বেশ ছোটবেলায় রোববারগুলো আসত, যাকে সাপ্তাহিক রাশিফলে লেখে, মিশ্র প্রভাব নিয়ে। সকাল সকাল উঠে পড়তে হত। যদিও অন্য দিনের চেয়ে একটু দেরীতে। কারণ অন্য দিনে স্কুল থাকত, আর ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমাদের স্কুল শুরু হত সকাল সাতটায়।
রবিবারের সকালটা শুরু হত দারুণ মজায়। কোনরকমে মুখ টুখ ধুয়ে এসেই বসে পড়তে হত পরোটা নিয়ে। গরম গরম তিনকোণা পরোটা। এ পিঠ - ও পিঠ আরশোলার ডানার রঙে মুচমুচে ভাজা আর তার সঙ্গে ফালি ফালি লম্বা কাটা আলুভাজা – পাঁচফোড়নের গন্ধ মাখা। মাঝে মাঝে মেথি দাঁতে চলে এলে তেতো লাগত – সে হোক সব মিলিয়ে সে এক অনবদ্য ঘটনা। কোন রোববার লুচি আর চৌকো কাটা আলু চচ্চড়ি – তাতে পাঁচফোড়ন নয় থাকত কালো জিরের ফোড়ন। মুখ তেতো হবার কোনো ভয় থাকত না।
জলখাবারের পর সকাল আটটা নাগাদ আমাকে নিয়ে বাবা রওনা দিতেন বাজারে। দুটো বড় থলি, আর একটা ছোট – খালি থলিগুলো আমি হাতে রাখতাম। কারণ বারান্দা বা জানালা থেকে আমার বন্ধুরা কেউ না কেউ দেখবেই – তখন গম্ভীর ভাবে বয়স্ক বয়স্ক ভাবটা ফোটাতে বেশ সুবিধে হত, হাতে খালি থলিগুলো রাখলে।
শ্রী গোপাল মল্লিক লেন, আর পুলি লেন হয়ে বড় রাস্তা কলেজ স্ট্রিট – পুরোনো নাম ছিল কর্নওয়ালিস স্ট্রিট – বিহারি টানা রিকশাওয়ালারা বলত কানোয়ালিস – কর্ণ মানে কান সেখান থেকেই আমি নিশ্চিত হই। কলেজ স্ট্রিটে পড়ে বাঁদিকে একটু গেলেই প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট। আর উল্টোদিকে বরাবর সঙ্গে থাকত মেডিকেল কলেজের পাঁচিল।
প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের মুখে একটা শিবমন্দির। সকাল বেলায় ট্যাং ট্যাং ট্যাং ট্যাং টানা ঘন্টা বাজিয়ে পুজো চলত। আর তার উল্টোদিকে ছিল বাঙালি পাঁঠার দোকান। পাঁঠাও যে বাঙালি হয় সেই প্রথম জেনেছিলাম। সেই দোকানে চিরপ্রতিষ্ঠিতা ছিলেন মা কালীর সুন্দর একটি প্রতিমা। দোকানের সামনে রবিবারে বেশ ভিড় জমত। এসব পার হয়ে, কল পাইপের অজস্র বন্ধ দোকান ডিঙিয়ে আমরা চলে আসতাম বৌবাজার মোড়ে – উল্টোদিকে অধুনালুপ্ত রূপম সিনেমা, তার কোলের ছানাপট্টি থেকে ছানার জলের টোকো গন্ধ নাকে আসত এপারেও।
রাস্তা পার হয়ে ফুলের দোকানের মাঝখানের গেট দিয়ে বাজার। ভীষণ হট্টগোল, হৈ চৈ আর সবুজে সবুজ। এত সবু্জ, জঙ্গল আর ধানের ক্ষেত ছাড়া কোথাও দেখিনি। দুনিয়ার যত শাক পাতার ঝোপঝাড় নিয়ে ফিরিওয়ালারা বসত ঠিক মুখটাতেই। পুঁই, লাউ, কুমড়ো, নটে, কলমি, শুসনি, হিঞ্চে, থানকুনি, সজনে পাতা, কারি পাতা, ধনে পাতা – এছাড়াও থাকত ঋতু অনুসারি বিশেষ শাক – গরমের শুরুতে নিম পাতা, সজনে ডাঁটা, বর্ষাকালে পাটশাক আর শীতকালে পালং আর পেঁয়াজকলি।
এই সব ডিঙিয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল মাছের দিকে। কি মাছ মিলবে। তার মুড়ো এবং কাঁটা তেল দিয়ে কোন চচ্চড়ি জমবে – তার ওপরে নির্ভর করত শাক সব্জি বাজারের নসিব। কারণ রোববারে কোন চচ্চড়ি হবে না – এটা আমার বাবা ও মা ভাবতেই পারতেন না। রুই কাতলা হলে একরকম, ইলিশ হলে অন্যরকম আর ভেটকি হলে পুরো পাল্টে যেত সব্জির ভাগ্য। কাজেই প্রথমেই কানকো উল্টে পেট টিপে পছন্দসই মাছ দরদাম হয়ে ঢুকে পড়ত ছোট থলিতে। আমার দায়িত্বে বাবা দিয়ে দিতেন ছোট থলিটি। তার সঙ্গে মাঝে মাঝে ঢুকে পরত মৌরলা বা চুনো মাছও – তার আছে অন্য রহস্য । মাছ যদি হয় নায়িকা – এরা সব পার্শ্বচরিত্র, তাই বলে মোটেই ফেলনা নয়। সে কথায় পরে আসছি।
তারপর সেই সবুজের সমারোহ থেকে একটা বড়সড় ঝোপ আমাদের থলিতে ঢুকে পড়ত। হয়তো লাউ শাক, কুমড়ো শাক বা পুঁই শাক হয়ে। সেটা নির্ভর করত আমার থলির মাছের ওপর। এইবার আসবে সব্জির পালা কোন শাকের কে জুড়িদার – থোড় না কুমড়ো, বেগুন না লাউ, মূলো না কচু, রাঙা আলু না ঝিঙে । এসব ব্যাপারে হরেক পারমুটেসন-কম্বিনেসন থেকে বাবা ঠিকঠাক বেছে নিতে পারতেন সঠিক সব্জি। অতি দ্রুত তারা চলে আসত শাকের থলিতে।
রোববারের শেষ পাতে চাটনি বা অম্বল হবে না এও কখনো হয়? চাটনির জন্যে ছিল পেঁপে, টোম্যাটো, চালতা, জলপাই – সেও চলে আসত সব্জির থলিতে – ঋতুর হিসেবে যখন যেমন পাওয়া যেত। আমাদের দেশ – যারে কয় আমাগো দ্যাশ – বর্ধমান জেলায়। সেখানে তেঁতুল দিয়ে মাছের টক – যাকে বর্ধমানের লোকেরা আদর করে অম্বল বলে – আমাদের বাড়িতেও মাঝে মাঝে হতো । মৌরলা মাছ বা পাঁচমিশেলি চুনো মাছ পেলে অম্বলের জন্যে পুরোনো তেঁতুল নিতে ভুল হতো না বাবার।
সবার শেষ বাজার, আলুর বাজার। আলুর সাজানো পাহাড়ের থেকে আলু বেছে নিতে দেখতাম বাবাকে। বড়ো আলুর ওজন বেশী, বেশী বাছতে হবে না বলে আমিও হাত লাগাতাম বাবার সঙ্গে – বাবা দেখে বলতেন – ‘উঁহু, ওটা আজ লাগবে না, ওটা মাংসের আলু - পরের রোববারে নোবো। আজ মাছ, তাই এই সাইজটা বেছে তোল’। বলে বাবা দেখিয়ে দিলেন নির্দিষ্ট সাইজটা! বুঝলাম আমার ছোট থলিতে যিনি আছেন তিনি নিছক মাছ নন – মৎস্য অবতার। ভগবান বিষ্ণু কেন সব ছেড়ে মাছ হয়ে জন্মেছিলেন, সেটা সেদিন টের পেয়েছিলাম। এতক্ষণ যে একটা বড়োথলি খালি ছিল সেটার পেটে ঢুকে পড়ল আলু। তার সঙ্গে আদা। আর আমার থলিতে ঢুকল শেষ দুই পদ – পেঁয়াজ আর রসুন। এতক্ষণ যে থলি ছিল বাজারের কেন্দ্রবিন্দু – সেই থলি এখন হয়ে গেল ব্রাত্য। আমি জানতাম – আমার থলিটা আমিষ থলি – এর সঙ্গে ঠেকাঠেকি হয়ে গেলে মা খুব বিরক্ত হতেন। আমার দিদিমা ও ঠাকুমা দুজনেই ছিলেন বিধবা – তাঁরা দেশ থেকে মাঝে মাঝে আসতেন আমাদের বাসায়। সেই সম্মানে মা খুব নিষ্ঠা নিয়ে পালন করতেন আমিষ-নিরামিষ ভেদাভেদটা। আমাদের বাড়িতে থলি, ঝুড়ি, বঁটি, শিল-নোড়া সবই আলাদা ছিল আমিষের জন্যে।
ঘরে ফিরে আমার থলিটা আমাকেই রাখতে হত ঘরের এককোণায় – বেড়ালের হাত থেকে বাঁচাতে গামলা চাপা দিয়ে – আর আমাকে বিশেষ ভাবে হাত পা ধুয়ে আসতে হতো আমিষ থলির বহনকারী হিসেবে। এসে দেখতাম মা বঁটি আর বড় বড় দু তিনটে থালা নিয়ে তৈরী হয়ে বসে গেছেন কুটনো কুটতে। বাবা থলি থেকে বেড়াল বার করার মতো বের করে ফেলেছেন সব কিছু – ঘরের মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে ক্ষুদ্র বৌবাজার। দু একটা আলু দৌড়ে চলে গেছে এদিক সেদিক। আর রান্নার ময়দানে নামার আগে শেষ মূহুর্তের গভীর জল্পনা চলছে বাবা মায়ের মধ্যে। আমি মায়ের পিঠে শুয়ে কাঁধে চিবুক রেখে শুনছি সে সব কথা।
কথা শেষ হয়ে যায়। মা আমাকে বললেন, - ‘পিঠ থেকে নাম, হাজার কাজ পড়ে আছে’। আর বাবা বললেন - ’হ্যাঁ, অনেক হয়েছে, এবার চল, ইংরিজি গ্রামারটা নিয়ে বসি। ট্রান্সলেশনগুলো কিচ্ছু পারছিস না তুই’।
মাথা নীচু করে পাশের ঘরে গিয়ে কোণা দোমড়ানো বই, খাতা আর শিস ক্ষয়ে যাওয়া পেন্সিল নিয়ে বসে পড়লাম। যা বাজার করে আনা হয়েছে সেটা মায়ের হাতে রান্না হয়ে খাবার বনতে ঘণ্টা তিনেকের ব্যাপার। এখন সবে সাড়ে নটা। কাজেই সাড়ে বারোটা একটার আগে গ্রামারের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি নেই। সে এক অন্য ইতিবৃত্ত। অন্য কোন দিন। সকালের হাজার মজার পর গ্রামারের গ্রাম্ভারি অত্যাচার – তাই আগেই বলেছিলাম – তখনকার রোববারগুলো আসত - যাকে রাশিফলে বলে – মিশ্র প্রভাব নিয়ে।
ছবিঃমহাশ্বেতা রায়