সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
পুজোর চিঠি

সিরাজুল,

একটা সাদা পাতা খুলে চুপ করে বসে আছি। আমার মাথার ওপরে অনন্ত আকাশ। চারিদিকে নিঃঝুম অন্ধকার। চতুর্থীর রাতে আমার সঙ্গী শুধু আমার চিলে কোঠার জানলা থেকে দেখা গঙ্গার ওপরে টিমটিমে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ভেসে চলা মাছ ধরার ডিঙিগুলো। আমি সারাদিন ধরে ভেবেছি লিখবো তোমাকে একটা চিঠি। আমি সারাদিন মেলে রেখেছি একটা সাদা পাতা আমার সামনে। কিন্তু শব্দরা আস্তে দেরী করছে ভীষণ। তারা যেন কোথায় আমার সাথে আড়ি করে চলে গেছে এই গভীর রাতে গহন অন্ধকারে। আমি ছুটছি...বিশ্বাস করো। আমি ছুটছি শব্দের পেছনে। চাঁদের বুড়ি যে কিছুক্ষণ আগে প্রচন্ড বকেছে। বলেছে হারিয়ে গেছে শব্দ গুলো আমার কাছ থেকে তোমাকে চিঠি লেখার। সত্যিই কি তাই? আমি চোখ বন্ধ করি। আমার চোখের পাতায় শরতের হিম এসে পড়ে। আমার চারপাশে জোনাকি ওড়ে। তারা মিটিমিটি আলো জ্বালিয়ে বলে যায় কতদিন লেখো না কল্লোল চিঠি সিরাজুলকে? আমি বলি অনেক দিন...অনেক দিন...। কতদিন তুমি এমন অন্ধকারে বসে থাকো না? আমি বলি অনেক দিন...অনেক দিন। ওরা প্রশ্ন করে তোমার সিরাজুল কি অনেক বড় হয়েছে? আমি বলি না এই টুকুনি। ছোট্ট-টা আছে আমার সিরাজুল। চিঠির বন্ধু কি বড় হয়? কিন্তু যে চিঠি লেখে তার বয়স বাড়ে। সেই প্রাচীন অরণ্যের মতো। লোলেগাঁওতে দেখা দুশো বছরের পুরোনো গাছটার মতো। শীতকালে পাতা ঝরার মতো। শিশির মেখে খালি পায়ে হাঁটার মতো। কি বিশ্বাস হচ্ছে না তো? ভাবছো আমি আবার খালি পায়ে শিশির মেখে হাঁটলাম কোথায়? তাহলে শোনো। বলি তোমায়। সে আমার আর এক বন্ধুর গল্প। তার সাথে পরিচয় হয়েছিল খালি পায়ে হাঁটতে গিয়ে। তার সাথে বন্ধুত্ত্ব হয়েছিল কাজের ছলে। গভীর অরণ্যের এক ক্যাম্পে। ভাবছো জঙ্গলের গল্প বলছি কিনা? একদম ঠিক। তবে এবার তোমার বাড়ির পাশে সুন্দরবনের গল্প নয়। দক্ষিণ থেকে এবার আমরা সোজা চলে গেছি উত্তরে। সেখানে তোমার আর আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে টারজান। চেনো নাকি তুমি টারজানকে? আচ্ছা। মারাত্মক বোকা তো আমি। কী করে চিনবে তুমি আমার বন্ধু টারজানকে। দাঁড়াও তাহলে পরিচয় করিয়ে দিই তার সাথে তোমার। স্বভাবে-মেজাজে আমার বন্ধুটি বড় নিরীহ। খেতে বড় ভালোবাসে সে। মাথা দুলিয়ে, ঘাড় নেড়ে নেড়ে সে তার প্রিয় খাবার চিবোয়। ঘন্টার পর ঘন্টা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটে। স্নান করতে সে বড় ভালোবাসে। জল দেখলে ঠিক তোমার মতোই সে আর উঠতে চায় না। বড় বড় কান নেড়ে, ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ পিটপিট করে সে খালি ভেজে। নিজের গায়ে জল ছিটোয়। দুষ্টুমি করার ইচ্ছে হলে আশে পাশের মানুষদের ভিজিয়ে দেয়। ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল আমি যখন খালি পায়ে বনের শিশির মেখে হাঁটছিলাম তখন। ওর মাহুত বন্ধু ওকে জলে নিয়ে গিয়ে স্নান করাচ্ছিল। নীচের ছবিতে টারজনকে দেখলেই বুঝতে পারবে সে কত আনন্দ করছিলো।

পুজোর চিঠি

আমি কাছে যেতেই আমাকেও তার লম্বা শুঁড় দিয়ে জল ছিটিয়ে দিলো। ভাবটা, আমি একা স্নান করবো কেন? তুমিও করো। টারজানের সাথে যখন আমার আলাপ হয়েছিল তখন ওর বয়স ছয় বছর। দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় গিজগিজ করছে। এক বিরক্ত করা সাহেবের পায়ের ওপর নাকি দাঁড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করেছিল। সাহেব ক্যামেরা ফেলে নাকি দৌড় দিয়েছিল পোঁ-পা।

পুজোর চিঠি

শুনেছি টারজানকে পাওয়া গিয়েছিল তোর্সা নদীর উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে থেকে। বেচারা দলছুট হয়ে মা বাবার কাছ-ছাড়া হয়ে একা একা ভাসতে ভাসতে কোথায় চলে যাচ্ছিল কে জানে? যদি না রামদাস তাকে দেখতে পেতো। যদি না রামদাস আরো লোকজন ডেকে এনে তাকে মোটা দড়ি, লম্বা গাছের গুঁড়ি দিয়ে টেনে তুলতো। "ও যখন এসেছিল তখন ওর বয়স ছয় মাস। কিচ্ছুটি খেতে পারে না। ওকে আমরা দুধ খাওয়ালাম। ফল খাওয়ালাম। কচি কলা গাছের ছাল খাওয়ালাম। খালি বায়না করতো। আর মায়ের জন্য মন কেমন হলে কাঁদতো।" টারজানকে স্নান করাতে করাতে আমাকে গল্প করেছিল রামদাস রাভা। শুনলাম এইরকম নাকি প্রতি বছরেই বর্ষার সময়ে হাতির বাচ্চা দলছুট হয়ে ভেসে যায় নদীতে। যাদের উদ্ধার করা যায় তারা বাঁচে। যাদের করা যায় না তারা বাঁচে না। তুমি কি জানো সিরাজুল এই প্রাচীনতম প্রাণীটি এক সাথে দল বেঁধে থাকে। এক একটা দলে কম করে কুড়ি বাইশজন। তারা দল বেঁধে ঘোরে। দল বেঁধে খায়। দল বেঁধে স্নান করে। গায়ের পোকা মারার জন্য ধুলো মাখে। আবার খাবারের সন্ধানে এক সাথে গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে। হাতি দলবদ্ধ প্রাণী। তবে যে তাদের একা দেখা যায় না তেমন নয়। সেই একা হাতিগুলো খুব রাগী হয়। আসলে কোনো দলে তারা জায়গা না পেলে একা হয়ে যায়। শাস্তি স্বরূপ কোনো হাতি একা হয়ে যেতে পারে। এমনকি মানুষের সংস্পর্শ যদি কোনো হাতি একবার পায় তাহলে আর তার জায়গা হয় না দলে। তাই ছোট হাতি গুলোকে উদ্ধার করা গেলেও তাদের আর জঙ্গলে ফেরত দেওয়া যায় না। কারণ কোনো দল এমনকি তাদের বাবা-মাও আর সেই বাচ্চা হাতিটাকে নেবে না। কাছে আসতে দেবে না।

এইরকম উদ্ধার করে আনা হাতি গুলোকে প্রশিক্ষন দিয়ে তাদের জঙ্গলের কাজে ব্যবহার করে বনদপ্তর। সরকারী কর্মচারী হয়ে যায় তারা তখন। আমার সাথে যখন টারজানের দেখা হয়েছিল তখন সে সরকারী কর্মচারী। প্রতি মাসে সরকার থেকে টাকা পায় কাজ করার জন্য। এবার তাহলে জানতে ইচ্ছে করছে কী কাজ করে টারজান? কি করে না আগে সেটাই বলো। জঙ্গল সাফ করে। বড় কাঠ বয়ে নিয়ে আসে। ট্যুরিস্টদের পিঠে চাপিয়ে ঘোরে। বাইরের হাতি এলে তাদের তাড়িয়ে আবার জঙ্গলে পাঠিয়ে দেয়। এই রকম আরো কত কি। তবে কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে তার দুষ্টুমি বুদ্ধি বাড়ে। রাতের আঁধারে পায়ের শেকল ছিঁড়ে তার জঙ্গলে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। বন্ধুদের কাছে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিছুতেই সে তার বন্ধু খুঁজে পায় না। মনের দুঃখে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। রামদাস জঙ্গলে গিয়ে খুঁজে নিয়ে এসে আবার পায়ে বেড়ি পড়ায়। খেতে দেয়। আদর করে। শান্ত হয় টারজান।

পুজোর চিঠি

কিন্তু তুমি কি জানো কেন হাতির দল জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে আসে? কেন তারা শস্য ক্ষেতে হামলা করে? কেন প্রত্যেক বছর ট্রেনের রাস্তায় হাতির এ্যাক্সিডেন্ট হয়। কেন টারজানের মতো হাতিদের নদীর স্রোতের মুখে পড়তে হয়? তার কারণ আমরা। আমরাই জঙ্গল কেটে নষ্ট করছি। ওদের থাকার জায়গা কমিয়ে আনছি। খাবার দিতে পারছি না। এইসব কথা শুনে জঙ্গলের পাশের গ্রাম পাখিরালার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে না? ওখানেও তো এমনই রাতের আঁধারে বাঘ ঢুকে পড়ে। তোমরা টিন পিটিয়ে, পটকা ফাটিয়ে, ভয় দেখিয়ে আবার ওদের জঙ্গলে ঢুকিয়ে দাও। ঠিক তেমনই জংলী হাতিদেরও দিতে হয়। সে আবার একটা বড় গল্প। সারা রাত জাগা...ধান পাহাড়া দেওয়া...মানুষ বনাম হাতির যুদ্ধের গল্প। সেই গল্প না হয় আর একদিন শোনাবো সিরাজুল। তার আগে আমাদের শপথ করতে হবে সভ্যতার নামে অরণ্য ধ্বংস করবো না। গাছ কাটবো না। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করবো।

দেখ, দেখতে দেখতে শাদা পাতা ভরে উঠলো। আর কিছুক্ষণ পরেই তো পঞ্চমীর সকাল। আমি তো বেশ দেখতে পাচ্ছি তুমি আর আনন্দী ঝুড়ি ভরে শিউলি ফুল কুড়োচ্ছো। সেই সুন্দর গন্ধ যে এই এতো দূরের চিলেকোঠা ছাদ থেকে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পাখিরালা। বলছে অনেক দিন বেড়াতে যাওনি কল্লোল। অনেকদিন দেখা হয়নি সিরাজুলের সাথে। সামনের শীতে কুয়াশাভরা হরিণভাঙায় দুজনে ডিঙি চালানোর শপথ নিয়ে চিঠি শেষ করলাম সিরাজুল। ভালো থেকো। অনেক অনেক আনন্দে থেকো।


ছবিঃ লেখক

চলচ্চিত্রবিদ্যা বিষয়ে অধ্যাপনা, তথ্যচিত্র নির্মাণ, ফিল্ম ও টেলিভিশন ধারাবাহিকের চিত্রনাট্যরচনা, এবং ফাঁকে ফাঁকে পেলে নিজের ব্লগে নানা স্বাদের লেখালিখি - বিবিধ ধারার ব্যস্ততার মধ্যে চাঁদের বুড়ির সাথে ইচ্ছামতীর প্রথম পায়ে হাঁটার দিনগুলিতে হাত ধরেছিলেন কল্লোল । এখনো সময় পেলে মাঝেমধ্যেই ইচ্ছামতীর জন্য কলম ধরেন হুগলী, উত্তরপাড়া নিবাসী কল্লোল।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা