রবিঠাকুরের ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ...’ পড়ার পরেও বর্ষার পর শরতের উঁকিঝুঁকি ছোটবেলায় তেমন অনুভবে আসত না। । সকাল সকাল ঘাসের ডগায় শিশিরের রেখা খুঁজে শরতের লক্ষণ মিলিয়ে নেওয়াও কলকাতা শহরে বেশ মুস্কিলের কাজ ছিল। কিন্তু মহালয়ার দিনটি মনে নিশ্চিত এঁকে দিত পুজোর আগমনী।
ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতেন বাবা। মাথার কাছে রেডি থাকত ট্রানজিসটর রেডিওতে কলকাতা-ক। টেবিল ক্লকের আওয়াজে ভোরের ঘুম ভাঙা মেজাজটা বিগড়ে যেত ঠিকই। কিন্তু এটাও ঠিক ওই আওয়াজই বয়ে আনত আমাদের জীবনে ছোট খাটো স্বাধীনতা আর তার সঙ্গে হাজারো মজার খাজানা। ওই ঘড়ি আমাদের ঘুম থেকে টেনে তুলত মহালয়ার দিন। কিংবা ভোরের ট্রেন ধরে দেশের বাড়ি বা মামার বাড়ি যাবার দিন। কলকাতার ছোট্ট বাসা বাড়ির বাঁধন থেকে মুক্তির সূচনাটা ঘোষণা করত ওই টেবিল ক্লকটিই – তাই তার কাছে আজও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
ঘড়ি বেজে উঠলেই মা উঠে প'ড়ে, রেডিও চালিয়ে দিয়ে বসে থাকতেন বিছানায়। রেডিও চলল – কিন্তু আকাশবাণী নয়, খড়খড় আওয়াজ আসছিল ওটা থেকে। মা বাবাকে জিগ্যেস করলেন – "কাল রাত্রে ঘড়ি মেলাও নি"?। বাবা বললেন –"মিলিয়ে তো ছিলাম। মনে হচ্ছে ঘড়িটা স্লো চলছে। পরশু একবার দেখিয়ে নোবো কাত্তিককে"। আমাদের গলির মোড়ে কাত্তিককাকুর ঘড়ি সারানোর দোকান। এতটুকু একটা দোকানে কাচের আলমারিতে হাজারো ঘড়ি এলোমেলো ছড়ানো। দেয়ালে পেন্ডুলাম দোলানো - না দোলানো অনেক ঘড়ি সব কটাই দশটা দশে থমকে থাকা। বাঁ চোখে লেন্সের ঠুলি পড়া কাত্তিককাকু টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মুখ তুলে তাকালে মনে হতো, আমার ভেতরের সব কলকব্জাও উনি দেখে ফেলছেন!
বাবা মার কথোপকথনের মধ্যেও কিন্তু আমার কানে এলো পাশের বাড়িতে পল্টুদের রেডিওর আওয়াজ। বাবাকে বললাম সে কথা। বাবাও এবার উঠে রেডিওর কানটা ধরে একটু নাড়াচাড়া করতেই – আমাদের রেডিওও কথা বলে উঠল। টিউনিংয়ের লাল কাঠিটা এদিক ওদিক হয়ে গিয়েই বিপত্তি। বাবার কথায় আমাদের টেবিল ক্লকটা স্লো বদনাম মেটাতে একটু যেন দ্রুত চলা শুরু করেছিল। এখন সেও বুক ফুলিয়ে বলতে লাগল "ঠিক ঠিক ঠিক ঠিক..."।
শুরু হয়ে গেল মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান। গান, কথা আর মন্ত্রের সে এক অদ্ভূত রসায়ন - আমার চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যেত শরৎকাল, পুজো, মা দুগগা – আর তাঁর আশ্চর্য দশভূজাা প্রতিমা...। সব কথা তখন শোনা হয় নি, সব মন্ত্র বোঝার প্রশ্নই ছিল না সেই বয়সে। কিন্তু তাঁর কণ্ঠের রণন রক্তে নিয়ে আসত কি এক দিশাহীন ব্যাকুলতা। রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত শরীর - বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আমার অন্তরে গড়ে তুলছিলেন তাঁর চিরস্থায়ী ভদ্রাসনটি।
শুরুতে একটু শোনার পর মাকে – "শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো, শুয়ে শুয়ে শোনো" – বলে বাবা নিজেই শুয়ে পড়তেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়েও পড়তেন। আমি মায়ের দেখাদেখি বসে শুনতে শুনতে - আধ শোয়া এবং একসময় পুরোই শুয়ে পড়তাম।
কিন্তু ঘুমের রাজ্য থেকেও মাঝে মাঝে কানে আসত মহিষাসুরমর্দিনী। মা ঠায় বসে বসে শুনতেন। যখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন সেই মন্ত্রগুলি –"ইয়া দেবী, সবর্ভুতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা..." ঘুম টুটে যেত। একই মন্ত্রের একটি মাত্র শব্দ পাল্টে দেবীর সকলরূপের আরাধনা, এ একমাত্র সংস্কৃতেই বোধহয় সম্ভব। উঠে বসতাম নিজে নিজেই। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখতাম ভোরের আলোময় মায়াবি আকাশ। মা একইভাবে বসে আছেন – কিন্তু তাঁর চোখে এখন অশ্রুধারা।
আজ মহালয়া, অমাবস্যা তিথি। পিতৃপক্ষের সমাপ্তি দিন। কাল প্রতিপদে দেবীপক্ষ শুরু। আজ পিতৃপক্ষের শেষদিনে পিতৃপুরুষের উদ্দ্যেশে গঙ্গাজল অর্পণ করে তর্পণ করার দিন। বাবা তর্পণ করবেন – পুজো করবেন নিজের হাতে। আজ ছুটির দিন হলেও কোন আমিষ রান্না আজ হবে না। বিশুদ্ধ নিরামিষ। পঞ্জিকা মতে অমাবস্যার নির্ঘন্ট দেখে গতকালই সময় নির্ধারিত – আজ সকাল নটা ছাব্বিশ গতে তর্পণক্রিয়া বিধেয়।
ওই নির্দিষ্ট সময়ের পর অপেক্ষায় থাকবেন আমাদের পিতৃকূল ও মাতৃকূলের দাদু ও ঠাম্মারা, দা’মশাই ও দিম্মারা। পিতামহ, প্রপিতামহ, বৃদ্ধপিতামহ, প্রবৃদ্ধপিতামহগণ এবং মাতামহ, প্রমাতামহ, বৃদ্ধমাতামহ, প্রবৃদ্ধমাতামহগণ সস্ত্রীক এসে দাঁড়াবেন পরলোকের ব্যালকনিতে। দুচারটে কালোতিল দক্ষিণ করতলে রেখে তার ওপর কুশি থেকে দুবিন্দু গঙ্গাজল। এই সামন্য অর্পণটুকু গ্রহণ করার জন্যে।
"হে আমার পূর্বপ্রজন্মের পিতা-মাতাগণ আপনারা সকলে আজ এই অমাবস্যা তিথির মাহেন্দ্রক্ষণে আমার নিকট উপনীত হইয়া আমার জলাঞ্জলি গ্রহণ করুন। বাবা, তুমি আমার থেকে এই তিল ও গঙ্গা জল নিয়ে তৃপ্ত হও। মা, তুমিও আমার হাতের এই তিল ও জল নিয়ে তৃপ্তি পাও। হে পিতামহ, আমার প্রদত্ত এই সতিলোদক গ্রহণ করিয়া আপনি তৃপ্ত হউন...পিতামহী আপনি আমার প্রদত্ত এই সতিলোদক গ্রহণ করিয়া তৃপ্ত হউন..."। পূর্বপ্রজন্মের যাঁরা আজ মৃত, তাঁরা আজ প্রেতযোনিলোকে রয়েছেন। যাঁদের দেবযোনিলোকে বাস তাঁরা দেবতা – অমর, তাঁদের প্রতি যেভাবে অঞ্জলি প্রদানের বিধি সেই বিধিতে এই অঞ্জলি প্রদান বিধেয় নয়। কাজেই মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে দিতে হবে জল – গঙ্গা বা কোন পবিত্র নদীর বুকে অথবা ঘরের তাম্রকুন্ডে।
বাবা যখন আমাদের পূর্বপুরুষদের এক এক জনের নাম উচ্চারণ করে এই অঞ্জলি অর্পণ করতেন, ছোটবেলায় মনে হত, আমার দাদুরা ঠাকুমারা এসে কেউ কেউ বসেছেন, কেউ বা দাঁড়িয়ে আছে্ন - আমার আশে পাশে, পিছনে। আমার কল্পনায় সেই অশরীরী উপস্থিতি কেমন যেন ভয়মিশ্রিত এক বিস্ময় সৃষ্টি করত মনে। পিছনে কারা যেন অস্ফুট কথা বলত – বাবার বিশুদ্ধ উচ্চারণের মন্ত্রের আড়ালে থেকে যেত সেই মৃদু কোলাহল। মাঝে মাঝে খুব প্রাচীন এক বৃদ্ধ কণ্ঠ মৃদুস্বরে যেন বলে উঠতেন – "সবাই এত বকবক করছ কেন, বাবাসকল? অঞ্জলি নিয়ে যে যার নিজের লোকে ফিরে যাও । ভুলে যেও না যে আমরা সবাই মৃত। আমাদের এই শ্রীমান নবীনকুমার বালকমাত্র, আমাদের এই আনন্দ কোলাহলে সে ভয় পেতে পারে... সেটা নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে কেউই চাই না .."।
এই কণ্ঠটি যে আমাদের গোত্রপিতা বৎস ঋষির সে বিষয়ে আমি যেন নিশ্চিত ছিলাম, যাঁর নাম অনুসারেই আমাদের গোত্রনাম বাৎস্য। কোলাহল স্তব্ধ হয়ে আসত। কিন্তু অনেক অনেক স্নেহ ও আশীর্বাদ মাখা নয়নের দৃষ্টি যেন নিঃশব্দে স্পর্শ করত আমার শরীর। আমি জানি সেই দৃষ্টি আমার অতিবৃদ্ধা পিতামহী ও মাতামহীদের।
কিছুটা বড় হয়ে - পল্লবগ্রাহী কিছু লেখাপড়া ও শখের বিজ্ঞানচর্চার ফলে এই সব অঞ্জলি অর্পণ, তর্পণকে মনে হত হাস্যকর এক কুসংস্কার বিশেষ। আমাদের বাপ-ঠাকুদ্দাদের আর খেয়ে দেয়ে কাজ পড়ে নি যে আমাদের দেওয়া ওই দু পাঁচটা কালোতিল আর দু ফোঁটা দূষিত গঙ্গাজল পেয়ে তৃপ্ত হবেন! তাও আবার হয় নাকি।
আজ এই বয়সে পৌঁছে বুঝি, তাঁরা ওই সামান্য জলাঞ্জলিতে তৃপ্ত হলেন কিনা সেটা আদৌ বড় কথা নয়। বড় কথা হল, আমরা তাঁদের মনে করে ধন্য হলাম কিনা। এই বিশাল দেশের, কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের যাবতীয় উত্থান পতন; ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় এবং প্রাকৃতিক পালাবদলের অনবরত ঝড়ঝঞ্ঝা তাঁরা সামলে এসেছেন কত যুগ ধরে! এক প্রদেশ থেকে ভিন্ন প্রদেশে বারবার স্থানান্তরিত হয়েও স্থির বিশ্বাস ও বিচক্ষণতা দিয়ে তাঁরা নিজেদের অস্তিত্ব অটুট রেখেছেন। যুগের সঙ্গে অনিবার্য অভিযোজন মেনে নিয়েও সেই জ্ঞান ও বিশ্বাস সঞ্চারিত করতে পেরেছেন তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। বড় কথা হল, আমরা এই অপরিশোধ্য ঋণের কথা বুঝতে পারছি কি?
হে আমার পিতৃ ও মাতৃকূলের প্রত্যক্ষ এবং বিস্মৃত পরোক্ষ পূর্বপুরুষগণ, আজ এই অমাবস্যা তিথির পি্তৃপক্ষ ও মাতৃপক্ষের পুণ্যসন্ধিক্ষণে আমার কৃতজ্ঞচিত্তের কালো তিল আর গঙ্গাজলের অঞ্জলি গ্রহণ করুন। আমার এই প্রজন্মের বিনম্র ও বিনীত স্মরণে আপনারা তৃপ্ত হোন এই ভেবে যে, আমরা আপনাদের ঋণ ভুলিনি। আপনারা আশীর্বাদ করুন এই কৃতজ্ঞতাবোধ যেন সঞ্চার করতে পারি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মে। অদূর ভবিষ্যতে আমার মৃত্যুর পর, যখন আমিও আপনাদের সঙ্গে একাসনে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করব এই অনুষ্ঠান, তখন আমিও যেন তৃপ্ত হতে পারি আমার ছেলেমেয়ে ও নাতিনাতনিদের আচরণে।
ছবিঃ আশিস স্যান্যাল, মহাশ্বেতা রায়, ফ্রি ইমেজ ওয়েবসাইট