পাপাঙ্গুল আর অনিফিশ -পর্ব ৪
ফুরফুরে হাওয়ায় খুশির রেশ নিয়ে অনিফিশ ঘুমিয়ে পড়েছিল পাপাঙ্গুলের হোগলা পাতার ছাউনি দেওয়া ঘরে। ভোরের একটা মিষ্টি নরম আলো এসে পড়েছে সেই অনিফিশের সোনালি পাখনার ওপর। চারিদিকে একটা নতুনের গন্ধ। নতুন দিন। নতুন বছর।। কাল পাপাঙ্গুলের দেশের লোকেরা সারা রাত ধরে অনেক আনন্দ উৎসব করে অনিফিশকে নিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে। এটাই পাপাঙ্গুলের দেশের নিয়ম। এরা ছেলে-বুড়ো কচি-কাঁচা সব্বাই একসাথে সেই দুরের টিলার কাছে যায় নতুন বছরকে স্বাগাত জানাতে। যে যেমনটি পারে নাচ-গান করে একসাথে মজা করে সারা রাত ধরে। পরদিন সক্কাল বেলা সবাই নতুন সবুজ হোগলা পাতায় তাদের ঘর ছায়, উঠোনে নানান রঙের ছবি আঁকে। সবাই নতুন পালক দিয়ে সাজে, আর আনেক খাওয়া দাওয়া, আনন্দ করে।
অনিফিশ তার সোনালি পাখনায় একটা ছোট্ট আড়মোড়া ভেঙ্গে তাকাল পাপাঙ্গুলের দিকে। সে দেখে পাপাঙ্গুল তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। হাতে তার একটা সবুজ রঙের খাতা। সেটাই পাপাঙ্গুল খুব সুন্দর একটা ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখছে। অনিফিশ একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে পাপাঙ্গুলের পাশে এসে খাতাটার দিকে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে বলে “পাপাঙ্গুল এটা কি?”
পাপাঙ্গুল বলে, "সুপ্রভাত অনিফিশ। কাল তোমার ঘুমোতে আনেক দেরি হয়ে গেছিল তাই আর তারাতারি তোমাকে ডাকিনি। কাল ঘুম কেমন হল, পাপাঙ্গুলের এই ছোট্ট হোগলা পাতার ঘরে?"
অনিফিশ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল "যাহ্ কি যে বল তুমি পাপাঙ্গুল , আমি তো আনেক দিন বাদে এমন সুন্দর একটা রাত কাটালাম কাল রাত্রে। আমি যে কি খুশি হয়েছি তোমার দেশে এসে কি বলবো। এমন সুন্দর নির্ভেজাল ভালবাসার দেশ আমি আগে কখন দেখিনি।"
পাপাঙ্গুল হেসে বলল "দেখবে দেখবে। দেখার কি আর শেষ আছে বন্ধু? কত দেশ, কত মানুষ, কত অজানা জিনিস, এসব দেখব বলেই তো ছাঁকনি চরে দেশ ছেড়ে দেশে বিদেশে ঘোরা। ঘরে থাকতে আমার একটুও ভাললাগে না অনিফিশ...জীবনটা কত ছোটো বলো। এইটুকু জীবনে কত কি দেখার জানার আছে বাকি।"
পাপাঙ্গুলে দেখে অনিফিশ তার ছোট পাখনাটা দিয়ে পাপাঙ্গুলের সবুজ খাতায় নরম করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পাপাঙ্গুল বলল –"অনিফিশ তুমি জিজ্ঞেস করছিলে না এটা কি?...এইটা আমার দিনলিপির খাতা। যখন যেখানে যা দেখি, আমার ভাললাগা খারাপ লাগার কথা, আমার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, আমি এই খাতায় লিখে রাখি রোজ। অবশ্য সত্যি বলতে রোজ লিখতে পারিনা। তবে যখন যেমন সময় পাই আমি এই খাতা খুলে বসি। বলতে পার এটা পাপাঙ্গুলের বন্ধু - তোমারই মতো। খুব কাছের বন্ধু।"
