সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
বিলাসবাবুর বন্দুকবাজি

শিবনগরের জমিদার বাড়ির বড়তরফের কর্তা বিশালবপু বিলাসবাবুর নড়তে চড়তে একটু বেশি সময় লাগে, তাঁর গজেন্দ্র গমনে মাটিতে ছাপ পড়ে| ওখানকার ওস্তাদ চোর দীনু তার পাতলা সিড়িঙ্গে চেহারা নিয়ে বরাবরই খুব চটপট আর চুপিসাড়ে হাতের কাজ সারতে পারে; কোনওদিন ধরা পড়েনি, তাড়াও খায়নি। অথচ একদিন জমিদার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকে দীনু খুব জব্দ হল বিলাসবাবুর কাছে। এই আজব কান্ডটা নিয়ে অনেক রকম গুজব চারদিকে ভেসে বেড়ায়। কেউ কেউ বলে চোর তাড়ানোর সময় লম্ফঝম্প করতে করতে বিলাসবাবু দোতালার বারান্দা ভেঙে পড়েছিলেন পলায়নরত দীনুর ওপর, কেউ আবার অন্য কথা বলে। সত্যি মিথ্যে যাচাই করতে গেলে এলাকার সবাই মুচকি হাসে; শুধু বিলাসবাবু গম্ভীর হয়ে যান আর দীনু উদাস। রকমফের আছে বলেই না গুজব হাওয়ায় ভাসে, তা নিয়ে চর্চা হয়; আর ইতিহাস মাটি খুঁড়ে বার করতে হয়, তারপরেও তা বইয়ের পাতা থেকে পরীক্ষার খাতার মধ্যে রয়ে যায়!

আরাম-আয়েস ছাড়াও জমিদারির স্মৃতি হিসেবে বিলাসবাবুর ছিল একটা বন্দুক - দোতালায় শোওয়ার ঘরে, আলমারিতে তোলা থাকত বরাবর; মালিকের মতই সুখী জীবন ছিল তার। প্রতি বছর একবার বিলাসবাবুকে থানায় যেতে হত বন্দুক আর লাইসেন্সের কাগজপত্র নিয়ে। বছরে ওই একবারই ওটাকে বার করে পরিষ্কার করে পুজো করা হত, থানায় যাওয়ার আগে। কাগজপত্রের কাজ মিটে গেলে আবার বন্দুক ফিরে যেত আলমারিতে এক বছরের জন্য। এছাড়া ওটার অন্য কোনওরকম ব্যবহার এলাকার অতিবৃদ্ধদেরও মনে পড়ে না। শুধু গুজবে কান দিলে শোনা যায়, বিলাসবাবুর হাতে দীনুর জব্দ হওয়ার পেছনে নাকি ওই বন্দুকটার বড় ভূমিকা ছিল।

বাৎসরিক বন্দুকপুজোটা পাঁজিতে না থাকলেও বিলাসবাবুর বাড়িতে হয়ে আসছে বহুদিন থেকে। দোল-দুর্গাপুজোর মত না হলেও, পাড়াপড়শী বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন সঙ্গে নিয়ে বেশ ধুমধাম করে পুজোটা হয়। পুরুতমশাই অমৃতযোগ-মাহেন্দ্রক্ষণ ইত্যাদির সূক্ষ্ম হিসেব কষে, আলমারি থেকে বন্দুক বার করার দিনক্ষণ বলে দিতেন। বন্দুক পরিষ্কার পর্ব চলত দিন দুয়েক। তারপর পুজোর দিনে ঘটোত্তোলন, পুষ্পাঞ্জলি, থানার উদ্দেশ্যে যাত্রারম্ভ, আরতি, ঘটবিসর্জন, বন্দুকশয়ন – সবই হত তিথি-নক্ষত্র মিলিয়ে। শান্তিজলের পর আলমারিতে বন্দুক তুলে রাখা হত নতুন কাপড়ে মুড়ে। প্রতিটা কাজের খুঁটিনাটি নিয়মকানুন বলে দিতেন পুরুতমশাই; সঙ্গে দশকর্মা-দানসামগ্রীর ফর্দও। খাওয়াদাওয়া, বাজারহাট সহ অন্যান্য জোগাড়যন্ত্রের জন্য বিলাসবাবু মধ্যমণি হয়ে মুরুব্বিদের নিয়ে বৈঠকে বসতেন; চা, পান, চাপানউতোরের মধ্যে দিয়ে পুজোর আয়োজন জমজমিয়ে এগোতো। এক এক করে ঝি-ঝিউড়িরা এসে পৌঁছত; হাঁকডাক, ছোটাছুটি আর ধমকধামকে বাড়িটা গমগম করত কয়েক দিনের জন্য।

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময় গতে আলমারি থেকে বন্দুক বার করে বিলাসবাবু গম্ভীর চালে এসে বসতেন উঠোনে রাখা তক্তপোষে, যেন পুজোমণ্ডপে ঠাকুর বসল। বন্দুক সাফসুতরো করতে তেলজলের আয়োজনে খামতি থাকত না। সরু-মোটা-সুতি-রেশম রকমারি কাপড়, লম্বা-ছোট-শক্ত-মোলায়েম নানা রকম বুরুশ, এসবও তৈরি থাকত। আরও থাকত ঝকঝকে পালিশের জন্য নারকেল তেল, মরচে তুলতে কেরোসিন, তিল-তিসি-সর্ষের তেলও থাকত। বুড়ি পিসিমার পরামর্শে ভেতরটা সাফ করার জন্য থাকত রেড়ির তেল, পুরানো ঘি আর রসুন তেল; যদিও বন্দুকের বায়ু বা কফের সমস্যার কথা কেউ কোনোদিন শোনেনি। পরিষ্কার পর্বে শোরগোল কম হত না; উঠোনে ভিড় জমে যেত। 'তেল লাও', 'জল লাও' ইত্যাদি হাঁকডাকের কাছে কোথায় লাগে একালের অয়েলিং বা সার্ভিসিং! বয়স্য পরিবৃত হয়ে বন্দুক পরিষ্কার আর রাজা-উজির মারা চলত সমান তালে। ঢালাও চা-পান-সরবতের ব্যবস্থা থাকায় মতামত দেওয়ার মত বিশেষজ্ঞের অভাব হত না। রঙিন 'হোলি হ্যায়' বা শিশিরের গন্ধমাখা 'যা দেবী সর্বভূতেষু'-র মতো তেলকালি মাখা 'ব্যারেল-ম্যাগাজিন-স্টক-কার্তুজ' ইত্যাদি শব্দগুলো হাওয়ায় ভর করে নাচতে নাচতে ছড়িয়ে পড়ত বাড়ির আনাচে কানাচে।

বন্দুক পরিষ্কারের পরে পরীক্ষা পর্ব; কাজটা বিলাসবাবু নিষ্ঠা ভরে করতেন। গুলি চালানোর ঝামেলা অনেক; তবু উড়ন্ত পাখি, ছুটন্ত বেড়াল কিছুই রক্ষে পেত না তাঁর বন্দুকের নিশানা থেকে। অতি উৎসাহী কেউ হয়ত বলে ফেলল – "ওই আমড়া গাছের মগ ডালটা ঠিকঠাক নিশানায় আসছে তো কত্তা!" অমনি কত্তা আমড়া গাছের দিকে বন্দুক তাক করতেন আর লোকজন দম বন্ধ করে বসে থাকত – 'এই বুঝি গুলি ছুটল'! কিছুক্ষণ পরে মাথা নেড়ে বন্দুক নামিয়ে তিনি আবার চিন্তিত মুখে ঝাড়পোঁছ শুরু করতেন, সবাই স্বস্তিতে মাথা দুলিয়ে আবার চায়ে চুমুক দিত। কেউ 'আহা' বলে উঠলে বোঝা মুশকিল হত সেটা বন্দুকের জন্য না চায়ের জন্য। শেষ পর্বে কেউ মাথায় কুমড়ো নিয়ে উঠোনের একপ্রান্তে দাঁড়াত, অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বন্দুক তাক করে বিলাসবাবু নানারকম কসরত দেখাতেন। গুলি চলবে না জেনেও দমবন্ধ করে দাঁড়াত দর্শকরা, পাছে মনঃসংযোগ নষ্ট হয়ে যায়। চেহারায় ঠিকঠাক আতঙ্ক ফুটিয়ে তুলতে পারলে কুমড়োধারীর ধুতি-গেঞ্জি সহ নগদ বিদায় জুটত। একবার কেষ্টযাত্রা দলের নন্দ কুমড়ো নিয়ে দাঁড়ানোর সময় দাঁতকপাটি লেগে কাপড় চোপড় ভিজিয়ে সে এক তুমুল কান্ড বাধাল। তার নগদ বিদায় দিয়েই তো নতুন 'হ্যাজাক' বাতি কেনা হল যাত্রাদলের।

নির্দিষ্ট দিনে ষোড়শোপচারে বন্দুক পুজোর সংকল্পে বসতেন বিলাসবাবু। হোম-যজ্ঞ-পুষ্পাঞ্জলি-প্রণাম সেরে প্রসাদী ফুল মাথায় ঠেকিয়ে বন্দুক কাঁধে দৃপ্ত ভঙ্গিতে ভিড় ঠেলে শাস্ত্রমতে যাত্রারম্ভের সমস্ত নিয়ম মেনে রওনা দিতেন থানার উদ্দেশ্যে। জুড়িগাড়ির বদলে গ্রামেরই কোনও ছোকরার মোটরবাইক জমিদারির মান রাখত। রাস্তার মোড়ে বন্দুকের নল শেষবার ঝিকিয়ে ওঠার পরে ভিড় পাতলা হত, কিন্তু একটা উৎসবের মেজাজ ছড়িয়ে থাকত গোটা গ্রামে। বিকেল নাগাদ আবার ভিড় জমত বাড়ির সামনে। মোড়ের মাথায় আকাশমুখো বন্দুকের নল দেখা গেলেই শাঁখ বাজত। গিন্নি ডালা সাজিয়ে দীপ-চন্দন দিয়ে বন্দুক বরণ করে ঘরে তুলতেন। সন্ধ্যের পর আরতির পাট চুকলে শান্তিজল ছিটিয়ে বন্দুককে আবার আলমারিতে তুলে রাখা হত। প্রসাদের ফলমূল-লুচি-হালুয়া-নাড়ু-কদমা বিলির পরে "আসছে বছর আবার হবে" বলতে বলতে সবাই বিদায় নিত। রাত্রে ঘনিষ্ঠদের পাত পড়ত বিলাসবাবুর লম্বা দালানে; পুজোর দিনে মাছমাংসের বালাই নেই, কিন্তু শাকান্নের এলাহি আয়োজন থাকত ভাজা-ডালনা-দই-মিষ্টি-পায়েস সহযোগে।

এমনই এক বন্দুক পুজোর রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পরে নিমন্ত্রিতরা বিদায় নিয়েছে। কাজকর্মের পাট চুকিয়ে বাড়ির লোকজনও যে যার মত শুয়ে পড়েছে। দোতালায় বিলাসবাবু গভীর ঘুমের মধ্যে ডুবে গেছেন অনেক আগেই। গিন্নিও গোছগাছের তদারকি সেরে শুতে গেলেন, তাঁরও যথেষ্ট ধকল গেছে সারাদিন।

বিলাসবাবুদের বাড়িটা পুরানো দিনের দোতলা বাড়ি; মাঝখানে বড়সড় উঠোনের তিনদিকে দালান আর ঘর, একদিকে ধানের মরাই। দালান থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সিঁড়ির মুখে একটা ভারী দরজা, যেটায় সিঁড়ির দিক থেকে শেকল বন্ধ করা যায়। সিঁড়ি শেষ হয়েছে দোতলার বারান্দায়, বারান্দার ও মাথায় একটা ঝাঁকড়া আমগাছ। উপরতলায় থাকেন কর্তা-গিন্নি, নিচের তলায় বাকিরা।

তখন কত রাত্রি জানা নেই; খুব আস্তে কোথাও একটা শব্দ হতে হঠাৎ গিন্নির ঘুম ভেঙে পরিস্থিতি বুঝে নিতে একটু সময় গেল। গিন্নির আন্দাজ একেবারে ঠিক; চোর শিরোমণি দীনু ঢুকেছে বাড়িতে - পুরনো আমলের দামি বাসনকোসন চুরির জন্য। ঠেলা দিয়ে কর্তাকে জাগানোর চেষ্টা করলেন গিন্নি। গুঁতোর চোটে বিলাসবাবুর ঘুম ভাঙতেই দুজনে মিলে প্রাণপণ চিৎকার জুড়লেন - "চোর... চোর... চোর..."।

কপাল সেদিন দীনুর সঙ্গে ছিল না। কত্তা-গিন্নির চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল বাড়ির সবার। বাড়িতে চোর ঢুকলে একদঙ্গল লোক ঘুম থেকে উঠে কি করতে পারে তা সবার জানা; হাতের কাছে যে যা পেল তাই নিয়ে হইচই, চেঁচামেচি, লম্ফঝম্প জুড়ে দিল সবাই। অল্প সময়েই উঠোন সরগরম হয়ে উঠল। আর সে সময় চোর কি করে তাও জানা; দীনু মরাইয়ের আড়ালে বসে ফিকির খুঁজতে লাগল পালানোর।

সব শোরগোল ছাপিয়ে দোতলা থেকে কত্তার গলা শোনা গেল – "বন্দুক নিকালো"। বিজাতীয় ভাষা শুনে উত্তেজনা বেড়ে গেল নিচের তলায়।

কয়েক মূহুর্ত বিরতির পরে আবার কত্তা হাঁক পাড়লেন "গোলি কাঁহা"? নিচে উত্তেজনার আগুনে ঘি পড়ল।

দীনু ভেবে দেখল, খিড়কিতে পাহারা বসে গেছে, সদরের দিকে জটলা। দোতলায় বন্দুক থাকলেও পালানোর জন্য সিঁড়ি দিয়ে উঠে, বারান্দা পেরিয়ে, আমগাছ বেয়ে নেমে যাওয়াটাই সবচেয়ে সুবিধের।

গোলমালের মধ্যে বন্দুক নিয়ে বিলাসবাবু ঘর ছেড়ে সদর্পে সগর্জনে বারান্দায় পদার্পণ করলেন। নিচে উত্তেজনার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল, একেবারে হুলুস্থূল কান্ড। সকালে বন্দুক পুজোর সংকল্প করেছেন, রাত্রে এক গুলিতে চোরের খুলি ফুটো করে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে তিনি ব্যাঘ্রগর্জন ছাড়লেন – "সামনে আও, বেরিয়ে আয় ব্যাটা।" দেরি না করে মরাইয়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দীনু, তারপর গোটা তিন চার লম্বা লাফে সিঁড়িতে পৌঁছেই দরজাটা টেনে শেকল তুলে দিল। নিচের ভিড়টা তাড়া করে এসেও আটকে গেল দরজার সামনে। ধরা পড়ার ভয়টা মজবুত দরজার ওপারে ফেলে রেখে, শব্দ না করে যত দ্রুত সম্ভব সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে গেল দীনু, সামনেই বারান্দা। কত্তার মুহুর্মুহু হুঙ্কার আর গুরুগুরু গর্জনে চারদিক থরহরি কম্পমান হলেও বন্দুক নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই ফাঁক গলে পাঁচেক লাফে বারান্দা পেরিয়ে আমগাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়তে হবে তাকে। কত্তা-গিন্নি জানেনই না নিচে ঠিক কি ঘটে গেছে কয়েক পলকের মধ্যে। একবার উঁকি মেরে বারান্দার অবস্থাটা বুঝে নিয়ে গুরুর নাম স্মরণ করে বুক ভর্তি দম নিয়ে দীনু সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে বারান্দায় মারল লাফ।

বিলাসবাবুর বন্দুকবাজি

কিন্তু কপাল এবারেও তার সঙ্গ দিল না। দীনু যেই না লাফ দিয়ে পড়েছে বারান্দায় অমনি কোত্থেকে লাফ মেরে বিলাসবাবুও বন্দুক বাগিয়ে এসে পড়লেন সামনে। বন্দুকের একেবারে সামনে, বন্দুকবাজির ভাষায় 'পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ'-এ পড়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেল দীনুর। ওস্তাদের ওস্তাদ হলেও দীনুর অভিজ্ঞতায় গুলিবন্দুকের ব্যাপার নেই, সূক্ষ্ম হাতের কাজের কারবারি সে। একবার এক বিয়েবাড়িতে নতুন বউ-এর নাক থেকে নাকমাছি খুলে এনেছিল বটে, কিন্তু নিজের নাকের সামনে বন্দুকের 'মাছি' দেখে দিশেহারা দীনু টাল সামলাতে পারল না।

পড়ে যেতে যেতে দীনু খড়কুটোর মত খামচে ধরল সামনে হাওয়ায় ভাসতে থাকা বিলাসবাবুর ধুতির কাছা, তারপর বেসামাল অবস্থায় খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নিচে। একা নয়, কাছায় কোঁচায় জড়িয়ে গড়গড়িয়ে গড়িয়ে পড়লেন বিলাসবাবুও। বন্দুকও বন্ধুর মত নিজের 'ঘোড়া' সামলে সিঁড়ির বন্ধুর উৎরাই বেয়ে মালিকের সঙ্গে নেমে এল নিচে। খন্ডমুহূর্ত পরে দেখা গেল, বন্দুক দেওয়ালে ঠেস দিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে নিচের থেকে এক ধাপ ওপরে। সিঁড়ির একেবারে নিচের ধাপে উপুড় হয়ে পড়েছেন বিলাসবাবু, পিঠটা ওঠানামা করছে নিঃশ্বাসের সঙ্গে; যেন ভক্তিভরে হাঁটু গেড়ে বন্দুককে প্রণাম করছেন। তাঁর বিশাল বপুর নিচে চাপা পড়ে আছে দীনু, মাথাটা শুধু দেখা যাচ্ছে। মাথার পাশ দিয়ে সিড়িঙ্গে হাত দুটো বেরিয়ে এসে জড়ো হয়েছে ঠিক বন্দুকের কাছে, যেন সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে। চোর আর গেরস্থ দুজনই অজ্ঞান, নো নড়নচড়ন। অনেক কষ্টে দুজনের জ্ঞান ফেরানো হয়েছিল সেদিন।

পরদিন সকালে ডাক্তার বদ্যি করে দেখা গেল দীনুর কোমর ভেঙেছে। বেশ কয়েক দিন হাসপাতলের ভাত খেয়ে সে বাড়ি ফিরেছিল লাঠি হাতে; বাপ-ঠাকুরদার থেকে পাওয়া সিঁদকাঠি হাতে নিয়ে ওস্তাদি দেখানোর ওখানেই ইতি। বিশালবপু বিলাসবাবু তাঁর গজেন্দ্র গমন নিয়েও ধরে ফেললেন ওস্তাদের ওস্তাদ দীনু চোরকে! মান-ইজ্জৎ সব হারিয়ে দীনু হঠাৎ করেই বুড়িয়ে গেল, লোকে বলে শরীরের চেয়েও মনে আঘাত লেগেছিল বেশি।

বিলাসবাবুও ব্যথায় কাতর ছিলেন। তবে হাসপাতালে যাওয়ার দরকার হয় নি, বাড়িতে জড়িবুটির মালিশেই কাজ হল। সুস্থ হতেই বিলাসবাবু বন্দুক-বিলাসে যবনিকা টানলেন; বন্দুক নিয়ে তাঁর আদিখ্যেতা বন্ধ হয়ে গেল। বন্দুক বিক্রি করে দিলেন। কখনও কথা উঠলে একটা শুকনো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে চুপ করে যান। তাঁরও মানে আঘাত লেগেছিল খুব, বয়সটা তাই লাফিয়ে বেড়ে গেল কয়েক ধাপ।

কি ঘটেছিল তা শুধু বিলাসবাবু আর দীনুই জানে। লোকে বলে গুলি-বন্দুকে অনভ্যস্ত দীনু আতঙ্কে আঁধার না দেখলে বুঝতে পারত, বন্দুক বাগিয়ে বিলাসবাবু লাফ মেরে সামনে এসেছেন বটে কিন্তু মুখোমুখি নয়; তাঁর মুখ বাইরে আমগাছের দিকে, দীনু তাঁর পেছনে, আর বগলে চেপে ধরা বন্দুকের নল দীনুর দিকে তাক করা। আসলে, বিলাসবাবুরও নিত্যদিন বন্দুক ধরার অভ্যেস নেই, চরম উত্তেজনায় তিনি একটা ছোট্ট গন্ডগোল পাকিয়েছেন - কুঁদোটা আমগাছের দিকে তাক করে বগলে চেপে ধরেছেন বন্দুকের নলটা। বাড়িতে চোর ঢুকলে গেরস্থ কি 'কুঁদো আগে না নল আগে' তাই নিয়ে ন্যায়শাস্ত্রের সূক্ষ্মবিচারে বসবে!

মরুকগে যাক; এখন বন্দুক নেই, তবে বন্দুকের ছবি আছে দেওয়ালে। এখন বছরে একদিন বাড়িতে নারায়ণের পুজো হয় একটু ভাল করে। সেদিনই বন্দুকের ফটোতে ধুপ জ্বেলে মালা দিয়ে বিলাসবাবু হাঁটুগেড়ে ভক্তিভরে প্রণাম করেন, ভুঁড়ির জন্য সাষ্টাঙ্গে প্রণাম তাঁর পক্ষে অসম্ভব। দীনুও আসে, প্রণাম করে প্রসাদ নেয়; তার আবার সাষ্টাঙ্গ প্রণাম ছাড়া উপায় নেই, কোমর ভাঁজ করা তার পক্ষে অসম্ভব। সন্ধ্যেবেলা তুলসীতলায় হরিনামের সঙ্গে বাতাসা লুঠ হয়। হরির লুঠের সময় মাথায় বাতাসার ধামা নিয়ে বিলাসবাবু 'যাদবায় মাধবায়' গাইতে গাইতে দেখে নেন দীনু কোনদিকে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর প্রথম বাতাসার মুঠোটা সেদিকেই তাক করে হওয়ায় ভাসিয়ে দেন, দীনুও হাওয়ার ভাসা বাতাসা মুঠো করে ধরে নেয়।


ছবিঃ পিনাকী দত্ত

জন্ম আর বড় হওয়া অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় হলেও কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া আর চাকরির সুবাদে এখন হাওড়ার বাসিন্দা। দেওয়াল পত্রিকায় লেখা শুরুর পরে স্কুল কলেজের পত্রিকা ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বই পড়া, নাটক দেখা, গান শোনারও নেশা আছে। পেশাসূত্রে দেশবিদেশে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা লেখার মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছেও আছে ।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা