টিভির দৌলতে কমবেশি হিন্দী সিনেমা, সকলেই দেখে থাকো নিশ্চয়ই। হিন্দী সিনেমায় প্রায়ই এমন হয়। ভিলেনের সাংঘাতিক ডেরায় এক নায়ক ভারি ভারি শিকলে বন্দী, পায়ের তলায় প্লাস্টিকের ভুখা কুমীর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্য নায়ক ঝনঝনিয়ে কাচের জানালা ভেঙে ঢুকে পড়ল অকুস্থলে। ঢুকেই দেখল খেলনা বন্দুক হাতে ঝুড়ি ঝুড়ি কাতিল – ভিলেনের সাঙ্গপাঙ্গ সব। সেও পড়ে গেল ভিলেনের খপ্পরে। দুই নায়ককে বন্দী করে ভিলেন এবার শুরু করল তার সাত পাতার ডায়ালগ। তার আজীবন করে আসা কুকীর্তির বিশাল ফর্দ। লাস্টে মিচকে হাসি হেসে ঘোষণা করল দুই হিরো আসলে শৈশবে চড়কের মেলায় হারিয়ে যাওয়া দুই ভাই! ভেইয়া – চোখে চোখে কথা শুরু দুই ভাইয়ে। তারপর যা হয় – সেটা সিনেমায় দেখে নিও – সবটা বললে হিন্দী সিনেমার জমাট রহস্যটাই মাটি।
কিন্তু সাড়ে চার ঘন্টা চড় চাপড়ের সঙ্গে চর্চার পর ‘যে ছেলেটি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে সে আমার ভাই হয়’ শুনে আমি মোটেই আনন্দ পাই নি। মনে হয়েছিল ভাইটা খামোকা ওখানে দাঁড়াল কেন? আর দাঁড়ালই যদি, তো আমার ভাই হতে, কে ওকে মাথার দিব্বি দিয়েছিল। কারণ ওটাই আমার ট্রানস্লেসানের বাক্য। The boy who stands there is my brother. লখী বাবুকা সোনা চাঁদি গহনাকা দুকান। আসলি শব্দটা ভিন্ন ভিন্ন শব্দের সামনে বসিয়ে একসময় বেশ কিছু দোকান দক্ষিণ কলকাতায় চালু ছিল। যেমন আসলি লখী বাবুকা..., লখী বাবুকা আসলি সোনা..., লখী বাবুকা সোনা আসলি চাঁদিকা..., লখী বাবুকা সোনা চাঁদিকা আসলি গহনাকা...ইত্যাদি। ঠিক সেই রকম বয়, হু, স্ট্যান্ডস আর ইজ এই চারটে শব্দ স্থানে অস্থানে সামনে পিছনে বহুবার বসিয়েও বাবাকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি সেদিন। যেমন – দি ব্রাদার ইজ মাই বয় হু স্ট্যান্ডস দেয়ার, দি হু ইজ মাই দেয়ার স্ট্যান্ডস ব্রাদার বয়... এই রকম সব। সত্যি বলতে সেদিন থেকেই আমি সকল বেরাদরির ওপর বিশ্বাস হারিয়েছি।
এরকম আরো কিছু ছিল। স্টেসনে পৌঁছানোর আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল। আর ডাক্তার পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই রোগী মারা গেল। কোনটা আগের আর কোনটা পরের অতীত। আরো সহজে বললে পুরোনো ভূত আর আনকোরা ভূত খুঁজে বের করার সেই একই বিড়ম্বনা – নো সুনার হ্যাড ... । নাঃ - এটা আর চেষ্টা করব না। এই বয়সেও ভুল করলে বেইজ্জতের একশেষ হবো।
তখন আমাদের বাড়িতে মুরগির চল একদম ছিল না। আর হরহপ্তায় মাংসও হতো না এখনকার মতো। মাসের প্রথম রোববারে মাংস হত – পাঁঠা বা খাসি – সামনের রাঙ বা গর্দান। পাড়ায় সব বাড়ি থেকেই ওই দিনে মাংস রান্নার গন্ধ উঠত। আরো বড় হয়ে যখন প্রেসার কুকার চালু হল, তখন রবিবারে বারোটা – সাড়ে বারোটার সময়, সমবেত সুরে কুকারের সিটি বহুবার শুনেছি পাড়ায় সব বাড়ি থেকে।
এই মাংস হওয়ার বিশেষ রবিবারেই পড়ার চাপটা পড়ত বেশী। মাংস কষার সময় থেকে মায়ের রান্নাঘর থেকে গন্ধ এসে ভুলিয়ে দিত ইংরিজির টেনস, ফ্রেজ, ইডিওমস, কগনেট অবজেক্ট, পার্টিসিপল, অ্যাডজেকটিভ, ন্যারেসন, ভয়েস চেঞ্জ... অথবা সংস্কৃত ব্যাকরণ কৌমুদীর শব্দ ও ধাতুরূপ, প্রত্যয়, সমাস, অপিনিহিতি, যোগরূঢি...। সব তালগোল পাকিয়ে একাকার মনে হত।
মাংস সেদ্ধ হয়েছে কিনা আর নুন ঠিক আছে কিনা টেস্ট করে দেখার জন্যে এক এক পিস মাংস সঙ্গে একটু ঝোল আমাদের বরাদ্দ ছিল স্নান করার আগে। এটাকে আজকালকার রেস্তোরাঁর ভাষায় স্টার্টার বা অ্যাপিটাইজার বললেও চলে। ওই নমুনাটা খাওয়ার পর আমার স্নানের সময়টা খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে যেত। প্রায়ই মায়ের কাছে বকুনি খেতে হত চান করার পরেও কানের পিছনে সাবানের ফেনা আর গোড়ালির পিছনে রাজ্যের ময়লা লেগে থাকার জন্যে।
আমার মাথায় তখন কিচ্ছু ঢুকছে না – সে সময় পেরেক ঠুকলেও বেঁকে যেত এমনই নিরেট আমার মাথা। বাবাও ছাড়ার পাত্র নন, জিদ ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন - আমাকে দ্বিতীয় নেসফিল্ড বা পি কে দেসরকার এবং ঈশ্বরচন্দ্র দেবশর্ম্মা বানিয়ে তুলতে। আমার এই চরম দুর্গতির সময় মা যেন মঞ্চে অবতীর্ণা হতেন মা দুর্গার মতোই। দশ হাত নিয়ে নয়, দুহাতে দুটি - গরম ঝোলের ধোঁয়া ওঠা কাঁসার বাটি নিয়ে। সুগন্ধে জিভে স্যালাইভার বন্যা বইত আর পাকস্থলী থেকে সব কিসিমের পাচক এনজাইম নিঃসৃত হয়ে আমার মাথার নিরেট ভাবটাও বেশ ফিকে হয়ে আসত।
প্রথমে বাবার হাতে বাটি দিয়ে মা বলতেন –
-“দ্যাখোতো – নুন টুন সব ঠিক আছে কিনা –“। বাবা সুড়ুৎ শব্দে ঝোলে চুমুক দিয়ে বলতেন
-“ফাসক্লাস হয়েছে – ভেরি গুড“। আমি তখন উবু জ্বলন্ত গরম মাংসের টুকরো মুখে নিয়ে হিমসিম, জিভে গালে ছেঁকা – মুখ হাঁ করে হা হা করছি ঠান্ডা হবার জন্যে। বাবার প্রশংসায় প্রসন্ন মা হাসি হাসি মুখে আমার অবস্থা দেখে বলে উঠতেন –
-“দ্যাখো, দ্যাখো বোকা ছেলের কান্ড দ্যাখো, একটু ঠান্ডা হতে দে - কিরে সেদ্দ হয়েছে”? আমি হা হা করা হাঁ মুখেই বড়সড় ঘাড় হেলিয়ে মাকে জানাতাম দারুণ।
এতক্ষণ রান্নাঘরের গরমে থাকার কারণে মায়ের স্বেদসিক্ত মুখে তৃপ্তির হাসি, বাবার প্রশংসা পেয়ে আর আমার অত্যাগ্রহ দেখে। দুচোখে স্নেহের অকূল পারাবার। সেই মুখ আর চোখের তুলনা পেতাম দুর্গা পুজোর সময়, কলেজ স্কোয়ারে মা দুগগার ঘাম তেল মাখা মুখ আর চোখে। সে সময় প্রতিমা বানাতেন শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র পাল। যাঁর আঙুলের জাদুতে কথা বলে উঠতে পারতেন দুর্গা প্রতিমা।
আমার নেসফিল্ড হবার নিষ্ফল ও নিদারুণ প্রচেষ্টার দুর্গতি থেকে মুক্তি দিয়ে আমার মা, বাবাকে নির্দেশ দিতেন তাড়াতাড়ি চান করে নেবার জন্যে, তা না হলে খাবার দাবার সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। বাবাও চূড়ান্ত হতাশায় আমাকে মুক্তি দিয়ে বলতেন-
-“তোমার এ ছেলের কিসস্যু হবে না, দেখো”।
-“আচ্ছা, আচ্ছা, ঘুনু হয়েই থাকবে না হয় চিরটাকাল – তুমি এখন যাও তো, চান করে নাও”।
বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। মায়ের কথাও খেটে গেছে অবিকল। বাবা মা কেউই আর নেই এই জীবনে। ‘ঘুনু’ হয়ে থাকা জীবনের অজস্র দুর্গতির মধ্যেও দুর্গতিনাশিনী সেই দৃষ্টি কিন্তু সঞ্চারিত হয়ে এসেছে পরবর্তী প্রজন্মেও। আজকাল বড় হতে থাকা আত্মজার চোখে মেলে হারিয়ে যাওয়া সেই শান্তির অনুভব - দিনশেষে ঘরে ফেরা হা-ক্লান্ত মনে। আর সেই ক্ষণটুকুই হয়ে ওঠে প্রকৃত রোববার।
ছবিঃদাড়িদা