ্গল কেটে কিছুটা সাফ করে ফেলে । মায়ের থানে আসার রাস্তাও কাটা হতে থাকে । চোখের সামনে তারা বিষধর সাপেদের রাস্তা এপার ওপার করতে দেখে । উইঢিপিটিকে কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া হয় । পাশে একটি লাল পদ্ম বানানো হয় উইঢিপির মাটি দিয়ে । ঢাক, শাঁখ ও ঘন্টার ধ্বনিতে জঙ্গলের চির নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে মনসার থানকে মর্যাদা দেন জমিদার যোগেশ্বর রায় । নারীপুরুষ নিজের হাতে মায়ের পুজো দেয় সেখানে । যেমন করে আমরাও পুজো করলাম ফুল, দুধ আর কলা কিনে । উইঢিপির ওপরেই দিধ ঢেলে সিঁদুর মাখিয়ে পুজো করা হল মা মনসা কে । ইচ্ছামত যা খুশি দাও । না দিলেও কেউ কিছু বলবেনা । পান্ডা বা পূজারীরও উপদ্রব নেই ।
বর্তমানে যে স্থানে মায়ের পুজো হয় সেই স্থানে আমরা গেছিলাম খড়গপুর থেকে ।
খড়গপুর থেকে NH-2 ধরে কোলকাতার দিকে গিয়ে জকপুর রেলষ্টেশনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ডুবগোহাল স্কুলের পাশ দিয়ে মইশ্যা গ্রামের ভিতর দিয়ে মনসা মন্দিরে যাওয়া যায় । খড়গপুর স্টশন থেকে লোকাল ট্রেনে জকপুর বা মাদপুর স্টেশনে নেমে ট্রেকার বা ভাড়ার গাড়িতে মন্দিরে যাওয়া যায় । কোলকাতা বা হাওড়া থেকে লোকালে মাদপুর বা জকপুর নেমে একইভাবে মন্দিরে আসতে হয় ।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সে এক এডভেঞ্চার! আমাদের হাতে গুগ্লম্যাপ । আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গ্রামের সরু মেঠো লাল রাস্তার মধ্যে দিয়ে হঠাত আবিষ্কার করলাম মইশ্যা । গাড়ির কাঁচ নামাতেই বনফুলের সোঁদা গন্ধ নাকে এল । আর পাখপাখালির কিচিরমিচির । কোথাও একটু ধানজমি কোথাও আবার সর্ষে ক্ষেতের হলুদ । সজনেফুলের গন্ধ বাতাস চারিদিক আচ্ছন্ন করে রেখেছে । আমগাছে মুকুল এসেছে সবে । কুঁড়ে ঘরের লাগোয়া একফালি জমিতে কত কত আলু, ফুলকপি, টমেটো ! কি ভলো লাগে আমার এসব তারিয়ে তারিয়ে দেখতে ! সেই জমিদারের আমল থেকে ঐ মনসা থানে মা বিষহরির পুজো হয়ে আসছে । খোলা অকাশের নীচে ঐ উইঢিপির কুন্ডলী ও পদ্মফুলে সারা বছর ধরে পুণ্যার্থীরা ফুল চড়াতে আসেন শুধু কৃষির জন্য এবং সাপের দংশনে যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেই জন্য । কথায় বলে "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর" তাই প্রতিবছর চৈত্রমাসের তৃতীয় মঙ্গলবারে এখানে মনসামায়ের মহাপূজা আর মেলা হয় । নিজের হাতে পুজো দেন দলে দলে পুণ্যার্থী । পশ্চিমবাংলায় গঙ্গাসাগরের মেলার পর এটি দ্বিতীয় বড় জনসমাগমের মেলা । সেই জমিদারের আমলে এই পুজোর রমরমা শুরু হতে থাকে । তারপর বৃটিশ সরকার মাদপুর থেকে জকপুর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করে। মায়ের থানে দাঁড়িয়ে রেললাইন এবং অনবরত ট্রেন যাওয়া আসা দেখা যায় । মন যেন হারিয়ে যায় কোথায় । সেই ট্রেনের বাঁশী আর মন্দিরের স্থান-মাহাত্ম্য মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় এক আকাশের নীচে ।