অনিফিশ তো কোন দিন দিনলিপির কথা শোনেনি, তাই সে ভারি খুশি হল পাপাঙ্গুলের কথা শুনে। সে ভাবল সত্যি তো, এ তো ভারী ভাল জিনিস। এভাবে যদি কেউ সব কথা লিখে রাখে দিনলিপিতে তাহলে মাঝে-মধ্যে গল্পের মত এই খাতা পরে খুব ভাল লাগবে। এই ভেবে সে আনন্দে একটা ছোট্ট ডিগবাজি খেয়ে নিল । অনিফিশ তো এমনি অল্পে খুশি, অল্পে দুখী, মনের মাঝে কিছু চেপে রাখতে পারে না। শরীরটার মত মনটাও সোনালি আর নরম। অনিফিশ পাপাঙ্গুলকে বলল, “আচ্ছা অনিফিশ আমি এবার একটু সাঁতার কেটে আসি।” তোমাদের তো আগেই বলেছি সাঁতার কাটা অনিফিশের শখ। তা ছারা অনিফিশ তো জলের দেশের প্রাণী, তাই জল ছাড়া সে বেশীক্ষণ থাকতে পারে না, মন খারাপ করে।
তাই সে সাগরপারে চলে গেল একটু সাঁতার কাটতে। পাপাঙ্গুলের ঘর থেকে সমুদ্র বেশি দূরে নয়, তাই তার পথ চিনতে কোন অসুবিধা হলনা। এদিকে পাপাঙ্গুল ঘোরের বশে ভাবছিল অনিফিশকে কি দাওয়াত খাউয়াবে। অনিফিশ তার দেশের অতিথি বলে কথা। কাল তো না হয় ডাকপুলি খেয়ে সবারই পেট ভর্তি ছিল। যেই না এসব ভাবতে ভাবতে সে ঘর থেকে বেরিয়েছে, দেখে কয়েক জন পাপাঙ্গুল দিদি এসেছে। সাথে চটপটি দাদু। চটপটি দাদু তো পাপাঙ্গুলের দেশের সবচেয়ে বড়। দাদুকে পাপাঙ্গুলের দেশের সবাই খুব ভালবাসে আর মানে। তাই তারা সব কাজে দাদুর অনুমতি নেয়। তো সেই চটপটি দাদু বলল – "পাপাঙ্গুল আজ আমার বাড়িতে তোমার আর অনিফিশের দাওয়াত। আজ আমরা সবাই মিলে একসাথে খাব। তোমাকে তাই সকাল সকাল বলতে এলাম।" এই কথা তা শুনে পাপাঙ্গুলের মন তো খুশিতে ভরে উঠল। চোখের কোণে এক চিলতে জল। পাপাঙ্গুল বুঝে পেল না দাদু কে কি বলবে। মাঝে মাঝে এমনও হয় যখন সব কথা গলার কাছে এসে আটকে যায়, খুশির আবেগে। কিভাবে একজন আর একজনের না বলা কথা বুঝে যায়, ভালবাসায় সবাই বুঝি এভাবেই একে অন্যকে কাছে টেনে নেয়। নাহলে কত বছর সে দেশছাড়া, সে কি ভেবেছিল এতো বছর পর দেশে ফিরে তাকে সবাই এমনি করে আপন করে নেবে? এভাবে আবার আদর-ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে! পাপাঙ্গুল মুখে কিছু বলতে পারল না খালি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
অনিফিশ সমুদ্রের নিল জল দেখে খুশীতে নেচে উঠল। পারের থেকে তাই লম্বা একটা লাফ দিয়ে পরল অনেক দূরের নিল জলে। আঃ! কি আরাম! অনিফিশ তার পাখনাটা এদিক-ওদিক করে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটল জলে। কিছুক্ষণ পড়ে বাইরে আওয়াজ শুনে মাথা তুলতে দেখে একদঙ্গল বাচ্ছা পাপাঙ্গুলের ছানা হুল্লোর করতে করতে আসছে সমুদ্রের দিকে। কালকে এই ছোট্ট ছানাগুলোই তো ওকে ঘিরে নাচ করছিল। অনিফিশ সাঁতরে পারে এসে ডাক দিল তাদের। অনিফিশকে দেখে তারা তো হই-হই করতে করতে এলো অনিফিশের কাছে। অনিফিশ বলল - "তোমরাও বুঝি সাঁতার কাটতে এসেছ?" ওদের মধ্যে একজন বলল "আমরা তো প্রায়ই আসি সমুদ্রে। তবে, আজ এসেছি আনন্দ-স্নান করতে। মানে নতুন বছরের প্রথম দিনে আমরা সবাই এক সাথে সমুদ্রে স্নান করে নতুন জামা পড়ে বড়দের নমস্কার করে আসি। তারপর আজ তো ভীষণ মজা। তুমি জান না? আজ দুপুরে আমাদের সবার চটপটি দাদুর বাড়িতে দাওয়াত। তুমিও তো যাবে সেখানে।" এই শুনে অনিফিস বেজায় খুশি হয়ে চোখ বড় করে বলল - "সত্যি?" তখন সবাই মিলে বলে উঠল - "সত্যি...সত্যি...সত্যি। আহা আলঙ্গুশ...আহা আলঙ্গুশ...আজকে মোদের মেজাজ বড় খুশ।"
অনন্যা দত্ত
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অনন্যা দত্ত
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ভীতু ছোটনের গল্প
বুবুন আর ছোটনের খুব মজা এবার বড়োদিনের ছুটিতে। দিন ছয়েকের জন্যে পুরী যাচ্ছে যে মা বাবার সঙ্গে। ছোটনের তো পুরী মনেই নেই, সমুদ্রও নয়। সেই কোন ছোটবেলায় গিয়েছিল, দু আড়াই বছর বয়েসে আর তখন নাকি ঢেউ দেখে খুব ভয় পেয়েছিল, নামতেই চায় নি, ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছিল নাকি। ছোটন এখন ক্লাস ওয়ানে উঠে গেছে অথচ ওর দাদা বুবুন এখনো ওকে ওই কথা বলে ভীতু ভীতু বলে খেপায়। আসলে সাত বছরের বড়ো তো, তাই ভাইকে একদম পাত্তাই দেয় না। এবার তাই ছোটন ভেবেই এসেছে ও অনেকক্ষণ ধরে সমুদ্রে চান করে দেখিয়ে দেবে যে ও মোটেই ভীতু নয়।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অদিতি ভট্টাচার্য্য
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
টুনটুনি ও দিদিমণি
টুনটুনির বড় আফসোস। তার গলার গান আছে, কিন্তু সুর নেই। এত গান আছে যে সময়-অসময়ে কারণে ছাড়াই সে সব সোডার মত ভুস-ভুসিয়ে বেরিয়ে আসে, কিন্তু সব সময় সুর-তাল-লয় ঠিক হয় না। টুনটুনি বোঝে ভুল হচ্ছে, কিন্তু ভুলগুলো যে কেউ ধরিয়ে দিয়ে ভালো করা গান শেখাবে, সে হওয়ার জো নেই। হবেই বা কি করে, তার বাড়ির লোক যে কবে কোথায় চলে গেছে। তারা থাকলে হয়তো বলতে পারত - তাদের বংশে কেউ কোনদিন গান আদৌ গাইত কিনা! তবে গান শিখতে না পারলেও সে দিন রাত গুনগুন করে চলে। সেরকম ভালো করে সুর খেলে না, তবু না গাইলে সুর আসবেই বা কি করে?
সুর কি তা না বুঝলেও টুনটুনি এইটুকু বোঝে যে সুরের তারিফ আছে। শুনেছে যে ঠিক ঠিক সুর লাগলে নাকি আগুন জ্বলে ওঠে, ঝড় ওঠে – এমনকি সূর্য ঢেকে যায়। কোনও পাখি সেরকম সুরে গাইতে পারে কিনা সে জানে না – কারণ আশে পাশে পাখি বলতে হয় কাক, নয় চড়াই, নয় ঘুঘু। তাদের গলার স্বর যেন। এদিকে দোয়েল, বুলবুলি, খঞ্জনা – এরা সব কোথায় যেন চলে গেছে। তবু টুনটুনি আশায় থাকে – যদি তার গান-টান শুনে অন্তত: যদি একটা ফুল-টুল ফোটে, কিংবা কেউ যদি তারিফ টারিফ করে। তাই তার চেষ্টার কোন কমতি নেই।
সেরকমই একদিন বিকেলবেলায় এক পেয়ারা গাছে বসে সে একটু গান গাওয়ার চেষ্টা করছিল – “টুন-টুনাটুন টুন ; করছে গুন গুন, যদি ফোটে একটা ফুল, নয়তো”
ঠিক এমন সময় ওপরের ডালে বসে থাকা এক হতচ্ছাড়া, ময়লা, বেআক্কেলে কাক হেঁড়ে গলায় বললে, “কি রে টুনটুনি, পেটব্যথা হয়েছে বুঝি? কতবার বলি যা হজম হয় না – তা খাস নে। ওরে তুই কি কাক নাকি?”
টুনটুনি একবার মিনমিন করে বলার চেষ্টা করল, “পেটব্যথা হয় নি, গান গাইছিলাম”
এই বলে কাক বিশ্রী গলায় হেসে বললে – “ও আবার গান নাকি? গান হচ্ছে গিয়ে এইরকম।” এই বলে সে তারস্বরে হেঁড়ে গলায় গান ধরলে – “লারে লারে লা লা, ! কাক ডাকে কা কা।”
কাকের কথা শুনে রাগে, অপমানে কুঁকড়ে গেল টুনটুনি। এই কাকেশ্বর এখানেই এসে প্রত্যেক দিন বসে থাকে – আর কিছু না কিছু বলে টুনটুনিকে উত্যক্ত করে। আজকের ঘটনার পর সে মনে মনে ঠিক করল, আর নয় – এবার সে পাড়া বদলে চলেই যাবে অন্য কোন পাড়ায়। ওরকম কাকের মত শ্রোতা থাকলে আর যাই হোক না কেন, কোনদিনও গান শেখা হবে না।
তাই বলে চাইলেই তো পাড়া বদলানো যায় না – তাতে নানাধরনের সমস্যা। আজকাল আবার গাছের সংখ্যা খুব কমে গেছে চারদিকে। আর যে কটা গাছ কোনও রকমে টিকে আছে, তাতে হয় ডাল-প্যালা খুব কম – নইলে অন্য কোন না কোন পাখির বাসা। খড় কুটোও আজকাল খুব ভালো আর পাওয়া যায় না। একটা বাসা করার মত গাছ পেলেই তো হল না – পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে গানের বুঝদার চাই। এটা হয় তো ওটা হয় না। ওটা হয় তো এটা হয় না। টুনটুনি কি আর করে; মনের দুঃখে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকল। একদিন কাকেশ্বর বলেই ফেলল, “কিরে টুনি, আজকাল তো আর চেঁচাচ্ছিস না দেখি। আমার গানটা কেমন? শিখবি নাকি?” এই বলে সে আবার মহানন্দে গান ধরে,
“কাকের আছে দুটি পা,
যথা ইচ্ছা তথা যা
কাক ডাকে কাকা
মন খুলে গান গা”
টুনটুনি কোন রকমে পালিয়ে বাঁচে। হঠাৎ একদিন তার মনে হল গাছে না থেকে একটা বাড়ি দেখে বাসা বাঁধলে কেমন হয়? পাখিদের মধ্যে গানের বুঝদার থাকুক বা না থাকুক, মানুষের মধ্যে তো থাকবেই – তারা টিভিতে গান শোনে, রেডিওতে শোনে। এর মধ্যে সমস্যা হল গেরস্তের বাড়ি বাসা বাঁধতে গেলে, তারা আবার ভেঙে দেয় অনেক সময়। কিন্তু তাও অনেক খুঁজে একটা আস্তানার সন্ধান পেল সে – একটা পুরনো বাড়ির দোতলায় একটা লম্বা বারান্দা। কিন্তু পেলেই তো আর হল না – অনেক গৃহস্থ বাড়িতেই পাখির বাসা দেখলে ভেঙে দেয়। তাই আরও কয়েকদিন নজর রাখতে হল। সেই বাড়ির দোতলায় লোক থাকলেও দেখা গেল, তারা কেউ সেই বারান্দায় বড় একটা যায় না। কেউ কাপড়ও শুকোতে দেয় না। কাজেই বিপদ কম। অনেক ভেবে চিনতে সেই বারান্দাতেই বাসা বাঁধল টুনটুনি।
এদিকে সেই বাড়িতে থাকতো এক ছোট্ট মেয়ে - তার নাম তুলি। তুলিকে দেখতে খুব মিষ্টি। সবাই তাকে ভালোবাসে, স্কুলে তার অনেক বন্ধু, সে ছবি আঁকতে ভালোবাসে। শুধু তার একটাই দুঃখ – সে একেবারেই গান গাইতে চায় না, আর ওদিকে মা তাকে জোর করে গান শেখাবেই। সপ্তাহে দু’দিন সন্ধেবেলায় এক জাঁদরেল দিদিমণি তাকে গান শেখাতে আসে। যে দিনগুলো গানের দিদির আসার কথা থাকে, সেদিন ভাবতে ভাবতে তার কানের কাছটা লাল হয়ে আসে দুঃখে। এমন নয় যে দিদিমণি তাকে কান মলে দেয় গান গাইতে না পারলে, তবু জোর করে গান শিখতে বসতে হবে ভাবলে দুঃখ যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। দুপুরবেলায় যখন বাবা-মা বাড়ি থাকে না, তখন ইস্কুল থেকে ফিরে সে বারান্দায় বসে তার দুঃখের কথা ভাবে।
সেদিন ইস্কুল থেকে ফিরে স্নান খাওয়া সেরে তুলি যখন বারান্দায় এল – ততক্ষণে টুনটুনি এসে তার বাসা বেঁধে ফেলেছে। তুলি তো তাই দেখে অবাক। আগে তো কখনও কোন পাখি এসে তাদের বাড়িতে আগে কোন পাখি বাসা বাঁধে নি। আর বাড়িতেই বা কেন – তুলি আগে কখনই কোন পাখির বাসা দেখেনি – কেবল বইতে পড়েছে বাবুই পাখি বাসা করে। সে অবাক চোখে টুনটুনির ছোট্ট বাসার দিকে তাকিয়ে রইল। কোথা থেকে যেন ডাল-পালা, শুকনো পাতা নিয়ে এসে বাসাটা তৈরি হয়েছে – কিন্তু কি করে ডাল প্যালা একসঙ্গে জুড়ে ঘরের মত হয়েছে, সেটাই বোঝা যাচ্ছিল না। টুনটুনি তখন খাবারের সন্ধানে বাইরে গিয়েছে। সে যখন ফিরল তখন দেখে তুলি অবাক চোখে তার বাসার দিকে চেয়ে বসে আছে। তুলিকে দেখেই টুনটুনির মায়া পড়ে গেল – ‘আহা কি মিষ্টি মেয়েটা’। দেখে আনন্দের তার বুক ভরে গান ভেসে উঠল –
“ধিন তা ধিন ধিন তা – সঙ্গী হল একটা – কথা বলে গান গেয়ে – কাটবে দারুণ দিন’টা”
তাই শুনে তুলি অবাক – ‘কি আশ্চর্য, ঐটুকু ছোট্ট পাখি, ও আবার গানও গাইতে পারে?’ আনন্দে আটখানা হয়ে সে হাততালি দিয়ে উঠল। টুনটুনি আগে কাউকে তার গানে হাততালি দিতে শোনেনি। সে একটু লজ্জা পেয়ে গেল।
তুলি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জিজ্ঞেস করলে – “তুমি গান গাও?”
টুনটুনি তখনও বোঝেনি যে তুলি ঠাট্টা করছে কি না। বিশেষ করে কাকের প্রতি চেপে রাখা অভিমানে সে বলে উঠল, “সে তো সব পাখিই গায়। এমনকি কাকও”
তুলি আরও অবাক হয়ে বললে, “বল কি? কাকও? কই শুনে তো কখনও মনে হয় না?”
