সিড়িঙের সমস্যা
সিড়িঙের খুব মনখারাপ। পেট চন্ চন্ করছে খিদেতে। সকাল থেকেই পেটে তেমন কিছু পড়েনি। সেই কাকভোরে পিড়িং, সিড়িঙের মা কতগুলো মাছি ধরে এনে দিয়েছিল। মরা মাছি। মাছি দিয়েই জলখাবার হয়েছে আজ। তাতে কি আর খিদে যায়? পেট টন্ টন্, কন্ কন্ করছে। পিড়িং এরও অনেকক্ষণ পাত্তা নেই। সেই কখন খাবারের যোগাড়ে গিয়েছে। এখনও ফেরেনি সে। সিড়িঙের তেমন করে খাওয়া হয়নি আজ। তাই পিড়িং পণ করেছে ছেলের জন্য খাবার এনেই একেবারে ফিরবে। কিন্তু গেছে সে অনেকক্ষন! কখন ফিরবে? সিড়িঙ খিদেতে আর পারে না যে!
গাছের ডালে বসে সিড়িঙ তাক্ করে মানুষের বাচ্চাগুলোকে। বাচ্চাগুলো চালাক হয়ে গেছে আজকাল। দূরে ঘুরছে, ফিরছে, খেলছে, হাসছে। এদিকে আসছে না একেবারেই। একবার নিম গাছের তলায় এলেই চুলের মুঠি ধরে সরাৎ করে ওপরে। তারপর কপাৎ করে জ্যান্ত গিলে ফেলা। কিন্তু কাঁহাতক্ আর এভাবে বসে থাকা যায়?
সিড়িঙের মানা আছে নিমগাছের দশ হাতের চৌহদ্দি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার। পিড়িং মানা করে গেছে। মানুষগুলো আজকাল নাকি সাহসী হয়ে গেছে। সেদিন পিড়িং ওই কোণের বাড়ি থেকে খাবার চুরি করতে গিয়েছিলো। এখন তো গোটা আস্ত মানুষ আর পাওয়া যায় না। তাই মানুষের এঁটোকাঁটা, ব্যাঙ, মাছি, মশা, মরা সাপ – এসব খেয়েই থাকতে হয়। তা সেদিন রাত্রে পিড়িং তার প্রাত্যহিক খাবারের চৌররযবৃত্তিতে গিয়ে মহা ফ্যাসাদে পড়েছিল। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে, মানুষের বাচ্চাগুলো হাঁ করে একটা কালো বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছে। বাক্সটার ভিতরে আবার লোকজন চলাফেরা করছে, কথা বলছে। পিড়িংও খাবার চুরি ভুলে গিয়ে হাঁ করে দেখছিল। দেখে বাক্সটার মধ্যে একটা সবুজ ভূত লাল চোখে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মানুষের বাচ্চারা সব আতঙ্কিত। এমন সময় কোথা থেকে একটা ঝাঁটাচুলের লোক এসে কিসব অং, বং বলতে বলতে চারদিকে ঘুরতে লাগলো আর বাচ্চা ভূতটার দিকে কিসব দানা দানা জিনিস ছূঁড়তে লাগলো। দানাগুলো ভূতটার গায়ে লাগামাত্রই পিড়িং এর চোখের সামনেই বাচ্চা ভূতটা কেমন নির্জীব হয়ে গেল। আর ঝাঁটাচুলো লোকটা ভূতটাকে একটা বোতলে পুরে ফেলে বোতলের মুখটা আটকে দিল একটা ছিপি দিয়ে। তারপর একটা মানুষের বাচ্চা বোতলে পরা ভূতটাকে টেবিলের ওপরে সাজিয়ে রাখলো। এসব দেখে শুনে পিড়িং এর চোখ গোলগোল, বুক ধরাস্ ধরাস্। পিড়িং বুঝলো ভূতে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, মানুষেরা এখন বোতলে ভূত পোষে। এসব দেখে পিড়িং মানা করেছে সিড়িঙকে নিম গাছের দশ হাতের চৌহদ্দি ছেড়ে কোথাও যেতে। একবার মানুষের কবলে পড়লে বোতলে পুরে রাখবে। কুকুর, বিড়াল, ছাগলের মত ভূতও পুষবে।
বসে বসে সিড়িঙ এসবই ভাবছিল। খিদেতে পেটের মধ্যে চুঁইচুঁই, কুঁইকুঁই। সিড়িঙের এখন এতো খিদে পেয়েছে যে গোটা দুই মানুষের বাচ্চা খেলে মনে হয় শান্তি হবে। সে তার কালো কালো সরু সরু প্যাংলা প্যাংলা পা দুটি নিয়ে ঝুপ্ করে নামলো গাছ থেকে। এখনও অন্ধকার দানা বাঁধেনি তেমন করে। জম্পেস করে চেপে বসেনি। কিন্তু সিড়িঙ মরীয়া। এখন খাবারের যোগাোড় না করলে মা নির্ঘাৎ সেই ব্যাঙাচি ভাজা নিয়েই ফিরবে। রোজ রোজ কাঁহাতক আর ব্যাঙাচি ভাজা খেতে ভালো লাগে!
খুব ভালো করে চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়েই, এক পা এক পা করে সে এগোলো। নিমগাছ থেকেই সে গন্ধ পেয়েছে। রাস্তার ধারের ওই কোণের বাড়িতে আজ খিচুড়ি আর ডিমভাজা হয়েছে। অনেকদিন আগে, মা একবার চুরি করে এনেছিল। সেদিন মা আর ছেলেতে খুব মজা করে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা খেয়েছিল। সেই স্বাদ সে এখোনও ভোলেনি। কিন্তু খানিকটা এগিয়েই সে থমকে দাঁড়ালো। দশ হাতের চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার তার মানা আছে। তাই সে একটু ইতস্তত, বিচলিত বোধ করে। কিন্তু গন্ধটা এখন আরও ঘন, আরও তীব্র, আরও লোভনীয়। সিড়িঙ পা রাখলো ধীরে ধীরে। দশ হাতের চৌহদ্দির বাইরে।
সন্তর্পণে পা ফেলে সে এগোয়। বাতাস আজ হাল্কা। ভারী নয় মোটেও। সিড়িঙ ভাবলো আজ সে ভাসবে। হাঁটবে না। তার পাগুলো তো কাঠির মতো সরু, সুতোর মতো ট্যাংলা প্যাংলা! তার হাঁটতে তাই অসুবিধে হয়। বাতাস ভারী হলে, বাধা বেশী। তখন সিড়িঙের ভাসতে অসুবিধে হয়। তখন সিড়িঙকে তার প্যাংলা প্যাংলা সূতোর মতো পাগুলো দিয়ে হাঁটতে হয়। সে মজা করে ভাসতে ভাসতে আর চলতে পারে না। আজ বাতাস হাল্কা থাকাতে সিরিঙ ভেসে মজা পাচ্ছে। সিড়িঙের ভাসতে তাই অসুবিধে হচ্ছে না কোনও। ভাসতে ভাসতে যত সে বাড়িটার কাছাকাছি যাচ্ছে, ততোই গন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সুরুৎ করে মুখে আসা জলটাকে সিড়িঙ গিলে ফেলে।
আস্তে আস্তে ভাসতে ভাসতে সে বাড়িটার একেবারে কাছাকাছি চলে এল। মার নিষেধের কথা ভুলে গেছে সে তখন। তার চোখের সামনে এখন শুধুই খিচুড়ি আর ডিমভাজা! সিড়িঙ বাড়িটার জানালা দিয়ে উঁকি দিল। সে জানে সে নিজে থেকে দেখা না দিলে তাকে দেখা যায় না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে এ বাড়ির ছোট ছেলেটি তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে খিচুড়ি আর ডিমভাজা। চাকুম্ চুকুম্, চাকুম্ চুকুম্। সলাৎ করে মুখে আসা জলটাকে টেনে নেয় সে আবার! আহ্। ব্যাঙাচি ভাজা আর খাবেই না সে আর!
সিড়িঙ তার শরীরটাকে পাতলা করে জানালা দিয়ে সুরুৎ করে ঢুকে পড়ে। খিদেতে পেটের মধ্যে চুঁইচুঁই, কুঁইকুঁই। সে ছোট ছেলেটির উল্টোদিকে তার ট্যাংলাম্যাংলা পাতলা পা দুটিকে ভাজ করে গুটিয়ে সুটিয়ে বসে। ছেলেটি টের পায় না। ভূতেদের তো আর দেখা যায় না, ইচ্ছে করে দেখা না দিলে! সিড়িঙ খেতে শুরু করে ছেলেটির পাত থেকে। সলাৎ। আহ্! কি স্বাদ! আবার নেয় সে। এবারে ছেলেটির খানিকটা যেন টনক নড়েছে। সে চোখ গোল গোল করে দেখে, সে খাওয়ার আগেই তার খাবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। সিড়িঙ ভাবলো ছেলেটি বোধহয় বেজায় ভয় পাচ্ছে। কিন্তু ভয় পাওয়া তো দূরের কথা! ছেলেটি চেঁচিয়ে তার মাকে ডাকছে। “মা, তাড়াতাড়ি এসো। আরেকটা ভূত এসেছে। শিগগীরী সর্ষেদানা আনো।“ সিড়িঙ ভাবে, আরেকটা ভূত মানে? এখানে কি খিচুড়ি, ডিমভাজার জন্য ভূতের মেলা বসে? ছেলেটির মা ছুটে আসেন, “কি হয়েছে বুবুন্?” বুবুন্ নামের ছেলেটি উত্তর না দিয়ে তার থালার দিকে মার দৄষ্টি আকর্ষণ করে। সিড়িঙের অবশ্য কোনও দৃকপাত্ নেই তাতে। সে গোগ্রাসে খাচ্ছে। বুবুনের মা ছুটে যান রান্না ঘরে। যখন ফিরে আসেন হাতে একটা ছোট বোতল। তাতে ছোট ছোট কালো কালো, গোল গোল দানা। এই বুঝি সর্ষেদানা? সিড়িঙ ভাবে মনে মনে। বুবুনের মা কৌটোটা খুলে ছড়িয়ে দিলেন বুবুনের থালার চারিপাশে। কয়েকটা দানা সিড়িঙের শরীরে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই সিড়িঙের সারা শরীর জবলতে লাগলো। সিড়িঙের খুব ঠান্ডা বোধ হতে থাকলো। সিড়িঙ গলে যেতে থাকলো। সিড়িঙ বুঝলো, ওই দানার মধ্যে এমন কিছু আছে যাতে সিড়িঙ অদৃশ্যেও গলে যাচ্ছে। আর তখনি সিড়িঙের মনটা হু হু করে উঠলো তার মা পিড়িং এর জন্য। মার মানা ছিল। সে শোনেনি। সে বুঝলো সে মরে যাচ্ছে। মরে যাওয়ার আগে তার আর মার সঙ্গে দেখা হলো না।
মিলিয়ে যেতে যেতে, গলে যেতে যেতে, সে হঠাৎই উপলদ্ধি করলো তার জায়গা আর পরিবেশ বদল হয়ে গেছে। সে শুয়ে আছে একটা পুরু নরম সরম বিছানায়। তার মুখের ওপর আরো পাঁচটা মানুষের মুখ ঝুঁকে আছে। তাদের মধ্যে কেউ একজন বললো, “ও ময়না, এতো একদম তোর মুখ রে! আবার দেখ কেমন পিট্ পিট্ করে চাইছে।“ ময়না নামের মেয়েটি তার গাল দুটো জোরে চেপে ধরে চকাস্ করে একটা চুমু খেলো। সিড়িঙের তা খুব একটা মন্দ লাগলো না। সিরিঙ তার হাতটা বাড়িয়ে ময়নাকে ছূঁতে গেল ধীরে ধীরে। কিন্তু এ কি? এ তো আর ভূতের হাত নেই! ভূতের কালো সূতোর মতো হাত আর নয়। কেমন গোল, গোল, পুরুষ্টু। নধর, নধর হাত। এ তো পুরোপুরি মানুষের বাচ্চার হাত! আর তখনই হঠাৎ খুব পরিচিত গন্ধ নাকে এলো তার। এই গন্ধ সিড়িঙের খুব চেনা! খিচুড়ি, ডিমভাজা, আর আরও কিছুর। সিড়িঙের মুখে এক চিলতে পাতলা হাসি ফুটে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে কে আবার বলে উঠলো, “ময়না রে! তোর মেয়ে তো জন্মেই হাসছে! এ কি পাকা মেয়ে রে!” ময়না নামের মেয়েটি আবারও সিড়িঙের দুই গাল চেপে চকাস্ চকাস্ করে আরো দুটো চুমু খেলো। কিন্তু সিড়িঙের ভাবনা এখন অন্যখানে! সে অপেক্ষায় আছে। খিচুড়ি ডিমভাজার জন্য। সে জানে তাকে একটু পরেই বুবুনের মতোই খিচুড়ি, ডিমভাজা দেবে তার নতুন মা, ময়না। আর সে তারিয়ে তারিয়ে খাবে। সিড়িঙের মন ভালোলাগায় ভরে উঠছিল। হঠাৎই তার চিন্তায় ছেদ পড়লো। ময়না নামের মেয়েটি কি একটা ঢুকিয়ে দিল তার মুখে! জিনিষটা খানিকটা লম্বাটে, সরু, স্বচ্ছ! তাতে সাদা রঙএর তরল পদাথ! কি বিচ্ছিরি খেতে! সেইসময় কে বললো, “ও ময়না রে! তোর মেয়ে দুধের বোতল বের করে দিল যে! ও খিচুড়ি ডিমভাজা খেতে চায়!” এতক্ষণে সিড়িঙের কান্না পেল খুব। এর থেকে তার ব্যাঙাচিভাজা অনেকই ভাল ছিল। হঠাৎই অনেকক্ষণ পর তার ভূত মা পিড়িং এর জন্য মন কেমন কেমন করে উঠলো। মানুষ মরে ভূত হয়, তা মানুষেরা জানে। কিন্তু ভূতেরাও যে মরে, মানুষের তা জানা নেই। আর তারা এটাও জানেনা, মানুষেরা কখনো যেমন জাতিস্মর হয়, ভূতেরাও কখনো কখনো মরে ভূতেস্মর হয়! সিড়িঙেরও ভূত জন্মের কথা খুব মনে আছে। চেনা গন্ধটা যতো তীব্র হচ্ছিল, পরিবেশটা ততোধিক্ অপরিচিত হয়ে উঠলো তার কাছে। হঠাৎ করেই সিড়িঙের কান্না পেল খুব। তার মা পিড়িং এর জন্য।
ঊর্মি ঘোষদস্তিদার (দত্তগুপ্ত)
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- লিখেছেন ঊর্মি ঘোষ দস্তিদার
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ঘুম নেই হরিমোহনবাবুর
ঘুম নেই হরিমোহনবাবুর চোখে। সারা পাড়া ঘুমে কাদা। কেউ জেগে নেই। শুধু এইচ এম দে ছাড়া। হরিমোহন ঘড়ি দেখলেন, রাত একটা। তিনি বাথরুম গিয়ে চোখে মুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা নিলেন। তারপর খোলা ছাদে গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ পায়চারি করলেন যদি এতে করে ঘুম আসে। কিন্তু না ঘুম আর আসে ন।
সকালে তিনি ছুটলেন ডাক্তার পাকড়াশির কাছে। হরিমোহনকে দেখে ডাক্তারবাবু বললেন, কি হরিবাবু ওষুধে কাজ দিচ্ছে? নাকি মাত্রা একটু বাড়িয়ে দেব। হরিমোহনবাবু বললেন একটু নয় ডাক্তারবাবু বেশ কড়া ডোজ দিন। ওষুধে কোন কাজ দেয়নি। কালকেও সারারাত জেগে কাটিয়েছি। ডাক্তারবাবু হরিমোহনের নাড়ি টিপলেন, চোখ দেখলেন, জিভ দেখলেন। তারপর এক সপ্তহের কড়া ডোজ দিয়ে ছেড়ে দিলেন। হরিমোহনবাবু বাড়ি ফিরে এলেন।
হরিমোহনবাবু সম্প্রতি কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। পাক্কা তেত্রিশ বছর অডিট সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত শুধু যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ-শতকরা এই নিয়ে ছিল তার কাজ কারবার। আয়ের সঙ্গে ব্যায়ের হিসেব মেলানো বড় সহজ কাজ নয়। দুটোর পাল্লা সমান করার লক্ষ্যে হরিমোহনকে সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হত। সবই তিনি করতেন নিজের হাতে। পাশে রাখা ক্যালকুলেটার মেশিনটায় ঝড় উঠত। খট খট শব্দের কোন বিরাম ছিল না। বাঁধানো মোটা রেজিস্টারের প্রতি কলমে আলাদা আলাদা হিসেব। সেই হিসেব নেমে আসে পাতার একেবারে নীচে। সেই হিসেবর জের টেনে নিয়ে যেতে হয় অন্য পাতায়। এইভাবে জের টানার কোনো ইতি নেই। এক বছরের হিসেবের জের গিয়ে ওঠে নতুন বছরের রেজিস্টারে। অফিসের রেজিস্টার বদল হলেও হরিমোহনের চেয়ার বদল হয় না কোনদিন। রুটিন মাফিক কাজ করে যান তিনি। তবে তার ফাঁকে তিনি ঘন্টা দেড়েক সুন্দর ঘুমিয়ে নেন। সেই ঘুমের স্বাদই আলাদা। অনেকটা ভাত ঘুমের মত। ছুটি হলে বাসে বা ট্রেনে হাফ-ঘুম দিতে দিতে দিব্যি বাড়ি ফিরে আসেন। হাফ-ঘুম জিনিসটা বেশ মজার। হরিমোহনবাবু হয়তো বাসে বা ট্রেনে উঠে বসার জায়গা পেলেন না, তা বলে খামতি থাকবে কেন? বাসের রড ধরে চোখ বন্ধ করে আধো জেগে দোল খেতে খেতে সুন্দর করে ঘুমানো যায়। এটাই তার হাফ-ঘুম। ড্রাইভার কোন কারণে হঠাৎ ব্রেক কষলেও হরিমোহনবাবুর হাত রডের সঙ্গে সেঁটে থাকে। হাত কখনো ঘুমোয় না। বাড়ি ফিরে তিনি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসেন। রাতের খাবার খেয়েউঠতে না উঠতে তাঁর ঘুম পেয়ে যায়। তো সেই হরিমোহনবাবুর আজ এ কি দশা! এত সুন্দর ফুলের মত নরম ঘুমটা তার জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এটা কি কম কষ্টের!
ভগীরথবাবুর বাড়িতে প্রতিদিন যে দাবার আড্ডা বসে সেটা এ পাড়ার একটা মিনি ক্লাব। ভগীরথবাবুর রাঁধুনি কাম হেল্পার ধরণী সকাল থেকে স্টোভ জ্বলিয়ে আদা দিয়ে লাল চা সাপ্লাই করে যায়। প্রথম দাবার আসর বসে সকাল আটটায়। খেলা চলে সাড়ে নটা পর্যন্ত। যাঁরা দশটা পাঁচটা অফিস করেন তাঁরা এই খেলায় অংশ নেয়। এরপর ধাপে ধাপে খেলা চলতে থাকে। হরিমোহনবাবু আগে মাঝেমধ্যে এই মিনি ক্লাবে উঁকি-ঝুঁকি মেরে গেছেন কয়েকবার। তবে এক দান যে বসে খেলেন সে সময় পাননি। আজ ভাবলেন একবার ভগীরথবাবুর বাড়ি থেকে ঘুরেই আসি।
হরিমোহনবাবুকে দেখা মাত্রই সকলে হৈ - হৈ করতে করতে দলে নিয়ে নিল। তারাশঙ্করবাবু হরিমোহনের থেকে দ-বছর আগে রিটায়ার করেছেন।তিনি বললেন, কি ভায়া এরই মধ্যে চোখের নীচে কালসিটে পড়ে গেল যে! অফিসে পাতার পর পাতা যোগ বিয়োগ করেই তো জীবন কাটিয়ে দিলেন। এবার বেশ আয়েশ করে খান আর ঘুমোন। আর মাঝ্যেমধ্যে আমাদের দর্শন দিয়ে যান। তারাশঙ্করবাবুর এই 'ঘুমোন' শব্দটা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে গেল।
লাল চা খেতে খেতে এই 'ঘুম বৃত্তান্ত' বর্ণনা করতেই সকালে দাবার চাল ভুলে তাকে নিয়েই পড়লেন। ব্যানার্জীবাবু বললেন, এ আর নতুন কথা কি? চাকরি জীবনের ইতি টানা কি সহজ কথা। একটানা কয়েক হাজার মাইল ছুটে এসে ঝট্ করে দাঁড়ানো সহজ কাজ নয়। তা একটু সময় লাগবে বৈকি। ঘুমের ব্যপার স্যাপার বোঝা অত সহজ নয়। তাকে যতই পায়ে ধরে সাধবেন ততই দূরে দূরে সরে যাবে। তার চেয়ে আমি বলি কি, একটা ফুলের বাগান করুন। মাটি কোপান, চারা বসান। বাগানের পরিচর্যা করুন। এতে শরীর ও মন দুইই ভালো থাকবে। আর মন ভালো থাকলে ঘুম যাবে কোথায়? সেও সুড় সুড় করে এসে হাজির হবে।
প্রণবেশ ভটচায একটু সেকেলে মানুষ। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় তাঁর ভরসা নেই। সব রোগের তিনি কবিরাজি ঔষধ-পথ্যের পথ বাতলে দেন। ব্যানার্জীবাবুকে মাঝপথে থামিয়ে বললেন, ঘুম আছে। ঘুম আপনার কাছে পিঠেই ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু আপনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। বায়ু-পিত্ত-কফ এই তিন প্রকার জিনিসের মধ্যে বায়ু যখন কুপিত হয় তখনই এই ঘুমের ব্যঘাত হয়। বায়ু ঘুমকে কাছে ঘেঁষতে দেয়না। এর দাওয়ই হল ভোরে উঠে ত্রিফলার জল খেয়ে এক ঘন্টা পরে এক চামচ মধু ও তুলসী পাতার রস সেবন করে থান্ডা জলে স্নান করবেন। তিন দিন পরে নিদ্রাদেবী হাজির হবেন।
বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় শৈলেন দাসের সঙ্গে দেখা। কি ভাবে যেন তাঁর ঘুম-কাহিনি তিনিও জেনে গেছেন। হরিমোহনকে চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে এক কাপ চা ধরিয়ে বললেন, ঘুমের সাথে মাথায় টাক পড়ার একটা সম্পর্ক আছে মাশাই। চুল একটা করে ঝরতে শুরু করলে দুশ্চিন্তায় ঘুম চলে যায়। তখন কেউ যদি বলেন মাথায় টাক পড়েছে কেন? তখন হয় বলতে হবে রাতে ঘুম হচ্ছেনা বলেই টাক পড়ছে অথবা টাক পড়ছে সেই চিন্তায় রাতে ঘুম হচ্ছেনা। শৈলেনবাবুর কথা শুনে হরিমোহনের মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল। তিনি মাথায় একবার হাত বুলিয়ে অবশ্য অনেকটা নিশিন্ত হলেন, কেননা টাক জিনিসটা এখনো তাঁকে দর্শন দেয়নি।
বাড়িতে বসেও কি রেহাই আছে। পাড়া-প্রতিবাশীরা ঘরে এসে ঝুড়ি ঝুড়ি উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। কি করতে হবে আর কি করা চলবেনা। তার লম্বা ফিরিস্তি শুনিয়ে যাচ্ছে। দুপুরে ভাত খেয়ে যেই একটু নিদ্রা দেবীর আরাধনায় বসবেন অমনি ভুপেন চক্কোতি এসে হাজির। বললেন, কি হে হরিমোহন, তুমি কি দিবা-নিদ্রার আয়োজন করছো নাকি? ভুলেও ও পথে যেও না যেন। তাহলে সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারবেনা। তারচে সারাদিন হাওয়া খেয়ে আর গল্প গুজব করে কাটানই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এই সব উপদেশ শুনে হরিমোহনবাবুর কান পচে গেছে। তিনি আর পেরে উঠছেন না। এরপর যেদিকে দু-চোখ যায় তিনি চলে যাবেন। তার ঘুম হচ্ছে না বলে পাড়া পড়শিদেরও ঘুম হচ্ছেনা এমন তো নয়। তারা তো বেশ খাচ্ছে দাচ্ছে, হরিমোহনকে দেখতে পেলেই ঘুম-বিষয়ক বিস্তর আলোচনায় ডুবে যাচ্ছে আর রাতে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে।
তো হরিমোহনবাবু সত্যি চললেন। কোথায় চলেছেন নিজেও জানেননা। লোকালয় ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে ছোট্ট একটা নদী। নদীর উপর বাঁশ দিয়ে তৈরি একটা সাঁকো। হরিমোহন সাঁকোটা পেরিয়ে গেলেন। তারপর একটা গাছের নীচে বসে পড়লেন। সূর্য্য অনেকখানি পশ্চিমে ঢলেছে। বকের ঝাঁক ইংরাজির 'ভি' আকার নিয়ে পূব দিকে উড়ে যাচ্ছে। এক একটা ঝাঁকে অনেকগুলো করে বক থাকছে। রোদ পেয়ে বকের ডানা ঝিকমিক করে উঠছে। হরিমোহন প্রতিটি ঝাঁকে মোট ক-টি বক থাকছে তার হিসেব করতে লাগলেন। প্রথম ঝাঁকে মোট চৌদ্দটা বক ছিল। ঝাঁকটা দূরে মিলিয়ে যেতেই আবার এক ঝাঁক বক উড়ে এল। তিনি দ্রুত গতিতে গুনতে লাগলেন এক-দুই-তিন। মোট এগারোটি। চৌদ্দ আর এগারোর যোগ করলেন মোট পঁচিশ। যোগটা শেষ করতে না করতেই এক সঙ্গে দু-ঝাঁক বক হাজির। এই বুঝি হিসেবে ভুল হয়ে গেল। কিন্তু না, তিনি চোখ চালিয়ে সব কটাকে পাকড়াও করলেন। একটাও পালাতে পারল না। তারপর পঁচিশের সঙ্গে যোগ করে মোট বকের সংখ্যা কত হল তার হিসেব কষতে না কষতেই তাঁর মস্ত একটা হাই উঠল। তবে হাইটা তাঁর নিজের হলেও তিনি সেটা খেয়াল করলেননা। পঁচিশের পাঁচ আর উনিশের নয় যোগ করলে ডান দিকে বসল চার আর হাতে থাকে এক...। ব্যাস অঙ্কের দাওয়াই সোজা ধাক্কা মারল হরিমোহনের ব্রহ্ম তালুতে। মগজ থেকে ঘুমের বার্তা এসে গেল দ-চোখের পাতায়। তিনি ঘাড় কাত করে ঘুমে কাত হয়ে পড়লেন। ঠিক যেমনটি এতদিন অফিসের চেয়ারে বসে ঘন্টা দেড়েক সুখ-নিদ্রায় মগ্ন হয়ে যেতেন তেমনটি। হরিমোহনের মাথার উপর দিয়ে অনেক বক উড়ে যাচ্ছিল। তবে সে সবের হিসেব রাখার মত আর কেউ ছিল না।
তরুণ কুমার সরখেল
আমডিহা, পুরুলিয়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন তরুণ কুমার সরখেল
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
চাঁদু
--‘চাঁদু,তোর খিদে পেয়েছে?’ঘরের গিন্নীমা চাঁদুকে ডেকে বললেন। অমনি চাঁদু মুখ কাঁদু কাঁদু করে মুখটা একবার ওপরে ওঠাল, একবার নিচে নামাল, তার মানে,হ্যাঁ,ওর খিদে পেয়েছে।
গিন্নীমা ওর রকম সকম দেখে হাসে,তারপর ঘরের ভিতর থেকে দুটো পাকা কলা এনে তার একটা চাঁদুর হাতে দেন।ও সঙ্গে সঙ্গে কলা ধরে নেয়,তারপর সেটা ছুলে খেয়ে ফেলে।
--‘আর একটা খাবি চাঁদু?’আবার গৃহিণী মা প্রশ্ন করেন।
আমার চাঁদু তেমনি আগের মত মাথা নাড়িয়ে ওঠে। গৃহিণীর হাতের কলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
ইচ্ছে করেই গিন্নীমা নিজের হাতে কলাটা ধরে থাকেন--চাঁদু কি করে,দেখবেন বলে।
না,চাঁদু বাঁদরামো করল না--লাফাল না,ঝাঁপাল না—গিন্নীমার দিকে এগোল না--কলাটা নেবে বলে।এখনো কেন দিচ্ছেন না--এ ধরণের কোন প্রতিবাদই ও করল না।শুধু মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কলার দিকে তাকাতে লাগল।অবশেষে গিন্নীমা ওর কাছে এসে ওর হাতে কলা তুলে দিলেন--ওর গলায়,মাথায় আদর করে দিলেন।চাঁদু আদর খেতে খেতে মুহূর্তের মধ্যে কলা ছুলে মুখে পুরে দিল।
--‘দুষ্টু কোথাকার,আমার আদরের বাঁদর!’বলে চাঁদুকে খানিক আদর করে নিজের কাজে অন্য ঘরে চলে গেলেন।
রবিবার গৃহ কর্তার ছুটি,মনে হয় সে দিন চাঁদুরও যেন ছুটি!স্কুলের যেমন ছুটি হয় সপ্তাহে এক দিন ঠিক তেমনি যেন ওরও ছুটি।ওর গলায় সে দিন চামড়ার বেল্ট কিম্বা অন্য কোন কিছুর বন্ধন থাকে না।সুবিধা,অসুবিধা সব ঘরের কর্তাই সামলে নেন। চাঁদু দুষ্টুমি বিশেষ একটা করে না,ঘরের বাইরে বেরোবার বিশেষ কোন প্রচেষ্টা ওর মধ্যে নেই।কর্তা সময়ে সময়ে ওর খবর নিয়ে যান,কখনো হয় তো জিগ্যেস করেন,‘কেমন আছিস চাঁদু--চাঙ্গা তো?’
--‘হু,হু’,ধরণের শব্দ করে ওঠে চাঁদু।কর্তাবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে।আর তাঁকে ঘিরে এপাশ ওপাশ ঘুরতে থাকে।কর্তা ওকে সপ্তাহে দু,তিন দিন স্নান করিয়ে দেন।অনেক সময় সাবান,শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করে ও।না,তাতে কোন আপত্তি নেই তার--দিব্বি কল তলায় দাঁড়িয়ে গায়ে জল নেয়।আর কর্তার দিকে মিটি মিটি তাকাতে থাকে।ওকে দেখলে বোঝা যায় যে ও স্নান করে বেশ মজা পাচ্ছে!
ঘরে কর্তা,গিন্নী--দু জনের সংসার।না,এমনি বলাটা ঠিক হল না।আসলে তিন জনের সংসার--চাঁদুর কথা বাদ দিলে চলবে কেন?কেউ তো নেই,কোন সন্তান হল না তাঁদের ঘরে।দুটি প্রাণী মিলে বাস করতেন--কর্তা আর গিন্নী।বহু দিন যাবত এমনি চলছিল।
এক দিন হল কি—তখন ঠিক দুপুর বেলা--কর্তার ঘরে আসার সময় হয় হয়।এমনি সময় তিনি অফিস থেকে ঘরে লাঞ্চ নিতে আসেন।সবে মাত্র বাইরে থেকে ঘরের বারান্দায় পা দিয়েছেন, এমনি সময় ঘরের ছাদে খ্যাঁক, খ্যাঁক,ধূপধাপ,সে সঙ্গে হুপ,হুপ শব্দ হতে লাগলো। বোঝা গেলো যে বাঁদরের দল এসেছে,ওরাই এমনি উধম করে চলেছে।ওদের উপদ্রবে ঘরের ছাদে কিছুটি শুকোতে দেবার জো নেই--কিছু না হোক কাপড় চোপর তো মেলতেই হয়।সে দিন বাঁদরের চিল্লামিল্লি ওঁদের ছাদেই যেন বেশী ঠেকছিল!
কর্তা ঘরে ঢুকলেন।বাঁদরের চেঁচামেচি শুনে তিনি ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন,তাঁর স্ত্রীর সাড়ি নিয়ে ওগুলো টানাটানি করে চলেছে!তিনি তাড়াতাড়ি গিন্নীকে ডেকে বললেন,‘কি গো! আমি ছাদে যাচ্ছি--দেখলাম তোমার সাড়ি নিয়ে বাঁদরেরা টানাটানি করছে!’
--‘সে কি!সাড়ি আবার খাবার জিনিস নাকি?’গিন্নী উতলা হোয়ে বলে উঠলেন।ঠিক এমনি সময় তার সাড়ি ধুপ,সামান্য শব্দ করে নিচে এসে পড়ল।গৃহিণী ছুটে গেলেন সাড়ি আনতে।কিন্তু এ কি!সাড়িতে কি যেন প্যাঁচিয়ে আছে না?কেমন যেন নাড়াচাড়া হচ্ছে সেটা!সাড়ির কাছে গিয়ে চীত্কার করে উঠলেন তিনি।চীত্কার শুনে তাড়াতাড়ি কর্তা,‘কি হল,কি হল?’বলে ছুটে এলেন।ওরা উভয়ে বিস্ময়ে হতবাক। বাঁদরের একটা খুব ছোট্ট বাচ্চা সাড়িতে প্যাঁচিয়ে রয়েছে--ওটা এত প্যাঁচিয়ে গেছে সাড়ির সঙ্গে যে বেচারা কোন রকম নাড়াচাড়া বা মুখ খুলে জোরে শব্দ পর্যন্ত করতে পারছে না!
বাঁদরের বাচ্চাটা খুব ছোট।দেখলে মনে হয় দু তিন দিনের বাচ্চা--গায়ে লোম পর্যন্ত ভালো ভাবে গজায় নি!খুব রোগা লিকলিকে--একেবারে মানুষের সন্তানের মত মনে হচ্ছিল ওটাকে!
কর্তা,গিন্নী বাচ্চাকে সাড়ি প্যাঁচানো অবস্থাতেই ঘরে নিয়ে এলেন।এ দিকে ছাদের ওপর বান্দরদের লাফালাফি দাপাদাপি সে সঙ্গে চীৎকার চেঁচামেচি সমানে চলছে।মনে হল সাড়ি প্যাঁচানো বাঁদরের বাচ্চাকে নিয়েই যত গণ্ডগোল।কিন্তু সাড়ি প্যাঁচিয়ে,সমস্ত শরীর জড়িয়ে বাচ্চা যে নিচে পড়ে গেছে তা হয়তো ওদের দল বুঝতে পারেনি।তাই ওদের এই হল্লাগুল্লা কেবল ছাদ ঘিরেই।এর মধ্যে বোঝা যাচ্ছিল একটা বাঁদর শুধু এ ছাদ থেকে ও ছাদ বিনা বাক্যব্যয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছিল।ও নিশ্চয়ই ওর বাচ্চাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।আর এদিকে দু দলে ঝগড়া চলছিল-- কে জানে ঠিক কি নিয়ে ঝগড়া!এ দিকে বাঁদরের কুট্টি বাচ্চাটা কিন্তু বেশী একটা ছটফট করছিল না।কর্তা ধীরে ধীরে ওর শরীর থেকে সাড়ির প্যাঁচ খুলে ওকে মুক্ত করলেন।বেচারা ব্যথা পেয়েছে নিশ্চয়!চুপচাপ অবশের মত শুয়ে আছে।আর জুলজুল করে তাকিয়ে আছে।কর্তার শুরুতে মনে হোয়ে ছিল,মরে যাবে না তো!মাথায় বড় আঘাত লাগে নি তো ওর?
--‘ও বাঁচবে তো?ও চুপ করে শুয়ে আছে কেন?’গিন্নী মা ভয়ে ভয়ে বলে উঠলেন।
কর্তা বাবু হাত নিয়ে গেলেন বাচ্চার সামনে,শুরুতে ও দু বার হাঁ করল,বোধ হয় কর্তাকে ভয় দেখাতে চাইল।তারপর বাচ্চাটা কি সুন্দর ভাবে নিজের হাত দুটো দিয়ে কর্তার হাত চেপে ধরল।আনন্দে কর্তা বলে উঠলেন,‘না গো, ভালো আছে,দেখো আমার হাত কেমন সুন্দর করে ধরেছে?’তাই দেখে গিন্নীও তাঁর হাত বাড়ালেন। ওমা,কর্তার হাত ছেড়ে দিয়ে এবার দু হাত বাড়িয়ে ও গিন্নীমার হাত চেপে ধরল।
বাচ্চাটা কেন যেন মানুষকে ভয় পাচ্ছিল না।ও এত ছোট বলে হয় তো--মানুষ আর বাঁদর জাতির প্রভেদ এখনো জানে না!
ব্যাস,তারপর থেকেই বাঁদরের বাচ্চা থেকে গেলো এই বাড়িতে।ওর বাঁদর মা অবশ্য এ দিকে কয়েক বার এসে ছিল,খুঁজেছিল বাড়ির আশপাশে,এমন কি ঘরের ভেতরেও অনেকবার উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে ছিল,কিন্তু বাচ্চাকে পাবে কি করে ?কর্তা বাবু,গিন্নীমা তখন বাচ্চাকে লুকিয়ে রেখে ছিলেন ওর মার থেকে আড়াল করে।
ওঁরা ওকে নিজের বাচ্চার মত পালতে লাগলেন।ওর নাম রাখা হল,চাঁদু।চাঁদু মানুষের মতই বড় হতে লাগলো।ওর জন্যে ফিডিং বোতল,দুধ সব কিছুর ব্যবস্থা হোয়ে ছিল।ও মানুষের মত ভাত, তরিতরকারি,এমন কি মাছ,মাংস পর্যন্ত খেত।তবে প্রকৃতির নিয়ম হিসাবে ও ফল খুব ভালো বাসতো--বিশেষ করে পাকা কলা,পাকা কলা ছিল ওর সবচে প্রিয় বস্তু।
দু চারটে কথাও চাঁদু মানুষের মত বলার চেষ্টা করত,যেমন ‘হ্যাঁ’,কে ‘হু’,বলত।মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ,না, জানাত।'কে'বলে কলার কথা বুঝাতো—‘ভা,দা’,বলে ভাত আর ডালের কথা বলতো।
বলতে গেলে চাঁদুই এ বাড়ির সন্তান হোয়ে গেছিলো।
ছোট থাকতেই ওর জন্যে জামা,প্যান্ট তৈরি করে পরানো হতো।ও বেশ দিব্বি ও গুলি পরে ঘরে ঘুরে ফিরে বেড়াত।ওকে বাইরে বিশেষ একটা যেতে দেওয়া হতো না।কারণ অন্য বাঁদরেরা দেখলে ওকে মারতে পারে বা ও বাঁদরের দলে মিশেও তো যাতে পারে!তা ছাড়া বাইরে আছে কুকুরের দল—ওরা তো ওকে ধরার জন্যে যেন ওত পেতে থাকে।
চাঁদুকে যদি বলা হতো, ‘বাবা,একটু নাচ দেখাও তো!’ও ‘নাচ’ শব্দ বুঝে নিত পারত।টিভিতে দেখা নাচের ভঙ্গী নিয়ে নাচার চেষ্টা করত।আশপাশের ছেলে মেয়েরাও ওকে দেখতে আসত।ওর সঙ্গে খেলা করার চেষ্টা করতো।ও কাউকে কোন দিন মারে নি—খেঁচ,খেঁচ,করে ধমক দিত--রেগে গেলে কেবল হাত তুলে থাপ্পড়ের মত দেখাত।
সেই বাচ্চা চাঁদু আজ ঘরের খুব আদরের।এখন আর ও বাচ্চা নেই।অনেক বড় হোয়ে গেছে।সব সময় ওকে ছেড়ে রাখা যায় না।গলায় লাগা থাকে তার দামী চামড়ার বেল্ট,তাতে লাগানো ঝকঝকে কারুকাজ করা রূপালি প্লেট!খায় ও থালা গ্লাসে,শোয় রীতিমত ভালো চাদর পাতা বিছানার খাটে।নিয়ম মত খাওয়া,পরা, স্নান করতে ও ভালোবাসে।কর্তা বাবু, গিন্নী মার আদর তো ও রোজ পায়--আর কি চাই ওর!
এমনি এক দিনের কথা--চাঁদুর ভাগ্যে নেমে এলো মহা বিপর্যয়।ক দিনের জ্বর,অসুখে হঠাৎ গিন্নী মা মারা গেলেন।চাঁদুর মুখ লটকে গেল--ও ‘গুঁ,গুঁ’ আওয়াজ করে কাঁদতে লাগলো।ঘরের আশপাশের লোকেরা দেখল,ও কাঁদছে--ওর চোখ ভরা জল!কর্তা বাবুও চাঁদুকে ধরে কাঁদছিলেন।চাঁদু বার বার ঘুরে ঘুরে ওর গিন্নী মার মৃত দেহের কাছে আসছিল,তাঁর দেহের ঢাকা সাদা চাদর সরিয়ে দিচ্ছিল।করুণ ভাবে তাকিয়ে ছিল গিন্নী মায়ের মৃত মুখের দিকে !
হঠাৎ গিন্নী মা কি ভাবে মারা গেলেন?সন্দেহের বশে কর্তা বাবুর ঘরে পুলিশ এলো।কর্তা বাবুকে সন্দেহ করে পুলিশ থানায় নিয়ে গেলো।
চাঁদু তখন ঘরে একা!জানলার শিকে ও শিকলে বাঁধা।বেচারাকে কে দেবে খেতে!ও এক দিন না খেয়ে থাকলো।পাড়ার লোকেরা ওকে খাবার দিয়ে গেলো।ও কিছুই খেলো না।আশপাশের বাচ্চারা ওকে কলা এনে দিলো।ও সামান্য মুখে ছুঁইয়ে ফেলে দিলো।দিন ভর বিষণ্ণ হোয়ে,মাথা নিচু করে বসে থাকলো চাঁদু।
এমনি ভাবে আরও দুটো দিন কেটে গেলো।গৃহকর্তা তখনও জেলে।সন্দেহের ঘেরায় তখনও তিনি পুলিশ হাজতে।তিনি হাতজোড় করে পুলিশ অফিসারকে অনুরোধ করলেন,‘স্যার, আমার ঘরে আমার চাঁদু একা আছে—ও খুব দুঃখ পেয়েছে। শুনলাম তিন দিন ধরে ও কিছুই খায় নি।দয়া করে আমায় কিছু সময়ের জন্যে যদি একবার ঘরে যেতে দেন!’
পুলিশ অফিসার জানতে চাইলেন,‘চাঁদু আপনার ছেলে নাকি?’
--‘হ্যাঁ,না,মানে,ছেলের মতই’,কর্তা বাবু সামান্য ইতস্তত করে বলে উঠলেন।
--‘ছেলের মতই মানে?’ পুলিশ সন্দেহের সুর টেনে বলে উঠলেন।
--‘স্যার,ও একটা বাঁদর,ওকে ছোট্ট বেলা থেকে আমরা মানুষ করেছি।’কর্তা বললেন।
--‘বাঁদর!আপনাদের ছেলে!’বিদ্রূপের সুর বেরিয়ে এলো পুলিশের মুখ থেকে।
পুলিশের লোক পর দিন কর্তাকে নিয়ে তাঁর ঘরে গেলেন।চাঁদু তাঁর খাটে শুয়ে আছে--মনে হল নিশ্চিতে ও ঘুমিয়ে আছে।পুলিশরা ওকে এমনি মানুষের মত ধুপদুরস্ত বিছানাতে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেল।
--‘চাঁদু,চাঁদু,বাবা!’কর্তা বাবু তাড়াতাড়ি চাঁদুকে ডেকে উঠলেন।
চাঁদু তেমনি ভাবেই শুয়ে রইল।
কর্তা বাবু ওর গায়ে ধাক্কা দিয়ে আবার ডেকে উঠলেন, ‘বাবা, চাঁদু! চাঁদু!!...’
চাঁদু আর উঠলো না--ওর ঘুম আর ভাঙ্গল না--ও তো চির দিনের মত ঘুমিয়ে পড়েছে!
কর্তা,‘চাঁদু,চাঁদু,বলে আকাশ ফাটা চীত্কার করে উঠলেন।
পুলিশের লোকেরাও তখন ঘরের এক কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।
তাপসকিরণ রায়স
জবলপুর, মধ্যপ্রদেশ
- বিস্তারিত
- লিখেছেন তাপস কিরণ রায়
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
কি মুশকিল!
মাত্র আট বছরের বিনুর মাথায় এতরকমের দুষ্টুবুদ্ধি আসে কি করে, এ এক রহস্য। কোনদিন রাস্তার ধারে বাদামভাজা খুঞ্চাওয়ালার খুঞ্চাটা উল্টে দিল, কোনদিন স্কুলে যাবার পথে মুচির মাথায় এক চাঁটি কশিয়ে দিল। কোনদিন বা রামবাবুদের বাড়ীর সদর দরজায় জলবিয়োগ করে দিল। সেদিন পরেশবাবুর বাড়ীর নতুন চুনকাম করা দেওয়ালে নামতা লিখে এলো। আর একদিন ক্ষেন্তিপিসির ছাগলটাকে খোঁটা থেকে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলো, সন্ধে পর্যন্ত পিসি ছাগল খুঁজে হয়রান। এইরকম কোন না কোন একটা গন্ডগোল না করে বিনু থাকতে পারতো না। আর বাড়ীতে দিদির প্র্যাকটিক্যাল খাতায় মুরগী এঁকে রাখা, ছোটোকাকার গিলে করা পাঞ্জাবীতে কাদা মাখা হাত মুছে রাখা, বিধবা পিসিমার গঙ্গাজলের পাত্রে ময়দার লেই ঢেলে রাখা, মায়ের রেসিপির বইয়ের পাতা ছিঁড়ে নৌকো বানানো, এসব তো লেগেই আছে।
বিনু যে সর্বদা জেনেশুনে দুষ্টুমি করতো, তা কিন্তু নয়। সম্পূর্ণ নির্দোষ আনন্দের জন্যে করা ছোট ছোট ব্যাপারগুলোও বড়দের এতো অসুবিধের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কি করে, তা বিনু আজ অবধি বুঝে ওঠেনি। অনেক সময়ে বুদ্ধি করে বড়দের উপকার করতে গিয়েও সে উল্টো ফল পেয়েছে।
যেমন সেবারের ঘটনাটা। প্রচন্ড গরম পড়েছে। সন্ধ্যার সময় বিনুর কানে গেল মা গজগজ করছে, 'ধিঙ্গি মেয়ের কান্ড দেখো! বালিশটা একটু রোদ দেখিয়েই তুলে নিতে বলেছিলাম। তা নবাবনন্দিনীর আর সারাদিনে সময় হল না সেটা তুলে আনার। এখন এই উপজ্বলন্ত বালিশ রাত পর্যন্ত আর ঠাণ্ডা হবে? আর কোনকালে যে আক্কেল হবে কে জানে বাবা।'
বিনু জানে মায়ের রাগটা দিদির উদ্দেশ্যে। বালিশ রোদ দেখিয়ে তুলতে ভুলে গেছে। হুঁ, দিদির আবার কান্ডজ্ঞান। কিন্তু একটা ব্যবস্থা তো করা দরকার। তাই খানিক বাদে কলতলায় এক বালতি জলে চোবানো বালিশটা পাওয়া গেল। আর তাইতেই আবার মাকে গলা তুলতে হল, এবার বিনুর উদ্দেশ্যে। সেইসঙ্গে চুলের মুঠি ধরে টেনে পিঠে গুমগুম করে দুটো কিল। বিনু ঠিক বুঝতে পারল না ভালো করতে গিয়েও কেন এই ফল হল। সে তো বালিশটা ঠাণ্ডাই করতে চেয়েছিল। কে না জানে জলে ডোবালে গরম জিনিষ ঠাণ্ডা হয়।
কিলকে তেমন আমল দেয় না বিনু। কিন্তু মায়ের এই চুল ধরে নাড়ার অব্যেশটা তার একদম পছন্দ নয়। আজ আবার নাড়াটা একটু জোরেই হয়ে গেছে, এখনও চুলের গোড়াগুলো চিনচিন করছে। এইরকম সময়ে বিনুর সতুজ্যাঠার কথা মনে পড়ে যায়। মাথাজোড়া টাক, দিব্যি দিলখোলা মানুষ। বাবা একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'সতুদা, তোমার যে এই মাথাজোড়া টাক, কোন অসুবিধে হয় না?' সতুজ্যাঠা বেশ মজার মানুষ, উত্তর দিলেন, 'অসুবিধে আর কি? শুধু মুখ ধোবার সময়ে বুঝতে পারি না কত পর্যন্ত ধুতে হবে।' সেই সতুজ্যাঠা প্রায়ই বলেন, 'ভগবান আমার একটা কথা অন্তত শুনেছেন। ইস্কুলে পন্ডিতমশাই যখন চুলের মুঠি ধরে নাড়া দিতেন, মনে মনে বলতাম, চুলগুলো নিয়ে নাও ভগবান। তা সে মনস্কামনা আমার আজ পূরন হয়েছে।' মায়ের হাতে চুলনাড়া খেয়ে বিনুরও সেইরকমই মনে হয়, আহা, যদি চুলগুলো না থাকতো। কিন্তু সতুজ্যাঠার টাকমাথা মুখটা ভেবে ভগবানকে আর সেটা জানায় না।
তারপর এই তো পরশুর কথাই ধরা যাক। কি দোষ ছিল বিনুর, যে সন্ধেবেলায় হঠাৎ সেজোকাকা তার ওপর অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো? আগের দিনে কেনা কাকার নতুন পেনটায় নাকি লেখা যাচ্ছে না। আরে বাবা, তাতে বিনু কি করবে? সারা দুপুর সে ওই পেন দিয়ে চিলেকোঠার দেওয়ালে ছবি এঁকেছে, কোনো সমস্যা তো ছিল না তখন। হ্যাঁ, শেষদিকে একটু অসুবিধে হচ্ছিল বটে, কিন্তু একটু চেপে ঘসে ঘসে আঁকতে দিব্যি কাজ চলে গেছে। সেই কথা বলতেই সারা বাড়ী মাথায় করে সেজোকাকা যা একখানা কান্ড করলো, তার ঠেলায় মা আবার তাকে সতুজ্যাঠার কথা মনে করিয়ে দিল।
শুধু বাড়ীতেই নয়, স্কুলেও সেদিন মিস তাকে সারাক্ষণ কান ধরে বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে রেখে দিল। বিনু কিন্তু টিচারের ভালো করতেই গিয়েছিল। হয়েছে কি, ক্লাসের সবচেয়ে বিচ্ছু ছেলে রাজু (এটা বিনুর মত, টিচারদের মতে এই খেতাবটা বিনু ছাড়া আর কারো হতে পারে না) টিচারের চেয়ারের বসবার জায়গায় বেশ ক'টা পিন খাড়া করে আটকে দিয়েছে। বল, এটা ভালো কাজ? টিচার তার ওপর বসতেই যাচ্ছিল, ঠিক সময়মতো চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে বিনু যে কি অপরাধ করলো বুঝতেই পারল না। হ্যাঁ, উলটে পড়ে টিচারের খোঁপা-টোপা খুলে দেওয়ালে মাথা ঠুকে আলু হল বটে, কিন্তু বিনু চেয়ারটা না সরিয়ে নিলে পিনগুলো তো টিচারের, ইয়ে, ওইখানে ফুটত কি না?
বাড়ী ফিরেও নিস্তার নেই, রাজু এসে মা'র কাছে স্কুলের কথা লাগিয়েছে। কানমলা দিয়ে মা বললেন, 'বল, আর কি কি করেছিস?' মা'কে কি করে বোঝায় বিনু যে, যদিও রাজুকে এক থাপ্পড় কষিয়ে বা টিচারের দিকে চকের টুকরো ছুঁড়ে তার শোধ নেওয়া উচিত ছিল। সে ইচ্ছে যে তার হয় নি, তাও নয়। কিন্তু কান ধরে সারাক্ষণ বেঞ্চির ওপর দাঁড়িয়ে থাকায় সে এসব কিছুই করতে পারে নি।
এইরকমই চলছিল। বিনুর বাবা ও মা পাড়াপড়শির নালিশ শুনতে শুনতে পাগল হবার যোগাড়। অপিস থেকে ফিরেই প্রায়ই বিনুর বাবাকে শুনতে হতো ছেলের সেদিনের কোন এক অভিনব কীর্তি। রাগের মাথায় মাঝেমধ্যেই তুলোধোনা করতেন বিনুকে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, তাতে বিনুর কোন বিকার হতো না। পরদিন আবার আর এক নতুন কীর্তির জন্যে আবার মার পড়ত। শেষাশেষি এমন হয়ে দাঁড়ালো, বিনুর বাবা বাড়ী ফিরেই দুচার হাত চড়চাপড় বসিয়ে দিতেন। তারপর জানতে চাইতেন, বিনু সেদিন কিছু করেছে কিনা। তাই ইদানীং বাবার বাড়ী আসার সময়ে বিনু ধারে কাছে বড় একটা থাকতো না।
সেদিন কিন্তু বিনুর সত্যিই কোন দোষ ছিল না। দোষ সম্পূর্ণ জুডোর, মানে বিনুর আহ্লাদী কুকুর, যে বিনুর প্রায় সবরকম দুষ্কর্মের সঙ্গী। সকাল থেকে মৌসুমি বৃষ্টির ধারাশ্রাবণ নেমেছিল। পথেঘাটে জলকাদা। বেলা পড়ে আসার সাথে বৃষ্টির তেজ কিছু কমেছিল। পুরো থামে নি, ঝিরঝির করে পড়ছিল। বিনুর পড়ায় মন বসছিল না, বাইরেও বেরোতে পারছিল না। বাড়ীর মধ্যে আর নতুন কি করা যায় মাথায় আসছিল না। একটু আগেই অবশ্য দয়ালকে মাথায় গোবর জলের বালতি নিয়ে উঠোন দিয়ে যেতে দেখেও অনেক কষ্টে গুলতি মেরে বালতিটা ফেলে দেবার লোভ সামলেছে। কেলেঙ্কারীটা একটু বেশী হয়ে যেতো। দাওয়ায় বসে ভাবছিল, এমন নিরালা দুপুরটা বেকার যাচ্ছে। রান্নাঘরের পেছনের বাগানে জ্যাঠাইমার লাগানো কচি ভিন্ডি গাছগুলোয় ছোট ছোট ভিন্ডি ধরেছে। চুপচাপ বসে না থেকে, দৌড়ে গিয়ে ওগুলোয় কাস্তের গোটাকয়েক কোপ বসিয়ে আসা যায় কিনা ভাবছিল, এমন সময় চোখে পড়ল জুডো মুখে করে জলকাদা মাখা একটা মরা খরগোশ নিয়ে এদিকেই আসছে।
সব্বোনাশ, এ নির্ঘাত পটলাদের বাড়ী থেকে মেরে এনেছে। পটলার বাবা নীহারকাকার খরগোশ আছে অনেকগুলো। একাজের জন্যে যদিও জুডোকে মোটেই ওস্কায় নি বিনু, কিন্তু সে জানে সন্দেহটা অবধারিতভাবে তার ওপরেই পড়বে। নীহারকাকা বাবার খুব বন্ধু, তাঁকে চটালে ফল যে খুব ভালো হবে না তাও বিলক্ষণ জানা। মনে মনে ভাবছিল কি করা যায়, ততক্ষণে জুডো খরগোশটাকে বিনুর পায়ের কাছে এনে ফেলে ল্যাজ নাড়তে লাগলো। যেন ভারি ভালো কাজ একটা করেছে। এধরনের কাজ করলে সাধারণত বিনুর প্রশংসাই পেয়ে থাকে জুডো। আজ কিন্তু ঠিক সেরকমটা হল না। জুডোকে একটা চাপা ধমক লাগিয়ে বিনু তাড়াতাড়ি খরগোশটাকে বৃষ্টির জলেই ভালো করে ধুয়ে নিল। তারপর পা টিপে টিপে গিয়ে পটলাদের বাড়ী গিয়ে ওটাকে রেখে এলো, যেখানে আর সব খরগোশগুলো ছিল। পেছন ফিরে একবার দেখে নিল, নাঃ, কেউ দেখতে পায় নি। আর বিপদ নেই। খরগোশটাকে দেখলে মনে হবে ঘুমোচ্ছে। যখন জানা যাবে ওটা মরে গেছে, তখন আর বিনুর ওপর সন্দেহ করার কিছু থাকবে না।
বাড়ী আসতেই বৃষ্টিতে ভেজবার জন্যে মা খানিকটা বকাবকি করল, তাতে তেমন আমল দিল না বিনু। চুপচাপ একটা বই খুলে বসে গেল। ছেলের হঠাৎ পড়ায় মন বসেছে দেখে মা'ও আর কিছু বললেন না।
সন্ধের সময়ে বাবা ফিরে মা'কে বললেন, 'আজ বিনু আবার কোন কান্ড করে নি তো? মোড়ের মাথায় নীহার একটা অদ্ভুত কথা বললে।'
শঙ্কিত বিনুর কান খাড়া হয়ে উঠল। হঠাৎ কেমন যেন নিরাপত্তার অভাব বোধ করল। বাড়ী থেকে পালিয়ে রাজুদের বাড়ী খানিকক্ষণ কাটিয়ে আসা যায় কিনা ভাবছিল, শুনতে পেল বাবা মা'কে বলছে, 'নীহারদের একটা খরগোশ কাল রাতে মারা গিয়েছিল। ওরা সেটাকে বাড়ীর পেছনে মাটিচাপা দিয়েছিল। আজ নাকি কে সেটাকে মাটি খুঁড়ে বার করে সাফসাফাই করে আবার তাদের বাড়ীতে রেখে গেছে!'
সূর্যনাথ ভট্টাচার্য
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সূর্যনাথ ভট্টাচার্য
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
কলিযুগের রামায়্ণ
নন্দীনগর পাড়ায় এক নাট্য প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়েছে। এ পাড়ার ছেলেরা যে নাটকটি মঞ্চস্থ করতে চলেছে তার নাম " কলিযুগের রামায়্ণ " ,বর্তমান সমাজের চিত্রপটে আঁকা এক অনবদ্য কাহিনী। এতে রাবণ সীতাকে হরণের পর রামের কাছে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দাবী করে মুক্তি পণের জন্য । দরিদ্র বনবাসী রাম চিন্তায় পাথর, ভাই ভরতকে টাকাটা জোগাড় করতে বলায় সে রামকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে রাজকোষে অত টাকা নেই, মন্দার বাজার, প্রজারা সময় মতো খাজনাও দেয় না । বনের ফল মূল খেয়ে কোনোমতে তারা দিন কাটায় এ হেন অবস্থায় পঞ্চাশ লক্ষ !! হনুমান এক যুক্তি দেয়, গন্ধমদন পর্বতের গায়ে নাকি একরকম গাছ পাওয়া যায় যার পাতার রস ছিটিয়ে দিলে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়, রাবণপুত্র ইন্দ্রজিতকে যদি ঐভাবে অজ্ঞান করে নিয়ে আসা যায় তাহলে মুক্তিপণ হিসাবে সীতা ও আরও পঞ্চাশ লক্ষ টাকা চাইলে দারিদ্রও ঘোচে আর সীতাকেও ফিরে পাওয়া যায় । এইরকম এক পালার জন্য ভীড় হবারই কথা । এ পাড়া, ও পাড়া, সব পাড়ার লোক মিলে সে যেনো এক জনসমুদ্র। রাবণের ভূমিকায় পাড়ার নাম করা বদরাগী বিশ্বনাথ কুন্ডু, হনুমানের ভূমিকায় পাড়ার কুস্তি চ্যাম্পিয়ন বীরেশ্বর মোদক আর রামের ভূমিকায় পাড়ার শুটকো অচিন সামন্ত , যাকে এক চড় মারলে আর এক চড় মারার আর জায়গা থাকে না। পালা শুরু হল। বেশ ভালোই চলছিল সব কিছু , কিন্তু হনুমান এক কাণ্ড করে বসল । রাবণ ও ইন্দ্রজিত একটা ঘরে ঘুমোচ্ছে , স্টেজের আলো নেভানো, হনুমান ইন্দ্রজিতের জায়গায় রাবণকে তুলে নিয়ে এলো রাম ও লক্ষণের কাছে। বিশ্বনাথ কুন্ডুর তখন রাগে সর্বশরীর জ্বলছে । সে নাটক ফাটক সব ভুলে এক বিরাশি শিক্কার চড় মারতে গেল হনুমানকে, আর সেই চড় পিছলে এসে পড়ল রামের গালে। শুটকো অচিন সামন্ত ওখানেই ধরাশায়ী, অজ্ঞান, কলিযুগের রামায়ণের ওখানেই যবনিকা পতন। এরপর শুটকো অচিনকে নিয়ে হাসপাতাল... প্রায় যমে মানুষে টানাটানি, তবে যমরাজ কোনো ঝামেলা করেন নি, সুস্থ হয়ে অচিন পরদিনই বাড়ি ফিরে এসেছিল| নাট্য প্রতিযোগীতার ফলাফল? সেটা নিশ্চয়ই আর তোমাদের বলে দিতে হবে না!
নীনা ঘোষ দস্তিদার
খড়্গপুর
- বিস্তারিত
- লিখেছেন নীনা ঘোষদস্তিদার
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প