স্থানীয় মানুষ বৃটিশদের অনেক কাকুতি মিনতি জানিয়ে মায়ের থানের বেদীকে বাঁচিয়ে রেলের লাইন নির্মাণ করতে অনুরোধ জানিয়েছিল । সাহেবরা হেসে কুটিপাটি ! সেই কথা শুনে বলেছিল "হিন্দুডের ওয়াটার, স্কাই, ফায়ার, এসবের ডেব্টা আঠে । বাট্ স্নেকের ডেব্টা! হোয়াট ইজ দিস?" বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে । মানুষেরা সাহেবকে অনেক ভয় দেখাল এবং সম্মিলিত হয়ে বাধা দিল। তাদের বাধা তোয়াক্কা না করে হাজার হাজার বাইরে থেকে আনা শ্রমিক দিয়ে বাহুবলের দ্বারা জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ শুরু করে দিল । হাজার হাজার বিষধর সাপ জঙ্গলের মধ্যে থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে অতঃপর সেই বৃটিশ ইঞ্জিনিয়ার সহ আরো অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে দংশন করে তাদের প্রাণ নিল । এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা প্রাণের ভয়ে ত্রিসীমানা ছেড়ে জীবন নিয়ে দৌড়ে পালাল । নতুন শ্রমিক এসে ক্রুদ্ধ হয়ে আগুন লাগিয়ে দিল জঙ্গলে । সর্পকুল বিনষ্ট হবে এই আশায় । কিন্তু বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে গেল তারা । তারপর জমিদার প্রজাদের সঙ্গে করে জঙ্গলের মধ্যে সরু রাস্তা কাটিয়ে অনায়াস যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং আবার সশরীরে ফিরে এলেন প্রজাদের নিয়ে । মা মনসা নিজের মন্দিরে প্রবেশের পথ এইভাবে করে দিলেন ।
মেদিনীপুর সহ সমগ্র দক্ষিণবাংলার মানুষ পুত্রলাভের আশায়, বেকারের চাকুরীর আশায়, হারানো গরুর খোঁজে, মারণ ব্যাধির নিরাময়ে মায়ের থানে মানত করে যায় । মেলা ও মহাপুজোর দিন নানাপ্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে পুজো কমিটি । স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির, বস্ত্রদান, দুঃস্থ ছাত্রদের পুস্তকদানের মত উন্নয়ন মূলক কাজও করে থাকে এই পুজো কমিটি ।
লেখা ও ছবিঃ
ইন্দিরা মুখার্জি
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে
এক দিনে ডেনমার্ক
সেদিন ছিল ২৯শে জুলাই । সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব এটাই ঠিক ছিল । তাও সেই কুঁড়েমি করে বেরোতে বেরোতে ১০টা বাজালাম । কোপেনহেগেন শহরে সেদিনটা খুব ঝলমলেও নয়, তবে বেয়াড়া একঘেয়ে বৃষ্টিও হচ্ছিল না । এরকম দিনকে ও দেশের ওয়েদার রিপর্ট-এ বলে, সানি ইনটার্ভাল্স্ ।
আমি যেখানে থাকতাম তার ঠিক পাশেই নরেব্রো ষ্টেশন । ১৩০ ক্রোনার-এর টিকেট কাটলে ডেনমার্ক-এর জিল্যান্ড দ্বীপ-এর অনেকটা অংশে সারাদিন-এর ঘুরে বেড়াবার টিকেট পাওয়া যায়, যতবার খুশি যেকোনো ট্রেনে চড়া যায় । সেরকমই একটা টিকিট আমি কেটে নিলাম । আগের দিন ইন্টারনেট ঘেঁটে অনেক খোঁজাখুঁজি করে তিনটে জায়গায় যাব বলে স্থির করে ফেলেছি । সেখানে কি ভাবে যাব, লোকাল ট্রেনের কতক্ষণ অন্তর অন্তর ছাড়ে , কি দেখার আছে , সব লিখে চোথা বানিয়ে রেখেছি । কাকতালিয় ভাবে তিনটে জায়গারই নাম 'হ' দিয়ে শুরু - হিলেরড্ , হুন্ডেস্টেড্ , হেলসিঙ্গর ।
নরেব্রো ষ্টেশন থেকে ট্রেনে চাপলাম । কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে কান্ট্রিসাইড-এর দৃশ্য শুরু হল । ঠিক যেমন আমাদের কলকাতার দক্ষিণের লোকাল ট্রেনগুলো গড়িয়া ষ্টেশন ছাড়াবার কিছু পরই গ্রাম্য দৃশ্য চোখে পড়ে । ইউরোপ-এর গ্রাম দেখতে খুব সুন্দর লাগে । আকাশে কালো মেঘ, এই বুঝি বৃষ্টি হয় হয়, আর রেললাইনের এপাশে ওপাশে চোখ জোড়ানো সবুজ চিরে ট্রেন চলেছে । এখানেও ক্ষেতের ধারে চাষীদের বাড়ি , শুধু এদেশের সঙ্গে তফাৎ - ওখানকার 'চাষী'-দের বাড়ির পাশেও BMW গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে ।
হিলেরড-এর প্রধান আকর্ষন ফ্রেডেরিক্সবর্গ কাসেল বা ফ্রেডেরিক্সবর্গ প্যালেস । হিলেরড্ ষ্টেশনে নেমে সাইনবোর্ড খুজছি কোন দিকে হাঁটতে থাকলে ফ্রেডেরিক্সবর্গ কাসেল-এর দিকে যাব । ডেনমার্ক-এর গ্রামে এমনিতেই লোকজন কম, তার ওপর রবিবারের বাজার । সাইনবোর্ড তো পেলাম, কিন্তু ভয়ঙ্করী ড্যানিশ ভাষার জ্ঞ্যান নিয়ে কিছুই পাঠোদ্ধার হচ্ছিল না ।
শেষে দেখি এক জায়গায়ে লেখা 'স্লট' , তার পাশে একটা কাসেল-এর মতন দেখতে কিছু আঁকা আর একটা দিক নির্ণয়-এর তীর চিহ্ণ । সেই রাস্তাই ধরলাম, তবে রাস্তায় কোনো লোক চোখে পড়লেই জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি ঠিক পথে যাচ্ছি কি না । অবশেষে কাসেল-এর চূড়া দেখা গেল । বেশ বড় একটা লেক, লেকের গায়েই ১৬২০ সালে তৈরী রাজপ্রাসাদ ।
লেকের জলে মিউট্ সোয়ান, ব্ল্যাক হেডেড গাল আর কমন কুট-এর ভিড় । সেখানে বাচ্চারা বাবা মা-র সঙ্গে এসে সেই পাখিদের কিসব খাওয়াচ্ছে, আর পাখিরা মহানন্দে ক্যাঁ-ক্যাঁ করতে করতে খাচ্ছে । লেকের ধার ধরে গাছের ছায়ায় ঢাকা সুন্দর রাস্তা ধরে প্রাসাদ-এর প্রবেশদ্বার । ডেনমার্ক-এর রাজবংশীয় রঙ হল সবুজ । সব প্রাসাদ বা দুর্গের চূড়ার দিকটা সবুজের ওপর সোনালী কাজ করা , বাকিটা পাথরের রং-এর । ইতিহাসে ঢুকে গেলে মন অন্যরকম হয়ে যায় , মনে হয় কত যুগ আগের এই রাজার বাসস্থান, কত ঘটনার সাক্ষি । তবে ইতিহাসে ঢুকতে গেলে কাসেল-এর ভেতর ঢুকতে হয়, আর কাসেল-এ ঢুকে দেখতে যাওয়ার প্রবেশমূল্যর দিকে চোখ পড়লে মনে হয়, সৌন্দর্য দূর থেকে উপভোগ করাই ভাল । আর ইতিহাস - বইতেই থাক !
হিলেরড-এর পালা সাঙ্গ করে এবারে এগোলাম আমার পরবর্তী গন্তব্য হুন্ডেস্টেড-এর দিকে । আকাশে মেঘ ঘনিয়েছে বেশ, কলকাতা হলে এতক্ষণে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নেমে যেত । শীতের দেশে বৃষ্টির চেয়ে মানুষ হয়তো মেঘলা আকাশই পছন্দ করে বেশি । ইউরোপ-এর আকাশ তাই বোধহয় মানুষের মনের কথা বুঝতে পেরে মেঘের সঙ্গে সখ্যতা করে রেখেছে । আবার আরেক ট্রেন, আবার নতুন মাঠ ঘাট, কোথাও বড় বড় উইন্ডমিল-এর চাকা, কখনও দূরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, কখনও সবুজ ঘাসের ওপর স্বাস্থ্যবান ঘোড়া ছুটে বেড়াচ্ছে । কিছু চেনা কিছু অচেনা দৃশ্য দেখতে দেখতে এক সময় সমুদ্রের একদম পাশে একটা ছোট্ট ষ্টেশনে ট্রেন থামল । এক ঘটা পরে আবার পরের ট্রেন আসবে, তাই আমার হাতে এক ঘন্টা রয়েছে ঘোরার জন্যে । সেই ট্রেন ধরতে না পারলে আরও এক ঘন্টা পরে পরবর্তী ট্রেন ।
হুন্ডেস্টেড হাভন
ষ্টেশনের পাশেই "হার্বার", ডেনমার্ক-এর ভাষায় "হাভ্ন্" । সারি সারি রংচং-এ নৌকা-র ভীড় । এরা সব আমাদের দেশের ট্রলার-এর মতন মাছ ধরতে যাবার বাহন । ডেনমার্ক-এ "ফিশিং" একটা প্রধান জীবিকা-র অন্যতম । জায়গাটা অদ্ভূত, ঠিক পর্যটক কেন্দ্রিক নয় । এখানে একটা পুরনো জং পড়ে যাওয়া জাহাজ, হার্বার-এ নোঙর ফেলে দাঁড় করানো । তার ওপরে উঠে তিন-চার জন মদ্যপ বীয়ার-এর ক্যান হাতে তান্ডব করছে । আমার কাছেও টাকা চেয়েছিল, আমি পাশ কাটিয়ে শুনতে বা বুঝতে না পাওয়ার ভান করে এগিয়ে গেলাম । সামনে পান্না সমুজ বল্টিক সী, তীরে পাথর ফেলে রাখা হয়েছে, সেই পাথরে বসে আবার কজন ছিপ ফেলে হাপিত্তেশ করে বসে আছে কখন মাছ বঁড়শিতে গাঁথবে । ঢেউ হয়তো থাকেই না এই সমুদ্রে, সেদিন তাও মেঘলা এবং কিঞ্চিৎ ঝোড়ো আবহাওয়ার কারনে কিছুটা জলের ওঠানামা দেখা গেল ।
হার্বার-এর পাশে একটা চমৎকার চন্দ্রাকার সমুদ্রতট । বালি দিয়ে তিনটে বাচ্চা মেয়ে সেখানে কাসেল বানাচ্ছে ।
হুন্ডেস্টেড-এর সমস্ত ঘর বাড়ি খুব রঙচঙে, তাই এই ছোট্ট জনপদ আরও সুন্দর লাগল । বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে উঁচুনিচু রাস্তায় হাঁটতে থাঁটতে সময় কেটে গেল ।
বেশী কিছু দেখা বা করার কিছু নেই, কিন্তু অল্পসময়ে ডেনমার্ক-এর আঘ্রান পেতে হলে এরকম অনামা অচেনা জায়গা-র থেকে ভাল আর কিছু হতে পারে না । ট্রেন আসার আওয়াজ শুনে পা চালিয়ে ষ্টেশনের দিকে গেলাম । হুন্ডেস্টেড-কে বিদায় জানালাম । প্রথমে ফিরে আস্তে হল হিলেরড ষ্টেশনেই, সেখান থেকে আবার ট্রেন বদল করে আমার শেষ গন্তব্য হেলসিঙ্গর-এর দিকে রওনা হলাম । ট্রেন যাচ্ছে এবার হাল্কা জঙ্গলের আলো আঁধারির মধ্যে দিয়ে । লোকজন খুব কম । পুরো ট্রেনই প্রায় ফাঁকা । বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে বেশ জোরে আর তার সঙ্গে বেশ জোরালো হাওয়া । শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেন-এর ভেতরে বসে যদিও বোঝা যায় না বাইরের আবহাওয়া, তাও গাছ গুলোকে দেখে আর ট্রেন ষ্টেশনে দাঁড়ালে যখন দরজা খুলছে তখন দমকা হাওয়ার দাপটে বোঝা যাচ্ছে বাইরে প্রকৃতি তান্ডব শুরু করেছে । এক ঘন্টা পরে একটা শহুরে যায়গা দেখতে পেলাম আর হটাৎ দেখি সমুদ্রের একদম পাশ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে । ঘড়িতে তখন ৭টা বাজে । কিন্তু ইউরোপের গ্রীষ্মে দিন থাকে রাত দশটা অব্ধি । তাই তখনও দিনের আলো যথেষ্ঠ । বৃষ্টি আগের থেকে কমলেও পুরপুরি থামেনি । হিলেরড ষ্টেশনের বাইরে সেই দুটোর সময় একটা বার্গার আর চিপ্স্ খেয়েছিলাম, তাই ক্ষিদেও পেয়েছিল । তাই একটা ছোট রেস্তোঁরায়ে বসে একটা পিজা স্যান্ডউইচ খেলাম । তারপরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে সমুদ্রের ধার দিয়ে কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে হার্বার-এর বাঁধানো রাস্তা ধরে হেঁটে চললাম সেলসিঙ্গরের প্রধান দ্রষ্টব্যের দিকে ।
শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট্ নাটকে যে এল্সিনোর রাজপ্রাসাদ-এর কথা লেখা হয়েছে, সেটা হল এই হেলসিঙ্গরের ক্রন্বর্গ কাসেল্ । ১৪২০ সালে নির্মিত এই সুবিশাল কাসেল উত্তর ইউরোপের রেনেসাঁ কাসেল-এর স্থাপত্যকর্মের অন্যতম, এবং এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকাভুক্ত । সুইডেন আর ডেনমার্ক-এর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া বল্টিক সী এই হেলসিঙ্গরে সব থেকে সঙ্কীর্ণ । হেলসিঙ্গরে দাঁড়িয়ে ওপারে স্পষ্ট দেখা যায় সুইডেন, তার বাড়ি ঘর, অনেকটা ডায়মন্ড হার্বার-এ নদীর মতন - চওড়া, কিন্ত ওপার দেখা যায় ।
ডেনমার্ক-এর হেলসিঙ্গর থেকে সুইডেন-এর হেলসিনবর্গে ক্রমাগত ফেরি চলাচল করছে । আর সে ফেরি মানে পেল্লায় জাহাজ ! একটা স্ক্যান্ডলাইন্স-এর আরেকটা এইচ,এইচ,ফেরিস-এর জাহাজ। একবার ডেনমার্ক থেকে সুইডেন, আবার সুইডেন থেকে ডেনমার্ক। ক্রন্বর্গ কাসেল্ একেবারে সমুদ্রের ঠিক ধারেই নির্মিত, সমুদ্রের দিকে তাক করে রাখা সারি সারি কামান । সমুদ্রের দিক থেকে এই দূর্গ আক্রমণ করা অসম্ভব ছিল বোঝাই যায় । সমুদ্র আর কাসেল-এর মধ্যবর্ত্তী আঁকাবাঁকা রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে থাকলে কিভাবে যে সময় চলে যায়, টেরই পাওয়া যায় না ।
বৃষ্টিও থেমে গেছিল, তাই ঠান্ডাটাও কম লাগছিল । কিন্তু ঘড়ির কাঁটা প্রায় নটা ছুঁই-ছুঁই । এবার ফিরে যেতে হবে । কাসেল থেকে বেরিয়ে ষ্টেশনে যাবার পথে দেখলাম কোপেনহেগেন-এর বিখ্যাত 'লিট্ল্ মারমেড'-এর অনুকরণে তৈরে স্টেনলেস স্টীল-এর তৈরী এক মূর্তি । স্টীল-এর তৈরী এরকম মূর্তি আমি এর আগে কোথাও দেখি নি ।
ষ্টেশন-এ যখন পৌঁছোলাম তখন কোপেনহেগেন যাবার ট্রেন ছাড়বার জন্যে প্রায় প্রস্তুত । এই ট্রেন হেলসিঙ্গর থেকে ছেড়ে কোপেনহেগেন হয়ে সমুদ্রের তলার টানেল-এর মধ্যে দিয়ে সুইডেনের মাল্মো শহরে পৌঁছোয় । আড়াই-তিন ঘন্টার সফর।
সারাদিনের ক্লান্তি তো ছিলই, তাই ট্রেনে বসে একটু চোখ লেগে আসছিল । বাইরেটা এবারে সন্ধ্যে থেকে রাত হয়ে যাচ্ছে । হেলেরুপ ষ্টেশনে নেমে যখন নরেব্রো যাবার ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছি তখন সারাদিনের কথা ভাবছিলাম । মনে হচ্ছে তিন দিনের ঘোরা একদিনে ঘুরেছি বারো ঘন্টার মধ্যে । পায়ের তলায় শর্ষেটা একটু বেশি মাত্রায়েই সক্রিয় ছিল এই দিনটায়, কিন্তু শুধু নিজের মতন করে চেনা-অচেনা ডেনমার্ক দেখার এই অদ্ভূত দিনের কথা চিরকাল মনে থেকে যাবে ।
লেখা ও ছবিঃ
ঋতম ব্যানার্জি
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন ঋতম ব্যানার্জি
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে