সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

আমাদের শৈশব মানে অপু-দুর্গার চিরায়ত শৈশব। কাশবন পেরিয়ে দিগন্ত ছোঁয়া ট্রেনের কু ঝিক ঝিক দেখতে দেখতে সময় থমকে গিয়েছে। মেঠোপথ চিরে কোন দূর দিকশূন্যপুরে চলে গেছে সেই রেললাইন। যুগের চাহিদা মেনে হারিয়ে গিয়েছে সেসব রেলপথ। তবু তাদের ধূসর ছবি আর যাত্রীদের হাসিকান্নার ইতিহাস হারায় না। পৃথিবীর মেঠোপথের আনাচে-কানাচে এমন সব হারিয়ে যাওয়া রেলপথ খুঁজে বেড়ালেন লেখক।

বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

৭৬২ মিলিমিটার চওড়া এই ন্যারোগেজ লাইন ইতিহাস হয়ে গিয়েছে কবেই। ১৮৯০ সালে তার যাত্রাপথের পরিকল্পনা। আর ১৮৯৫ সালে তারকেশ্বর থেকে মগরা পর্যন্ত প্রায় ৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে তার প্রথম যাত্রার শুরু। স্থানীয় মানুষের উৎসাহ আর প্রয়োজনেই তৈরি হয়েছিল এই বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল রেলপথ। পরে ১৯০৪ সালে ত্রিবেণী পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হলে রেলপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় প্রায় ৫৫ কিলোমিটার। পথে রেলস্টেশনগুলি ছিল তারকেশ্বর, চৌতারা, দশঘরা, কানানদী, ধনিয়াখালি, ভাস্তাড়া, দ্বারবাসিনী, মহানাদ, হালুসা, মগরা এবং ত্রিবেণী।  পরে ১৯১৭ সালে দশঘরা থেকে জামালপুর পর্যন্ত ১৩.৪ কিলোমিটার লম্বা একটি শাখা লাইন তৈরি হয়। বৃটেনে তৈরি ছোট ২-৪-০টি লোকোমোটিভ স্টীম ইঞ্জিন ব্যবহার করা হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫৬ সালে এই রেলপথ পরিত্যক্ত হয়। দীর্ঘ অবহেলায় রেলপথ এবং রেলস্টেশন গুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

১৯৫৩ সালে প্রকাশিত একটি রেল রিপোর্ট অনুযায়ী, বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল রেলপথের সর্বাঙ্গীণ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল মেসার্স মার্টিন বার্ন লিমিটেড কোম্পানির উপর। যাত্রা শুরুর ১৫ বছর পর হুগলী ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড এটি অধিগ্রহণে উদ্যোগী হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনিক টালবাহানা এবং আইনি জটিলতায় তা সম্ভব হয় নি। কেউ কেউ বলেন, চকদীঘির সিংহরায় জমিদারেরা এই রেলপথ পরিচালনা করতেন। কিন্তু এই তথ্যের সমর্থনে কোন বিশ্বস্ত তথ্যসূত্র মিলছে না।
 
২০০৯-১০ রেল বাজেটে এই রেলপথের পুনরুজ্জীবনের জন্য ৩৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে বলে ঘোষণা হয়। কিন্তু সে ঘোষণার বাস্তবায়ণের জন্য পরবর্তীকালে সামান্যতম পদক্ষেপও নেওয়া হয় নি।

স্ত্রেসা-মোট্টারোন রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

দুপুর ১২-৫৫, মে ১৩, ১৯৬৩। শেষবারের মতো স্ত্রেসা থেকে ট্রেন ছাড়ল মোট্টারোনের উদ্দেশ্যে। শেষ হল ইতালীয় আল্পস পাহাড়ের গা বেয়ে ছবির মতো সুন্দর এক রেলযাত্রার ইতিহাসের। উনবিংশ শতকের শেষে টোমাসো টাডিনি এবং আলেসান্দ্রো স্কটির উদ্যোগে বহু বাধা-বিঘ্ন-অর্থকষ্ট পেরিয়ে এই রেল-প্রকল্পের সূচনা হয়। অসাধারণ নিসর্গশোভায় মোড়া এই রেলপথে প্রথম ট্রেন চলতে শুরু করে ১৯১১ খৃষ্টাব্দের ১১ জুলাই। রেলযাত্রার সূচনায় সেদিন এমন এক মহোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল যার তুলনা মেলা ভার। দিনে-রাতে ভুরিভোজ, সাঁতার প্রতিযোগিতা, নৌকা বাইচ, ফুটবল ম্যাচ- কত কিছুর যে আয়োজন হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই।

সে যাই হোক, এবার রেলপথের কথায় আসি। মোট্টারোনের রেলট্র্যাক ছিল ১ মিটার চওড়া। পাহাড়ী পথে সবচেয়ে উঁচু জায়গাটা সমুদ্রতল থেকে প্রায় ১১৮২ মিটার উঁচুতে। প্রায় ৯.৯ কিলোমিটারের এই যাত্রাপথ পেরোতে সময় লাগত মোটামুটি ৬৫ মিনিট। পথে ছিল ছ'টি রেলস্টেশন- স্ত্রেসা, বেদাস্কো-বিন্দা, বেজ্জো, গিগ্নেসে-লেভো, আল্পিনো, বোরোমিও এবং মোট্টারোন। ১৯১১ সালে গোটা যাত্রাপথের রেলভাড়া ছিল ৯ লিরা। এই রেলপথে প্রচুর পর্যটক মোট্টারোনের পাহাড়ে বেড়াতে আসতেন। ১৯৪৫ সালে মোট্টারোন রেলের চরম রমরমার সময়ে এক বছরে ১০৮০০০ মানুষ এই ট্রেনে চড়েছেন। ট্রেনটি শুধু যাত্রীবাহীই ছিল না। বাণিজ্যিক প্রয়োজনে মোট্টারোনের পাহাড়-চুড়ো থেকে বরফ বয়ে আনত সে স্ত্রেসা শহরে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমতে শুরু করে মোট্টারোন রেলপথের যাত্রী সংখ্যা। বিপুল আর্থিক ক্ষতি সামলেও রেলপথটি টিঁকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ১৯৫৯ সালে বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিতে হয় এটিকে। এর পরিবর্তে পর্যটকদের জন্য চালু হয় দ্রুতগামী নতুন কেবল কার। রেলপথের ছবি আর ইঞ্জিনের দেহাবশেষ ঠাঁই পেল র‍্যাঞ্চো শহরের মিউজিয়ামে।

কর্ডোবা-হুয়াতুস্কো রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

স্পেনীয় ভাষায় তার নাম ছিল ফেরোকারিল দে কর্দোবা এ হুয়াতুস্কো সংক্ষেপে এফসিসিএইচ। ৬১০ মিলিমিটার প্রস্থের এই ন্যারো গেজ রেলপথের সূচনা হয় ১৯০২ সালে। মেক্সিকোর সুউচ্চ পিকো দে ওরিজাবার পাহাড়ী পথে এই রেলপথ নির্মাণের কাজটি ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। মেক্সিকোর ব্যবসায়ী হুলিও লিমান্তাউর এবং হুগো শেরার সে অর্থব্যয়ে কার্পণ্য করেন নি। আর প্রযুক্তিবিদ হুয়ান নাভারো আর কার্লোস মোরিকার্ড নিঁখুত নকশা এবং অক্লান্ত শ্রমে গড়ে তোলেন ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ। পথে রিও জাম্পা নদীর জটিল শাখাপ্রশাখার উপর প্রায় ৭৮ মিটার উঁচুতে তৈরি টোমাৎলান সেতু প্রযুক্তির এক অনন্য নিদর্শন। কোস্কোমাটেপেক থেকে টোমাৎলান পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার পথ সুনির্দিষ্ট ঢাল বজায় রেখে নিঁখুত ১৯ ডিগ্রি কৌণিক বক্রতা বজায় রাখা হয়েছিল।

রেলপথ নির্মাণের সূচনালগ্ন থেকেই অর্থসংকট, কাঁচামালের অভাব, আবহাওয়ার প্রতিকূলতা, সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত ছিল রেলযাত্রী, মালিক, শ্রমিক- সকলেই। এমনকি ১৯০৯ সালে নির্মাণপর্বের মধ্যভাগে এই রেলের অনেক সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে বাধ্য  হয় প্রধান নির্মাণ সংস্থা ফেরোকারিল মেহিকানো। মূলত আর্থিক লোকসানের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় পাহাড়-নদীর সৌন্দর্য্য মাখা অতুলনীয় এই রেলপথ।

সোংফা-দালাত কোগ রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

রহস্যময় সোংফা-দালাত কোগের নির্জন পথে কান পাতলে এখনও হয়ত শোনা যাবে তার হুইসেলের দীর্ঘশ্বাস। তুষার-কুয়াশায় ঢাকা পথে শোনা যাবে তার ইঞ্জিনের দীর্ঘশ্বাস, চাকার টিংটাং শব্দ। ১৯০৩ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৯৩২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ফরাসী প্রযুক্তিবিদদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হয়েছিল এই দুর্গম রেলপথ। দালাত- থাপ চ্যাম রেলপথ বা দালাত-ফ্যাং র‍্যাং রেলপথ নামেও পরিচিত ছিল এটি। রেলপথের দু'ধারের  প্রাকৃতিক শোভা ছিল অতুলনীয়। ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ দুর্গম পাহাড়ী পথে এই রেলপথ নির্মিত হয়েছিল চার পর্যায়ে। খরচ হয়েছিল প্রায় ২০ কোটি ফ্রাঁ। খাড়াই পথে চড়ার জন্যে রেলট্রাকের মাঝখানে পাতা ছিল করাতের মতো দাঁতযুক্ত একটি ধাতব লাইন। পাঁচটি সুদীর্ঘ টানেল ছিল যাত্রাপথে। প্রথম দিকে সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানিতে তৈরি বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের সাহায্যে তিন কামরার ট্রেনগুলি চালানো হত। পরে ডিজেল ইঞ্জিনের ব্যবহার শুরু হয়। যাত্রাপথে ছিল মোট ১১টি স্টেশন- থাপ চ্যাম, ট্যান মাই, সোং ফা, কো বো, এও গিও, ডন ডুওং, ট্রাম হ্যানহ, কাউ দাত, দা থো, ট্রাই ম্যাট, দা লাত।

 ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় বারংবার সামরিক আক্রমণে এবং বোমাবিস্ফোরণে এই সুন্দরী রেলপথের বিভিন্ন অংশ, ট্রেনের কামরা এবং ইঞ্জিন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭৫ সালে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় এই রেলপথ। অনেক পরে, ১৯৯০ সালে, পর্যটন শিল্পের চাপে ভিয়েতনাম সরকার এই পথের মাত্র ৭ কিলোমিটার অংশ পুনরুদ্ধার করে বিশেষ ট্যুরিস্ট ট্রেন চালানো শুরু করে। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া সোংফা-দালাত কোগ রেলের রহস্যময় দুর্গম আনন্দের ছোঁয়া ওই সামান্য পথে আর ফিরে আসে নি।  

অ্যাভন্টুর রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তে ভারত মহাসাগরের এলিজাবেথ বন্দর ছোঁয়া ন্যারোগেজ রেলপথ অ্যাভন্টুর। স্থানীয় আফ্রিকান ভাষার 'অ্যাভন্টুর' শব্দের অর্থ হল অ্যাডভেঞ্চার। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের উদ্যোগে মূলত ফল এবং কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য ১৮৯০ থেকে ১৯০৬ খৃষ্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল ২৮৫ কিলোমিটার লম্বা এই রেলপথ। ১৯০৫ সালে হুমেউড রোড থেকে হিউম্যান্সডর্প পর্যন্ত পথের প্রায় ১১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশে যাত্রিবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ১৯০৬ থেকে শহরতলির আরেকটি শাখা রেলপথে এলিজাবেথের ভ্যালী জংশন থেকে বালমার পর্যন্ত যাত্রিবাহী রেল চলতে শুরু করে। ওই শাখাপথের ব্যস্ততা এত বেশী ছিল যে দিনে মোট ২২ টি ট্রেন চলত। কিন্তু সড়কপথের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এঁটে উঠতে না পেরে ১৯২৮  সালে বন্ধ হয়ে যায় বালমার রেলপথ। ১৯৪০ সালে একই কারণে বন্ধ হয়ে যায় হুমেউড-হিউম্যান্সডর্পের যাত্রিবাহী ট্রেন। বাণিজ্যিক মন্দার কারণে পরে বন্ধ হয়ে যায় পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল।

ষাটের দশকে পর্যটন শিল্পের হাত ধরে পুনরুজ্জীবিত হয় এই রেলপথ। ১৯৬৫ সালে চলতে শুরু করল সুবিখ্যাত পর্যটক ট্রেন 'অ্যাপল এক্সপ্রেস'। হুমেরেল থেকে লোয়েরি পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে এই ট্রেনটির সময় লাগত আড়াই ঘন্টার কাছাকাছি। আবহাওয়ার মতিগতি বুঝে ট্রেনটিকে কখনো চালানো হত বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে, কখনো ডিজেল ইঞ্জিনে। হাওয়া শুকনো থাকলে আগুনের ঝুঁকি এড়াতে ডিজেল ইঞ্জিন, আর বর্ষাকালে আর্দ্র আবহাওয়ায় বাষ্পচালিত ইঞ্জিন। পথে ভ্যান স্ট্র্যাডেন্স রিভার ব্রিজ ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ ন্যারো গেজ সেতু যা প্রযুক্তির এক অতুলনীয় নিদর্শন। সেতুর দু'পাশে প্রাকৃতিক শোভাও ছিল মনোরম। ছিল বলছি কেন? এখনো রয়েছে সেই অতুলনীয় রেলপথ ও সেতুর সৌন্দর্য্য। কিন্তু কোন ট্রেন আর চলে না। সড়কপথের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে পড়ে ২০১১ সাল থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে যাত্রিবাহী অ্যাপল এক্সপ্রেসের চলাচল। পরিত্যক্ত পথে গজিয়ে উঠছে মস-ফার্ণ-ছত্রাক।    

প্যারেঞ্জানা রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

ইতালির ত্রিয়েস্তে শহর থেকে ক্রোয়েশিয়ার প্যারেঞ্জো শহর (বর্তমান নাম পোরেক) পর্যন্ত ছিল এই সুন্দর রেলপথ। কেউ আবার আদর করে একে ডাকত 'ইস্ত্রাংকা' বা 'পরিকাঙ্কা'- অর্থাৎ ইস্ত্রিয়া শহর থেকে আসা সুন্দরী নারী। ৭৬০ মিলিমিটার চওড়া ন্যারোগেজ লাইন। দৈর্ঘ্য প্রায় ১২৩ কিলোমিটার। ইউরোপের দীর্ঘতম ন্যারোগেজ রেলপথ। তার ইতিহাসের জয়যাত্রার শুরু ১৯০২ সালের পয়লা এপ্রিল। ত্রিয়েস্তে থেকে যাত্রা শুরু করে ইতালির সার্বোলা, মুগিয়া হয়ে, স্লোভেনিয়ার দেকানি,কোপার, সেকোভিজে পেরিয়ে ক্রোয়েশিয়ার ত্রিবান, লিবাদে শহর পেরিয়ে প্যারেঞ্জো স্টেশনে পৌঁছুত সেই ট্রেন। যাত্রা পথে ছিল ৮টি সুড়ঙ্গ, ১১টি সেতু আর অতুলনীয় প্রাকৃতিক নিসর্গ শোভা। প্রথমদিকে, ইউ-সিরিজের ত্রি-অক্ষীয় বাষ্পচালিত ইঞ্জিন ব্যবহৃত হত। গতিবেগ ছিল গড়ে ২৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। ত্রিয়েস্তে থেকে প্যারেঞ্জো যেতে সাত ঘন্টা লাগত। পরে পি-সিরিজের লোকোমোটিভ ইঞ্জিন এলে ট্রেনের গতি বেড়ে হয় ৩১ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। ইতালির ত্রিয়েস্তে এবং স্লোভেনিয়ার কপার রেল সংগ্রহশালায় এইসব ইঞ্জিনের নিদর্শন রাখা আছে। ১৯৩৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচ লাগতেই এই রেলপথ পরিত্যক্ত হয়। ঐ বছরের ৩১ আগস্ট শেষবার পথে নামে ইস্ত্রিয়ার সুন্দরী ট্রেন প্যারেঞ্জানা।
 
ইতালি, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া- তিন দেশে এখনো পড়ে রয়েছে প্যারেঞ্জানার দেহাবশেষ। গাছপালা, লতাপাতা, ছত্রাকের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে সুড়ঙ্গ, সেতু, স্টেশন, ওয়র্কশপ, ওয়্যারহাউসের ঘুমিয়ে থাকা শরীর। সমীক্ষা বলছে, এই মুহুর্তে যদি সাফ-সুতরো করে চালু করা যায় তবে এই সুন্দরী রেলপথের ৯৪ শতাংশ অংশে ঝমঝমিয়ে চলতে পারে ট্রেন। আশার কথা যে, প্যারেঞ্জানা রেলপথের শতবর্ষে, ২০০৩ সাল থেকে তিন দেশের উদ্যোগে সত্যিই শুরু হয়েছে সাফসুতরো করার উদ্যোগ। হয়ত অদূর ভবিষ্যতেই ইতিহাস আর সৌন্দর্য্যপিপাসু পর্যটকেরা সামিল হতে পারবেন নতুন করে সেজে ওঠা প্যারেঞ্জানার এই সুন্দরী ট্রেন সফরে।  

ট্রান্স-অ্যান্ডিন রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

স্পেনীয় ভাষায় তার নাম ফেরোকারিল ত্রান্স্যান্দিনো। ১০০০ মিলিমিটার প্রস্থের মিটারগেজ রেলপথ। আর্জেন্তিনার মেন্দোজা শহর থেকে শুরু হয়ে আন্দিজ পর্বতমালার দুর্গম পাহাড়ী পথে ২৪৮ কিলোমিটার পেরিয়ে চিলির সান্তা রোসা দে লা আন্দেজে তার সমাপ্তি। ১৮৫৪ সালে এই রেলপথের পরিকল্পনা করেন চিলির বাসিন্দা দুই ভাই- হুয়ান ক্লার্ক এবং মাতেও ক্লার্ক। আর্থিক টানাটানিতে বারবার বাধা পড়েছে দুর্গম এই রেলপথের কাজে। দীর্ঘ পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ে অবশেষে ১৯১০ সালে এ পথে প্রথম ট্রেন চলাচল শুরু হয়। প্রাচীন পর্যটকদের পায়ে চলা পথ অনুসরণ করে রেলপথ নির্মাণ করতে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে অনেক সুড়ঙ্গ এবং সেতু বানাতে হয়। চিলি এবং আর্জেন্তিনা দু'দেশের আন্তর্জাতিক সীমানায় সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৩২০০ মিটার উচ্চতায় লাস কুয়েভাস নামক স্থানে রয়েছে ৩.২ কিলোমিটার দীর্ঘ এক দুর্গম সুড়ঙ্গপথ। আন্দিজের তুষারপাত থেকে বাঁচানোর জন্য উচ্চ অংশের রেলপথে আচ্ছাদনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।

১৯১০ সালে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের সাহায্যের চালানো শুরু হয় ট্রেন। পরে ১৯২৭ সালে রেলপথের বৈদ্যুতিকীকরণ হয়। ১৯২৪ সালে আন্দিজের হিমবাহজাত এক বন্যায় ট্রান্স-আন্দিয়ান রেলপথের আর্জেন্তিনার দিকের প্রায় ১২৪ কিলোমিটার অংশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খুব দ্রুত সারিয়ে ফেলা হয় ওই ক্ষতিগ্রস্ত অংশ। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং তুষারপাতজনিত সমস্যা লেগেই রইল। বগি লাইনচ্যুত হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার। ধস ও তুষারপাতে রেলপথ বন্ধ হওয়ায় অনেক সময় ট্রেন দুর্গম পাহাড়চুড়োয় দিন কয়েকের জন্যে আটকে যেত। ফলে দিনে দিনে যাত্রী পরিবহণ এবং পণ্য পরিবহন কমে আসছিল। অন্যদিকে সড়কপথের বাস ও প্রাইভেট কারের সাথে বাড়ছিল অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এরই মধ্যে ১৯৭৭-৭৮ সালে চিলি এবং আর্জেন্তিনার মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক বিবাদ শুরু হলে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুধু বন্ধ হওয়াই নয়, সামরিক আক্রমণের আশঙ্কায় চিলির সেনাবাহিনী এই রেলপথের একটা বড় অংশ ধ্বংস করে ফেলে। পরে ১৯৭৯ সালে  রাজনৈতিক উত্তেজনা কমলেও রেলপথের পুনরুদ্ধার হয় নি। খন্ডিত বিধ্বস্ত রেলপথে শেষবারের মতো পণ্যবাহী ট্রেন চলে ১৯৮৪ সালে।  

গিউমগ্যাংসান রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

কোরিয়ার পাহাড়ী রেলপথ গিউমগ্যাংসান স্ট্যান্ডার্ড গেজের- প্রায় ১৪৩৫ মিলিমিটার চওড়া। ১৯২৪ সালে কোরিয়ার আধুনিকীকরণ প্রকল্পে জাপানী প্রশাসন এই রেলপথ নির্মাণ করে। ১১৬.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ কঙ্গোসান ইলেকট্রিক রেলওয়ে নামেও পরিচিত ছিল। সম্পূর্ণ রেলপথ ছিল ১৫০০ ভোল্ট ডিসি বিদ্যুৎ যুক্ত। ৮ পর্যায়ে এই দুর্গম রেলপথ নির্মাণ করা হয়-১ আগস্ট ১৯২৪ তারিখে চেওরবোন-গিমহোয়ার মধ্যে ২৮.৮ কিলোমিটার ট্রেন চালু হয়। এরপর ৩০ নভেম্বর ১৯২৫ তারিখে গিমহোয়া-গিউমসিওং -২২.২ কিলোমিটার, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ তারিখে গিউমসিওং – ট্যাঙ্গাম-৮.৬ কিমি, ১ সেপ্টেম্বর ১৯২৭ তারিখে ট্যাঙ্গাম-চ্যাংডো- ৮ কিলোমিটার, ১৫ এপ্রিল ১৯২৯ তারিখে চ্যাংডো – হ্যেওল্লি-  ১৫.১ কিলোমিটার, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ তারিখে হ্যেওল্লি – হ্বোয়াগ্যে- ১২ কিলোমিটার, ১৫ মে ১৯৩০ তারিখে হ্বোয়াগ্যে- গিউমগাংগু -১৩.৩ কিলোমিটার, ১ জুলাই ১৯৩১ তারিখে গিউমগাংগু – নাইগিউমগাং- ৮.৬ কিলোমিটার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপক সামরিক ক্ষয়ক্ষতির কারণে ১৯৪৪ সালে প্রাথমিক ভাবে বন্ধ হয়ে যায় এই রেলপথ। পরে ১৯৫০ সালে কোরীয় সরকার সম্পূর্ণভাবে ইতি টেনে দেন এই রেলপথে। উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কিছুটা অংশ জুড়ে এখনো পড়ে রয়েছে গিউমগ্যাংসান রেলপথের দেহাবশেষ। অনন্য প্রযুক্তিতে নির্মিত গিউমগ্যাংসান ইলেকট্রিক রেলব্রিজ আজ শুধুই এক ঐতিহ্যবাহী দ্রষ্টব্যস্থল। রেলপথের ইতিহাসের ছবি, তথ্য, ইঞ্জিন, কামরার দেহাবশেষ পর্যন্ত সংরক্ষিত হয় নি রাজনৈতিক টানাপড়েনে।

এমডেন-পিউসাম-গ্রিটসিয়েল রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

এমডেন-পিউসাম-গ্রীটসিয়েল উত্তর জার্মানির পূর্ব ফ্রিসিয়ার একটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হালকা রেলওয়ে। জার্মান ভাষায় এর নাম ছিল ক্রেইসবান এমডেন-পিউসাম-গ্রীটসিয়েল।এই মিটারগেজ রেল লাইন ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ছিল যা  পশ্চিমে এমডেন থেকে শুরু হয়ে ক্রামহর্নের সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ পেরিয়ে পিউসাম স্টেশন পেরিয়ে লেবাশট উপসাগরের গ্রীটসিয়েল বন্দরে শেষ হত। ১৮৯৯ সালের ২৭ জুলাই এমডেন থেকে পিউসাম পর্যন্ত ৯.৬ কিলোমিটার পথে প্রথম যাত্রিবাহী এবং পণ্যবাহী ট্রেন চলতে শুরু করে। পরে ১৯০৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর গ্রীটসিয়েল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় রেলপথ। ১৯৪৪ সালের সময়সারণী থেকে জানা যাচ্ছে, ব্যস্ত এই রেলপথে ভোর পাঁচটা থেকে সন্ধ্যে ছ'টার মধ্যে মোট সাতটি ট্রেন চলাচল করত। ২৩ কিলোমিটার যাত্রাপথ অতিক্রম করতে সময় লাগত ৪৭ মিনিট।
    
১৯৩৩ সাল থেকে এই রেলপথের দায়িত্ব গ্রহণ করে হ্যানোভার স্টেট রেলওয়ে অফিস। আরো পরে ১৯৫৯ সালে রেলপথের ভার নেয় বেনথেইমের এইবান কোম্পানি। কিন্তু সড়ক পরিবহনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এঁটে উঠতে না পেরে ১৯৬৩ সালের ২৫ মে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় এই রেলপথ।

কুন্ডলা উপত্যকা রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

কুন্ডলা উপত্যকা রেলওয়ে ছিল ভারতের প্রথম মনোরেল সিস্টেম । কেরালার মুন্নারের কাছে কুন্ডলা ভ্যালিতে প্রথমে ১৯০২ সালে বেসরকারি উদ্যোগে মনোরেল সিস্টেম চালু হয়। প্রাথমিকভাবে একটি কার্ট রাস্তার উপর দিয়ে চলত এই এক কামরার ট্রেন। কেরালার কান্নান দেবান পাহাড়ে ছিল রেলপথের শীর্ষবিন্দু বা টপ স্টেশন। মুন্নার এবং মাদুপট্টি থেকে চা এবং অন্যান্য পণ্য এই মনোরেল মারফৎ পাঠানো হত। মনোরেল চলত এউইং সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে। রেলট্র্যাকের উপর একটি ছোট চাকা এবং রাস্তায় একটি বড় চাকা কামরার ভারের সামঞ্জস্য রক্ষা করত। কোন ইঞ্জিন নয়, ষাঁড়ে টেনে নিয়ে যেত এই মনোরেল।
 
পরে ১৯০৮ সালে ৬১০ মিলিমিটার ন্যারো গেজ রেলপথ তৈরি হয়। চালু হয় বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে টানা ট্রেন।  ১৯২৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় (যা মালয়ালী বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী ৯৯-এর বন্যা নামে পরিচিত) এই রেলপথ বিধ্বস্ত হয়। মেরামত করে ট্রেন চালানোর উদ্যোগ পরে আর নেওয়া হয় নি।
    
সুন্দরভাবে নির্মিত মুন্নার রেলওয়ে স্টেশনটি পরবর্তীকালে পরিণত হয়েছে টাটা টী কোম্পানির আঞ্চলিক কার্যালয়ে। রেলপথের কঙ্কাল ঢাকা পড়ে গিয়েছে সড়কপথের কংক্রিটের তলায়। কুন্ডলা উপত্যকার সুবিখ্যাত অ্যালুমিনিয়াম রেলব্রিজ থেকেও রেলপথের চিহ্ন উধাও। রেললাইনের ভাঙা অংশ, চাকা, স্লিপার, সাইনবোর্ড লতাগুল্মের আড়ালে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, সংরক্ষণ হয় নি। ভারতবর্ষে সবচেয়ে আগে হারিয়ে যাওয়া এই রেলপথের কিছু ধূসর ছবি কেউ কেউ বাঁচিয়ে রেখেছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে।

কালীঘাট-ফলতা রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

 

খাস কলকাতার শরীর ঘেঁষে থাকা এই ন্যারোগেজ রেলপথটির চিহ্নমাত্র নেই এখন। জেমস লং সরণীর পিচরাস্তার নীচে হারিয়ে গিয়েছে তার দেহাবশেষ। লন্ডনের ম্যাকলেওড রাসেল অ্যান্ড কোম্পানির এজেন্ট ম্যাকলেওড অ্যান্ড কোম্পানি নির্মাণ করেন এই ৭৬২ মিলিমিটার ন্যারোগেজ লাইন। ৪৩.৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই কালীঘাট ফলতা রেলপথের সংক্ষিপ্ত নাম ছিল কেএফআর। ১৯১৭ সালের ২৮ মে এই পথে প্রথম ট্রেন চলাচল শুরু হয়। পথে স্টেশন গুলি হল- কালীঘাট , ঘলেশাপুর, সখের বাজার, ঠাকুরপুকুর, পৈলান, নেওয়ারী, হল্ট নম্বর ১, উদয়রামপুর, আমতলা, হল্ট নং ২, প্রতিভানগর, শিরাকোল, শিবানীপুর, দীঘিরপার, হরিণডাঙা, হল্ট নং ৪, সাহারার হাট, ফলতা। ১৯২০ সালের ৭ মে মাঝেরহাট পর্যন্ত আরো ১.৪৮ কিলোমিটার সম্প্রসারিত হয় রেলপথ। কালীঘাট-ফলতা রেলওয়েই ভারতবর্ষে প্রথম ২-৬-২ ডেল্টা ক্লাস এ-কে ইঞ্জিন ব্যবহার শুরু করে।
 
একই সময়ে ম্যাকলেওড কোম্পানি আরো তিনটি ন্যারোগেজ রেলপথ পরিচালনা করত- বাঁকুড়া-দামোদর রেলপথ, বর্ধমান-কাটোয়া রেলপথ এবং আমেদপুর-কাটোয়া রেলপথ। ১৯৫১-৫২ সালের একটি রেল রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, চারটি পথের মধ্যে কালীঘাট-ফলতায় খরচ হত সবচেয়ে বেশী, মুনাফা হত সবচেয়ে কম। স্বাভাবিকভাবেই ১৯৫৭ সালে ম্যাকলেওড কোম্পানি তার পাততাড়ি গুটিয়ে নিলে কালীঘাট-ফলতা রেলপথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। অন্য তিনটি ন্যারোগেজ ভারতীয় রেল অধিগ্রহণ করায় দীর্ঘকাল টিমটিম করে ট্রেন চলেছে সেসব পথে। পরে ব্রডগেজে রূপান্তরিত হয়েছে সেসব পথ। কিন্তু কালীঘাট-ফলতা রেলপথের আর চিহ্নমাত্র নেই।   

আসেন্সবানেন রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

দক্ষিণ ডেনমার্কের আসেন থেকে টমারাপ স্টেশনবাই পর্যন্ত প্রায় ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ চালু হয়েছিল ১৮৮৪ সালের ৩১ মে। ১৪৩৫ মিলিমিটার প্রস্থের স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলপথ। যাত্রাপথের রেলস্টেশনগুলি হল- টমারাপ,নারেনবর্গ,কিভস্মোজ ট্রিনব্রেট,নারুপ, হোল্টেগার্ড ট্রিনব্রেট, গ্ল্যামসবিয়ের্গ, কোপেনবিয়ের্গ, ফ্লেমলোজ, হোয়েড, এবারাপ, কিরুম বিলেটস্লাগস্টেড এবং আসেন। আট কামরার ট্রেনগুলি চলত বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে। রেলপথের রমরমার সময় সারা দিনে মোট ৯ জোড়া ট্রেন চলত। দীর্ঘকাল নিয়মিত যাত্রী পরিষেবা এবং পণ্য পরিষেবার দিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ রেলপথের আর্থিক দুরবস্থা শুরু হয়। অবশেষে ১৯৬৬ সালের ২১ মে বন্ধ হয়ে যায় যাত্রিবাহী ট্রেনের চলাচল। পণ্যবাহী ট্রেন তখনো লোকসানের বোঝা নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলছিল। ড্যানিশ পরিবহন মন্ত্রক তাও বন্ধ করে দিল চিরতরে।

হারিয়ে যাওয়া আসেন্সবানেন রেলপথে এখন প্রতি বছর অক্টোবর মাসে দু'সপ্তাহ ব্যাপী ট্রলি সাইকেল প্রতিযোগিতা হয়। দিন কয়েকের জন্য প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে মাটি-ঘাস-লতাপাতায় ঢেকে থাকা রেলপথের দেহাবশেষ। নিও-গথিক এবং টাইরোলিক স্থাপত্যের রেলস্টেশনগুলি নির্জন নিষ্প্রাণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সেইসব প্রাণবন্ত দিনের ছবি ধূসর হয়ে রয়ে গিয়েছে সংগ্রহশালায়।

ওয়ারবার্টন রেলওয়ে

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণের উপকণ্ঠে একটি পরিত্যক্ত রেলপথ ওয়ারবার্টন। উনবিংশ শতকের শেষভাগে যখন এই রেলপথের পরিকল্পনা করা হয়, তখন প্রথমে ন্যারো গেজ রেললাইন বানানোর কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে তৈরি হল ১৬০০ মিলিমিটার প্রস্থের ব্রড গেজ রেলপথ। ১৯০১ সালের ১৩ নভেম্বর ৩৭ কিলোমিটার লম্বা এই রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ওয়ারবার্টন টাউনশিপ থেকে শুরু করে ইয়ারা ভ্যালির বন-জঙ্গল-নদী-কৃষিজমির নয়নাভিরাম দৃশ্য পেরিয়ে লিলিডেলের পাহাড়ী পথে শেষ হত সেই ট্রেনের যাত্রা। প্রায় ৬৫ বছর রমরমিয়ে এই রেলপথে চলে যাত্রী পরিবহন এবং পণ্য পরিবহন। আর্থিক লোকসানের জন্য ১৯৬৫ সালের ১ আগস্ট চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল এই রেলপথ।  
    
১৯৭০ সালের পর রেলপথের বিভিন্ন সম্পত্তি বিক্রি করা শুরু হয়। আপার ইয়ারা সংগ্রহালয়ে ঠাঁই পায় ভাঙা ইঞ্জিনের মডেল, যাত্রাপথের ধূসর ছবি ইত্যাদি। ধুলো-ঘাসে ঢেকে যাওয়া এই রেলপথের স্মরণে অবশ্য প্রতি বছর ৩৭ কিলোমিটার ব্যাপী এক পদযাত্রা এবং সাইকেল যাত্রার আয়োজন করা হয়।

ফুকুশিমা-রিনকাই-এনা রেলপথ

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

জাপানের বন্দর শহর ফুকুশিমার ইজুমিতে বাণিজ্যিক পণ্য সরবরাহ করার জন্য তৈরি হয়েছিল ১০৬৭ মিলিমিটার চওড়া এই মিটারগেজ লাইন। ৫.৫ কিলোমিটার লম্বা এই রেলপথে ছিল মাত্র তিনটি রেলস্টেশন- ইজুমি, মিয়াসিতা ফ্রাইট টার্মিনাল এবং ওনাহামা ফ্রাইট টার্মিনাল। ১৯০৭ সালে ঘোড়ায় টানা এক কামরার ট্রেন দিয়েই এই রেলপথে পণ্য পরিবহনের সূচনা। মূলত সমুদ্রজাত লবণ এবং মাছ পরিবাহিত হত এই রেলপথে। পরে ওনাহামা শিল্পাঞ্চল থেকে দস্তা পরিবহন শুরু হয়।

১৯১৬ সালে ওনাহামা থেকে এনা পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার সম্প্রসারিত হয় এই রেলপথ। শুরু হয় এনা থেকে ওনাহামা হয়ে ইজুমি পর্যন্ত যাত্রী পরিষেবা। ১৯৩৬ সালে এই পথের এনা-ওকাহামা অংশ বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫৩ সালে আবার চালু হয় ফুকুশিমা-রিনকাই-এনার সামগ্রিক যাত্রী পরিষেবা। কিন্তু ১৯৬৫ সালে টাইফুনের ভয়ঙ্কর তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রেলপথ। এনা-ওনাহামা অংশ ১৯৬৮ সালে চিরতরে বন্ধ হয়। ১৯৭২ সালে বন্ধ হয় ইজুমি-ওনাহামা অংশের যাত্রী পরিষেবা। হোক্কাইডো আর ফুকিশিমার রেল-মিউজিয়ামে শুধু রয়ে গেল ভাঙা রেলকামরা, যন্ত্রপাতি আর পরিত্যক্ত পথের শাদা-কালো ছবি।  

ব্রিজটন-স্যাকো নদীর রেলপথ

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিজটন অ্যান্ড স্যাকো রিভার রেলওয়ের সূচনা হয়েছিল ১৮৮৩ সালে। ৬১০ মিলিমিটার প্রস্থের ন্যারোগেজ রেলপথ। ৩৪ কিলোমিটার লম্বা রেলপথে ছিল ১৩টি রেলস্টেশন। সারাদিনে ৪টি ট্রেন চলাচল করত হ্যারিসন থেকে ব্রিজটন পর্যন্ত। এর মধ্যে দু'টি যাত্রিবাহী ট্রেন। ট্রেনের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ৩২ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। কাঠ, কয়লা, পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য, আপেল, ভুট্টা, দানাশস্য ইত্যাদি পরিবাহিত হত।

ত্রিশের দশকের শেষভাগে এই রেলপথের বাণিজ্যিক সরবরাহে মন্দা দেখা দেয়। মূলত পর্যটন শিল্পের হাত ধরে তখন চলছিল এই রেলযাত্রা। পরে ১৯৪১ সালে আমেরিকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচ লাগতেই বিভিন্ন অংশীদারী কোম্পানির শেয়াড়ে টানাটানি পড়ে। রেলের সম্পত্তি বিক্রি শুরু হয়। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় এই রেলপথ।

কঙ্গোর মায়ুম্বে রেলপথ

হারিয়ে যাওয়া রেলপথ

কঙ্গো নদীর বন্দর বোমা থেকে ৎসেলা পর্যন্ত ১৪০ কিলোমিটার লম্বা রেলপথ ছিল মায়ুম্বে। ৬১০ মিলিমিটার প্রস্থের ন্যারোগেজ লাইন। ১৮৯৮ সালের ৩০ জুন বেলজিয়ান সংস্থা সোসিয়েতে দ্য শেমিন্স দে ফার ভিসিনো দু মায়ুম্বে বা সিভিএম এই রেলপথের পরিকল্পনা করে। ১৮৯৯ সালের ৭ মে বোমা থেকে বাঙ্গু পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার পথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ১৯০০-১৯১২ এর মধ্যে তিন ধাপে এই রেলপথ ৎসেলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।

বেলজিয়ামে তৈরি সেন্ট লিওনার্ড লিয়েগের বিভিন্ন লোকোমোটিভ এই রেলপথে ব্যবহৃত হত। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্থিরতা সামলে দিব্যি চালু ছিল এই ট্রেন। ১৯৩৬ এবং ১৯৭৪ সালে রেল কোম্পানির প্রশাসনিক পরিবর্তন হলেও ট্রেন চলাচলে কোন বিঘ্ন ঘটে নি। কিন্তু ১৯৮৪ সালে কঙ্গোর সামরিক একনায়ক মোবুটু সেসে সেকোর হাতে পড়ে রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায় মোয়ুম্বে রেলপথ। পরে সামরিক শাসনের অবসান ঘটলেও রেলপথ পুনরুজ্জীবিত হয় নি। 

ছবিঃ উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট

জন্ম হুগলী জেলার কোন্নগর নবগ্রামে। বর্তমানে পেশাসূত্রে দেরাদুনে। পেশায় বিশ্বব্যাংকের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। কৈশোরের শেষ থেকে ছড়া-কবিতা লিখছেন বিভিন্ন মুদ্রিত কিশোর পত্রিকায় এবং পরে বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকায়। 

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা