কেমব্রিজে নিজের হাতে তৈরী রেডিও টেলিস্কোপের সামনে দাঁড়িয়ে যুবাবয়সী জসলিন বেল
ছোটবেলাটা ডায়মন্ডহারবারে কেটেছে। বিদ্যুৎব্যবস্থা এখনকার মত উন্নত ছিল না, প্রায়শই কারেন্ট যেত। আমরা বলতাম, লোডশেডিং হয়েছে। সন্ধ্যে হলেই হ্যারিকেন-দেশলাই-মোম-লম্ফ ইত্যাদি হাতের কাছে রাখাটা চল ছিল। বিকেলবেলা খেলতে বেরোতুম, বাড়ির পাশেই খেলার মাঠ, ঘন্টা দু'য়েক ক্রিকেট বা ফুটবল (যে মরশুমে যা, শীতে ক্রিকেট, বর্ষায় ফুটবল) খেলে বাড়ি এসে হাতপা ধুয়ে একটু কিছু মুখে দিয়ে সোজা পড়াশুনোয় বসে পড়তাম। হামেশাই সেই পড়াশুনোটা হ্যারিকেনের আলোয় হত।
ডায়মন্ডহারবার কলকাতার দক্ষিণে, রাস্তায় গেলে কিলোমিটার পঞ্চাশেক। মফস্বল শহর, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিও খুব যে বেশি লোকের বাস ছিল তা নয়। ইদানীং কলকাতার রাতের আকাশে যেমন একটা চিরস্থায়ী রাগী লাল আভা থাকে, সেরকমটা ছিল না। এই আলোকদূষণ না থাকায়, বিশেষ করে রাতে লোডশেডিং হলে, আকাশে প্রচুর প্রচুর তারা দেখা যেত। আকাশে চাঁদ না থাকলে, লোডশেডিং হলে, মেঘ একেবারেই না থাকলে, এবং আলোকদূষণ ও বায়ুদূষণ কম থাকলে খালি চোখে মোটামুটি হাজার দু'য়েক তারা দেখতে পাওয়া উচিত। দুঃখের বিষয়, আজকাল কলকাতা শহরের মধ্যে বসে আমরা ভাল দিনে বেশির চেয়ে বেশি গোটা চল্লিশেক তারা দেখতে পাই।
তারা দেখাটাও একটা বিজ্ঞান। বাংলায় এর নাম জ্যোতির্বিদ্যা, ইংরিজিতে অ্যাস্ট্রোনমি। তারা-গ্রহ-চাঁদ-ধূমকেতু-উল্কা ইত্যাদি দেখা, ক্যাটালগ করা, সেই তথ্য বিশ্লেষণ করা, এবং তার থেকে মহাকাশ ও মহাবিশ্বের রহস্য খানিকটা হলেও ভেদ করার মধ্যে একটা অদ্ভুত মজা আছে, এক অনাবিল আনন্দ আছে। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগেও মানুষ খালিচোখেই রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত আর ভাবত, সত্যি কত কী রহস্য লুকিয়ে আছে ওই ছোট্ট শাদা-নীল-লাল-হলুদ ফুটকিগুলোতে।
জসলিনও তেমনই হয়ত ভাবতেন।
উত্তর আয়ারল্যান্ডে লুরগান শহরে ১৯৪৩ সালের ১৫ জুলাই সুজ্যন জসলিন বেলের (Susan Jocelyn Bell) জন্ম। শহর না বলে মফস্বল টাউন বলাই ভাল। বাবা ফিলিপ বেল আর্কিটেক্ট ছিলেন, আরমাঘ প্ল্যানেটেরিয়ামের নকশা ওনারই বানানো। কলকাতায় যেমন বিড়লা তারামন্ডল, উত্তর আয়ারল্যান্ডে তেমন আরমাঘ তারামন্ডল। ছোটবেলায় সেখানে সময় কাটিয়ে ও বাবার লাইব্রেরী থেকে জ্যোতির্বিদ্যার বই নিয়ে পড়ে জসলিনের ছোটবেলাটা কেটেছে। মহাকাশ নিয়ে জসলিনের আগ্রহ দেখে তারামন্ডলের কর্মীরাই জসলিনকে জ্যোতির্বিদ্যাকে পেশা হিসাবে নেওয়ার জন্য উৎসাহ দেন।
কিন্তু জসলিন যে মেয়ে। মহিলাদের বিজ্ঞান নিয়ে পড়াটা তখনকার দিনে অতটা সহজ ছিল না। এখানে আমরা যেটাকে হাইস্কুল বলি, গ্রেট বৃটেনে সেটাকে সেকেন্ডারি স্কুল বলা হত। সেখানে জসলিনকে ভর্তি করে দিয়েছেন ফিলিপ। প্রথম দিনই ঘোষণা হল যে ক্লাসের পর দুপুরবেলা ছেলেরা একটা ঘরে যাবে, আর মেয়েরা সম্পূর্ণ অন্য একটা ঘরে। দেখা গেল ছেলেদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিজ্ঞানের গবেষণাক্লাসে, আর মেয়েদের পাঠানো হয়েছে ডোমেস্টিক সায়েন্স বা গার্হস্থ্যবিজ্ঞানের ক্লাসে। রাতে বাড়িতে এ'কথা শুনে ফিলিপ ও জসলিনের মা অ্যালিসন তো একেবারে ফায়ার। মেয়ে হয়েছে বলে সে বুঝি বিজ্ঞান পড়ার যোগ্য নয়, অ্যাঁ? মেয়েগুলো শুধু রান্নাঘর আর ঘরগেরস্তই সামলাবে আর ছেলেগুলো বসে বসে দিব্যি বিজ্ঞান শিখবে? ওটি হোবি নি। আমাদের মেয়েও বিজ্ঞান পড়বে বৈকি, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান পড়ার কোন দরকার নেই।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। জসলিনের মা-বাবার রাগারাগিতে ও আরও কয়েকটি মেয়ের বাড়ির লোকের প্রতিবাদের পরের দিন জসলিন ও তার দুই মেয়ে বন্ধুকে সায়েন্স ল্যাবে ছেলেদের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়িয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা শিখতে দেখা গেল।
কিন্তু তা বলে জসলিনের সংগ্রাম শেষ হয়ে গেল বললে ভুল বলা হবে। সেকেন্ডারি স্কুল পাশ করে জসলিন গেল গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে, উদ্দেশ্য পদার্থবিদ্যা নিয়ে অনার্স পড়বে। গ্লাসগো স্কটল্যান্ডে, সেখানে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে জসলিন আবিষ্কার করল যে ফিজিক্স ক্লাসে সেই একমাত্র মেয়ে। অতগুলো এতগুলো ছেলের মধ্যে একা মেয়ে জসলিন, তার ওপর রোজ লেকচার হলে ঢোকবার সময় ছেলেদের প্রচুর টিটকিরি তাকে সহ্য করতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও জসলিন হাল ছাড়েনি, দাঁতে দাঁত চেপে তিন বছর কাটিয়ে ১৯৬৫ সালে অনার্স নিয়ে সসম্মানে পাশ করেছে।
একটু এখানে নিজের কথা বলি। এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে আমি কলেজ জয়েন করি। বিষয় জসলিনের মতই পদার্থবিদ্যা অনার্স, কলেজ প্রেসিডেন্সী। আমাদের ক্লাসে গোটা তিরিশ-চল্লিশ ছেলে ছিল, আর প্রথমে ছিল মাত্র দু'টি মেয়ে। মাস কয়েক পরে বেথুন থেকে আরও দু'জন জয়েন করে মোট চারজন হয়। ওদিকে উদ্ভিদবিদ্যা বা বটানি অনার্সে ছাব্বিশজন মেয়ে, একটি ছেলে। জসলিনের চল্লিশ বছর পরে বিজ্ঞানে মেয়েদের সংখ্যা বেড়েছে বটে, কিন্তু পদার্থবিদ্যা এখনও ছেলেদেরই খাস তালুক। তোমরা যারা এই লেখা পড়ছ, যদি মেয়ে হও, আর যদি বিজ্ঞান---বিশেষ করে পদার্থবিদ্যায় কৌতুহল থাকে, তাহলে কিন্তু তা নিয়ে পড়াশুনো করতে দ্বিধা করো না। মগজাস্ত্রে শাণ দেওয়ার এত ভাল সুযোগ খুব একটা পাবে না।
যাই হোক, জসলিনের গল্পে ফিরে যাই। গ্লাসগো থেকে পাশ করে জসলিন খানিক ফাঁপরে পড়ল। ছোটবেলা থেকেই অ্যাস্ট্রোনমিতে কাজ করার ইচ্ছে, বৃটেনে অ্যাস্ট্রনমি নিয়ে কাজ করার সুযোগও প্রচুর, আর কাজে সফল হলে খ্যাতি-যশ-প্রতিপত্তিও আছে। এডমন্ড হ্যালি, যাঁর নামে হ্যালির ধূমকেতু, ৭৬ বছর বাদে বাদে পৃথিবী ঘুরে যায়, ইনি বৃটিশ। উইলিয়াম হার্শেল, ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কর্তা, ইনিও বৃটিশ। আর্থার এডিংটন, যিনি ১৯১৯ সালে সূর্যগ্রহণের সময় আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির প্রমাণ করেছিলেন, তিনিও বৃটিশ। আবার প্যাট্রিক মুর, যিনি বিবিসি রেডিওতে ১৯৫৭ থেকে ২০১২ সালে অবধি দ্য স্কাই অ্যাট নাইট (The Sky at Night) প্রোগ্রামটি পেশ করেছিলেন, তিনিও বৃটেনেরই লোক। যুবাবয়সে জসলিন প্রোগ্রামটি যে শুনেছিলেন বা শুনতেন, সে নিয়ে বোধহয় খুব একটা সন্দেহ থাকার কারণ নেই।
ছোটবেলায় ডায়মন্ড হারবারের সেই লোডশেডিঙের সন্ধ্যেগুলোয় আমিও প্যাট্রিক মুরের তত্ত্বাবধানে খালি চোখে বিভিন্ন নক্ষত্রমন্ডল নেবুলা গ্যালাক্সি ইত্যাদি দেখে চেনার চেষ্টা করতাম। মানে প্যাট্রিকসায়েব অবশ্যই সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না, ছিল তাঁর লেখা একটা অত্যন্ত ভাল বই, ফিলিপ্স গাইড টু স্টার্স অ্যান্ড প্ল্যানেট্স (Philip's Guide to Stars and Planets)। বইটি জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছিলেন। বাবা নিজেও স্টারগেজিং বা তারাদেখন করতে খুব ভালবাসতেন। এখনও রাতের আকাশে তারার দিকে তাকালে সেই বইটার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে বাবার শান্ত গলাটা। ওই যে বিটলজ্যুস, ওই রিজেল, ওইটা ওরায়ন। আর ওই, ওইটে ক্যাসিওপিয়া।
বৃটিশ জ্যোতির্বিদদের তালিকাতে অবশ্য একজনও মহিলার নাম নেই। একজনের নাম আসা উচিত, যদিও ইতিহাসের পাতায় তাঁর ভাইয়ের নাম বেশি উজ্জ্বল---ক্যারোলিন হার্শেন, উইলিয়ামের বোন, নিজে যিনি একজন অতি সুদক্ষ জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তাই জসলিনের সামনে উদাহরণ বলতে তেমন কেউ ছিল না, জ্যোতির্বিদ্যা বা নভোপদার্থবিদ্যা নিয়েই যদি কাজ করতে হয়, তাহলে তাঁকেই পায়োনীয়ার হতে হবে।
এ ছাড়াও আরেকটা মুশকিল ছিল। টেলিস্কোপে চোখ রেখে বিভিন্ন তারা-গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করতে হলে রাতের বেলা ছাড়া গতি নেই। এদিকে রাতের বেলায় মানমন্দির বা অবজারভেটরিতে একলা বসে কাজ করতে জসলিনের ঘোর আপত্তি। এবার কী হবে?
সুখের বিষয়, আলো ছাড়াও মহাকাশ ও বিশ্বব্রহ্মান্ড দেখার উপায় যে আছে, এবং সেই উপায় কাজে লাগিয়ে অন্য ধরনের কিছু টেলিস্কোপ যে তৈরী করা সম্ভব, সেটা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বৈজ্ঞানিকমহল বিলক্ষণ বুঝে ফেলেছিলেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাভেনডিশ ল্যাবের অ্যাস্ট্রোফিজিক্স গ্রপের প্রধান প্রফেসর মার্টিন রাইল যেমন। ১৯৩২ সালে কার্ল জ্যানস্কির আবিষ্কারের পর এক নতুন ধরনের জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা শুরু হয়। এর নাম হয় রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি, এবং এতে ব্যবহার হয় রেডিও টেলিস্কোপ। অনেকটা ডিশ অ্যান্টেনার মত দেখতে এই টেলিস্কোপ দিয়ে রেডিও বিকিরণ ধরা যায়।
কিন্তু রেডিও? রেডিও তো আমরা বছরে একবার মাত্র খুলি, তাও ঝেড়েঝুড়ে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে। মহালয়ার ভোরে বীরেনভদ্রের গলায় মহিষাসুরমর্দিনী শোনা ছাড়া রেডিওর ব্যবহার আজকাল বেশ কমেই গেছে। সেই ফ্রেডি মার্কারি আশির দশকের শুরুতে রেডিও নিয়ে গান লিখেছিলেন, তার পর থেকে রেডিও জিনিসটাই আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে কেমন একটা গুডবাই হয়ে গেছে। অথচ এই বেতারযন্ত্র আবিষ্কার ও বেতারতরঙ্গকে কীভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায় সেটা কিন্তু দেখিয়ে গেছেন এক বাঙালিই। দুঃখের বিষয়, জগদীশ বসু এর জন্য নোবেল পুরষ্কার পাননি। অনেকে মনে করেন, সেটা ওনার পাওয়া উচিত ছিল। বদলে নোবেলটা পেয়েছিলেন ইতালির মার্কনি, ১৯০৯ সালে।
মহাকাশের তারাদের থেকেও কিন্তু সর্বদা রেডিও তরঙ্গ বিচ্ছুরিত হচ্ছে। উদাহরণ আমাদের সুয্যিমামা। পদার্থবিদ্যার ভাষায় একে ব্ল্যাকবডি বা কৃষ্ণবস্তু বলা হয়। কৃষ্ণবস্তু যত গরম হবে তার থেকে অবলোহিত বা ইনফ্রারেড থেকে শুরু করে লাল-কমলা-হলুদ-সবুজ-নীল-বেগুনি পেরিয়ে অতিবেগুনি বা আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির বিকিরণ ঘটবে। সূর্য বা অন্যান্য তারাদের ক্ষেত্রে ইনফ্রারেড চেয়েও কম শক্তিশালী মাইক্রোওয়েভ এবং তারও নীচে রেডিও তরঙ্গের বিকিরণও ঘটে থাকে। আবার অনেক বিশালাকায় তারা, নিউট্রন তারা বা ব্ল্যাকহোল হলে তা থেকে এক্সরে'র মত মহাশক্তিধর রশ্মিও বেরোতে পারে বটে।
জসলিনের সময়ে রেডিও তরঙ্গ মেপে জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার চর্চা বেশ উন্নত হয়েছে। কেমব্রিজের মার্টিন রাইলের নাম করলাম, তিনি এমন একধরণের নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার করেছিলেন যে দিয়ে ছোট ছোট রেডিও রিসিভার বা বেতারগ্রাহক কাজে লাগিয়ে বিশাল বড় রেডিও ডিশের সমতুল্য কাজ পাওয়া যায়। কোন এক দূরের মহাজাগতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে হয়ত প্রয়োজন দেড় কিলোমিটার ব্যাসের একটা রেডিও টেলিস্কোপ। সেরকম প্রকান্ড ডিশ বানানো কার্যত অসম্ভব। রাইলের পদ্ধতি মেনে কাজ করলে অত বড় ডিশ লাগবেই না, মাটিতে দেড় কিলোমিটার ব্যাসের একটা কাল্পনিক বৃত্ত এঁকে তার বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা ডিশ বসালেই কেল্লা ফতে! সহকর্মী অ্যান্টনি হিউইশকে সঙ্গে নিয়ে রাইল এই কাজে সাফল্যও পেয়েছিলেন।
জসলিনের মনে হল, রেডিও অ্যাস্ট্রোনমিই তাঁর জন্য আদর্শ পথ। পর্যবেক্ষণের কাজ দিনের বেলাতেও দিব্যি চলতে পারে, সূর্য আকাশে থাকল কী থাকল না তাতে রেডিও তরঙ্গের কী? হ্যাঁ, মানে, সূর্যের দিকে সোজাসুজি টেলিস্কোপ তাক করলে কতটা কাজের কাজ হবে ভাববার বিষয়, যদি না কাজটা হয় সূর্যের রেডিও বিকিরণ নিয়ে চর্চা করা।
হিউইশ সূর্য নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল কোয়েজার (quasar, Quasi-Stellar Radio Source)। বহুদূরের গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিপুল ভরবিশিষ্ট কৃষ্ণগহ্বর বা কালোগর্ত থেকে নির্গত অত্যন্ত উচ্চশক্তিমান বিকিরণই পৃথিবীর রেডিও টেলিস্কোপে কোয়েজার রূপে ধরা পড়ে। এই তথ্য আমরা এখন জানি, ষাটের দশকে বিজ্ঞান ততটাও অগ্রসর হয়নি। হিউইশ এই কোয়েজার নিয়েই গবেষণা করছিলেন, দরকার ছিল একটা ভাল নতুন রেডিও টেলিস্কোপের, দরকার ছিল একজন দক্ষ বুদ্ধিমান ছাত্রের। প্রথমটা পেলেন, কিন্তু বুদ্ধিমান ছাত্রের বদলে পেলেন এক অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও কৌতুহলী ছাত্রী।
জসলিন কেমব্রিজের পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করার আগে দু'বার ভেবেছিলেন। কেমব্রিজের রেডিও অ্যাস্ট্রনমি বিভাগ তখন বৃটেনের সর্বশ্রেষ্ট, সেখানে সুযোগ পাওয়া সহজ নয়। তার চেয়ে বরং অস্ট্রেলিয়াতে যাওয়াই অপেক্ষাকৃত সহজ, সেখানে রেডিও অ্যাস্ট্রনমি নিয়ে প্রচুর ভাল কাজও হচ্ছে। মুশকিল হল, অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় জানুয়ারী মাস থেকে, ওখানকার গ্রীষ্মকালের একদম মাঝামাঝি। এদিকে জসলিনের হাতে তখনও মাস তিনেকের মত সময় ছিল, কপাল ঠুকে দিলেন কেমব্রিজে অ্যাপ্লাই করে। তারপর একদিন হতবাক হয়ে দেখলেন, ইয়া মেফিস্টোফিলিস নীলগাই নীলগাই, পেয়ে গেছেন!
কেমব্রিজে পৌঁছে সবকিছু দেখেটেখে জসলিন বেচারীর চক্ষু চড়কগাছ। ইম্পস্টার সিন্ড্রোমে (Impostor Syndrome) ভুগতে থাকলেন --- খালি মনে হত, ভুল করে কেমব্রিজ তাকে সুযোগ দিয়েছে, তিনি আসলে এই পদের যোগ্য নয়, তিনি আসলে প্রতারক, ছলচাতুরী করে লোকের চোখে ধুলো দিয়ে কেমব্রিজে সুযোগ পেয়েছেন, এইবার তিনি ধরা পড়বেন, ধরা পড়লেই খেল খতম। আর হ্যাঁ, তিনি মহিলা, মহিলারা বিজ্ঞান করবে, ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত। নিশ্চয়ই কোথাও কিছু একটা ভুলচুক হচ্ছে, সত্যিটা বেরিয়ে পড়বে খুব শিগগিরি।
সৌভাগ্যক্রমে, এই মানসিক অবস্থা জসলিন কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। অ্যান্টনি হিউইশের নতুন রেডিও টেলিস্কোপ তৈরীর কাজে লেগে পড়লেন জসলিন। দু'বছর সময় লাগল টেলিস্কোপটা তৈরী করতে। টেলিস্কোপ বলতে আমাদের চোখের সামনে যেমন একটা নল বা চোঙার মত জিনিস ভেসে ওঠে, দু'দিকে কাঁচ লাগানো, সেরকম একেবারেই নয়। রেডিও টেলিস্কোপের মত ডিশও এখানে অনুপস্থিত। তার বদলে রয়েছে সাড়ে চার একর জমিতে বসানো প্রায় হাজারখানেক দেড় থেকে দু'মানুষ সমান উঁচু বাঁশের বা কাঠের পোস্ট, এই পোস্টের মাথায় গোটা দুই ডাইপোল বসানো, আর সবকিছু মোটা মোটা বৈদ্যুতিক তার দিয়ে জোড়া। সবমিলিয়ে প্রায় ১২০ মাইল বা ১৯০ কিলোমিটার তার লেগেছিল এই পুরো টেলিস্কোপটা তৈরী করতে। শুধু মাটিতে পোস্ট পুঁতে তার ওপর ডাইপোল বসিয়ে তার দিয়ে জুড়ে দিলেই হবে না, তার মধ্যে প্রচুর প্লাগ-সুইচ-ক্যাপাসিটার ইত্যাদি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিও বসাতে হবে, আর অতি অবশ্যই তারটার তলার ভিজে ঘাস বা কাদা মাটিতে ছুঁলে চলবে না।
পুরো টেলিস্কোপটার আয়তন তাহলে ঠিক কতটা দাঁড়াল? ১০০ মিটার বাই ৪০ মিটার (৩৩০ ফুট বাই ৪৪ ফুট) বড় একটা মাঠ কল্পনা কর। লম্বায় এটা একটা বড়সড় ফুটবল মাঠের সমান, চওড়ায় একটা মাঝারি সাইজের ফুটবল মাঠের সমান। তাতে প্রতি দু'মিটার বা ছ'ফুট অন্তর একটা করে কাঠের পোস্ট বসবে। কে বসাবে? কেন, হিউশের ল্যাবেরই ছাত্রছাত্রী ও টেকনিশিয়ানরা, আবার কে? হাতুড়ি পেটাবার দায়িত্ব অবিশ্যি জসলিনের ছিল না, যদিও সে কাজও তিনি যথেষ্ট করেছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল ওই তার-কেবল ইত্যাদি ব্যাপারটা সুষ্ঠুভাবে করা, যাতে টেলিস্কোপ একবার চালু হলে বেগড়বাঁই না করে। দু'বছর রামখাটুনির পর সম্পূর্ণ জুগাড়ে করা টেলিস্কোপবাবাজী জন্ম নেন, এবং জসলিন এবং হিউইশ গ্রপের সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে প্রথম চান্সেই দিব্যি চালু হয়।
টেলিস্কোপ চালু তো হল, আকাশের দিকে তাকে তাক করাও হল, ভূমিকম্প বা হার্টবীট যেরকম রুল টানা কাগজে আঁকা হয়ে যায় সেভাবে রেডিও টেলিস্কোপও গ্রাফ কাগজে মনের আনন্দে আঁকিবুকি কাটতে শুরু করল। এক চান্সেই টেলিবাবা চালু হয়েছেন, কেবল-টেবলে কোনও গোলমাল দেখা দেয়নি, এইসব ভেবে জসলিন প্রথম প্রথম খুব একটু নাচানাচি করছিলেন। ঘন্টা দু'য়েকের মধ্যেই বুঝলেন, এই রে, টেলিবাবা থেকে এত যে তথ্য বেরচ্ছে, সেটার বিশ্লেষণ তো তাকেই করতে হবে। এবং সেটা মোটেও মুখের কথা নয়। টেলিবাবা সারাক্ষণই চালু আছেন, আঁকিবুকি কাটা কাগজের স্তুপ জমা হচ্ছে টেবিলে। চওড়ায় খুব বড় না হলেও, সারাদিনে প্রায় ৯৬ ফুট কাগজ লাগত সম্পূর্ণ তথ্য রেকর্ড করার জন্য। মানে প্রায় ৩০ মিটার। সারাদিন নাকে চশমা এঁটে জসলিন ওই ৩০ মিটার কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন, কখনও কখনও কোয়েজারের সঙ্কেত পেতেন, কখনও কখনও আবার মানুষের তৈরী কৃত্রিম সঙ্কেতও পেতেন। আসলে রেডিও তো, এরকম অপ্রয়োজনীয় সঙ্কেত সবসময়ই থাকে। কোনটা কৃত্রিম আর কোনটা কোয়েজার বাছাই করার ভার ছিল একমাত্র জসলিনের।
এই কাজ করতে করতে একদিন জসলিন একটা অদ্ভুত সঙ্কেত দেখতে পেলেন। খুবই ছোট মেয়াদের সঙ্কেত, জসলিন পরে মেপে দেখেছেন শুরু থেকে শেষ অবধি সঙ্কেতটি মাত্র ১.৩৩ সেকেন্ড লম্বা। গ্রাফ কাগজে তার মোট দৈর্ঘ্য এক ইঞ্চির চার ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ মাত্র ৬ মিলিমিটার। ভাবা যায়? ৯৬ ফুট লম্বা দিস্তে দিস্তে কাগজ, তার মধ্যে এক কোণে লুকিয়ে আছে মাত্র ৬ মিলিমিটারের ছোট্ট একটা সঙ্কেত, তাও জসলিনের শ্যেন দৃষ্টি এড়ায় নি। ১.৩৩ সেকেন্ডের মধ্যেই সঙ্কেতটা একটা নির্দিষ্ট তালে বেশ কয়েকবার ওঠানামা করেছে, যেন কোন এক অদৃশ্য মহাজাগতিক ছন্দের তালে তাতাথৈথৈ ঝঙ্কার বাজছে। ধ্বনি থাকলে হয়তো একটা স্পষ্ট বিপ-বিপ-বিপ আওয়াজ শোনা যেত, যেন খাটের পাশে ভোরবেলা ডিজিটাল অ্যালার্মঘড়ি বাজছে। বা হয়তো সমরেশ মজুমদারের অর্জুন সিরিজের কার্ভালোর বাক্স গল্পে ভিনগ্রহী প্রাণীটি যে ভাবে তার হারানো যন্ত্রকে কাছে ডাকার চেষ্টা করত, সেরকম একটা সিগনাল।
জসলিন, ও পরে অ্যান্টনি হিউইশেরও প্রথম-প্রথম তাই-ই মনে হয়েছিল বটে। হিউইশকে ব্যাপারটা দেখাতে প্রথমে উনি পাত্তাই দেননি, বলেন হয় টেলিস্কোপ গোলমাল করছে, নয় এটা মানুষের তৈরী কোন কৃত্রিম সঙ্কেত। পরে জসলিন আরও সাবধানে পরীক্ষানিরীক্ষা করেও যখন একই সঙ্কেত খুঁজে পান, তখন জসলিন শুধু নয়, হিউইশেরও মনে হয়, হুম, এত নিয়মিত তালে সঙ্কেত আসছেও আবার মহাকাশ থেকেই, তাহলে কী...?
সঙ্কেতটির কোডনেম দেওয়া হয় এলজিএম-১ (LGM-1)। অর্থাৎ লিটল গ্রীন মেনদের (little green men) পাঠানো প্রথম সঙ্কেত। মঙ্গলগ্রহে নাকি বেঁটে সবুজরঙের মানুষ থাকে, তারাই নির্ঘাত এই অদ্ভুত বিপ-বিপ-বিপ সঙ্কেত পাঠিয়েছে, এই ভেবেই মজা করে এলজিএম নামটা রাখা। মঙ্গলে যে দু'পেয়ে বা কোন উচ্চতর জীব থাকা অসম্ভব, মোটামুটি বৈজ্ঞানিক মহল কিন্তু ততদিনে জেনে গেছে।
তাও, হতেও তো পারে এলজিএম-১ সত্যি সত্যিই সৌরজগতের বাইরে থেকে আসা কোনও সভ্যতার পাঠানো সঙ্কেত। জসলিন লেগে পড়লেন এর পক্ষে বা বিপক্ষে তথ্যপ্রমাণ জোগাড়ের কাজে। ফল এলও কিছুদিন বাদে, ঠিক একইরকম সঙ্কেত রেকর্ড হল টেলিবাবার গ্রাফ কাগজে, কিন্তু এবার তার উৎস আকাশের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রান্ত। তার মানে হয় দু'টো সম্পূর্ণ আলাদা সভ্যতা ঠিক একই সময়ে একদম একই সঙ্কেত পাঠিয়ে পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছেন, নতুবা এটা কোনও স্বাভাবিক মহাজাগতিক ঘটনা।
অকাম্স রেজার (Occam's Razor) নামে একটা তত্ত্ব আছে। একই প্রশ্নের যদি বিভিন্ন উত্তর বা সমাধান পেশ করা হয়, তাহলে বেশিরভাগ সময় সবচেয়ে সহজবোধ্যটাই সত্যি হয়ে থাকে। অতএব ইটি-এলিয়েন সভ্যতার হাইপথিসিস বাই-বাই হয়ে গেল। বদলে এল সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক বস্তু। খুব সাবধানে যত্ন করে হিসাব-গণনা ইত্যাদি করে বোঝা গেল যে, কোয়েজার যেমন আমাদের গ্যালাক্সির বাইরেকার বস্তু, এই নতুন সঙ্কেতের উৎস কিন্তু আমাদের এই মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যেই অবস্থিত। শুধু তাই নয়, এই সঙ্কেতের ধারাবাহিকতা দেখলে চোখ কপালে ওঠে। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ঘড়িকে হার মানায় এই সঙ্কেতের সময়ানুবর্তিতা।
কেমব্রিজে প্রথমবার হিউইশ এই আবিষ্কার নিয়ে সেমিনার দেবেন, লেকচার হলঘর কানায় কানায় ভর্তি, জসলিনের হিসাবে বৃটেনের প্রায় সমস্ত উল্লেখযোগ্য জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ এসেছেন এই অদ্ভুত সঙ্কেতের কথা শুনতে। দর্শকাসনে রয়েছেন খোদ প্রফেসর ফ্রেড হয়েল (Fred Hoyle), বিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বৃটেনের শ্রেষ্ঠ অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট। হিউইশের লেকচার শোনার পর হয়েল বললেন যে তাঁর মতে এই সঙ্কেত আসছে সুপারনোভা বিস্ফোরণের পরে তারার অবশিষ্ট অংশ থেকে। এরকম একধরনের সুপারনোভা রেমন্যান্ট বা অতিনবতারার অবশেষ থেকে যে এই সঙ্কেত আসতে পারে সেটা হিউইশ গ্রুপের মাথায় আসেনি তা নয়, কিন্তু জসলিন অবাক হয়ে গিছলেন কীভাবে হয়েল ওই অতটুকু সময়ের মধ্যে কাগজকলম ছাড়াই মাথায়-মাথায় বেশ গোলমেলে কিছু ক্যালকুলেশন করে ঠিক উত্তরটা বলে দিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, ফ্রেড হয়েল ভুল করার মত লোক নন। সঙ্কেতটা আসছিল সুপারনোভার অবশিষ্ট অংশ থেকেই। ভর ও আয়তনের দিক থেকে দেখলে তারাদের মধ্যে সূর্যের স্থান মোটামুটি মাঝের দিকেই। সূর্যের চেয়ে অনেক বেশি ভরবিশিষ্ট তারাদের জীবন অনেক তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, শেষমুহুর্তে প্রকান্ড এক বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে তারার বেশিরভাগ উপাদানই চারদিকে ছিটকে চলে যায়, পড়ে থাকে হয় নিউট্রন তারা বা কৃষ্ণগহ্বর। বেশিরভাগ নিউট্রন তারা আয়তনে কলকাতার হাফ সাইজের হয়, অর্থাৎ ব্যাস ওই ১৫ কিলোমিটারের মত। এর ঘনত্ব কিন্তু সাংঘাতিক। এক চামচ নিউট্রন তারার ভর প্রায় দেড় কোটি টন!
চ্যাম্পিয়ন ঘনত্ব ছাড়াও কিছু কিছু নিউট্রন তারার আরেকটি গুণ আছে। এরা প্রচন্ড গতিতে নিজের চারদিকে বনবন করে ঘুরতে ভালবাসে, আর এই ঘূর্ণির চক্করে এদের মধ্যে উচ্চশক্তির চৌম্বক ফীল্ডের সৃষ্টি হয়। শাদা কাগজের ওপর লোহার গুঁড়ো ফেলে তার ওপর একটা চুম্বক বসালে যে প্যাটার্ন দেখা যায়, সেইটি সেই চুম্বকের চৌম্বক ফীল্ড। তারার সঙ্গে ফীল্ডও সাঁইসাঁই গতিতে ঘুরতে থাকে, ঘুরতে ঘুরতে নিজের চারদিকে নিজেই পেঁচিয়ে যায়, ফীল্ড লাইনগুলো তারার দু'মেরুর চারদিকে ভীষণভাগে ঘনীভূত হতে থাকে। এমতাবস্থায় সিনক্রোট্রন রেডিয়েশন বলে একধরনের বিকিরণের সৃষ্টি হয়, চৌম্বক ফীল্ডের দেখানো পথ বেয়ে নিউট্রন তারার দুই মেরু দিয়ে সরু টিউবের মত সেই বিকিরণ মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এরকম নিউট্রন তারা যদি পৃথিবীর সঙ্গে বিশেষ একটা কোণ বরাবর থাকে, তাহলে পৃথিবীতে রাখা রেডিও টেলিস্কোপ কী দেখবে?
বিপ-বিপ-বিপ
এরা পালসার (Pulsar)। কোয়েজারের মত পালস (pulse) শব্দের সঙ্গে তারার, মানে star কথার -ar যোগ করে পালসার। এরা কসমিক টাইমকীপার, মহাজাগতিক ঘড়ি। সময়ানুবর্তিতায় চ্যাম্পিয়ন এরা। আটষট্টি সালে পালসার আবিষ্কারের পর পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে, পালসার নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে, হাজার হাজার পেপার লেখা হয়েছে, অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বিজ্ঞানটাই পাল্টে গেছে জসলিন বেলের এই অদ্ভুত আবিষ্কারে।
ক্র্যাব নেবুলা বা কর্কট নীহারিকা। ছবি তুলেছে চন্দ্র মহাকাশ দূরবীন। লালগুলো দূশ্যমান আলোয়, নীলগুলো এক্সরেতে। একদম মধ্যিখানের ওই উজ্জ্বল গোলকটা ক্র্যাব পালসার।
অ্যাঁ? কী বললেন? কার আবিষ্কারে? জসলিন বেল? সে আবার কে রে বাবা? ১৯৭৪ সালে পালসার আবিষ্কারের জন্য নোবেল পেলেন তো অ্যান্টনি হিউইশ, আর তাঁর সঙ্গে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে মৌলিক অবদানের জন্য নোবেল পেলেন ডিপার্টমেন্ট হেড প্রফেসর স্যার মার্টিন রাইল। যোগ্য লোকই নোবেল পেয়েছে, সন্দেহ নেই। মার্টিন রাইলের পদ্ধতি ব্যবহার করেই হিউইশ গ্রুপ পালসার আবিষ্কার করেছেন, আর হিউইশ গ্রুপের প্রধান তো হিউইশই, বাকিরা তো...বাকি, একস্ট্রা। নোবেল-টোবেল ওই প্রধানরাই পেয়ে থাকে। বিশেষ করে যদি সেই প্রধান পুরুষ হন।
বাঁদিকে স্যার মার্টিন রাইল; ডানদিকে অ্যান্টনি হিউইশ
জসলিন বেলকে পরে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি হেসে বলেন, আরে বাবা, বিজ্ঞান তখন কীভাবে হত সেইটে তো বুঝতে হবে। একজন প্রধান বৈজ্ঞানিক থাকতেন, আর তাঁর অধীনে বহু লোকে কাজ করেন, অনেকটা দাবার বোড়ের মত। জসলিন নিজেকে ওই দাবার বোড়ের সঙ্গেই তুলনা করেছেন। বলেছেন, আরে বাবা, চুয়াত্তর সালে নোবেল কমিটি হয়ত আমার নামই শোনেনি, প্রাইজ দেওয়া তো পরের কথা।
>> কিন্তু, প্রফেসর বেল, ব্যাপারটা কি অন্যায় হয়নি?
>> হয়েছে বৈকি, কিন্তু তাতে আমার বিশেষ ক্ষোভ নেই। দেখো ভাই, ষাটের দশকের মাঝামাঝি ও শেষের দিকে মহিলা হয়েও যে শান্তিতে পিএইচডিটুকু করতে পেরেছি তাই অনেক। পালসার আবিষ্কারের পর খবরের কাগজ রেডিও এমনকি টেলিভিশনের রিপোরর্টার এসে ছেঁকে ধরেছিল। খালি বলে, এই টেলিস্কোপটার সামনে এভাবে দাঁড়াও, এই গ্রাফ পেপারটা ধরে এইভাবে দেখো, হাঁটু গেড়ে বসো, মাটিতে বসে দেখো। আমি বলি, ওরে আমায় তোরা ছেড়ে দে রে বাবা, আমি পালসারের লোক নই, আমার কাজ কোয়েজার নিয়ে, থিসীসটা লিখতে দে নয়তো ডিগ্রীটা দেবে না রেএএএএ...
কে কার কথা শোনে। মজার ব্যাপার হল, এত মিডিয়া কভারেজ হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু সুইডেনের নোবেল কমিটি ডঃ এস. জসলিন বেলকে স্টকহোমে আমন্ত্রণ জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। হাজার হোক, মেয়ে বলে কতা।
>> কিন্তু ওই সঙ্কেতটা যদি আপনার চোখে না পড়ত, যদি ফের সেই সঙ্কেত পাওয়ার ব্যাপারে এতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ না হতেন, সঙ্কেতটি যে সাধারণ নয় সেটা যদি আপনি না দেখিয়ে দিতেন...
>> দেখো ভাই, আমি তখন ডক্টরেট করছি, গ্র্যাড স্টুডেন্টের পক্ষে নোবেল পাওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি বলে তোমার মনে হয় না?
নোবেল পাননি বলে জসলিনের মনে সত্যিই তেমন ক্ষোভ নেই। কেন যে পাননি সেটা তিনি বিলক্ষণ জানেন, তাই বলেন, আমি এখন এক এক্সক্ল্যুসিভ ক্লাবের মেম্বার। ডিএনএ-র গঠন যে একটা বিনুনির মত ডবল হেলিক্স, সেটা তো প্রথম আবিষ্কার করেন রোজালিন্দ ফ্র্যাঙ্কলিনই। অথচ নোবেল পান ফ্রান্সিস ক্রিক ও জেম্স ওয়াটসন। নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়াটা যে কী, সেটা প্রথম বিশ্লেষণ করে বোঝান অটো হান, লিজে মাইটনার, ও অটো ফ্রিশ। অথচ ১৯৪৪ সালের রসায়নে নোবেল প্রাইজটা শুধুমাত্র অটো হানের নামেই হয়। চল্লিশের দশকের হলিউডের অভিনেত্রী হেডি লামার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পিয়ানোবাদক জর্জ অ্যানথেইলের সঙ্গে ফ্রিকোয়েন্সী হপিং বলে একধরনের প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন, যা ব্যবহার করে জার্মান ও জাপানী সিগনাল জ্যামারে মিত্রশক্তির নৌবাহিনীর বেতারবার্তা আটকে যাওয়া বন্ধ হয়। পরে এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ব্লুটুথ (Bluetooth) ও ওয়াই-ফাই (WiFi) প্রযুক্তির আবিষ্কার সম্ভব হয়। কই, লামারের নাম শোনা যায় তেমন? বা ভেরা রুবিন। ডার্ক ম্যাটার বলে যে অদ্ভুত বস্তু নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহল এখন উৎসাহের চরমে, তার আবিষ্কর্তা রুবিনই। এঁরা কেউই নোবেল পাননি বটে, কিন্তু বিংশ শতকের বিজ্ঞানের এঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
বিজ্ঞানের জগতের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার পাননি বটে, অন্যভাবে জসলিন কিন্তু সম্মানিত হয়েছেন। বৃটেনের রয়্যাল অ্যাস্ট্রনমিকাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট পদে ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সাল ছিলেন বেল বারনেল, পরে ২০০৮-১০ সালে ইনস্টিট্যুট অফ ফিজিক্সের প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত হন। এ ছাড়াও সারাজীবন প্রচুর পুরষ্কার পেয়েছেন, ২০০৭ সালে বৃটেনের ডেম কম্যান্ডার অফ দি অর্ডার অফ দ্য বৃটিশ এম্পায়ার (DBE) সম্মাণে ভূষিত হন। অর্থাৎ নাইটহুডও পেয়েছেন ডেম সুজ্যন জসলিন বেল বার্নেল, Dame Susan Jocelyn Bell Burnell।
পালসার আবিষ্কার হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে এই বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে ডেম জসলিন আরেকটি পুরষ্কার পেলেন। স্পেশ্যাল ব্রেকথ্রু প্রাইজ ইন ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স (Special Breakthrough Prize in Fundamental Physics) নামে এই প্রাইজের মোট আর্থিক মূল্য ৩০ লাখ ডলার। তুলনামূলকভাবে নোবেল প্রাইজের আর্থিক মূল্য ১০ লাখ ডলারের মত, সেটাও পুরষ্কার প্রাপকদের মধ্যে ভাগ করা হয়ে থাকে। সেদিক থেকে পঁচিশ বছর বয়সে করা যুগান্তকারী আবিষ্কারের পুরষ্কার হিসাবে পঁচাত্তর বছর বয়সে পাওয়া এই অগাধ ধন নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও জসলিনের জীবনের অন্যায্য ঘটনাগুলিকে খানিকটা হলেও...
না। জসলিন তেমন লোকই নন। পুরষ্কার ও সম্মান উনি মাথা পেতে নেবেন, কিন্তু টাকাটা দিয়ে উনি একটা বিশেষ বৃত্তির গঠন করছেন। বৃত্তির তহবিলে কারা উপকৃত হবেন? বিজ্ঞান গবেষণাকে পেশা হিসাবে বেছে নিতে চান এমন মহিলারা, জাতিগত সংখ্যালঘুরা, এবং উদ্বাস্তু শরণার্থীরা।
নো-বেল (No-Bell) প্রাইজ পাননি, তাতে এই মহীয়সী প্রতিভার কিছু এসে যায় নি। জসলিনের হাত থেকে তো আর নোবেলটা ফস্কে যায় নি, নোবেলেরই হাত থেকে বরং জসলিন বেল ফস্কে গেছেন।
ছবিঃ