অনেকদিন পরে আবার, প্রকৃতিকে নিয়ে গল্প করার জন্য, তোমার কাছে ফিরে এলাম।
আমরা প্রকৃতিমায়ের কোলে বসবাস করি। প্রকৃতির নিয়মগুলি আমাদের সবার মনে রেখে এবং সম্মান করে চলা উচিৎ। প্রকৃতিকে ঠিকভাবে না বুঝতে পারলে তার সাথে সংঘাত বাধবে, আর সেই সংঘাতের ফলে, মানুষ এবং প্রকৃতি, দুইয়েরই ধ্বংস অনিবার্য।
মাস খানেক আগে, গত ২৫শে এপ্রিল, ২০১৫, ভারতের প্রতিবেশি দেশ নেপাল সম্মুখীন হয়েছিল এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের, যার জেরে অন্তত ৮০০০ জন মানুষ মারা গেছেন, আরো অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে, নষ্ট হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। সেই ভূমিকম্পের জেরে কেঁপে উঠেছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলও, এবং নানা জায়গায় অব মিলিয়ে মারা গেছেন প্রায় ৫০ জন মানুষ। সাথে সাথেই কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশ এবং চীনের কিছু অঞ্চলও। এই ভূমিকম্পের 'আফটারশক'-এ পর পর আরো ঘন ঘন কয়েকদিন কেঁপে উঠেছিল নেপাল। একেকটি আফটারশকের মাত্রা ছিল প্রায় একটি আসল ভূমিকম্পের সমান। আর মাত্রকয়েকদিন আগে, ১২ই মে, আবার একটি বেশ বড়সড় ভূমিকম্প হয় নেপালে। এবারের রিখটার স্কেলের তীব্রতার পরিমাপ ছিল ৭.৩। যদিও এইদিনের কম্পনকে বলা হচ্ছে এপ্রিল মাসের কম্পনের আফটারশক, কিন্তু এটি ছিল প্রায় একটি আসল ভূমিকম্পের মতই তীব্র। এবং এর ফলে নিহত হন আরো অনেক মানুষ। আবার কেঁপে ওঠে ভারতের এবং আশেপাশের দেশগুলির বেশ কিছু অঞ্চল। ভূমিকম্পের ভয়ে ঘরবাড়ি-অফিস ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে অসংখ্য মানুষ। ওদিকে নেপালে তো বেশিরভাগ মানুষ রাস্তাতে বা তাঁবু আশ্রয় করে দিন কাটাচ্ছেন। এই দ্বিতীয় ভূমিকম্পের পরে সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তা ঘাট আরো বেশি করে নষ্ট হয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব মানুষ উদ্ধারকাজে গেছেন, তাঁরাও ভালভাবে কাজ করতে পারছেন না।
আজ, আমি তোমাকে, ভূমিকম্প কেন হয়, সেই নিয়ে গল্প করব। কিছু কিছু বিষয় একটু কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু সেগুলিকে না বললে পুরোটা বলা হবে না।
এটা তো জান যে, পৃথিবী ওপর থেকে ভেতর অবধি বিভিন্ন স্তর নিয়ে তৈরি। একদম ওপরে স্তরটিকে বলা হয় ভূ-ত্বক (crust)। একদম ভেতরের অংশটিকে বলা হয় ভূ-মজ্জা (core)। আর এই দুইয়ের মাঝখানের অংশটি ম্যান্টেল (mantle) নামে পরিচিত। ভূ-ত্বক বা crust তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল বিভিন্ন প্লেট দিয়ে। এই প্লেটগুলি সর্বদাই একে অপরের গায়ে ঘষাঘষি করছে, এবং একে অপরের দিকে সরছে। এই সরণ খুবই কম- বছরে এক সেন্টিমিটারের মত। কিন্তু এই প্লেটগুলি ঐটুকু করে সরলেও, তার ফলে ভয়ানক শক্তির সৃষ্টি হয়।
এই বিভিন্ন স্তর গুলি যখন নড়াচড়া করে, তখন একে অপরের সাথে ধাক্কা খায়, একে অপরকে ঠেলা মারে, তার তার ফলে পৃথিবীর গভীরে স্তরগুলির ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা ঘর্ষণজনিত শক্তিগুলিকে জাগিয়ে তোলে। বহুদিন ধরে এই টানাপোড়েন একটু একটু করে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন ভূ-ত্বকের নীচের পাথরগুলি আর চাপ সহ্য করতে না পেরে, ভেঙে যায়। এইভাবে হঠাৎ ভেঙে যাওয়ার ফলে, সেগুলির থেকে প্রচুর পরিমানে শক্তি নির্গত হয়, যা অতি দ্রুতগতিতে আশেপাশের পাথরের স্তরগুলিতে এবং ভূপৃষ্টে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে ভূমিকম্প হয়। সবকিছু কেঁপে ওঠার ফলে ভূপৃষ্ঠের ওপরে গড়ে ওঠা বাড়িঘর ভেঙে পড়ে, জীবন এবং সম্পত্তি নষ্ট হয়। মূল ফাটলের ঠিক সরাসরি ওপরে ভূপৃষ্ঠের যে জায়গায় কম্পন গিয়ে আঘাত হানে, সেই জায়টিকে বলা হয় এপিসেন্টার।
পাথর ফেটে পড়া, এবং তার ফলে জমে থাকা শক্তি ছড়িয়ে পড়ার ফলে ভূ-পৃষ্ঠের ওপরে যে কাঁপুনির সৃষ্টি হয়, তাকেই ভুমিকম্প বলা হয়।
ভূমিকম্প কতটা তীব্র এবং বিধ্বংসী হবে, সেটা নির্ভর করে সেই সময়ে কতটা শক্তি নির্গত হয়েছে এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে কত গভীরে হয়েছে, তার ওপর। মূল ফাটল ধরতে পারে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে অনেক গভীরে, অথবা খুব কাছাকাছি। যদি কাছাকাছি হয়, তাহলে নির্গত শক্তি ভূ-পৃষ্ঠের ওপর অনেক্ল বেশি প্রভাব ফেলবে , এবং তার ফলে বিপর্যয় অনেক বেশি পরিমাণে হবে।
ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপার জন্য নানারকমের স্কেল ব্যবহার করা হয় - যেমন মারকেলি স্কেল, রিখটার স্কেল, মোমেন্ট স্কেল।
এবার আমি একটু জানাই নেপালের ভূমিকম্প কিভাবে হল।
পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন টেকটনিক প্লেটগুলি
গত কয়েক লক্ষ্য কোটি বছর ধরে, ভারতীয় প্লেটটি (Indian crustal Plate) উত্তরের এশীয় প্লেটের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে। এই দুটি প্লেটের সংঘর্ষ রেখা ধরেই আজকের হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়েছে।এর ফলে এই অঞ্চলের পাথর গুলির ওপরে এবং ভুপৃষ্ঠের গভীরে এক প্রবল শক্তির সৃষ্টি হয়েছে, যা যুগ যুগ ধরে পাথরগুলিকে ভেঙে, চুরমার করে, এমনকি গলিয়ে পর্যন্ত ফেলেছে। যে শক্তি এইরকম সব ভীষণ শক্ত পাথরকে গলিয়ে ফেলতে পারে, তার ক্ষমতা কতটা সেটা নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছ।
আর এই কারণেই এটা খুবই স্বাভাবিক যে, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে গভীরে থাকা পাথরগুলি এই রকম চাপ সহ্য করতে করতে একদিন ফেটে পড়বেই। নেপালেও ঠিক সেই ঘটনাই ঘটেছে। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর কাছাকাছি একটি জায়গায় ভূ-পৃষ্ঠ থেকে খানিকটা নিচেই এইভাবে যুগ যুগ ধরে জমে থাকা শক্তির প্রবল চাপে পাথর ভেঙে পড়ে। পাথগুলি ভেঙে পড়ার ফলে যে বিশাল শক্তি উৎপন্ন হয়, তা সোজা ধেয়ে আসে ওপরে এপিসেন্টারের দিকে। এপিসেন্টারের ওপরের স্তরে পৌঁছে সেই শক্তি ঘুরপাক খেতে খেতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার চলার পথে সবকিছুকে ধ্বংস করে ফেলে ।
২৫শে এপ্রিল, ২০১৫ -এর সকালবেলা নেপালে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের এপিসেন্টার এবং তার প্রভাবের বিস্তৃতি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এই ছবিতে
রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের এই তীব্রতার পরিমাপ ছিল ৭.৯। এই মহা শক্তিশালী ভূমিকম্প শুধুমাত্র কয়েকহাজার মানুষকেই মেরে ফেলেনি, সাথে সাথে ধ্বংস করে দিয়েছে প্রায় গোটা কাঠমাণ্ডু শহরটাকে এবং আশেপাশের অনেকটা অঞ্চলকে, ধ্বংস করে দিয়েছে অনেক প্রাচীন স্থাপত্য, মন্দির এবং প্রাসাদ।
নেপালে এত এত মানুষের প্রাণ গেল, প্রায় সমস্ত বড় বাড়ি ভেঙে পড়েছে, এর প্রধাণ কারণ অবশ্যই এই ভূমিকম্প। কিন্তু সেটা ছাড়াও অন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণটা জান কি? দেখা যাচ্ছে যে, এখানকার বেশিরভাগ বাড়িগুলি তৈরি হয়েছিল অত্যন্ত খারাপ মালমশলা দিয়ে এবং বাড়ি তৈরির সঠিক নিয়ম কানুন না মেনে। বেশিরভাগ বাড়ি গুলি তৈরি হয়েছিল ইঁট বা পাথর দিয়ে, মাথার ওপরে ছিল কাঠ বা কংক্রিটের ছাদ। ভূমিকম্পের ফলে এই সব বাড়িগুলি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে, এবং বহু মানুষ শুধুমাত্র এই ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়ে শ্বাসকষ্টে মারা যান।
ভূমিকম্প কখন ঘটবে কেউ জানে না, আগে থেকে এর বিষয়ে সতর্ক করে দিতে পারবে না কেউ। ভূমিকম্পকে থামানোও সম্ভব নয়। তাহলে কিভাবে আমরা ভূমিকম্প হলে জীবননাশ এবং সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনতে পারব?
এই প্রশ্নগুলি যুগ যুগ ধরে মানবসভ্যতাকে চিন্তায় রেখেছে। আর এই প্রশ্নগুলির উত্তর সম্ভবতঃ রয়েছে জাপানের স্থাপত্যভাবনাচিন্তার মধ্যে। চীনের পূর্ব্ দিকে একগুচ্ছ আগ্নেয় দ্বীপের সমষ্টি নিয়ে জাপান দেশটি তৈরি। পুরো দেশটাই অন্তন্ত বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ। তবুও এখানকার মানুষ আশাহত হয়নি, বরঙ দিনে দিনে নিজেদের দেশকে পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক এবং শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করেছে। ভূমিকম্পের জন্য নিজেদের ভাগ্য বা আকাশ-পাতালের দেব-দেবীকে দোষ না দিয়ে নিজেদের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছে। এর জন্য তারা স্থাপত্য প্রযুক্তির সাহাস্যে হাল্কা ধরণের বাড়ী বানায়, যেগুল ভূমিকম্পে সহজেই ভেঙে পড়বে না, আর পড়লেই, ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকবে।
জাপানীরা প্রাচীন কালে কাঠ এবং কাগজ দিয়ে বাড়ি তৈরি করত, যাতে ভূমিক্মপে সেগুলি ভেঙে পড়লেও ক্ষয়ক্ষতি বা প্রানহানী না হয়, এবং সহজেই আবার বানিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু আজকের দিনে তো আর ওইরকম বাড়ি বানিয়ে থাকা বাস্তবসম্মত নয়। টোকিওর মত বড় শহরে অনেক বড় বড় আকাশ্চুম্বী বাড়ি আছে। কিন্তু সেই বাড়িগুলিও ভূমিকম্পে সহজে ভেঙে পড়েনা। এর কারণ হল, জাপানে বাড়িগুলিকে কড়া নিয়ম মেনে , উন্নত মানের কংক্রিট এবং স্টিলের ফ্রেম দিয়ে , উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে বানানো হয়, যা ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হওয়া ঝাঁকুনি অনেকটাই সহ্য করে নিতে পারে।
তাহলে জাপান যেটা করতে পারে, ভারত বা নেপাল সেটা করতে পারে না কেন?
এর মূল কারণ কল আমরা বিজ্ঞানকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিই না, তার সাথে আমাদের এই সব বিষয়ে সামাজিক সচেতনতাও খুব কম। যেকোন সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত সমাধান না করে, আমরা দেবদেবীর পুজো, যাগ-যজ্ঞ - এইসব বিষয়ে অনেক বেশি সময় এবং অর্থ নষ্ট করি।
দেওয়াল গুলিকে শক্ত করতে হবে স্টিলের বীমের সাহায্যে
বাড়ির নীচে ঝাঁকুনি সহ্য করার জন্য 'শক অ্যাবজর্বার' এর ব্যবস্থা করতে হবে
কংক্রিটের দেওয়ালের ভেতরে স্টীলের বীম দিতে হবে যাতে দেওয়ালগুল কম কাঁপে
আমাদের উচিত এই সমস্ত অযৌক্তিক এবং অবৈজ্ঞানিক কাজকর্ম না করে বৈজ্ঞানিক ভাবে, নিজেদের বুদ্ধি এবং প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা। আমাদের উচিত ভূমিকম্প প্রতিরোধকারী স্থাপত্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাড়ি তৈরি করা; পাহাড়ের গায়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জঙ্গল কেটে ফেলাও থামানো উচিত, কারণ গাছের শিকড় পাহাড়ের ঢালে মাটি ধরে রাখতে সাহায্য করে। পাহাড়ের ঢালে প্রচুর গাছ কেটে ফেলার ফলে পাহাড়ের ঢালের ওপরের স্তরের মাটি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ফলে এইসব জায়াগায়, ভূমিকম্প বা ভারি বৃষ্টি হলে সহজেই ধস্ নামতে পারে।
তীব্রতার নিরিখে ভারতের ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলের ম্যাপ। ভূমিকম্প হলে ভারতের প্রায় ৫৯% অঞ্চল যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।এই ম্যাপ অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় পুরোটাই মাঝারি থেকে বেশি মাত্রার তীব্রতার ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল।
আমাদের আরো যেটা করা উচিত, সেটা হল, সঠিকভাবে ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল গুলিকে চিহ্নিত করা এবং তার ম্যাপ তৈরি করা। এই ধরণের ম্যাপ করা থাকলে ভবিষ্যতে কোন বড় স্থাপত্য বা বড় নগর তৈরি করার সময়ে আগে থেকেই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলিকে বাদ দেওয়া যাবে।
অনুবাদঃ মহাশ্বেতা রায়
জলরঙের ছবিঃ অনুভব সোম
অন্যান্য ছবিঃ বিভিন্ন ওয়েবসাইট