বড্ড মুশকিলে পড়েছেন বিখ্যাত লেখক বিরিঞ্চিবাবু। অনুরোধে পড়ে একটা হাসির গল্প লেখায় হাত দিয়েছেন; কিন্তু কাগজে কলমপাত হয়নি এখনও। অনেক ভেবেও কূলকিনারা পাচ্ছেন না, হাতে সময় একদম নেই, সবমিলিয়ে একেবারে জগাখিচুড়ী অবস্থা।
বিরিঞ্চিবাবুর নামযশ সবই রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনীকার হিসেবে। চোর-ডাকাত-খুনী-বদমায়েশ তাঁর গল্পের পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়ায় আর তাদের শায়েস্তা করার জন্য পুলিশ বা গোয়েন্দারা তাঁর কলমের ডগায় ওৎ পেতে বসে থাকে। তাঁর নতুন বই বেরোলে পুলিশের কাজ বেড়ে যায়; ভিড় সামলানো ছাড়াও, বই-চুরি, বই-ছিনতাই, পকেট সংস্করণ হলে বই-পকেটমারির কেসও আসে প্রচুর। লেখার শুরুতেই রহস্যের জট পাকিয়ে, বিরিঞ্চিবাবু সে জট খোলেন শেষ লাইনে; রুদ্ধশ্বাসে মাঝের অংশটুকু পেরোনোর দায়িত্ব পাঠকের। ওই রুদ্ধশ্বাস ব্যাপারটার জন্যই জনস্বাস্থ্য দপ্তর থেকে বিরিঞ্চিবাবুকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল খুব বড় বা ধারাবাহিক উপন্যাস না লেখার জন্য। সেলুনটেলুনে নাকি তাঁর লেখার বিভিন্ন অংশ পোস্টারের মতো করে টাঙিয়ে রাখে চুলকাটার সুবিধের জন্য।
এহেন বিরিঞ্চিবাবুর মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। সমস্যা সামান্যই, ব্যাপারটার মধ্যে কিন্তু চুরি-ডাকাতি-খুন-জালিয়াতির মতো রহস্যের নামগন্ধ নেই। তবু রহস্য পাকানো আর তার সমাধান করায় সিদ্ধকলম বিরিঞ্চিবাবুর বিশাল রাশভারী চেহারা যেন চিন্তায় মিইয়ে গেছে।
আসলে দিনকয়েক আগে, 'আশ্চর্য প্রদীপ' পত্রিকার সম্পাদক সুবন্ধু গোঁসাই, এক জমজমাট আড্ডায় বিরিঞ্চিবাবুকে অনুরোধ করলেন, "রহস্য গল্প তো অনেক হল, এবার একটা হাসির গল্প হয়ে যাক 'আশ্চর্য প্রদীপ'-এর 'খিকখিক-খ্যাঁকখ্যাঁক' বিশেষ হাসি সংখ্যায়।" বুদ্ধি মন্দ নয়, একগুচ্ছ নতুন লেখকের সঙ্গে বিখ্যাত রহস্য-লেখক বিরিঞ্চি সমাদ্দারের প্রথম লেখা হাসির গল্প খুব জমে যাবে; বাজারে পত্রিকার একটাও কপি পড়ে থাকবে না।
লস্যিতে চুমুক দিতে গিয়েও প্রস্তাব শুনে থমকে গেলেন বিরিঞ্চিবাবু। অন্য আড্ডাবাজরা হৈ হৈ করে উঠল; রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনিকার বিরিঞ্চি সমাদ্দারের লেখা হাস্যকর রহস্যকাহিনি বা রহস্যময় হাসির গল্প সাহিত্য জগতে আলোড়ন তুলবে, তাতে আর নতুন কি! বিরিঞ্চিবাবুর কোনও আপত্তিই ধোপে টিকল না, অনেক গাঁইগুঁই করেও অনুরোধের ঢেঁকিটা গিলে ফেললেন তখনকার মতো; ভেবেছিলেন সময় বুঝে কিছু একটা বলে পাশ কাটিয়ে দেবেন।
এই কয়েক দিনে, নানান রহস্যময় ব্যস্ততার মধ্যে, ঢেঁকিটা ওগরানো হয়নি বিরিঞ্চিবাবুর; করছি করব বলে সুবন্ধুবাবুকে ফোন আর করা হয়ে ওঠেনি। ছোটদের পত্রিকা, তায় হাসির গল্প; খুব একটা গুরুত্ব না দেওয়ায় গলার মধ্যে ঢেঁকির অস্তিত্বটা টেরও পাওয়া যায়নি।
কিন্তু একদিন সক্কালবেলা চা হাতে নিয়ে আলগোছে খবরের কাগজটা খুলতেই হঠাৎ গলার মধ্যে ঢেঁকিটা নিজের অস্তিত্ব জানান দিল। নজরে এল 'আশ্চর্য প্রদীপ' পত্রিকার বড়সড় বিজ্ঞাপন - আর মাত্র কয়েক দিন, আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্য হাজির করছে 'খিকখিক খ্যাঁকখ্যাঁক' বিশেষ হাসি সংখ্যা; হাসি খুশি আর মজায় ভরপুর একগুচ্ছ লেখার সঙ্গে থাকছে বিখ্যাত রহস্য-গল্প লেখকের রোমাঞ্চকর হাসির গল্প। লেখক তালিকায় বেশ বড় বড় অক্ষরে কায়দা করে বিরিঞ্চিবাবুর নাম লেখা আছে।
এ সব কী!
রিং-এর শব্দে চমকে উঠে বিষম সামলে ফোন তুলতেই অগ্রজ লেখক সুরঞ্জনবাবুর উচ্ছ্বসিত গলা শুনতে পেলেন বিরিঞ্চিবাবু।
- তাহলে ভায়া, রহস্যের বাইরে কলমপাত করলে শেষ পর্যন্ত!
- না মানে, ওই চাপে পড়ে, মানে...
- অত সংকোচের কী আছে? রহস্যের মতো হাসিও দারুন জমবে তোমার হাতে। তা এগোলো কতটা?
এগোলো? আদৌ যে লিখতে হবে, তা তো এখন বোঝা যাচ্ছে। সেদিন চাপে পড়ে হ্যাঁ বলাটা একেবারেই ভুল হয়েছে, ফোন ছাড়ার পরে হাড়ে হাড়ে বুঝলেন বিরিঞ্চিবাবু ।
হুঁশ ফিরল ডোরবেলের শব্দে; পাড়ার নগেনবাবু, বিরিঞ্চিবাবুর লেখার ভক্ত; হাসির গল্পের জন্য আগাম অভিনন্দন জানাতে এসেছেন। এককাপ চায়ের সঙ্গে একটু খেজুরে আলাপ করে নগেনবাবুকে বিদেয় করার পরে হাসির গল্প লিখে মানরক্ষার চিন্তাটা বিরিঞ্চিবাবুর মজ্জার ভেতরে গেড়ে বসল।
সকালটা এভাবেই কাটল; উৎসাহী গুণগ্রাহীদের আগাম শুভেচ্ছা আর প্রশ্নের বন্যায় লেখা নিয়ে একটু গুছিয়ে ভাবনাচিন্তা করা মাথায় উঠল। ভাবনাচিন্তা তো নয় দুর্ভাবনা আর দুশ্চিন্তা চেপে বসল মাথায়, কী লিখি, কী লিখি। হাসির গল্প কীভাবে লেখে! শুরু হবে কীভাবে! শেষটাই বা কেমন হবে! আগে গল্প পরে হাসি নাকি আগে হাসি পরে গল্প? কত বড় হওয়া উচিত হাসির গল্প? দমফাটা হাসির গল্প আবার বেশি বড় হলে পাঠকের দম না আটকে যায়! তাহলে কি হালকা হাসি? না কি মুচকি হাসি? সে আবার 'খিকখিক খ্যাঁকখ্যাঁক' হাসি সংখ্যায় চলবে তো! ভাবতে ভাবতে জেরবার হয়ে গেলেন বিরিঞ্চিবাবু; রহস্যগল্প লেখালেখিতে তাঁর এতদিনের অভিজ্ঞতা হাস্যকর ভাবে বিফল হল হাসির গল্পের জন্য। নিজের ব্যর্থতা দেখে নিজেই হেসে ফেললেন কয়েকবার, কিন্তু হাসির গল্প মাথায় এল না।
বেলার দিকে ফোন করলেন সুবন্ধুবাবু।
- লেখা তৈরি তো? রতনকে পাঠাবো?
- না, মানে, এখনো কিছু লিখে উঠতে পারিনি। সময় লাগবে।
- সময় তো লাগবে মশাই, আপনার মতো অমন নিখুঁত লেখা আজকাল আর কজন লেখে বলুনতো! সবাই ভাবে হাসির গল্পে খুঁটিনাটিতে নজর দেওয়ার দরকার নেই। তা ভালো; চার পাতায় হয়ে যাবে তো?
- লেখা শুরু করলে চারপাতাই যথেষ্ট; কিন্ত……
- হাসালেন মশাই। এক কাজ করুন, বিকেলের দিকে চলে আসুন আমার অফিসে। অলংকরণের জন্য প্রতাপ সরকারকেও ডাকছি। আপনার থেকে গল্পটা একটু বুঝে নিয়ে ও কাজ শুরু করে দেবে।
- এবারের মতো বাদ দিন না! পরে সুবিধে মতো দেখা যাবে।
- রসিক মানুষ মশাই আপনি! শুনুন, আপনারটাই বাকি। বিকেলে চলে আসুন, এই গরমে প্যারামাউন্ট-এর সরবত আর পুঁটিরামের আইসক্রিম সন্দেশ খেতে খেতে জমিয়ে আপনার গল্পটা শুনবো। বেশিক্ষণ আটকাবো না, রাতে লেখার ফাইনাল কপি করে নিন; কাল সকালে রতন আপনার বাড়ি থেকে নিয়ে সোজা সুধীরবাবুর প্রেসে চলে যাবে। বাকি লেখা সব মেশিনে উঠে গেছে।
- মাফ করুন দাদা, এখনও আমি শুরুই করতে পারিনি। আপনি অন্য কিছু ব্যবস্থা করুন এবারের মতো।
একটু থেমে সুবন্ধুবাবু বললেন, "সত্যি বলছেন! আজকের পেপারে কিন্তু বড় করে বিজ্ঞাপন দিয়েছি, দেখেছেন নিশ্চই।"
বিরিঞ্চিবাবু কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, "একেবারে নিয্যস সত্যি কথা বলছি দাদা, একটা আঁচড়ও কেটে উঠতে পারিনি এখনো।"
সুবন্ধুবাবু অভিজ্ঞ সম্পাদক, ভালো করেই জানেন কী করে লেখা আদায় করতে হয়। সুতরাং আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পরে বিরিঞ্চিবাবু শেষপর্যন্ত একদিন অতিরিক্ত সময় চেয়ে নিয়ে আবার ঢেঁকি সহ ঢোঁক গিললেন।
বিরিঞ্চিবাবু সময় চেয়ে নিলেন বটে, কিন্তু হাসির গল্প লেখার মতো কিচ্ছুটি মাথায় এল না। ভেবে ভেবে মাথা গরম হয়ে গেল, নাওয়া খাওয়া ভুলতে বসলেন; শেষে গিন্নির ধমক খেয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। স্নানের পরে স্বভাব নাস্তিক বিরিঞ্চিবাবু ঠাকুরঘরে ঢুকলেন এ যাত্রায় উৎরে দেওয়ার আর্জি নিয়ে। প্রণাম সেরে ওঠার পরে, তেমন কিছু না ভেবেই প্রদীপটা মেঝেতে ঘষে দিলেন; যদি দৈত্য টৈত্য এসে একটা হাসির গল্প দিয়ে যায়। কিছুই হল না, বিরিঞ্চিবাবু যে তিমিরে ছিলেন সে তিমিরেই রইলেন।
দুপুরে একটু গড়িয়ে নেওয়া বিরিঞ্চিবাবুর বরাবরের অভ্যেস। কিন্তু মাথায় দুশ্চিন্তার কুম্ভীপাক নিয়ে ঘুম কি আর আসে! হাসির গল্প ভাবতে গিয়ে ছোটবেলায় পড়া গল্পগুলো একটার পর একটা মনে পড়তে লাগল, বেশ মজাই লাগল তাতে কিন্তু নতুন গল্প ভাবতে গেলেই মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল।
ছোটবেলায় পড়া হাসির গল্পের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ল পাগলা দাশুর কথা। "আবার সে এসেছে ফিরিয়া" বলে পাগলা দাশু যেন মঞ্চে এল মিহিদানার হাঁড়িতে চিনে পটকা নিয়ে। দাশুর পিছু পিছু কালাচাঁদ এল ছবি নিয়ে, শ্যামলাল এল কবিতা নিয়ে, চালিয়াৎ এল, সবজান্তা এল, নূতন পন্ডিত এলেন, যজ্ঞিদাসের মামা এলেন, সবশেষে বিষ্ণুবাহন এল দিগ্বিজয় সেরে। সব মনে পড়ে গেল, শুধু একটা নতুন হাসির গল্প মাথায় এল না। মনে মনে হেসে ফেললেন বিরিঞ্চিবাবু, নন্দলালের মন্দ কপালই বটে।
না, এভাবে হবে না; মনটাকে সংযত করতে রীতিমত ধমক দিলেন বিরিঞ্চিবাবু, "চুপ করে দাঁড়া, নাহলে দড়াম মেরে মাথা উড়িয়ে দেব।" কিন্তু মন কি আর ধুনুচি মাথায় রাস্তার মোড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার বান্দা! সকাল থেকে মনের সঙ্গে অনেক লড়াই করেছেন; 'ল্যাংমুচকি', 'ডানপটকান' এর মতো কুস্তির প্যাঁচ কষেও বাগে আনতে পারেননি। মুচকি হাসলেন বিরিঞ্চিবাবু, শেষে কি নিছক একটা হাসির গল্পের জন্য দুদিন উপোস করে তিনদিনের দিন সকালে মন্ত্র পড়তে হবে নাকি রে বাবা! অজান্তেই পাশের বাড়ির জানালার কার্নিশে বসে থাকা কাকটার দিকে চোখ চলে গেল। ব্যাটা ঘাড় বেঁকিয়ে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন দ্রিঘাংচু। কাকটা তাঁর দিকে তাকিয়ে কঃ করে হঠাৎ ডেকে ওঠায় ফিক করে হেসেও ফেললেন। কী যেন ছিল মন্ত্রটা? মনে পড়তেই বিড়বিড় করে আওড়ালেন, "হলদে সবুজ ওরাং ওটাং, ইঁট পাটকেল চিৎপটাং….." নাহ, কিছুই ঘটল না, শুধু কাকটা উড়ে গেল। ধুর, সমস্যা সমাধানের জন্য ফকিরের জামা খোঁজার চেয়ে ফকির হওয়াই ভালো। লেখালেখি ছেড়েছুড়ে ফকির হওয়ার আগে পাশ ফিরে শুলেন বিরিঞ্চিবাবু।
চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল হয়তো; তবু স্পষ্ট দেখলেন "সুবর্ণ সুযোগ, সুবর্ণ সুযোগ" বলে চিৎকার করে আশ্চর্য প্রদীপের হ্যান্ডবিল বিলি করছেন সুবন্ধুবাবু। হঠাৎই একটা হ্যান্ডবিল থেকে দৈত্য বেরিয়ে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল "কতদূর লেখা হল ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ?"
সুরঞ্জনবাবু বললেন "লিখতে লিখতে গল্পতো শেষ হয়ে যাবে ভাই, তাই গল্প আর্দ্ধেক লেখা হলে কাগজ কলম আর গল্প তিনটেই উল্টে নাও।"
আঁকিয়ে ছোকরা প্রতাপ, স্কেচবই আর পেন্সিল হাতে নিয়ে বলে চলেছে, "না না আমায় আর ছবি আঁকতে বোলো না"।
রতন আবার খুব তেড়িয়া মেজাজে জিজ্ঞাসা করল, "লেখাটা আনতে কোথায় যেতে হবে? উলুবেড়ে না মোতিহারি না রামকিষ্টপুর না কাশিমবাজার? তিব্বত হলেও রাজি আছি, রাস্তা তো সোজা, কলকাতা, ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত ব্যাস!"
নগেনবাবু খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলছেন, "হাসব না! একজন হাসির গল্প লিখতে গিয়ে গোয়েন্দা গল্প লিখে ফেলেছে আর সেই গোয়েন্দা গেছে হাসির খোঁজে;" কথা শেষ না করেই আবার হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
প্রেসের সুধীরবাবু ঘোলাটে চশমার আড়াল থেকে চোখ পাকিয়ে মাথা নেড়ে বলে উঠলেন, "কাল বিকেলের মধ্যে লেখা না পেলে লেখকের তিনমাসের জেল আর সাতদিনের ফাঁসি।"
এরমধ্যে গিন্নি আবার কোত্থেকে উদয় হয়ে জোর ধমক আর রাম ঠেলা দিয়ে বললেন, "গল্প লেখার নামে পড়ে পড়ে ঘুমোনো হচ্ছে!"
এসব শোরগোলের মাঝে অনেকক্ষণ থেকেই বিরিঞ্চিবাবু বুঝতে পারছিলেন হাসির গল্প লিখতে রাজি হওয়াটা একটা অবিমৃষ্যকারিতা হয়ে গেছে। এবার গিন্নির ঠেলা খেয়ে যেই না কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন অমনি স্বপ্নটপ্ন ঘুমটুম সব ভেঙে গেল হুড়মুড় করে। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব হারিয়ে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বিরিঞ্চিবাবু।
গিন্নি জিজ্ঞাসা করলেন, "ঘুমের মধ্যে এত হাসির কি হল?"
বিরিঞ্চিবাবু বিড়বিড় করে বললেন, "হাসছিলাম? কী যেন একটা স্বপ্ন দেখছিলাম।"
তারপরেই তড়াক করে উঠে বসলেন বিরিঞ্চিবাবু, স্বপ্নটা দিয়েই একটা সুন্দর হাসির গল্প তৈরি হয়ে যাবে। ছেঁড়াছেঁড়া স্বপ্নটা মনে মনে ঝালিয়ে নিতে গিয়ে হো হো করে নিজেই হেসে ফেললেন। ভুলে যাওয়ার আগে লেখা শুরু করা দরকার। হাত বাড়িয়ে নোটবইটা টেনে নিয়ে কলম বাগিয়ে লিখতে বসলেন। একটা জবরদস্ত নামও ঠিক করে ফেললেন – 'হ য ব র ল' রহস্য। স্বপ্ন আর তার থেকে তৈরি গল্পের কথা ভাবতেই পেটের ভেতর থেকে ভুসভুসিয়ে হাসি বেরিয়ে এল। সে হাসি সামলাতে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি, বিষম লেগে হেঁচে কেশে দম আটকে একাকার কান্ড বাধিয়ে ফেললেন বিরিঞ্চিবাবু।
জল খেয়ে, বুকে পিঠে মালিশ করে একটু আরাম হল। সামলে ওঠার পরে তরতর করে প্রায় একপাতা লিখে ফেললেন। প্লটটা মাথায় এসে যাওয়ার পর বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে এবার, লেখাটা এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা। এখন মনে আবার উল্টো অশান্তি; লেখা মাথায় এসে গেলে চেপে রাখা খুব কষ্টকর, লিখে শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি পাওয়া যায় না।
লিখতে লিখতে বিরিঞ্চিবাবুর মনে হল, স্বপ্নাদ্য গল্পটা ঠিকঠাক লিখতে গেলে আসল 'হ য ব র ল' গল্পটা একবার পড়ে ফেলা দরকার। চরিত্রগুলোর নাম ধাম বাচনভঙ্গি ইত্যাদি একটু বিশদে ঝালিয়ে নেওয়া দরকার। সুকুমার রচনাবলীটা আলমারি থেকে নামাতে হবে, একবার উল্টেপাল্টে চোখ বুলিয়ে নিলেই হবে।
লেখা নিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা টুল নিয়ে বিরিঞ্চিবাবু গেলেন বইয়ের আলমারির সামনে। সুকুমার রচনাবলীটা হাতের সামনে নেই, থাকার কথাও নয়; সেই কবে তুলে রাখা হয়েছে, আর নামানো হয়নি। টুলে উঠে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। সামনের দিকে অন্যান্য বই, পত্রপত্রিকা ডাঁই করে রাখা আছে, সেসব ঠেলে সরিয়ে নজর চালানোর মতো জায়গা বার করলেন। পেছনের সারির তিননম্বর বইটা হলেও হতে পারে। খবর কাগজের মলাট হলুদ হয়ে গেছে, তার ওপর পেন দিয়ে লেখাটা আবছা হয়ে যাওয়ায় পড়া যাচ্ছে না, তবে দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা দেখে সুকুমারই মনে হচ্ছে।
ছাই, হাত বাড়িয়েও নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না, বড় একটা টুল হলে সুবিধে হত। যাইহোক, আপাততঃ ঘাড় উঁচু করে ডিঙি মেরে বইটার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করলেন।
হঠাৎ কোথা থেকে কী হয়ে গেল বোঝা গেল না। ভারি কিছু উল্টে পড়ার শব্দে বাড়ির সবাই দৌড়ে এল। তারপর ধরাধরি করে যন্ত্রনাকাতর বিরিঞ্চিবাবুকে তুলে সোজা নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে।
পাক্কা দশদিন পরে, পায়ে প্লাস্টার, হাতে ব্যান্ডেজ, কোমরে বেল্ট লাগিয়ে বাড়ি ফিরলেন বিরিঞ্চিবাবু। এখন বেশ কয়েকদিন বিছানাতেই থাকতে হবে; নড়াচড়া যত কম তত ভালো, বলে দিয়েছেন ডাক্তার। লেখালেখির উপায় নেই, পড়াশুনো চলতে পারে।
গিন্নি একগাদা নতুন আসা পত্রপত্রিকা দিয়ে গেলেন। আশ্চর্য প্রদীপের 'খিকখিক খ্যাঁকখ্যাঁক' সংখ্যাটাও আছে তার মধ্যে। হাত পায়ের চোট বাঁচিয়ে, ব্যথা সামলে পত্রিকাটা হাতে নিলেন বিরিঞ্চিবাবু।
প্রচ্ছদ তো দারুন, দ্বিতীয় পাতায় দু কলম জুড়ে সূচিপত্র। নিচে চৌকো বাক্সের মধ্যে লেখা, "দুর্ঘটনাজনিত অসুস্থতার কারণে বিখ্যাত লেখক বিরিঞ্চি সমাদ্দারের প্রথম লেখা হাসির গল্প এই সংখ্যায় প্রকাশ করা গেল না। লেখকের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।" যাক বাবা, কারণটা বলেই দিয়েছে, বদনামের ভয়টা কম, খুশি হলেন বিরিঞ্চিবাবু। তবে খুশির দামটা একটু ভারী পড়ল আরকি! তা আর কী করা যাবে অতবড় চেহারা নিয়ে টুল উল্টে গেলে ভারী তো পড়বেই; যেভাবে পড়েছিলেন, একেবারে সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করেননি সেই ভাগ্যি।
ভাবতে ভাবতে পাতা উল্টে যাচ্ছিলেন বিরিঞ্চিবাবু। পাতাজোড়া একটা চৌকো বাক্সে 'একটি বিশেষ ঘোষণা' দেখে চোখ আটকে গেল।
কী কান্ড! 'হ য ব র ল রহস্য'র যতটুকু লিখেছিলেন, সেটা হুবহু ছেপে দেওয়া আছে। নিচে বলা আছে, লেখক এই লেখা শেষ করতে পারেননি দুর্ঘটনাজনিত কারণে। বৈপরীত্যের মাঝেই হাসি লুকিয়ে থাকে এই দার্শনিক বিশ্বাস থেকে পরের রহস্য গল্প সংখ্যায় তাঁর এই হাসির গল্পটি প্রকাশ করা হবে। আর রহস্য গল্পের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের কথা মনে রেখে 'আশ্চর্য প্রদীপ' একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে। লেখকের শুরু করা খসড়া হাসির গল্পের সূত্র ধরে রহস্য গল্প লিখে পাঠাতে হবে দুহাজার শব্দের মধ্যে। বিরিঞ্চিবাবুই বিচার করবেন, বাছাই করা প্রথম তিনটি গল্প পুরস্কার পাবে, পাঁচটি গল্প প্রকাশিত হবে ওই বিশেষ রহস্য সংখ্যায়। পুরস্কার মূল্য সহ অন্যান্য নিয়মাবলীও বিশদে দেওয়া আছে।
কী গেরো, গিন্নিকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন, দুর্ঘটনার পরেরদিন রতন বলে একটি ছেলে এসে লেখা চাইতে গিন্নি ওই নোটপ্যাড থেকে ওপরের পাতাটা ছিঁড়ে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। রাগে হতাশায় পাশ ফিরে শুতে গিয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে অনুরোধের ঢেঁকি গেলার কষ্ট হাড়ে হাড়ে অনুভব করলেন বিরিঞ্চিবাবু।
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি