দার্জিলিং জমজমাট
না বাপু, নাম দেখে ভেবে বস না আমি ফেলুদার গল্প লিখতে বসেছি। কিন্তু কি করব বল, সেই ছোট্টবেলায় যেহেতু পড়েছিলাম 'দার্জিলিং জমজমাট', তাই প্রথমেই এই শব্দদুটো মনে পড়ল, তাই ভাবলাম আমার আজকের বেড়াতে যাওয়ার গল্পের নাম এই হোক।
যাক্গে, যা বলছিলাম। ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে আমরা, মানে আমি, বাবা, মা আর ভাই, সবাই মিলে দার্জিলিং বেড়াতে গেছিলাম। শীতের শুরুতে যাচ্ছি, তাই একটু ভয় ভয় ছিল মনে, যে বোধ হয় খুব ঠাণ্ডা লাগবে। তা সে যাই হোক, ঠাণ্ডা উপভোগ করতেই ত যাওয়া, তাই না? তাই বেশি ভাবনা চিন্তা না করে ব্যাগ-বাক্স গুছিয়ে, নির্দিষ্ট দিনে বেরিয়ে পড়লাম। ট্রেন ছিল দার্জিলিং মেল, শিয়ালদা স্টেশন থেকে রাত দশটায় ছাড়ে। কামরায় উঠে , জায়গা নিয়ে গুছিয়ে বসে, বাড়ি থেকে নিয়ে আসা স্যান্ড্উইচ আর মিষ্টি খেয়ে যে যার বার্থে কম্বলচাপা দিলাম। আধো ঘুম- আধো জাগরণের মধ্যে দিয়ে সকাল হয়ে গেল।
সকালে ট্রেন আধাঘন্টা দেরি করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছাল। ইতিমধ্যে আমাদের আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাড়ির ড্রাইভার আমাদের ফোন করে ফেলেছেন। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার জন্য প্রচুর শেয়ার জীপ, অন্যান্য গাড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু যেহেতু আমার বাবা-মা দুজনেরই বয়স হয়েছে, তাই আমরা আলাদা গাড়িতে যেতে চেয়েছিলাম। এই বিষয়ে আমাদের সাহায্য করেছিলেন আমাদের বন্ধু 'নেচারবিয়ন্ড' - এর পার্থ।
যাইহোক, স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের নির্দিষ্ট গাড়ি খুঁজে পেলাম। মাল পত্র সব তুলে গুছিয়ে বসলাম। বেশ ঝলমলে রোদ ছিল, যদিও নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে মোটেও দেখা গেল না।
চা বাগানের মধ্যে দিয়ে পথ
শিলিগুড়ি শহর দ্রুত ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ি সেবকের রাস্তা ধরল। পাশে পাশে চলতে শুরু করল টয় ট্রেনের লাইন। তবে সে বেশিদূর আমাদের সঙ্গ দিল না। আমাদের গাড়ি একটু পরেই বাঁ দিকে ঘুরে গেল। দুই-পাশে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলল। পেরিয়ে গেলাম এক বিস্তৃত সেনা ছাউনি। তারপরে গাড়ি ডান দিকে ঘুরে এক পাহাড়ি রাস্তা ধরল। সে রাস্তা বড় এবড়ো-খেবড়ো, পাথরে ভরা। গাড়ির ঝাঁকুনিতে তো গায়ে ব্যথা হয়ে যাওয়ার যোগাড়। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার বললেন, এই পথের নাম রোহিনী। আমি প্রায় বছর পনেরো আগে দার্জিলিং গেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে। তখন উঠেছিলাম পাঙ্খাবাড়ির পথ ধরে, আর নেমেছিলাম হিলকার্ট রোড (এন-এইচ ৫৫) ধরে।
তাই আমি ভেবেছিলাম আমাদের গাড়ি সেই হিলকার্ট রোড ধরেই যাবে। যাওয়ার আগে আমাদের খুব একটা জানাও ছিল না যে এই রাস্তা সারানোর কাজ চলছে, তাই সেখান দিয়ে যাত্রীবাহী গাড়ি যাওয়া নিষেধ। আমরা তো তাই ভাবছি, আমাদের ড্রাইভার এ কোন রাস্তা দিয়ে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে রে বাবা! আমার বন্ধু বিক্রম আমাকে বলে দিয়েছিল, ড্রাইভারকে বলবি রোহিণীর রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে। ফলে আমি আরো অবাক হচ্ছিলাম- এই বাজে রাস্তায় যেতে বললে কেন কে জানে...
যাইহোক, পাল্কির মত দুল্কি চালে গাড়ি তো চলতে লাগল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অনেক ওপরে বাঁ দিকে দেখতে পেলাম অনেক বাড়িঘর - একটা শহর। ড্রাইভার বলল, ওইটা কার্সিয়ং, আমরা ওখানেই যাচ্ছি। ওরেব্বাবা!
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় ধীর-মাঝারি গতিতে গাড়ি ক্রমশঃ ওপরে উঠতে থাকল। রাস্তার এক দিকে পাহাড়ের দেওয়াল, অন্যদিকে গভীর হতে থাকা খাদ। অনেক নিচে দেখতে পাওয়া গেল ছোট ছোট বাড়ি -ঘর, রূপোলী নদী, ফিতের মত রাস্তা। একটা কথা এখানে না বললেই নয়। পাহাড়ের গাড়ি চালকেরা কিন্তু খুব ধীর-স্থির ভাবে গাড়ি চালান। যদি একটা বাঁকে দুটো গাড়ি মুখোমুখি হয়ে যায়, তাহলে নিজেদের মধ্যে ইশারায় যেকোন একজন থেমে গিয়ে অন্যজনকে আগে উঠে বা নেমে যেতে দেন। কোন হই-হল্লা নেই, ধাক্কা -ধাক্কি নেই, নিয়ম ভেঙে এগিয়ে যাওয়া নেই।
কার্সিয়ং
ঘন্টা দুয়েকের মাথায় আমরা অবশেষে কার্সিয়ং পৌঁছালাম। এতক্ষণ আমাদের সোয়েটার পড়তে হয়নি। কিন্তু এবার একটু কুয়াশা আর মেঘ দেখা দিল, আবহাওয়া একটু ভেজা ভেজা, বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। ভাই বলল, গুগল্ বলছে আগামি ৪-৫ দিন এইরকমই আবহাওয়া থাকবে! ড্রাইভার বললেন, এইরকমই চলছে গত দুই-তিন দিন ধরে। যাঃ বাবা, এত ভেবে-চিন্তে নভেম্বরের গোড়ায় এসে শেষে কিনা মেঘ-বৃষ্টি!যাইহোক, সেইসব ভাবনা আপাততঃ মুলতুবি রেখে আমরা কার্সিয়ং এর বাস স্ট্যান্ডে গরম গরম মোমো আর চা খেয়ে নিলাম।
তারপরে আবার যাত্রা শুরু। ঘন্টাখানেকের পরে দেখা দিল দার্জিলিং শহর। প্রথম দেখায় মোটেও খুব ভাল লাগবে না। গিজগিজে বাড়িঘর, ভীড়ে ঠাসা বাজার এলাকা, জিপ আর প্রাইভেট গাড়ি ভর্তি, হোটেলের দালালদের ধাক্কাধাক্কি। তবে তার মধ্যেও মন কেড়ে নিল পথের ধারে পাহাড়ি বাড়ির বারান্দায় ফুটে থাকা মরসুমি ফুলের সারি।
পথের ধারের ফুলের বাগান
লাল কোট পড়া স্কুলের মেয়েদের দঙ্গল পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম আমাদের কয়েকদিনের বাসস্থানে- চৌরাস্তা মল থেকে একটু এগিয়ে, উইন্ডামেয়ার হোটেল আর সাউথফিল্ড কলেজকে ডান হাতে রেখে, সেন্ট অ্যান্ড্রিউজ চার্চকে ডান হাতে রেখে, জিমখানা ক্লাবের পরে অবজারভেটরি হিলের ওপরে এক পাশে দার্জিলিং টুরিস্ট লজে। এই হোটেলটি পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তর পরিচালনা করে। এই হোটেলের সবথেকে বড় মজা হল এর নিজস্ব একটা ছোট ফুলে সাজানো লন আছে।
ঘরে ঢুকে তো বেশ মন ভাল হয়ে গেল। ঘরের লাগোয়া ছোট বারান্দার জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সবুজ লন, লন পেরিয়ে লম্বা জুনিপার, আর তারপরেই - সাদা কুয়াশা। আর কিছুই দেখা যায় না। যাইহোক, তাড়াতাড়ি স্নান করে নিয়ে রোদ থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়লাম। একটু হাঁটলেই মল। সেখানে পথের পাশে পাতা বেঞ্চে বসে পর্যটক এবং স্থানীয় মানুষেরা রোদ পোহাচ্ছেন। ছোট বাচ্চারা ঘোড়ায় চরে ঘুরছে, এক ঝাঁক পায়রা খাবারের লোভে হু-উ-উ-শ করে উড়ে আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। ঘোড়ার গায়ের গন্ধে অবশ্য একটু বিরক্তি লাগছিল।
অবজারভেটরি হিল রোড
যাইহোক, এক পাহাড়ি চা-বিক্রেতা মহিলার কাছ থেকে চা খেয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম অব্জারভেটরি হিলের পথ ধরে। পথের একদিকে শ্যাওলা মাখা পাথুরে দেওয়াল, অন্যদিকে ঢালু খাদের মত নেমে গেছে। সেইখানেই দেখতে পাচ্ছি নানা হোটেল, সুন্দর সাজানো বাগান, ছোটখাট বাড়ি, মাঝে মাঝে পথের ধারে বসার জন্য বেঞ্চ পাতা। কিন্তু পাহাড় আর দেখতে পাচ্ছি না। এই পথে হাঁটছেন পর্যটকেরা, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, বয়স্ক তীব্বতী মহিলারা - বেশ লাগছে চুপচাপ ঠাণ্ডা মাখা পথ ধরে হাঁটতে।
এক চক্কর কাটতে না কাটতেই ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে পড়ল। বাবা-মাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে, আমি আর ভাই একটু সন্ধ্যের চৌরাস্তা দেখব বলে বেরোলাম। এদিক-সেদিক ঘুরে, বাজারের এক ছোট দোকান থেকে কিনে খেলাম তীব্বতী খাবার শ্যাবেলে।হোটেলে বলে দিয়েছিল রাত আটটার মধ্যে ডিনার খেয়ে নিতে। আমরা তো শহুরে লোক, ভাবছি এত তাড়াতাড়ি আবার রাতের খাবার কেউ খায় নাকি! কিন্তু ডাইনিং রুমের বয়স্ক পরিবেশক সন্তবীর ঠামি , যাঁর আর মাত্র তিন মাস চাকরি আছে, যখন আমাদের বললেন, এর পরে তাঁকে দুই কিলোমিটার এগারো নম্বরের ভরসায় ফিরতে হবে, আর পথে লোডশেডিং-ও হতে পারে, তখন বুঝলাম কেন আমাদের 'আর্লি ডিনার' করতে বলা হয়েছিল। তারপর থেকে বাকি দিন গুলিতে আর কোনদিন দেরি করে রাতে খেতে নামিনি।
কুয়াশা ঢাকা দার্জিলিং
তারপরে তো দিন দুয়েক কেটে গেল। কাঞ্চনজঙ্ঘা তো দূর, আশেপাশের কোন পাহাড়েরই দেখা নেই। সব কুয়াশায় ঢাকা। প্রথম দিন যাও বা দিনের বেলায় একটু রোদ ছিল, তার পরের দিন তো একদম কুয়াশা আর মেঘ। হোটেলের জানালা থেকে দেখে মনে হচ্ছে আমাদের বাগানটার পরেই বোধ হয় আর কিছু নেই। তার মধ্যেই আমরা সকাল বিকেল হাঁটছি যতটা সম্ভব।আর সকাল বিকেল খুব ভাল ভাল দার্জিলিং চা খাচ্ছি।
মন ভাল করে দেওয়া দার্জিলিং চা
ঠান্ডার মধ্যে ভোরবেলা বাবা-মাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে, একদিন সবাই মিলে দিনের বেলাই গেলাম টাইগার হিল দেখতে। টাইগার হিলে ওঠার পথ বড় সুন্দর। কিন্তু ওপরে উঠেও চারিদিকে শুধু মেঘ আর কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। ফেরার পথে একটু ঘুরে দেখে নিলাম বাতাসিয়া লুপের ফুলে ভরা বাগান।
বাতাসিয়া লুপের শহীদ মিনার
হিহি করে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এসে, দার্জিলিং স্টেশনের কাছে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম আমি আর ভাই - উদ্দেশ্য- একটু পায়ে হেঁটে শহরটাকে দেখা, আর খিদে বাড়ানো। কারণ, তার পরেই আমরা হানা দিলাম কেভেন্টার্সে- এই একশো বছরেরও বেশি পুরনো রেস্তোঁরার খোলা ছাদে বসে 'ইংলিশ ব্রেকফাস্ট' খাওয়ার জন্য।
কেভেন্টার্স
কেভেন্টার্সের কথা প্রথম পড়েছিলাম ফেলুদার প্রথম অ্যাডভেঞ্চার 'দার্জিলিং জমজমাট' উপন্যাসে। সত্যজিৎ রায়ের 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' ছবি তৈরিই হয়েছে দার্জিলিং এর পটভূমিকায়। সেখানে কেভেন্টার্সের খোলা ছাদের রেস্তোঁরায় কয়েকটা শট আছে।তাই কেভেন্টার্স সম্পর্কে আমার আগ্রহ ছিল অসীম। তাই কেভেন্টার্সের খোলা ছাদে বসে সেই ইংলিশ ব্রেকফাস্ট আর হট চকোলেট তো খেতেই হত। সেই খাবার অবশ্য সামনে পড়ার সাথে সাথেই ঠাণ্ডায় প্রায় বরফ হয়ে গেল।
কেভেন্টার্সের ইংলিশ ব্রেকফাস্ট
ভরদুপুরের সসেজ, সালামি, মিট লোফ ইত্যাদি সহযোগে সেই খাওয়া প্রায় লাঞ্চেরই সামিল। সেইরাতে অবশ্য বেদম পায়ে ব্যথা হয়েছিল- পাহাড়িদের মত কি আর খাড়াই পথ বেয়ে হাঁটার অভ্যাস আছে নাকি আমাদের!
এইখানে বলে রাখি, মনে মনে খুব ইচ্ছা থাকলেও, দার্জিলিং গিয়ে আমাদের টয় ট্রেনে চড়া হয়নি। পর্যটকদের জন্য দিনে বার তিনেক ট্রেন চলে দার্জিলিং থেকে কার্সিয়ং। কিন্তু সেই ট্রেনের টিকিট পাওয়াই মুশকিল। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমরা যে-কদিন থাকব, তার মধ্যে টিকিট পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। তাই আমাদের ওই আসা-যাওয়ার পথে ছোট্ট নীল ট্রেন চোখে দেখেই খুশি থাকতে হল।
টয় ট্রেন
আমাদের হোটেলের অন্যান্য পর্যটকেরা আর কর্মচারীরা বলেছিলেন যে আকাশ পরিষ্কার থাকলে ভোরের দিকে হোটেলের বাগান থেকেই সোজা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়া যাবে। তা তিনি আর দেখা দিচ্ছেন কই! তিনদিনের মাথায় তো সকাল থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। রঙিন উলের টুপি পড়া হোটেলের হাসিমুখ কর্মচারী ছেত্রীজি হেসে হেসে বললেন- সবাই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে খালি দেখেই চলে যায়, কিছু দেয় না, তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা গোঁসা করে মেঘের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়েছে। নেহরু রোডের সোয়েটার-এর দোকানের মালিক বললেন- নভেম্বর মাসে এইরকম বৃষ্টি কখনো হয়না। গ্লেনারিজ এ বসে কাঁচের ওপার থেকে জল ভরা মেঘেদের ধেয়ে আসা দেখতে দেখতে আমরা ভাবলাম- আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ...
পর পর দুইদিন ভোরবেলা উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে অপেক্ষা করেছি, ঐ বুঝি তার দেখা পেলাম। কিন্তু হতাশ হয়েছি। তার ওপর আবার আগের দিন বৃষ্টি পড়েছে। তাই পরের দিন ভোর বেলা অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলেও রেগে-মেগে শুয়ে রইলাম। কিছুতেই উঠব না- জানি তো কিচ্ছু দেখা যাবে না। কিন্তু হটাৎ শুনলাম মায়ের গলা। মা নিজেদের ঘর থেকে বেরিয়ে করিডোরে ডাকতে ডাকতে আসছেন-উঠে পড় শিগ্গির, দেখ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিয়েছে...
সেই ডাক শুনে তো এক লাফে লেপ-কম্বল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। বারান্দার কাঁচের জানলার পর্দা সরালাম, আর একটু বাঁ দিক করে সামনেই দাঁড়িয়ে তিনি - পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ-কাঞ্চনজঙ্ঘা !
প্রথম দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘা
সূর্যোদয় বেশ খানিক্ষণ আগে হয়ে গেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে হাল্কা হলদেটে রঙের আভাস।এত কাছ থেকে এত বড় পর্বত দেখার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। এই অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম- অবাক বিস্ময়ে। নিজেকে মনে হল কত ছোট আমি, কত তুচ্ছ, এই মহাপর্বতের সামনে। যেন স্বয়ং ঈশ্বর, যেন এক অধিপতি , যিনি নিজের সভাসদদের দুইপাশে নিয়ে রাজ্যশাসনে বসেছেন। ক্রমে ঝলমলে রোদ উঠল। মন ভাল হয়ে গেল। যাকগে, অবশেষে দেখা তো পেলাম।
সারাদিন রোদ থাকলেও কাঞ্চনজঙ্ঘা অবশ্য বেলা বাড়ার সাথে সাথে মেঘ-কুয়াশার পেছনে আধাআধি মুখ ঢাকলেন। মাঝে মাঝে ফাঁকফোকর দিয়ে একটু আধটু দেখা যেতে লাগল। ঝকঝকে সোনালি রোদ পিঠে মেখে, নীল -সাদা পর্বতমালাকে পটভূমিতে রেখে, ঠাণ্ডা হাওয়া খেতে খেতে, আমরা দেখতে গেলাম দার্জিলিং শহরের একটু বাইরে তীব্বতীদের শরনার্থীদের উপনিবেশ (Tibetan Refujee Self Help Centre)।
তীব্বতী শরণার্থীদের উপনিবেশ
যাওয়ার পথে দেখতে পেলাম সবুজ কার্পেটের মত চা বাগান, আর দারুণ সুন্দর দেখতে সব স্কুল আর কলেজ। এক জায়গায় দেখলাম, দুই বছর আগে ভূমিকম্পে রাস্তার খানিকটা অংশ ভেঙে গেছিল। সেখানে সেনাবাহিনী একটা ব্রীজ তৈরি করে দিয়েছে। সেই সেতুতে একসাথে দুইদিক থেকে গাড়ী যেতে পারবে না। সেতুর দুইপাশে দুইজন সৈনিক দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের নির্দেশে একেকবার একেকদিকের গাড়ি এগোচ্ছে। তখন অন্যেরা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছে।
পথের ধারে চা-বাগান
এইখানে বলে রাখি, চা-গাছের ফুল কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে। দেখেছ কি কোনদিন? এখানে একটা চা গাছের ফুলের ছবি দিলাম, সাথে দেখা যাচ্ছে গাছের পাতা আর কুঁড়িও।
চা-গাছের ফুল
যেহেতু আকাশ পরিষ্কার ছিল, তাই পরের দিন ভোর সাড়ে চারটে-পৌনে পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে পড়লাম সূর্যোদয়ের সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য দেখব বলে। ডান দিকে পুবের আকাশ তখনো গাঢ় ধূসর, আর বাঁ দিকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখা যাচ্ছে হালকা ছাই রঙের আকাশের পটভূমিতে আর এক পোঁচ ছাই রঙ মেখে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমাদের ঘর থেকেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তাই ধড়াচূড়ো পরে বাইরে বেরোনোর দরকার-ই নেই। শাল মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা নিয়ে খচাখচ ছবি তুলতে লাগলাম।
পূবের আকাশে রঙ ধরছে
ক্রমে কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে রঙ ধরল - সবার প্রথমে রঙ লাগল পর্বতের চূড়ায় -হাল্কা গোলাপি। সেই রঙ বদলাতে লাগল- গোলাপি থেকে লালচে কমলা হয়ে হলুদ, তারপরে সোনালি। সাথে সাথে পূবের আকাশ ও অন্ধকার থেকে লাল-কমলা-হলুদ হয়ে সাদা হতে থাকল। সময় একটু একটু করে পেরোতে লাগল, আর কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে আলোর পরিমাণ ও বাড়তে থাকল। অনেকের কাছে শুনেছিলাম, কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে নাকি সূর্যের সাত রঙ দেখা যায়। সাত না হলেও, আমরা একবার কয়েক মূহুর্তের জন্য সবুজ আলোও দেখতে পেয়েছিলাম।
সূর্যের প্রথম আলোয় রঙ ধরছে কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে
আর সূর্যোদয় যখন পুরোপুরি হল, তখন ঝিলিক দিয়ে উঠল কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া -যেন লক্ষ মানিক এক সাথে ঝলকে উঠল কয়েক মূহুর্তের জন্য। তারপরেই দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ল, সোনালি আলোয় নেয়ে-ধুয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা তার বরফে মোড়া সাদা পোষাকে যেন রাজ্যশাসনে বসল। প্রায় এক ঘন্টা ধরে চলতে থাকা এই স্বর্গীয় ঘটনা ঘরের ভেতর বসে থেকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া এক বিরল অভিজ্ঞতা বটেই।
স্বমহিমায় কাঞ্চনজঙ্ঘা
সেইদিন ছিল আমাদের চলে আসার দিন। রাতে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনের টিকিট কাটা আছে। তাই এই রোদ ঝলমল দিন আর উজ্জ্বল কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ছেড়ে যদিও চলে আসতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু সে তো হওয়ার নয়। কাজেই ব্যাগ-বাক্স গুছিয়ে বেলা এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম।
আগে থেকেই ঠিক ছিল, আমরা ফেরার পথে মিরিকের পথ হয়ে আসব। তাই ঘুম স্টেশন থেকে কার্সিয়ং-এর রাস্তা না ধরে আমাদের গাড়ি ডান দিকে বাঁক নিল। গাড়ি চলতে লাগল ছোট ছোট জনবসতির মধ্যে দিয়ে। আমাদের গাড়ীর ড্রাইভার বললেন, আজ এখানের লোকেদের খুব আনন্দের দিন। এখানে দুই-তিন মাস করে রোদ ওঠে না।আজ রোদ উঠেছে, সবাই খুব খুশী। শুনে ভাবলাম, আমরা সমতলের লোকেরা কত ভাগ্যবান, প্রায় সারা বছরই সূর্যের মুখ দেখতে পাই!
পথের সাথী হল কাঞ্চনজঙ্ঘা
মাখনের মত মসৃণ রাস্তা ধরে ছুটে চলল আমাদের গাড়ি। আসার পথে গাছপালার ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখা গেল ধবধবে সাদা কাঞ্চনজংঘাকে - যেন আমাদের হাসিমুখে বিদায় জানাচ্ছে। আমাদেরও আর দেখে দেখে আশ মেটে না। পথে পড়ল লম্বা, ঘন সবুজ পাইনের বন, ছোট ছোট বাড়ি, তাদের বাগানে কমলালেবুর গাছ, তাতে সবুজ সবুজ কাঁচা কমলা ঝুলছে।
মিরিকের পথের পাশে চা-বাগান
দার্জিলিং থেকে মিরিক আসার পথে একেক জায়গা এত সুন্দর যে মনে হচ্ছিল বাড়ি না ফিরে এখানেই আরো কিছুদিন থেকে যাই। পথের মাঝে মাঝেই পড়ল ঢালু টিনের ছাদের স্কুল- সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলে বেড়াচ্ছে। ড্রাইভার বললেন- এরা অনেক সময়ে এক-দেড় ঘন্টা পাহাড়ী পথে হেঁটে স্কুলে আসে। পাহাড়ের কোলে একটা ছোট্ট স্কুল, জায়গাটার নাম কি সুন্দর - টিংলিং - ঠিক যেন ছোট্ট ঘন্টার আওয়াজ। আমার ভাই তো ঠিকই করে ফেলল, এইখানেই চলে এসে এই ছোটদের ইশকুলে পড়াবে।
পাহাড়ী ইশকুলের খুদে পড়ুয়ারা
মিরিক পৌঁছালাম দুপুরবেলা। সেখানে একটা ছোট হোটেলে দুপুরের খাওয়া খেলাম, আর মিরিক লেকের আশেপাশে খানিক ঘোরাঘুরি করলাম। তারপরে আবার যাত্রা শুরু। মিরিক পৌঁছানোর আগে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে, পথের দুইপাশে যা সবথেকে বেশি চোখে পড়ে, তা হল চা-বাগান।
পথের পাশে চা-বাগান
কখনো পাহাড়ের চড়াইতে, কখনো উতরাইতে- সবুজ কার্পেটের মত বিস্তৃত ছোট ছোট চায়ের ঝোপ। মাঝে মধ্যে দেখা গেল, মাথায় লম্বা বেতের ঝুড়ি নিয়ে পাতা তুলছেন বাগানের কর্মচারীরা। কোথাও দেখলাম সংগ্রহ করা পাতার বোঝা নিয়ে কারখানার দিকে হেঁটে চলেছেন তাঁরা।
চা-বাগানের শ্রমিকেরা বাগান থেকে পাতা তুলে ফিরছেন
পথে পড়ল একটা সরু ঝরনা, অনেক ওপর থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে। আমাদের ড্রাইভার গঙ্গা সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জল খেলেন, আমরাও বোতলে সেই জল ভরে নিলাম। গঙ্গা বললেন - এ জল হল মিনারেল ওয়াটারের বাবা! রাস্তার বাঁকে এক জায়গায় পথের পাশে হটাৎ করে পড়ল দুটো ছোট্ট দোকান। ছোট্ট, কিন্তু কত কি বিক্রি হচ্ছে সেখানে - বেশ কয়েক রকমের অজানা পাহাড়ি সব্জী, ফল আর ফুলের গাছ। আমাদের ড্রাইভার গঙ্গা সেখান থেকে নিজের বাড়ির জন্য সব্জী বাজার করলেন। আমরাও কিছু পাহাড়ি টমেটো কিনলাম।
পথের পাশে হটাৎ দোকান
বিকেল হতে হতে গাড়ি নেমে এল চেনা এলাকায়। ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ল শিলিগুড়ি শহরে। বরফ ঢাকা পাহাড়, ঠাণ্ডা আবহাওয়া, মেঘ, বৃষ্টি, পাইনের বন, চা-বাগান --- ধীরে ধীরে বদলে গেল ভীড়ে ঠাসা , বাক্স-বাড়ি ভরা শহরে। কোন এক ক্রসিং-এ ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। আর মনটা হটাৎ করে খুব খারাপ হয়ে গেল।
এন-জে-পি স্টেশনে পৌঁছে গেলাম সময় মত। ট্রেন ও এসে গেল ঠিক সময়ে। কিছুমিছু খেয়ে বাঙ্কে উঠে রাতের মত আশ্রয় নিলাম। পরের দিন ঠিক ভোর ছ'টায় দার্জিলিং মেল আমাদের পৌঁছে দিল শিয়ালদা স্টেশনে। ফিরে এলাম নিজের চেনা শহরে। মনে রয়ে গেল অবজারভেটরি হিলকে ঘিরে থাকা কুয়াশামাখা মল রোড।
লেখাঃ
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা
ছবিঃ
মহাশ্বেতা রায় ও কৌস্তুভ রায়
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মহাশ্বেতা রায়
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে
নববর্ষের চার কল্পতরু
পশ্চিম মেদিনীপুরের এক গ্রামের মধ্যে দিয়ে বছর শুরুর দিনে যেতে যেতে বর্ষবরণ দেখে এলাম । খড়গপুর থেকে হিজলী ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে সালুয়া পেরিয়ে নাক বরাবর কেশিয়াড়ির পথে । সোজা গেলে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে ভসরাঘাট না গিয়ে তার আগেই ডান দিকে মোরামের পথ, মাটীর পথ ধরে বহু পুরোণো দুর্গা মন্দির । সর্বমঙ্গলা মন্দির আর কাশীশ্বর জিউ ।
বেলা গড়িয়ে, দুপুর পেরিয়ে, বিকেলের সময় চলেছিলাম পয়লা জানুয়ারির দিন ।
শহরে তখন কত হিড়িক ধুম করে নিউইয়ার পার্টির । কত তোড়জোড় রেস্তোরাঁয়া, ক্লাবে, মাঠে ময়দানে। সার্কাসের তাঁবুতে, চিড়িয়াখানায়, শীতের মেলাপ্রাঙ্গনে তখন মানুষে মানুষে ছয়লাপ । গ্রামের মানুষের মনে সেই নিয়ে কোনো হেলদোল নেই ।
নতুন বছরের প্রথম সূর্যাস্ত তখন রঙ ছড়িয়ে চলেছে আপনমনে । ঠান্ডার দাপটও ছিল বেশ । আর রাস্তায় যেতে যেতে চড়ুইভাতির গন্ধ । তখন বনভোজনের রসুইখানার ঝাঁপ ফেলা হচ্ছে । তারই মধ্যে জোরে মাইকে বেজে চলছে" পরাণ যায় জ্বলিয়ারে "... বড়রাস্তার একপাশে সেন্ট পলস গীর্জায় বর্ষবরণের পার্টির শেষ ঝলক । মাদল বাজছে আর সাথে ট্রাইবাল ডান্স । বিলিভার্স চার্চে নিউইয়ারের ফেস্টুন ।
সর্বমঙ্গলা মন্দির
খড়গপুর আইআইটি ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকে ৫ কিলোমিটার গেলে পড়বে ইন্দা বাজারের মোড় । সেখান থেকে পূবদিকে আরো খানিকটা গেলে পড়বে ইন্দা দুর্গা মন্দির আর তারপরই বাঁদিকে খড়গেশ্বরের শিব মন্দির । এই মন্দিরের নামেই এই জায়গার নাম খড়্গপুর । কারো মতে, রাজা খড়্গসিংহ তৈরী করেছিলেন এই মন্দির । আবার কারো মতে বিষ্ণুপুরের রাজা খড়্গমল্ল ২০০ বছর আগে এই মন্দির তৈরী করেছিলেন ।মন্দিরের অভ্যন্তরে গর্ভগৃহে প্রোথিত খড়্গেশ্বর শিবলিঙ্গ । শিবরাত্রি, আর গাজনের সময উতসব হয় এখানে ।
মন্দির চত্বরে বহু প্রাচীন একটি অশ্বত্থ গাছের বেদীমূলে রয়েছে আদিবাসীদের আরাধ্যা কোনো দেবতার প্রস্তর মূর্ত্তি । দক্ষিণবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এই অঞ্চলগুলি প্রধানত:আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা ছিল । তবে এখন সূর্য দেব রূপে ইনি পূজিত হন ।
খড়্গেশ্বর
মন্দিরের নাট মন্দিরে এখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে । স্থানীয় মানুষ জন আর মন্দিরের পুরোহিত বিদ্যালয়টি চালনা করেন । মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণও তাঁরাই করেন আর মন্দিরের মধ্যে অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই স্কুলটি করেছেন তাঁরা ।জটাজুটো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বহু পুরোণো অশ্বত্থ বৃক্ষ আর বহন করছে সময়ের সাক্ষ্য ।পুরো মন্দিরটী তৈরী পাথর দিয়ে । কোনো ইঁট নেই এর গায়ে । এখন সাদা রঙ করা হয়েছে ।
খড়্গেশ্বর মন্দির
খড়্গেশ্বরের মন্দির থেকে আরো কিছুদূর গ্রামের পথ ধরে স্থানীয় মানুষদের জিগেস করতে করতে পৌঁছনো যায় হিড়িম্বেশ্বরী মন্দিরে ।
হিড়িম্বেশ্বরী মন্দির
বড় বড় দীঘি পরিবেষ্টিত ইন্দার এই গ্রামটির নাম বামুনপাড়া । কথিত আছে মহাভারতে পঞ্চপান্ডবের অজ্ঞাতবাসের সময় ভীম ঘুরতে ঘুরতে এসে স্থানীয় এক অনার্য নারী হিড়িম্বাকে বিবাহ করেন ;এই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলটির নাম ছিল "হিড়িম্বা ডাঙা" এই অঞ্চলে হিড়িম্বার আরাধ্যা একটি অত্যন্ত জাগ্রত কালীমূর্ত্তি ছিল যা কালাপাহাড়ের অত্যাচারে,কালের স্রোতে ভেসে যাওয়া এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল ।এখনো গাছের নীচে সেই অতি প্রাচীন পাথরের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় আর সেইখানেই বাংলার ১৩৭৫ সালে নতুন করে মন্দির স্থাপন করেন বামুনপাড়ার স্থানীয় মানুষ জন । মন্দিরের মধ্যে ধাতব কালীমূর্ত্তির পাশে শীতলারও ধাতব মূর্ত্তি পূজো হয় ।
হিড়িম্বেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস
মহাভারতের ভীম নাকি দক্ষিণবঙ্গে বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়েছিলেন । পঞ্চপান্ডব অধুনা মেদিনীপুর ও সংলগ্ন জেলার গহিন অরণ্যের মধ্য দিয়ে বনবাসে চলেছিলেন, সে কথার উল্লেখ কাশীরাম দাস অনুদিত মহাভারতে পাওয়া যায় । কুন্তী পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে বসলেন সেই জঙ্গলেই । আর সেখানেই উপজাতি পরিবারের রাক্ষস হিড়িম্ব আর তার বোন হিড়িম্বা এসে উপস্থিত হল । মহা উল্লাসে নরখাদক হিড়িম্ব তার কাজ সারতে পঞ্চপান্ডব সহ মাতা কুন্তীকে সংহার করতে উদ্যত হল আর মহাবলী ভীমসেন তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন । হিড়িম্বকে বধ করে ভীমসেন তার দেহ রেখে এলেন খড়গেশ্বর শিবের মন্দিরের সামনে আর হিড়িম্বা রাক্ষসীর সাথে তার পর ভীমের প্রণয় ও গান্ধর্ব মতে তাকে বিয়ে ( এবং অবশ্যই সেই সময় বিয়ে না করে উপায়ও ছিলনা ভীমের, কারণ অরণ্যে শয্যা পেতে উপজাতিদের সাথে শান্তিপূর্ণ বসবাস না করে কি উপায় থাকে! ) স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করেন প্রাচীনকালে "মেদ" উপজাতির বাসভূমি হিসেবে মেদিনীপুর ভূখন্ডর নাম এই ঘটনার সাক্ষী বহন করছে। অতএব উপজাতির আবাসস্থল হিসেবে মেদিনীপুরের এই তথ্যটি ফেলে দেবার নয় । ভীম হলেন মেদিনীপুরের এক পরাক্রমশালী দেবতা । তাই মহা সমারোহে ভীমের পুজো করার জন্যই ঐ অঞ্চলের গ্রামবাসীরা ভীম-একাদশীর ব্রত পালন করেন ।
অতএব ঘটা করে ভীমের পুজো, খড়গেশ্বর ও হিড়িম্বেশ্বরী কালী মন্দির অনেক পুরোনো সময়ের দলিলের সাক্ষ্য এখনো বহন করে চলেছে ।
এবার গাড়ি নিয়ে খড়গপুর থেকে তমলুক । গুগ্ল ম্যাপে মোটামুটি ঠাহর করে নিয়ে বেরিয়ে পড়া আরকি । আর স্মার্টফোন বাকী দিশা দেখানোর জন্য তো আছেই । তমলুক পূর্ব মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার্স । এককালে যার নাম ছিল তাম্রলিপ্ত । পূর্বে রূপনারায়ণ আর পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এই তাম্রলিপ্ত ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান বন্দর । বঙ্গোপসাগর এর খুব কাছে ।
তমলুক-পাঁশকুড়া বাসষ্ট্যান্ড পৌঁছে হরিরবাজার, জেলখানা মোড়, চক্রেশ্বর পেরিয়ে বর্গভীমা মন্দির । কাছেই একটি মাঠে গাড়ি রাখা হল । সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মায়ের মন্দিরে ।
বর্গভীমা মন্দির
দেবী বর্গভীমা হলেন তমলুক শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । দেবীকে ঘিরে দুটি কিংবদন্তী আছে । প্রাচীন যুগের কিংবদন্তী অনুযায়ী জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে দেবীর মাহাত্ম্যের উল্লেখ পাওয়া যায় । মহাভারতের যুগে যখন তাম্রলিপ্তে ময়ূরবংশীয় রাজা তাম্রধ্বজের রাজবাড়িতে এক জেলে বৌ নিয়মিত মাছ সরবরাহ করত । একদিন সে পথে আসার সময় তার ঝুড়ির মাছে, রাস্তার একটি জলভরা গর্ত থেকে জল নিয়ে ছেটানো মাত্রই মরা মাছগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে । রাজবাড়িতে গিয়ে এই ঘটনা জানানোর পর জেলেবৌ সহ রাজা ঐ স্থানে পৌঁছে জলেভরা গর্তের বদলে সেখানে দেবীমূর্তি আসীন একটি বেদী দেখতে পান সেইখানেই রাজা ঐ দেবীর পূজা শুরু করেন ও সেই দেবীই বর্গভীমা নামে পরিচিত ।
প্রাচীনযুগের আরো একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দেবী বর্গভীমার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । প্রাচীন যুগের তৃতীয় কিংবদন্তী অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর বাম গুল্ফ(গোড়ালি) তমলুকের এই অংশে পতিত হয়েছিল তাই এটি একটি শক্তিপিঠের অন্যতম ।
কিংবদন্তীর কড়চা দূরে সরিয়ে রাখলেও বিশ্বাস করতে হয় যে দেবী বর্গভীমা হলেন দক্ষিণবঙ্গের অগণিত দেবদেবীর অন্যতম স্থানীয় লৌকিক দেবী । মূল মন্দিরের গঠনরীতিও চমত্কার এবং এখানে বর্গভীমার সাথে অন্যান্য দেবদেবীর পাথরের মূর্তি আছে । সপ্তরথ রীতিতে নির্মিত এর নাম বড় দেউল । যেখানে দাঁড়িয়ে ভক্তরা দেবীকে দর্শন করেন তার নাম জগমোহন । এছাড়াও রয়েছে যজ্ঞমন্দির এবং নাটমন্দির । উত্তরদিকে মন্দির সংলগ্ন একটি কুন্ড আছে ।
বর্গভীমা মন্দিরের কুন্ড
মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে দেবদেবীর ২৬টি টেরাকোটার নিপুণ চিত্র আছে ।
বর্গভীমা মন্দিরের টেরাকোটা মূর্তি
ছোটবেলায় নিয়ম করে প্রতিবছর দক্ষিণেশরে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কল্পতরু উত্সবে সামিল হতাম । ভীড় ঠেলে দর্শন করাতেও কত তৃপ্তি মানুষের! এখন সেটাও খুব মিস করি । মিস করি গঙ্গার ধার, ঠাকুরের মন্দিরের নিরিবিলি নিস্তব্ধতা আর সেই একরাশ অনাবিল শান্তি নিয়ে কল্পতরুর কাছে প্রার্থনা করা । কি যে চাইতাম জানিনা । কিন্তু যেতাম ও সারাবছরের রেসোলিউশান নিয়ে চোখ বুঁজে অনেক ভাবতাম । "এই বছরে, এটা করবনা, সেটা করতে হবে"...আরো কত কিছু !
নতুন বছরে সর্বমঙ্গলা, খড়গেশ্বর, হিড়িম্বেশ্বরী আর বর্গভীমাই আমার কল্পতরু উত্সবে সামিল হলেন ।
লেখা ও ছবিঃ
ইন্দিরা মুখার্জি
খড়গপুর
- বিস্তারিত
- লিখেছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে