চেনা আকাশের গভীরে আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে যে অচেনা আকাশটা রয়েছে, সেখানে বিচিত্র মেজাজের অনেক তারকা রয়েছে। কেউ নাচছে, কেউ ঘর ছেড়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছে, কেউ নিজের গ্রহকেই গিলে ফেলছে, কেউ যখন-তখন দুমদাম বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। তাদের কীর্তিকলাপের নমুনা শুনলে শুধু যে বিস্মিত হতে হয়, তাই নয়, পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব দিয়ে তাদের কার্যকলাপের ব্যাখ্যা করতে বিজ্ঞানীরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। আমাদের ক্ষুদ্র পৃথিবীর ক্ষুদ্র পরিমন্ডলের ধারণার নিরিখে ওই সব তারকার সুব্যাপ্ত পাগলামি বোঝা দুষ্কর। এক এক ক'রে শুনে নেওয়া যাক সেইসব বিচিত্র তারকাদের কথা।
(১) উলফ-রায়েট তারার নাচ
না। ছৌ বা কথাকলি নয়। এ নাচ একই ছন্দে, ধরাবাঁধা সময় মেনে। এখনো পর্যন্ত জানা সবচেয়ে দূরবর্তী কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে ঘিরে নাচ করছে একটি উলফ-রায়েট তারকা। পৃথিবী থেকে এদের দূরত্ব ৬০ লক্ষ আলোকবর্ষ।(আলো এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তা হল ১ আলোকবর্ষ। কিলোমিটারের হিসেবে এক আলোকবর্ষ দূরত্ব মাপতে গেলে ৯৫-এর পিঠে ১১খানা শূন্য বসাতে হবে)। দক্ষিণ আকাশের ভাস্কর মন্ডলীতে থাকা এনজিসি ৩০০ নামক সর্পিলাকার গ্যালাক্সির মধ্যে রয়েছে ওই কৃষ্ণগহ্বর এবং নৃত্যশীল নক্ষত্র। মৃত নক্ষত্রের শরীর সঞ্জাত ওই কৃষ্ণগহ্বরটি সূর্যের চেয়ে ২০ গুণ ভারী। আর কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, অপরিসীম ঘনত্ব, অপরিসীম আকর্ষণের টানে উলফ-রায়েট তারাটি একটানা ৩২ ঘন্টার এক নৃত্যছন্দ মেনে নেচে চলেছে। আর কৃষ্ণগহ্বরটি ওর শরীর থেকে টেনে নিচ্ছে জ্বলন্ত গ্যাস। খুব শিগগিরই, মানে আগামী কয়েক লক্ষ বছরের মধ্যে অবশ্য এই নাচানাচি আর টানাটানির খেলা শেষ হবে। উলফ-রায়েট তারাটি তীব্র সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরিণত হবে কৃষ্ণগহ্বরে। কৃষ্ণগহ্বরের মতোই উলফ-রায়েট তারার চরিত্রও কিন্তু বর্ণময়। সূর্যের চেয়ে অন্তত ২০ গুণ ভারী দুর্লভ এই তারাগুলির পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ২০০০০০ কেলভিন পর্যন্ত হতে পারে। বিবর্তনের পথও সাধারণ তারকাদের মতো নয়। প্রচুর পরিমাণে জ্বলন্ত গ্যাস দেহের বাইরে নিক্ষেপ করায় বদমেজাজি এই তারকাগুলি সাধারণত দশ লক্ষ বছরের বেশী বাঁচে না। আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সিতে প্রায় ৪০০০০ কোটি তারকার মধ্যে মাত্র ২০০টি তারা উলফ-রায়েট শ্রেণীর।
(২) নিজের চতুর্দিকের গ্রহ গিলে খায় 'ব্লোয়াটার' তারকা
অদ্ভুত এই তারকা আবিষ্কার করে বিজ্ঞানীরা চমকে উঠেছিলেন। এদের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা মাত্র ১৭০০-২২০০ কেলভিন, অর্থাৎ নক্ষত্রের তেজে জ্বলে ওঠার মতো নয়। অথচ এদের মেজাজ, উজ্জ্বলতা, ঠাট-বাট উচ্চবর্ণের নক্ষত্রদের মতো। কিভাবে সেটা সম্ভব! সেই কারণ খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আরও অবাক হলেন। প্রায় ২০০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা গ্যালাক্সি এনজিসি ৩৬০৩-এর নক্ষত্রস্তবকের মধ্যে থাকা ৯টি এই শ্রেণীর তারকাকে দীর্ঘকাল পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন যে তারাগুলি তাদের চারপাশে প্রদক্ষিণরত গ্রহগুলিকে গিলে খেয়েই অমন হয়েছে। অভিকর্ষীয় টানে পাথুরে গ্রহগুলি জ্বলন্ত গ্যাসের মধ্যে গিয়ে পড়ায় তারকার পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা কমে গিয়েছে। নইলে এই নক্ষত্রগুলি সাধারণ বাদামী বামন নক্ষত্রের মতোই দৃশ্যমান হত।
(৩) অতি লঘু নক্ষত্র আর্দ্রা
আর্দ্রা নক্ষত্রের বহির্মন্ডলের মতো লঘু হাইড্রোজেন গ্যাস আমাদের সুপরিচিত জগতে কোথাও মিলবে না। মৃত্যুপথযাত্রী লোহিত বামন দশায় পড়ে বহির্মন্ডলীয় নিউক্লিও দহনে ওর এমন দশা। আকাশের কোথায় আছে এই আর্দ্রা তারকা? হেমন্তের সন্ধ্যায় পুব আকাশে যে নক্ষত্রময় শিকারী পুরুষ উদিত হয় সে হল কালপুরুষ। ওই কালপুরুষের বাঁ কাঁধের রক্তবর্ণ তারাটি হল আর্দ্রা। গ্রীক নাম বেটেলগিউজ। পৃথিবী থেকে ওর দূরত্ব প্রায় ৬৫০ আলোকবর্ষ। সূর্যের চেয়ে ২০ গুণ ভারী আর্দ্রার বয়স কিন্তু খুব বেশি নয় , মাত্র ২০ কোটি বছর। মাত্র বলছি এই কারণেই যে, আমাদের সূর্যের বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। আর ৪৫০ কোটি বছর বয়সেও সূর্য নবীন যুবক তারা; কিন্তু আর্দ্রা ২০ কোটি বছরেই মৃত্যুপথযাত্রী ! কিন্তু কেন তার মৃত্যু? সেটা জানতে গেলে নক্ষত্রের বিবর্তন কাহিনি অল্প কথায় জেনে নিতে হবে। প্রথমে দেখা যাক, নক্ষত্রের জন্ম হয় কিভাবে? অতিকায় এক হাইড্রোজেন গ্যাসপিন্ড জমাট বেঁধে তারার জন্ম দেয়। সেই গ্যাসপিন্ডের ওজন কিলোগ্রামে প্রকাশ করতে গেলে ১৬-এর পিঠে ২৮ খানা শূন্য বসাতে হবে। ঐ সুবিশাল গ্যাসপুঞ্জ একত্রিত হলে বিপুল অভিকর্ষীর চাপে তার কেন্দ্রস্থলে হাইড্রোজেন গ্যাসের নিউক্লিও দহন শুরু হয়। এই নিউক্লিও দহন ব্যপারটা কি? সরলতম নিউক্লিও দহনে হাইড্রোজেন গ্যাস অন্তত ১,৩৫,০০,০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পুড়ে হিলিয়াম গ্যাস তৈরি করে এবং নির্গত করে আলোকশক্তি। সূর্যের কেন্দ্রে এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১,৫০,০০,০০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় প্রতি সেকেন্ডে ৬০ কোটি টন হাইড্রোজেন পুড়ে হিলিয়াম আর আলো তৈরি হচ্ছে। এর পরেও সূর্যে যে পরিমাণ হাইড্রোজেন জ্বালানী মজুত আছে তাতে তার হেসে-খেলে আরো ৫০০ কোটি বছর তো চলবেই, ১০০০ কোটি বছরও চলতে পারে। তাহলে আর্দ্রার এমন মুমুর্ষু দশা কেন? সূর্যের চেয়ে ২০ গুণ জ্বালানী রয়েছে ওর ঘরে, বয়সও মাত্র ২০ কোটি বছর, অথচ মৃত্যু ওর শিয়রে ! কারণ শৈশব থেকেই আর্দ্রার লাইফস্টাইলটাই আলাদা ছিল। জন্মের সময় আর্দ্রার ভর ছিল আরো অনেক বেশি – সূর্যের ভরের প্রায় ৩০ গুণ। ওই সুবিশাল ভরের চাপে ওর কেন্দ্রের তাপমাত্রা হয়ে ওঠে অত্যধিক – প্রায় ৩,০০,০০,০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। অত তাপে হাইড্রোজেন হু-হু করে পুড়ে সব জ্বালানী শেষ। যেই জ্বালানী শেষ হল অমনি কেন্দ্র থেকে আলোকশক্তির নির্গমন বন্ধ হল, আর অভিকর্ষীয় বলের চাপে কেন্দ্রীয় অঞ্চল চুপসে যেতে শুরু করল। কেননা, ওই বহির্মুখী আলোকশক্তিই ঠেলে রেখেছিল অন্তর্মুখী অভিকর্ষীয় বলকে। এবারে যেই কেন্দ্রীয় অংশ চুপসে যেতে থাকল, অমনি তারকার বহির্মন্ডলে শুরু হল হাইড্রোজেনের নিউক্লিও দহন যা তারকার বহির্ভাগকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিশাল থেকে বিশালতর করে তুলতে লাগল। আমাদের পরিচিত আকাশে জ্যেষ্ঠা, রোহিণী, স্বাতী –সব তারার এখন এই দশা। এই মৃত্যুকালীন দশার নাম লোহিতদানব দশা।
(৪) পিস্তলের গুলি ছুঁড়ে চলেছে পিস্তল তারকা
সত্যিকার পিস্তলের গুলি নয়। তবে তার চেয়েও ঢের ঢের শক্তিশালী জ্বলন্ত গ্যাস ছুঁড়ছে ক্রমাগত। সেই গ্যাসের পরিমাণ অকল্পনীয়। পৃথিবী থেকে ২৫০০০ আলোকবর্ষ দূরে ধনুরাশিতে থাকা ' পিস্তল তারকা' এক আশ্চর্য তারা। গত শতাব্দীর নব্বই দশকে এই তারাটি আবিষ্কারের পর মনে করা হয়েছিল এটিই আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সির সবচেয়ে ভারী তারা। এর ভর সৌরভরের প্রায় ১৩০ গুণ। ধনুরাশির আলো আর ধুলোর আড়ালে থাকা এই তারার বদমেজাজী চরিত্রের জন্য এর নাম রাখা হয়েছে পিস্তল তারা। আজ থেকে প্রায় ৬০০০ এবং ৪০০০ বছর আগে পিস্তল তারা নিজের শরীরে দুটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রায় ১০ সৌরভর পরিমাণ বিপুল গ্যাস বাইরে ছুঁড়ে দেয়। ওখানেই সে থেমে থাকে নি। তার গরম মেজাজের শরীর ঘিরে এখনো বইছে তীব্র নাক্ষত্রিক বাতাস- সৌরবাতাসের ১০০০ কোটি গুণ বেগে। ঐ বেগে বাতাস সূর্যের শরীরে বইলে সূর্য কবেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। পিস্তল তারকার উজ্জ্বলতা সূর্যের উজ্জ্বলতার ১৬,০০,০০০ গুণ। সূর্যে গোটা এক বছরে যে আলোকশক্তি উৎপাদন হয়, পিস্তল তারকা মাত্র ২০ সেকেন্ডেই ঐ শক্তি উৎপাদন করে দিতে পারে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, পিস্তল তারার বয়স মেরেকেটে ৪০ লক্ষ বছরের বেশী নয়। জন্মকালে তার ওজন ছিল অনেক বেশী, প্রায় ২০০ সৌরভর। বদমেজাজী করে বিপুল পরিমাণ গ্যাস বাইরে নিক্ষেপ করায় এখন তার ভর অনেক কমে গেছে। কিন্তু ভর কমলেও জ্বালানী ফুরোয় নি। সে মৃত্যুপথযাত্রী নয়, সে যুবক তারকা। বিজ্ঞানীরা এই শ্রেণীর তারাদের নাম দিয়েছেন নীলবর্ণ উজ্জ্বল বিষমতারা। আকাশগঙ্গার ৪০০০০ কোটি তারার মধ্যে মাত্র ১০০টি তারা এই শ্রেণীর। দক্ষিণ আকাশের নৌকাতলমন্ডলীর তারা 'ইটা ক্যারিনা' (, হংসমন্ডলীর 'পি সিগনাই', বৃশ্চিকরাশির 'ভি ৯০৫ স্করপাই'–এরা নীলবর্ণের বিষমতারা। এদের ভর যেমন সৌরভরের ১০০ গুণেরও বেশি, তেমনই আকারেও এরা সুবৃহৎ - ব্যাস সৌরব্যাসের অন্তত ১০০ গুণ। ৫০-৬০ লক্ষ বছরের বেশি এরা বাঁচে না। পিস্তল তারার বয়স এখন ৪০ লক্ষ বছর। আগামী ১০-২০ লক্ষ বছরের মধ্যেই দুমম করে বিপুল হাইপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে ওর মৃত্যু হবে।
(৫)অজানা বিবর্তনের পথে ভি ৮৩৮ মোনোসেরোটিস
মধ্য আকাশের একশৃঙ্গ তারকামন্ডলের অদ্ভুত সুন্দর তারা 'ভি ৮৩৮ মোনোসেরোটিস'কে যদি পৃথিবীর আকাশ থেকে খালি চোখে পূর্ণরূপে দেখা যেত, তাহলে বোধহয় পৃথিবীর মানুষ তার থেকে চোখ ফেরাতে পারত না। কিন্তু ২০০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা এই তারাকে দেখতে হলে হাবল বা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির স্পেস টেলিস্কোপগুলির সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তারাটির চারপাশে বহুবর্ণী আলোয় মাখা গ্যাস ও ধুলিপুঞ্জ তারাটির বিস্ফোরণের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে। ৪০ লক্ষ বছর আগে তারাটির ভর ছিল সূর্যের ভরের ৬৫ গুণ। কিন্তু তারাটি বিপুল পরিমাণ জ্বলন্ত গ্যাস বাইরে নিক্ষেপ করায় ওর ভর এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৫ সৌরভরে। ভি ৮৩৮ মোনোসেরোটিসের অবস্থান ছায়াপথের ঘূর্ণনতল থেকে অনেকটাই দূরে। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী, গ্যালাক্সির ঘূর্ণনতল থেকে বেশী দূরে অতিকায় নক্ষত্রের জন্ম হওয়া সম্ভব নয়। তাই কিভাবে এই তারার জন্ম হল তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা ধন্দে। ধোঁয়াশা রয়েছে নক্ষত্রটির বিবর্তন নিয়েও। সুন্দর এই নক্ষত্রটি নক্ষত্রজীবনের ঠিক কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীমহলে বহু মত। কেউ মনে করেন, এর কেন্দ্রীয় তারাটি কার্বন আর অক্সিজেনের সমন্বয়ে তৈরি শ্বেত বামন তারা। কেউ মনে করেন, এটি ৮ এবং ০.৩ সৌরভরযুক্ত দুটি তারার সংঘর্ষজনিত বিস্ফোরণ। আবার কেউ মনে করেন যে, তারাটির তীব্র অভিকর্ষীয় টানে কোন গ্রহ তারাটির আবহমন্ডলে ঢুকে পড়ায় ঘর্ষণজনিত তীব্র উত্তাপে ডয়টেরিয়ামের নিউক্লিও দহন শুরু হওয়ায় আবহমন্ডল ফুলে উঠেছে।
(৬) দৈত্য তারকা 'আর দোরাদাস'
দক্ষিণ আকাশের সুবর্ণাশ্রম তারামন্ডলের লোহিত দানব তারা 'আর দোরাদাস'। সৌরব্যাসের ৩৭০ গুণ ব্যাসযুক্ত এবং সৌর-উজ্জ্বলতার ৬৫০০ গুণ উজ্জ্বলতা যুক্ত এই তারাটির পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা মাত্র ২৮০০ কেলভিন। ভর অবশ্য বেশ কম- মাত্র ১.২ সৌরভর। আকাশে দৃশ্যমান তারাদের মধ্যে আপাত আকৃতির বিচারে এটিই সবচেয়ে বড় তারা। উত্তর গোলার্ধের আকাশের আর্দ্রা তারার চেয়েও প্রায় ৩০ শতাংশ বেশী এর বিস্তৃতি। কিন্তু আসল চমক লুকিয়ে আছে তারাটির উজ্জ্বলতার হ্রাস-বৃদ্ধিতে। এমনিতেই এর নির্গত আলোর বেশীরভাগ অংশই রয়েছে অবলোহিত অংশে। তাই খালি চোখে একে কষ্টেসৃষ্টে দেখা যায়। তার ওপর এর প্রভা ৬.৬ থেকে ৪.৮-এ ওঠানাম করে। উজ্জ্বলতার হ্রাসবৃদ্ধির পর্যায়কালটাও গোলমেলে- কখনো ৩৩৮ দিন, আবার কখনো ১৭৫ দিন। পৃথিবী থেকে ১,৮০,০০০ আলোকবর্ষ দূরে বৃহৎ ম্যাগেলানীয় মেঘ গ্যালাক্সিতে রয়েছে এই তারা।
(৭) অতি-দ্রুতগামী তারা ইউ এস ৭০৮
আকাশগঙ্গার ঘূর্ণনতলের থেকে অনেক দূরে জ্যোতির্মন্ডলের প্রান্তসীমায় থাকা বিচিত্র নক্ষত্র ইউ এস ৭০৮ সব দিক থেকেই বিস্ময়কর। সূর্যের চেয়ে কম ভরযুক্ত এই তারাটির পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা অত্যধিক- প্রায় ৪৬৫০০ কেলভিন। ওইটুকু তারার পক্ষে এত তাপমাত্রা সত্যিই অবিশ্বাস্য। তারাটির শরীরে হিলিয়ামের বিস্ময়কর আধিক্যই ওর অত্যধিক তাপমাত্রার জন্য দায়ী। তাপমাত্রা আর উজ্জ্বলতার কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু ওর গতিবেগও যে লাগাম ছাড়া। আকাশগঙ্গার সাপেক্ষে তারাটি ৭৫১ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড বেগে ছুটছে। এত বেগে ছুটলে আকাশগঙ্গার পক্ষে তাকে ধরে রাখা সম্ভব নয়। ধরে রাখতে পারছেও না। তাতে অসুবিধা নেই। এই তারাটিকে ' অতিদ্রুতগামী তারা'–এর গোত্রভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু রহস্য অন্য জায়গায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরের আকর্ষণে দুটি শ্বেতবামনের সংঘাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল এই তারাটি। তারাটির যা গতিবেগ তাতে ওই বেগে চলে আকাশগঙ্গার কেন্দ্র থেকে বর্তমানের অবস্থানে যেতে তারাটির ৩.২ কোটি বছর লাগার কথা। কিন্তু তারাটির বয়স তার চেয়ে ঢের কম।
(৮)হীরের টুকরো তারা- বিপিএম ৩৭০৯৩
দক্ষিণ আকাশে অশ্বমানব তারামন্ডলে প্রায় ৫০ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে এই অত্যাশ্চর্য তারাটি। তারাটির কেন্দ্র একটি জমাত-বাঁধা হীরকখন্ড যার ওজন কিলোগ্রামে মাপতে গেলে ২. ২৫-এর পিঠে ৩০ খানা শূন্য বসাতে হয়। মানে ওই অবিশ্বাস্য হীরকখন্ডের ওজন ক্যারটে মাপতে গেলে ১০-এর পিঠে ৩৩ খানা শূন্য বসাতে হবে। কী করে তৈরি হল ওই হীরে? মৃত্যুকালীন শ্বেতবামন দশায় তারাটির কেন্দ্রের প্রায় সমস্ত কার্বন জমাট বেঁধে তৈরি হয়েছে হীরেটি। সব শ্বেতবামন তারায় অবশ্য এমন হয় না। এটা ঘটেছে বিপিএম ৩৭০৯৩ অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায়। সাধারণত শ্বেতবামনের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ২৫০০০-২০০০০০ কেলভিন হয়। কিন্তু বিপিএম ৩৭০৯৩-এর পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা মাত্র ১১৭০০ কেলভিন। কেন? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই তারাটি অতিবৃদ্ধ তারা। বয়স প্রায় ১২০০ কোটি বছরেরও বেশী। আর এই দীর্ঘ সময় ধরে ঠান্ডা হতে হতেই এ পুরো জমে হীরে!!!
(৯)হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে ওঠে ইটা ক্যারিনা
শোনা যাক দক্ষিণ আকাশের নৌকাতল মন্ডলীর তারা ইটা ক্যারিনার কথা। পৃথিবী থেকে প্রায় ৮০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা এই তারাটির ভর সৌরভরের ১২০ গুণ। এতেই অবাক হওয়ার কিছু নেই। জন্মকালে তারাটির ভর নাকি ছিল প্রায় ১৫০ সৌরভর। অতিকায় এই তারার উজ্জ্বলতা গত তিন শতাব্দী ধরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে-কমেছে। এর প্রকৃত উজ্জ্বলতা হিসেব করে বিজ্ঞানীরা দেখলেন তা সূর্যের উজ্জ্বলতার প্রায় ৫০,০০,০০০ গুণ। তারাটি ৩০ সৌরভরের একটি তারাকে এবং অতিকায় এক নীহারিকাকে অভিকর্ষ বলের টানে নিজের চারদিকে ঘোরাচ্ছে। ইটা ক্যারিনার ব্যাস বিশাল, -সৌরব্যাসের ২৪০ গুণ। তীব্র আঘাত তরঙ্গ বা শক ওয়েভ তারাটির চারপাশে তীব্র সুপারসোনিক বেগে ছুটে চলেছে। পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রাও অত্যধিক প্রায় ৩৭০০০ কেলভিন। ছায়াপথের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা হিসেবে দাবিদার তারাদের মধ্যে এই তারাটি কিন্তু সবার চেয়ে এগিয়ে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে তারাটির আকর্ষণ অন্য এক কারণে। এ নাকি খুব শিগগির সুপারনোভা বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে। ২০০৬ সালে দূর আকাশে ঘটা দু'টি মহাশক্তিশালী সুপারনোভা বিস্ফোরণ 'এসএন ২০০৬ জেসি' (৭.৭ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, মার্জার তারকামন্ডলের গভীরে) এবং 'এসএন ২০০৬ জিওয়াই' ( ২৩.৮ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, পার্সিয়ুস তারকামন্ডলের গভীরে) – এর তারাদু'টির সাথে তাত্ত্বিক মিল দেখে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইটা ক্যারিনা নাকি আমাদের জীবৎকালের মধ্যেই সুপারনোভা বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে।
(১০) প্রবল কাঁপনে কাঁপছে এসজিআর ১৮০৬-২০
পৃথিবী থেকে ১০ আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে হলে পৃথিবীর জীবমন্ডল ধুয়ে মুছে যেত ওই প্রবল কম্পনের ঠেলায়। অনেক দূরে, ধনুরাশির গভীরে প্রায় ৫০০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা যে নিউট্রন তারাটির শরীরে ওই কম্পন জেগেছে, তার চৌম্বকশক্তির পরিমাপ করে অবিশ্বাস্য এক সংখ্যা মিলল। এযাবৎ জানা তারাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এতটাই বেশি যে এর অবিশ্বাস্য চৌম্বকশক্তির ধারণা সূর্যের চৌম্বকশক্তির নিরিখে মাপতে গেলে সূর্যের চৌম্বকশক্তির পিঠে ১৫ খানা শূন্য বসাতে হবে। ২০০৪ সালে তারাটিতে এক প্রবল বিস্ফোরণ ধরা পড়ে। ওই বিস্ফোরণে নির্গত গামারশ্মির পরিমাণ হিসেব কষে বিজ্ঞানীদের চক্ষু চড়কগাছ। সূর্য ১০০০০০ বছরে যে শক্তি উৎপাদন করে, এই তারাটি এক সেকেন্ডের এক দশমাংশ সময়ে সেই শক্তি উৎপাদন করেছে। তারাটির ব্যাস মাত্র ২০ কিলোমিটার। তাহলে এতটা চৌম্বকশক্তি এল কোথা থেকে? একটু আগে বলা নিউট্রন তারকা এস এক্স পি ১০৬২-এর চেয়ে এর আবর্তন বেগ অনেক বেশী ( প্রায় ৮ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড) হলেও সাধারণ নিউট্রন তারার নিরিখে এই বেগ যথেষ্ট কম। সাধারণ নিউট্রন তারার আবর্তন বেগ প্রায় ৬০০-৮০০ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড। ফলে তারাটির আবর্তনজাত শক্তি আর তাপশক্তির পুরোটাই রূপান্তরিত হয়েছে চৌম্বকশক্তিতে। আর ওই তীব্র অভ্যন্তরীণ চৌম্বকশক্তির মোচড়ে নক্ষত্রের পৃষ্ঠদেশে প্রবল চাপে বিস্ফোরণ ঘটেছে। পৃথিবী থেকে ১০ আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে যদি এরকম কোন বিস্ফোরণ ঘটে, তাহলে পৃথিবীর ওজোন স্তরটাই পুরোপুরি উবে যাবে। আর এরকম একটা তারা যদি চাঁদের দূরত্বের অর্ধেক দূরত্বে রাখা হয়, তাহলে পৃথিবীর সব এটিএম কার্ড আর ক্রেডিট কার্ডের চৌম্বকীয় প্রলেপের ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলবে।
(১১) ভীমবেগে পালাচ্ছে এইচ ই ০৪৩৭-৫৪৩৯
দক্ষিণ আকাশের সুবর্ণাশ্রম মন্ডলীর তারকা এইচ ই ০৪৩৭-৫৪৩৯। পৃথিবী থেকে প্রায় ২০০০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা এই তরুণ তারাটির পৃষ্ঠতল অত্যন্ত উষ্ণ- তাপমাত্রা প্রায় ২০০০০ কেলভিন। তারকাটির উজ্জ্বলতাও অত্যধিক – সূর্যের উজ্জ্বলতার অন্তত ১৫০০০ গুণ। ভর সৌরভরের ৮ গুণ। এসব কোন অস্বাভাবিক ব্যপার নয়। গন্ডগোল তারকাটির গতিবেগে। আমাদের গ্যালাক্সি আকাশগঙ্গার সাপেক্ষে প্রায় ৭২৩ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা অবিশ্বাস্য বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। এই অবিশ্বাস্য বেগ কে জুগিয়েছে সেটা যেমন এক রহস্য, তেমনই এক রহস্য তারকাটির জন্মস্থান নিয়ে। তারাটির বয়স প্রায় তিন কোটি বছর। একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী বলছেন, তারাটির জন্ম আমাদের প্রতিবেশী গ্যালাক্সি বৃহৎ ম্যাগেলানীয় মেঘে, এবং জন্মের পরই এই তারা এক অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর এবং নিজের সঙ্গী নক্ষত্রের যৌথ ঘাড়-ধাক্কা খেয়ে অমন অবিশ্বাস্য বেগে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা শুরু করেছে। অন্য এক দল জ্যোতির্বিদের দাবী, এই তারকার জন্ম আমাদের আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিতেই। হাবল টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ লব্ধ তথ্য বিশ্লেষণ করে তাদের দাবী, তারকাটির বয়স অত বেশী নয়- খুব বেশী হলে ২ কোটি বছর। আর তারাটি সাধারণ নীলবর্ণ তারকা নয়, এটি একটু বেশী নীল রঙের ব্লু স্ট্র্যাংলার তারকা, যা দু'টি তারকার মিলনে উৎপন্ন। আকাশগঙ্গার কেন্দ্রেই নাকি তিন তারকার (যার মধ্যে একটি তারা কৃষ্ণগহ্বর) সংসারে জন্ম হয়েছিল এইচ ই ০৪৩৭-৫৪৩৯-এর। সেখান থেকেই তাকে অর্ধচন্দ্র দেওয়া হয়।
(১২)অবিশ্বাস্য বেগে পাক খাচ্ছে পালসার পিএসআর জে ১৭৮৪-২৪৪৬ এডি
পৃথিবী থেকে প্রায় ১৮০০০ আলোকবর্ষ দূরে ধনুরাশির 'টারজান ৫' নক্ষত্রস্তবকের মধ্যে রয়েছে এই নিউট্রন তারকা। দুই তারকার সংসারের সদস্য হওয়ায় এর আলো মাঝেমধ্যেই বাড়ে কমে। ২০০৪ সালে আবিষ্কৃত এই পালসারটি এ যাবৎ জানা পালসারদের মধ্যে সবচেয়ে জোরে ঘুরছে। প্রতি সেকেন্ডে নিজের চতুর্দিকে ৭১৬ বার পাক খায় এই তারকাটি। নাক্ষত্রিক বিবর্তনে অত্যন্ত ঘন এবং শীর্ণ হলেও এর ব্যাস নেহাত কম নয়- প্রায় ৩২ কিলোমিটার। অর্থাৎ পালসারটির নিরক্ষীয় অঞ্চলে ঘূর্ণন বেগ মাপলে তা আলোকের বেগের প্রায় ২৫ শতাংশ। এই নক্ষত্রের আবিষ্কর্তা জ্যাসন হেসেলের দাবী, পালসারটি তার প্রবল অভিকর্ষীয় টানে সঙ্গী তারকাকে বিকৃত করে ফেলেছে। তিনি আশা করছেন অভিকর্ষীয় তরঙ্গ অনুসন্ধানকারী 'লিগো' টেলিস্কোপ এই পালসার থেকে আশাতিরিক্ত অভিকর্ষীয় বিকিরণের সন্ধান পাবে।
(১৩) কৃষ্ণগহ্বর আইজি আর জে ১৭০৯১-এর বিস্ময়কর জেট
বৃশ্চিক নক্ষত্রমন্ডলীর গভীরে পৃথিবী থেকে প্রায় ২৮০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা এই ছোট্ট কৃষ্ণগহ্বর থেকে নিঃসৃত জ্বলন্ত গ্যাসের স্রোত বিচার করে বিজ্ঞানীদের চক্ষু চড়ক গাছ। স্রোতের বেগ প্রায় ৩.২ কোটি কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। মাত্র ১০ সৌরভরের একটি নেহাতই ছোট কৃষ্ণগহ্বর। ওর চেয়ে কয়েক কোটি গুণ ভারী কৃষ্ণগহ্বর এ ব্রহ্মাণ্ডে রয়েছে। এই আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিতেই রয়েছে ওর চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ ভারী কৃষ্ণগহ্বর। তাদের ক্ষেত্রে নাহয় অমন অবিশ্বাস্য বেগে গ্যাস জেট নিক্ষেপ মানা যায়; কিন্তু এত পুঁচকে এই ব্ল্যাকহোল কিভাবে এমন জেট ছুঁড়ছে? বিজ্ঞানীদের অনুমান, চৌম্বক ক্ষেত্রের কোন অস্বাভাবিকত্বই এই ঘটনার জন্য দায়ী। কৃষ্ণগহ্বরটির রহস্যকাহিনি শুধু নিক্ষিপ্ত গ্যাস স্রোতের অবিশ্বাস্য বেগেই শেষ হচ্ছে না। পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, কৃষ্ণগহ্বরের আকর্ষণে আগত পদার্থের ৯৫ শতাংশ তার বহির্মন্ডল থেকে উড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওই স্রোতের তাড়নায়, যা কৃষ্ণগহ্বরের সনাতন মডেলের পরিপন্থী। চন্দ্র এক্স-রশ্মি পর্যবেক্ষণাগারের আয়ন বর্ণালী বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা আরো তাজ্জব। ওই স্রোত নাকি কখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, আবার কখনো চলতে থাকে তীব্রভাবে। সূর্যজাতীয় একটি সাধারণ তারকা নাকি এই কৃষ্ণগহ্বরটিকে প্রদক্ষিণ করছে। কিভাবে সে টিঁকে আছে, কে জানে?
ছবিঃ উইকিপিডিয়া