আজকাল আড়াই বছর থেকেই ইস্কুল জীবনের সূত্রপাত ঘটে থাকে – আমাদের হত পাঁচ/ ছ বছর বয়সে ক্লাস ওয়ান থেকে। আমাদের ছোট্টবেলায় - তখনো ইস্কুলের মুখ দেখেছি কি দেখিনি ঠিক মনে পড়ছে না। সেই সব দিনে, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত অনেক ধরনের ফিরিওয়ালা আসত আমাদের পাড়ায়।
তাদের মধ্যে একজন ছিল ‘বেদে বুড়ি’। নাম অনুসারী বয়স্কা মহিলা। বেঁটে খাটো হৃষ্ট পুষ্ট চেহারা। হাতে থাকত মাঝারি সাইজের পেটমোটা একটা থলে। পাড়ার মধ্যে এ বাড়ি ওবাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়াত, আর হাঁক দিত ‘দাঁতের পোওওওকা বাআআআর করি’। অবিকল এই সুরেই- ‘দাঁতের’ আর ‘করি’ শব্দ দুটো ছোট্ট ঊচ্চারণ আর মাঝের দুটো বেশ লম্বা। সে আসত মোটামুটি বেলা বারোটা সাড়ে বারোটার সময়। বাবা অফিস আর দাদা স্কুলে বেড়িয়ে যাবার পর দশটা সাড়ে দশটার পর থেকে আমার সমস্ত দৌরাত্ম্য চলত একলা মায়ের ওপর। মা ওই সময়টায় আমাকে পাশে নিয়ে কাচাকাচি, কোনদিন সেলাই ফোঁড়াই এইসব কাজগুলো সারতে থাকতেন।
সেবার রথের মেলা থেকে পোড়া বাঁশের একটা বাঁশি কিনে দিয়েছিলেন বাবা, আমার নাছোড় বায়নায়। বাঁশির ফিরিওয়ালা কি সুন্দর সুর তুলছিল বাঁশিতে। হ্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালার মতো। আমি বাবার হাত ধরে ঝুলে পড়েছিলাম বাঁশি কিনে দেবার জন্যে। একটা বাঁশি কিনলাম, কিন্তু এতটুকু সুর বের করতে পারলাম না সেটা দিয়ে। ফুঁ দিলে অদ্ভূত আওয়াজ বের হত, যার তুলনা পেয়েছিলাম আরেকটু বড় হয়ে মামারবাড়িতে খাঁচায় পোষা চন্দনা পাখির থেকে। কেউ যখন কাছাকাছি থাকত না, একটা টুলের ওপর উঠে খাঁচার জালের বাইরে বেরিয়ে পড়া সবুজ লেজটা একটু টানলে ভয়ে এবং ব্যথায় - আমার বাঁশির মত আওয়াজ করত সেই চন্দনা। সেই শুনে দিদিমা, মা বা মাসীমারা চেঁচামেচি করে দৌড়ে আসার আগেই আমি সেখান থেকে পগার পার।
সেই বাঁশিতে সুর তুলতে বিফল মনোরথ আমি একদিন আবিষ্কার করলাম সাবান জল ভরা বালতির মধ্যে আদ্দেকটা ডুবিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিলে সুন্দর কুলকুল আওয়াজ ওঠে আর বড় বড় বুদবুদ তৈরি হয়। রোদ পড়ে সেই বুদবুদের গায়ে খেলে বেড়ায় রামধনু রং। আবিষ্কারের নেশা বড়ো নেশা - বিশেষ করে ওই বয়সে। মাকেও দেখালাম ফলাও করে – মা কাচা কাপড় চোপড় নিয়ে তখন হিমসিম- ‘বাঃরে, ঘুনু আমার কত্তো কি শিখে ফেলেচে’ বলে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি নিজের কৃতিত্বে মশগুল। সব কাজ সেরে বালতি ভরা সাবান জলটা মা যখন ফেলে দিলেন ঝাঁঝরির মুখে। হতাশায় দুঃখে আমি ঘরে গিয়ে এককোণায় বসে রইলাম গোমড়া গম্ভীর মুখ করে। পণ করেছিলাম, মায়ের সঙ্গে আড়ি – একটাও কথা বলব না।
প্রথমে মা আমার ভাবান্তর লক্ষ্যই করেননি, হাতের কাজ সামলাতেই ব্যস্ত ছিলে্ন। তারপর সব কাজ সেরে আমার কথা মায়ের খেয়াল হলো, চান করার সময়। প্রথমে ডাকাডাকি, কোন সাড়া দিলাম না। যদিও আড় চোখে দেখছিলাম মা আসছে্ন কিনা। ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে মা ঘরে এলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে মা জিগ্যেস করলেন- -‘কি হয়েছে, সোন্টা’। সাড়া দিলাম না ঘাড় শক্ত করে রইলাম।
-‘ও মায়ের ওপর রাগ করেছ, সণ্টু? কি হয়েছে বাবু’। সাড়া দিলাম না।
-‘আচ্ছা সোনা আচ্ছা, মাটা না হয় দুত্তু, সন্টু তো সোনা আমার, লক্ষ্মী আমার – চলো চানু করে নিই। অনেক বেলা হয়ে গেছে’।
তাও সাড়া দিলাম না। সকাল ছটা থেকে উঠে জল খাবার, রান্না বান্না, বাবার অফিস, দাদার ইস্কুল, ঘরের কাজ, কাচাকাচি - মায়েরও ধৈর্য্যের বাঁধ টুটে আসত। মায়ের মিষ্টি গলা একটু কড়া হয়ে উঠত –‘সন্টু, চলে আয়, চান করে নিবি’। আমি সবে তখন ভাবছি মায়ের কথা মেনে নোবো, নাকি আরেকটু দেখব। সেই সময়ই ওই বেদে বুড়ি হাঁক পাড়ত- ‘দাঁতের পোওওওকা বাআআআর করি’।
ব্যস, মা বলে উঠতেন,
-‘দাঁড়া তো, ওই বেদে বুড়িকে ডাকি, আমার ছেলের মাথার পোকাগুলো সব বের করে দিয়ে যাক। সেদিন হারুর মা বলছিল হারুও নাকি এমনি করত, একদিন ডেকে সব পোকা বের করে দিল হারুর মাথা থেকে’-। আমি ভয়ে মায়ের কাছে ঘন হয়ে দাঁড়াই, বলি
-‘তাপ্পর কি হল? হারু মরে গেল’?
-‘ধুর বোকা, মরবে কেন, বালাই ষাট, দিব্বি ভাল হয়ে গেল। হারুর মা যা বলত হারু সব শুনত। একটুও কষ্ট দিত না মাকে’।
কে বা হারু, আর কে তার মা আজও জানি না। কিন্তু আমার মনে বেদে বুড়ি ঢুকে পড়ল। নিরীহ দেখতে এক বেচারা বৃদ্ধা, লোকের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ায় দাঁতের অলীক পোকা বার করার ফিরি নিয়ে। আমার কাছে সেই হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর। আমার দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হলেই মা বেদে বুড়ির শরণাপন্ন হত।
সেই বেদে বুড়ি আজ আর নিশ্চই নেই – থাকলে ব্রেকিং নিউজ হতো। ইতিমধ্যে মাও চলে গেছেন বহুদিন। কিন্তু আজও কোন না কোন বেদে বুড়ির ভয় অন্য ভাবে অন্য রূপে বসে গেছে মাথার ভিতর। তার থেকে আর পরিত্রাণ নেই বোধহয় কোনদিন।