সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

সাল ১৯৪৫। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষ হওয়ার মুখে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি জাপানের বন্দর শহর কোবের ওপর হঠাৎ একদিন দেখা দিল ঝাঁকে ঝাঁকে মার্কিনি যুদ্ধবিমান। সতর্কতার সাইরেনের আওয়াজ থামার আগেই মাটির দিকে ধেয়ে এক শত শত বোমা। সেই বোমা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে ফেটে পড়ল প্রবল বিস্ফোরনে। চারিদিকে আগুন লেগে গেল। সেই আগুনে ধ্বংস হয়ে গেল বাড়ি ঘর, রাস্তা ঘাট, স্কুল, হাসপাতাল; মারা গেল অগুন্তি মানুষ; আহত হল আরো কত শত মানুষ।

সেই ভয়ানক দিনে, সেইতা নামের চৌদ্দ বছরের এক কিশোর, তার চার বছরের ছোট্ট বোন সেতসুকোকে নিয়ে পড়ল মহাবিপদে। বোমারু বিমান আসার খবর নিয়ে সাইরেন বাজার সাথে সাথে সেতসুকো আর সেইতার অসুস্থ মা রওনা দিয়েছিলেন বম্ব শেল্টারের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। তাদের জাহাজী বাবা গেছেন যুদ্ধ করতে। এদিকে দুই ভাইবোন তাদের শেষ মূহুর্তের সঞ্চয়গুলি মাটির নিচে ভাঁড়ারে লুকাতে ব্যস্ত ছিল। তারা যখন কাজ শেষ করে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটল, তখন মাথার ওপর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসছে আগুনে বোমা। কিভাবে যে সেইতা নিজেকে আর ছোট্ট বোনকে বাঁচাল, সে নিজেই জানে না। সেই ভয়ানক বোমাবাজি থামার পরে, যখন মোটা কালো ধোঁয়া আর ছাই একটু একটু করে সরতে থাকল, তখন সেইতা তার মাকে খুঁজতে বেরোল। মাকে তারা খুঁজে পেল একটু পরেই, স্কুলবাড়ির মধ্যে বসা অস্থায়ী হাসপাতালে। মা বোমার আঘাতে গুরুতর জখম হয়েছিলেন। তিনি আর বেঁচে ছিলেন না।

অগত্যা অনাথ দুই ভাই বোন আর কোন উপায় না দেখে আশ্রয় নিল অন্য শহরে দূর সম্পর্কের এক মাসির বাড়িতে। মাসি প্রথম দিকে আদর যত্ন করলেও, কিছুদিনের মধ্যেই দুটো বেশি পেটের ভাতের যোগান দিতে বিরক্ত হয়ে গেলেন। এর মধ্যে একদিন সেইতা তাদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে গিয়ে তাদের শেষ সঞ্চয় খাবারগুলি এবং অন্যান্য জিনিষপত্র নিয়ে এল। বয়াম ভর্তি আচার, আর অন্যান্য শুকনো খাবার যা ছিল মাসিকে দিল। তবে সে একটা জিনিষ রেখে দিল- ফ্রুট ড্রপ্‌স্‌ (নানারকম ফলের স্বাদওয়ালা লজেন্স)এর একটা ছোট্ট টিন। বোন যখন খুব মন খারাপ করে বসে থাকে, বা আবদার করে, তখন সে তাকে চুপিচুপি বার করে দেয় সেই ফ্রুট ড্রপ্‌স্‌ এর টিন। নানা স্বাদের ছোট্ট গুলি মুখে পুরে তার বোনও হয় মহা খুশি। ওদিকে সেতসুকো আর সেইতার মাসি বললেন, তাদের যদি ভাত খেতে হয়, তাহলে মায়ের কিমোনোর বদলে চাল কিনতে হবে। সেইতা বাধ্য হল মায়ের জন্য বাবার পাঠানো কিমোনোটি মাসির কাছে বিক্রি করতে।

যুদ্ধের চাপ বাড়ার সাথে সাথে খাবারের যোগান কমে আসছিল; সাথে সাথে বাড়ছিল সেইতা আর সেতসুকোর মাসির বিরক্তি আর মুখঝামটানি। শেষে একদিন দুই ভাই বোনে ঠিক করল তারা আলাদাই থাকবে। দুজনে নিজেদের অল্প সম্বল গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়ল, আর শহরের বাইরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে এক পরিত্যক্ত বম্ব শেল্টারে আশ্রয় নিল। নিজেদের জন্য এইরকম দারুণ সুন্দর একটা থাকার জায়গা পেয়ে তারা তো খুব খুশি। রাতের অন্ধকার কাটানোর জন্য তারা দুজনে জোনাকি ধরে এনে মশারির মধ্যে ছেড়ে দিল। তারপরে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।

কিন্তু পরদিন সকালে খাবার যোগাড় করে ফিরে এসে সেইতা দেখল , সেতসুকো ঘরের সামনে একটা ছোট্ট কবর খুঁড়েছে- তার সব জোনাকি সকালে মরে গেছে। সেতসুকো পরম যত্নে তার প্রিয় জোনাকিদের কবর দেয়। তার মনে পড়ে তার হারিয়ে যাওয়া মায়ের কথা, নিখোঁজ বাবার কথা। সেইতা ছোট্ট বোনকে নানা কথায় ভোলায়। দুজনে এক সাথে রান্না করে, স্নান করে, খেলা করে, সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যায়।

নিজেদের মত করে বাঁচতে চাওয়া সেই দুটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ের জীবন কিন্তু মোটেও সহজ রইল না। কিছুদিনের মধ্যেই চালের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেল। সেইতা গ্রামের চাষীদের কাছ থেকে ধার চাইতে শুরু করল। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে সবারই খাবারে টানাটানি, কেই বা আর রোজ সাহায্য করে? শেষে সেইতা এক অসৎ উপায় ধরল। যখনই বোমা পড়ার সাইরেন বাজত, আর সবাই নিজেদের বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে পালাত, সেইতা তখন ধেয়ে যেত সেইসব ফাঁকা বাড়িগুলির দিকে। যেখানে যা পেত- খাবার, জামাকাপড়- চুরি করে নিয়ে চলে আসত।

কিন্তু এইভাবে কতদিন বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে পারল এই দুটি অসহায় ভাই বোন? সেতসুকো আর সেইতার জীবন কোন দিকে মোড় নিল? গল্পের সেই শেষ অংশ আর আমি বলব না। ১৯৮৮ সালে স্টুডিও ঘিবলির প্রযোজনায় তৈরি এই জাপানি অ্যানিমেশন ছবিটি ইউটিউবে বিনামূল্যেই দেখতে পাওয়া যায়। তাই কোন ছুটির দিনে সময় করে দেখে নাও এই ছবিটি।

গ্রেভ অফ দ্য ফায়ারফ্লাইজ উপন্যাসের লেখক আকিয়ুকি নোসাকার ছোটবেলা কেটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপানে। চোখের সামনে নিজের বোনেদের অনাহারে, অপুষ্টিতে মারা যেতে দেখেন তিনি। সেই বেড়ে ওঠার বয়সে অনেক সময়ে অল্প খাবার সংগ্রহ হরতে পারলে, বোনের সাথে ভাগ না করে একাই খেয়ে ফেলতেন তিনি। বড় হয়ে সেই সব দুঃখজনক স্মৃতিকে মাথায় রেখেই ১৯৬৭ সালে তিনি লেখেন আত্মজীবনীমূলক এই উপন্যাস, জাপানি ভাষায় যার নাম- হোতারু নো হাকা। তাঁর লেখা এই উপন্যাসটিকে নিয়ে অনেকেই ছবি বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নোসাকা রাজি হন নি। শেষে যখন তাঁর কাছে অ্যানিমেশন তৈরির প্রস্তাব আসে, তখন তিন সম্মতি দেন, কারণ তিনি মনে করেছিলেন সেলুলয়েডের থেকে অ্যানিমেশন এই গল্পকে অনেক বেশি প্রাণ দিতে পারবে। জাপানের অ্যানিমে শৈলীতে তৈরি এই অ্যানিমেশন ছবিটি যুদ্ধের কঠিণ বাস্তবতা,আর তার মাঝেই দুটি প্রাণচঞ্চল ভাই-বোনের বেঁচে থাকার লড়াই, তাদের নিজেদের ছোট ছোট আনন্দ- সব কিছুকেই অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।

তাঁর আশা ব্যার্থ হয়নি। ছবির পরিচালক ইসাও তাকাহাতা অবশ্য তাঁর এই ছবিটিকে যুদ্ধ বিরোধী ছবি বলেন না,বরং যুদ্ধের পটভূমিকায় দুটি ছেলেমেয়ের জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত এবং তার ফলাফলের গল্প হিসাবেই দেখেন। কিন্তু সারা পৃথিবীর সমালোচক এবং দর্শকদের মধ্যে অনেকেই এই অ্যানিমেশন ছবিটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় তৈরি যুদ্ধ-বিরোধী, মানবিক সেরা ছবিগুলির মধ্যে একটি বলে মনে করেন।


ছবিঃসংগৃহীত

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা