এক কাঠুরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গুনগুন করে গাইতে গাইতে চলেছিল। ওর মন ছিল খুশিতে ভরা। এর আগে এতো খুশি বোধহয় ও কোনদিন হয়নি। ওর কিছু পড়শি জঙ্গলের মধ্যে একটা নতুন অংশ খুঁজে বার করেছে- সেখানে অনেক বড় বড় আর লম্বা লম্বা গাছে ভর্তি। হাঁটতে হাঁটতে কাঠুরে পৌঁছে গেলো বনের মধ্যে সেই অংশে। ঘন জঙ্গল আর বড় বড় গাছগুলি দেখে ও মুগ্ধ হয়ে গেলো। খানিক্ষণ দেখে শুনে এবার ও ভাবতে বসলো কোন গাছটা কাটবে। আরো ভালো কাঠ খুঁজে বার করার জন্য ও জঙ্গলের আরো গভীরে ঢুকে গেলো। হটাত ও দেখতে পেলো একটা খুব উজ্জ্বল আলো ওর দিকে যেন এগিয়ে আসছে। সেই আলোয় ওর চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। কাঠুরে আলোর তেজ থেকে বাঁচার জন্য দুই হাত দিয়ে চোখ ঢাকলো। এইভাবে খানিক্ষণ গেলো। তারপর আলোটা ধীরে ধীরে মরে গেলো। তখন কাঠুরে দেখলো ওর সামনে, ঘাসের ওপর পড়ে আছে কতগুলি পোড়া দেশলাইকাঠি। কাঠুরে তো অবাক! জঙ্গলের মধ্যে এই দেশলাইকাঠি গুলো এলো কোথা থেকে? কিছুক্ষণ আগেও তো ছিলোনা। আর ওই আলোটা?
এইসব সাত-পাঁচ ভাবছে, এমন সময় ও দেখতে পেলো জঙ্গলের ভেতর থেকে সাতজন মানুষ ওর দিকে এগিয়ে আসছে। তারা সবাই খুব লম্বা, গায়ে তাদের ঢোলা রেশমের আলখাল্লা, আর তাদের মুখে সুন্দর হাসি। "এই তো এইখানে" বলে তাদের মধ্যে একজন নিচু হয়ে দেশলাইকাঠিগুলি তুলে নিলো। তারপরেই তারা হটাত করে কাঠুরেকে দেখতে পেলো।
"কে তুমি? এখানে কি করছো?" গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলো একজন।
কাঠুরে হাত জোর করে বললো," প্রভু, আমি একজন গরিব কাঠুরে, ভালো কাঠের খোঁজে জঙ্গলে ঢুকেছি।" তখন তাদের মধ্যে একজন বললো, "প্রমাণ কোথায় যে তুমি কাঠুরে?" কাঠুরে তাদেরকে তার কুড়ুল আর বস্তা দেখালো। তখন সেই সাতজন মিলে কাঠুরেকে বললো -"এসো আমাদের সঙ্গে।"
সাতজনের পিছনে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে কাঠুরে দেখতে পেলো জঙ্গলের মধ্যে একটুখানি পরিষ্কার জায়গা। সাতজনের মধ্যে যে সবচেয়ে লম্বা, সে বললো- "দাঁড়াও এখানে"।
এই বলে সবাই মিলে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেলো।
কাঠুরে একলা বসে অনেক্ষন অপেক্ষা করলো। করতে করতে ভাবলো, স্বপ্ন দেখছি না তো? চারিপাশে ঘন সবুজ জঙ্গল, আর কতরকমের গাছ - তাদের মধ্যে অনেকগুলো সে কোনদিন দেখেইনি। এমন সময়ে সেই সাতজন তার কাছে ফিরে এলো। তাদের মধ্যে একজন তার দিকে কি যেন ছুঁড়ে দিল! কাঠুরে তাকিয়ে দেখলো তার সামনে পড়ে আছে পাঁচটা পোড়া দেশলাইকাঠি।
"এগুলি কি?" জিজ্ঞাসা করলো কাঠুরে।
"এগুলি হল আমাদের অদ্ভূত সৃষ্টি। এইগুলি সঙ্গে থাকলে কেউ কোনদিন শীত বোধ করবে না। যখন খুব শীত পড়বে, তখন এইগুলোকে একসাথে ঘষলেই চারপাশটা গরম হয়ে যাবে। আমরা এইগুলির নাম দিয়েছি 'আশ্চর্য দেশলাইকাঠি'।
"কিন্তু আমাকে এগুলো দেখাচ্ছেন কেনো?" অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো কাঠুরে।
"আমরা তোমাকে এগুলির শক্তির কথা জানালাম। তুমি যদি আমাদের জন্য একমাস কাজ করে দাও, তাহলে আমরা এইগুলি তোমাকে দিয়ে দেবো। তোমার আর শীতে কোনদিন কষ্ট হবেনা। তুমি আমাদের হয়ে কাজ করো, তোমার বাড়িতে ঠিক খবর পৌঁছে যাবে। ওদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেটা আমরা দেখবো।"
এই কথা শুনে কাঠুরে রাজি হয়ে গেলো। কাঠুরে সেই সাতজনের কথামতো জঙ্গলের মধ্যে কাজ করতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে তাকে মাটি কোপাতে হত, মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ কাটতে হত, আবার কখনও জঙ্গল পরিষ্কার করতে হত। সেই সাতজন মাঝে মাঝে এসে তার কাজ দেখে যেতো, আরো কাজ দিয়ে যেতো, আর তার খাবার দিয়ে যেতো।
এইভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পর এক রাতে খুব ঠাণ্ডা পড়লো। সে সাতজন এসে তখন সেই আশ্চর্য দেশলাইকাঠি গুলো ঘষলো, আর অমনি কাঠুরের খুব গরম আর আরাম লাগতে থাকলো। সেই কাঠিগুলোকে মাঝখানে রেখে সবাই তার চারিদিকে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
শুয়ে শুয়ে কাঠুরের চোখে তো ঘুম আসেনা। তার মাথায় এক দুষ্টুবুদ্ধি এলো। চুপচাপ উঠে কাঠুরে দেশলাইকাঠিগুলোকে কুড়িয়ে নিলো। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে তার কুড়ুলটা অন্য হাতে নিয়ে জঙ্গল পেরিয়ে দৌড় লাগালো।
পরদিন সকালে বাড়ি পৌঁছালে তার বউ আর ছেলে-মেয়ে তো খুব খুশি হল। কাঠুরে দেখলো সেই সাতজন তাদের কথামত তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল অনেক খাবার, জামা-কাপড়, আর টাকা-পয়সা। তাই তার বাড়ির সবাই বেশ আনন্দেই ছিলো। কাঠুরে কাউকে সেই দেশলাইকাঠিগুলির কথা বললো না। খুব সাবধানে তার একটা পুরোনো জামার পকেটের ভিতর রেখে দিলো।
তারপর একদিন রাতে শনশন করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে বরফও পড়তে শুরু করলো। বাড়ির সবাই যখন আগুনের পাশে বসেও শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে, তখন কাঠুরে চুপিচুপি পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেই আশ্চর্য দেশলাইকাঠিগুলিকে ঘষে দিলো। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে চারিপাশটা আরো গরম হয়ে গেলো। কাঠুরে আর তার বউ আর ছেলে-মেয়ের আর একদম শীত করলো না। কাঠুরে ছাড়া অন্যরা অবশ্য বুঝতে পারলো না কেনো এমন হলো।
এইভাবে কেটে গেলো বেশ কয়েকটা দিন আর রাত। বাইরে বরফ পড়লেও কাঠুরের বাড়ির ভেতর সবাই বেশ আরামে থাকলো।
তারপর একদিন রোদ উঠলো। কাঠুরে কাজে বেরোলো। কাজের পর বাড়ি ফিরে এসে সে আর দেশলাইকাঠিগুলিকে খুঁজে পেলোনা। খুব চিন্তায় পড়ে গেলো কাঠুরে। এমন সময় তার বউ এসে রাগি গলায় বললো -"আবার যদি ঘর নোংরা করো, তাহলে তোমার সব জিনিষ ফেলে দেবো, যেমন আজকে দিয়েছি তোমার পুরোনো জামার পকেটের থেকে কতগুলি পোড়া দেশলাইকাঠি!"
"কি করেছো! কোথায় সেগুলি?" চিতকার করে বললো কাঠুরে।
"অন্য ময়লাগুলোর সাথে রাস্তার ধারে ফেলে দিয়েছি। এতক্ষনে জমাদার তুলে নিয়ে চলে গেছে" বলে বউ গটগটিয়ে চলে গেলো।
কাঠুরে রাস্তার ধারে গিয়ে আঁতিপাতি করে খুঁজলো, কিন্তু সেই চুরি করা আশ্চর্য দেশলাইকাঠিগুলিকে আর খুঁজে পেলো না।
ঋদ্ধি চক্রবর্তী
অষ্টম শ্রেণী
দ্য ফিউচার ফাউন্ডেশন স্কুল
কলকাতা