টুনটুনি তার দুঃখের কথা মন খুলে তুলিকে বললে। তুলিও তাই শুনে তাস সব কথা টুনটুনিকে বললো। আর বলার পরেই তার মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি খেলে গেল। কেমন হয় যদি টুনটুনি তার বদলে দিদিমণির কাছে গান শিখে নেয়? টুনটুনিকে বলতেই সেও দারুণ খুশি হল। এটাই তো সে চেয়ে এসেছে এতদিন। আর এখন এত বড় সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? যেমন কথা তেমন কাজ। প্রথম আলাপেই তুলি আর টুনটুনি খুব বন্ধু হয়ে গেল।
সেদিন সন্ধেবেলায় গানের দিদিমণি আসতেই তুলি মহা আনন্দে হাসতে হাসতে এসে হাজির। দিদিমণি ভারিক্কী মানুষ। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা খুব হাসিখুশি থাকুক – এটা তাঁর একেবারেই পছন্দ নয়। হাসিখুশি হলেই তো আর সম্মান থাকে না, ভয় থাকে না। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “এত হাসি কিসের তুলি?”
“জানো তো দিদিমণি – আজকে না আমার একটা বন্ধুও তোমার কাছে গান শিখতে আসবে”
দিদিমণি অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন, “তোমার আবার কোন বন্ধু গান শিখতে আসবে?”
“টুনটুনি”
“টুনটুনি - সে আবার কে? না না ওসব হবে না। খালি ফাঁকিবাজি করার ফন্দী না? আমি আরেকজনকে গান শেখাতে শুরু করলে তোমার খুব সুবিধে হয় তাই না? ওসব চলবে না – নাও গান ধর”, এই বলে তিনি হারমোনিয়াম ধরে টানা শুরু করলেন।
তুলি একবার মিনমিন করে বলার চেষ্টা করল যে, “টুনটুনি একটা পাখি”, কিন্তু তার গলা দিয়ে একটুও আওয়াজ বেরল না।
সামনে গানের খাতা ফরফর করে উড়ছে। তুলির চোখ ফেটে জল আসছিল। সে একবার ঢোক গিলে বলার চেষ্টা করেছিল যে সে ফাঁকি দিতে চায় না। তার বন্ধু কেবল গান শিখতে চায় – সে কাউকে বিরক্ত করবে না। কিন্তু ভয়ে আর সেটুকুও বলতে পারল না। চোখে জল দেখে দিদিমণি আরও একটু বকে, আরও কিছু গান, সরগম খাতায় লিখে উঠে পড়লেন। ছিঁচকাঁদুনে বাচ্চাকাচ্চাও তাঁর একদম সহ্য হয় না। যাদের গান শেখার ইচ্ছেই নেই, তাদের বাড়ির লোকজনও যে কেন জোর করে কে জানে।
সব শুনে টুনটুনিরও খুব খারাপ লাগল। সে ভেবেছিল এই প্রথম একজন গানের গুরু পাবে – যার কাছে সে সত্যিই গান শিখতে পারবে। দুঃখে তার বুক ফেটে গান বেরোতে লাগল –
“না না না না / গান শেখা আর হল না
টুনির আবার গাইবে কবে/ সা রে গা মা”
তখন প্রায় রাত হয়ে গেছে। তুলিকে তুলির মা খেতে ডেকে নিয়ে গেছে। টুনটুনিই কেবল মনের দুঃখে গান গাইছিল। এমন সময়ে দেখল গাঢ় ছায়ার মত কি একটা এসে যেন বারান্দার পাশে এসে বসল। টুনটুনি ভয়ে ভয়ে সেদিকে তাকিয়েছে এমন সময় সেই ছায়াটা খুব পরিচিত গলায় বলে উঠল – “আরে টুনি যে?”
টুনিও পালটা অবাক হয়ে বলে, “কাকেশ্বর’দা, তুমি?”
কাকেশ্বর বললে, “সন্ধ্যে থেকে জিরিয়ে এই আবার একটু ঘুরতে বেরিয়েছি, এমন সময় মনে হল টুনির গান শুনতে পাচ্ছি যেন। তোকে তো কদিন ধরে দেখতে পাচ্ছি না। তাই খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে তোকে দেখতে পেলাম”
টুনটুনির গান নিয়ে কাকেশ্বর চিরকাল ঠাট্টাই করে এসেছে। সেই তার কাছে এই কথা শুনে টুনি আরও অবাক হল – “তুমি যে বল আমি গাইলে নাকি পেটে ব্যথার চেঁচানোর মত লাগে – আজকে সেই তুমিই বলছ যে আমার গান শুনে আমাকে খুঁজে পেয়েছ?”
কাক হেসে জবাব দিলে, “আরে সে তো তোকে রাগানোর জন্য কত কিছুই বলতাম। তা তোর এত দুঃখ কিসের?”
টুনটুনি এক করে সব খুলে বলল। নিজের কথা বাদ দিয়ে অবশ্য, মুখের ওপর তো আর কাউকে বলতে পারে না তোমার জন্য পেয়ারা গাছ ছেড়ে চলে এসেছি।
কাকেশ্বর গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে উত্তর দিল, “আরে দূর – এ বার কোন ব্যাপার নাকি। তুইও যেমন! গান শিখতে কি আর ওরকম ভারিক্কী দিদিমণি লাগে নাকি? সে তোর যা দু-একটা ভুল হয়, সে সব আমিই শিখিয়ে দেব। তুই এখন ঘুমোগে যা। বাকি সব আমি সামলে নেব।”
যদিও কাকের ওপর টুনটুনির একদমই ভরসা ছিল না। তবু সে দুঃখের কথা বলতে পেরে একটু আরাম বোধ করছিল। তাই সে বাসায় ফিরে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা সময় ঘুমিয়েই পড়ল।
এরপর কয়েকদিন কেটে গেছে। তুলি সকালবেলায় উঠে টুনটুনির সঙ্গে গল্প করে, ইস্কুলে গেলে টুনটুনি গিয়ে তার জানলার পাশে বসে থাকে – আবার বাড়ি ফিরেও তাদের গল্প শেষ হয় না। এই গল্প করতে করতে দু একটা ছোট ছোট গানও তুলি শিখে নিয়েছে টুনটুনির কাছ থেকে। তার খেয়াল হয়নি যে গানের দিদিমণি আর আসছেন না। ব্যাপারটা টুনটুনিও এক রকম ভুলেই গেছে।
এমন সময় একদিন সকালে তুলির বাবা তুলিকে ডেকে বললেন, “শোন তুলি, তোকে একটা কথা বলা হয়নি। তোর গানের দিদিমণি আর আসতে পারবেন না বলেছেন।”
শুনে ভয়ে তুলির বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল, ‘এই রে, উনি আবার বাবার কাছে নালিশ করেন নি তো?’ তাও সে জিজ্ঞেস করল, “কেন বাবা?”
“আর বলিস না – সে এক অদ্ভুত কাণ্ড। আমাকে ফোন করে বললেন যে উনি নাকি আর কাউকে গান শেখাবেন না। কেন জিজ্ঞেস করতে বললেন – দুনিয়ার কাক নাকি গিয়ে ওনার দরজা জানলা সর্বত্র ভিড় করছে আর গান শেখাতে বলছে। প্রথম কদিন এরকম চলার পর ঘুঘু, হাঁড়িচাচা, ছাতারে – যত বিচ্ছিরি গলার পাখি আছে সব – এমনকি রাতে নাকি প্যাঁচাও। ওনার মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে কিনা কে জানে। আমিও ভাবলাম ওরকম ছিটিয়াল দিদিমণির কাছে তোর গান শেখার আর কোন দরকার নেই”
কোন রকমে হাসি তুলি বাবার সামনে থেকে এক ছুটে চলে এল বারান্দায় – তারপর তার হাসি আর দেখে কে। সেই হাসিতে যোগ দিল টুনটুনিও। কাকেশ্বরের ওপর তার আর কোন রাগ নেই।
কদিন পর থেকে একজন নতুন অল্পবয়সী দিদি এল তুলিকে গান শেখাতে। সেই দিদিটা খুব মিষ্টি, সব সময় হেসে কথা বলে। তুলি আর টুনটুনি সমান আগ্রহে গান শিখতে লাগল। শুধু দুঃখ একটাই কাকেশ্বর মাঝে মাঝে এসে ভুল ধরে দিয়ে যায়। তবে তাতে কারও খুব একটা রাগ হয় না।
অভ্র পাল
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অভ্র পাল
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প