নমস্কার বন্ধুরা। আমি গেছোদিদি। আমার ভাইকে হয়ত তোমরা চেনো, সে যেখানে খুশি যেতে পারে। আর আমি? আমি যখন খুশি যেতে পারি। গতবার আমরা কেটি বাউম্যানের কৃষ্ণগহ্বরের ছবি আর রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনের ডিএনএ অণুর ছবি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। জেনেছিলাম কীভাবে ছবিদুটো তোলা মোটেও সহজ ছিল না, প্রচুর মেহনত ও গণনা করেই ফল মিলেছিল। বাউম্যানের ক্ষেত্রে গণনার কাজটা কম্পিউটারের সাহায্যে করা হয়েছিল, আর ফ্র্যাঙ্কলিনের ক্ষেত্রে হাতেকলমে, কেননা ফ্র্যাঙ্কলিনের সময়ে, অর্থাৎ বিংশ শতকের পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে কম্পিউটারের ব্যবহার অতটা নিয়মিত বা সহজ হয়নি। কম্পিউটার বলতে অবশ্য এখানে যান্ত্রিক গণকের কথাই বলছি। শব্দটির আরেকটি অর্থ আছে, যেটা আমরা পরের কিস্তিতে শিখব। এখন বরং যাওয়া যাক ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে, মার্কিন মুলুকের নাসায়। আজ ২০শে জুলাই, একটি বিশেষ মহাকাশযান ও তার মধ্যে যে তিনটি মানুষ আছে তাদের দিকে সবার চোখ।
(বাঁদিকে) এডউইন অল্ড্রিনের ক্যামেরায় তোলা নীল আর্মস্ট্রঙের ছবি; (ডানদিকে) আর্মস্ট্রঙের ক্যামেরায় তোলা অল্ড্রিনের ছবি, অল্ড্রিনের হেলমেটে আর্মস্ট্রং আর ঈগলের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। দু’টো ছবিই চাঁদের বুকে তোলা, ২০ জুলাই ১৯৬৯
“One small step for a man. One giant step for Mankind.”
চাঁদের বুকে পা দিয়ে নীল আর্মস্ট্রঙের এই বিখ্যাত উক্তি আমাদের প্রায় কারুরই অজানা নয়। ১৯৬১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি গোটা বিশ্বের সামনে পণ রেখেছিলেন যে ষাটের দশক শেষ হওয়ার আগেই মার্কিনরা চাঁদের বুকে পা রাখবে। অ্যাপলো ১১ মহাকাশযান থেকে লুনার মডিউলে চেপে আর্মস্ট্রং আর এডউইন “বাজ” অল্ড্রিন চাঁদে নামায় কেনেডির শপথ সত্যি হয়। অবশ্য নাও হতে পারত।
১৬ জুলাই ১৯৬৯। মার্কিন মুলুকের ফ্লোরিডায় কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্যাটার্ন ফাইভ (Saturn V) রকেটে চেপে অ্যাপলো ১১ মহাকাশযান চাঁদের দিকে পাড়ি দেয়। মহাকাশযানে যাত্রীসংখ্যা ৩ — আর্মস্ট্রং, অল্ড্রিন, আর মাইকেল কলিন্স। অ্যাপলো ১১ দু’ভাগে বিভক্ত — একটা কমান্ড মডিউল, নাম কোলাম্বিয়া (Columbia), আর একটা লুনার মডিউল, নাম ঈগল (Eagle)। তিনদিন বাদে, ১৯শে জুলাই নাগাদ অ্যাপলো ১১ চাঁদের চারপাশে কক্ষপথে ঢোকে। আর্মস্ট্রং ও অল্ড্রিন লুনার মডিউলে ঢোকেন, কলিন্স কমান্ড মডিউলে থেকে যান। ২০শে জুলাই ঈগল কোলাম্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চাঁদের মাটির দিকে এগোতে থাকে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, অল্ড্রিন আর্মস্ট্রং কলিন্স তিনজনেই ব্যস্ত এবং উত্তেজিত, পৃথিবীতে নাসার হিউস্টন সেন্টারে সবাই উদ্গ্রীব হয়ে বসে আছেন, সমস্ত বিশ্ব রেডিও টিভি ইত্যাদিতে কান বা চোখ রাখছে। সবকিছু প্ল্যানমাফিক ঠিকঠাক চলছে, হঠাৎ…অ্যালার্ম বেজে উঠল লুনার মডিউলে। যান্ত্রিক গোলোযোগ! কোথাও একটা গন্ডগোল হয়েছে, ঈগল চাঁদের বুকে নামবে কি নামবে না সেই সিদ্ধান্ত এক্ষুণি নিতে হবে। যাকে বলে বেশ হাইভোল্টেজ ব্যাপার।
(বাঁদিকে) স্যাটার্ন ফাইভ রকেটে চেপে অ্যাপলো ১১ চলেছে চাঁদের দিকে; (ডানদিকে) অ্যাপলো ১১-র মহাকাশচারীরা, (বাঁদিক থেকে) নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স, এডউইন 'বাজ' অল্ড্রিন
চাঁদে যাওয়া ব্যাপারটা ঠিক ওই পাশের পাড়ার মনোহরের পান্তুয়ার দোকান থেকে ল্যাংচা আনা যে নয়, সেটা তোমরা নিশ্চয়ই বুঝেছ। প্রথমে পৃথিবীর বুক থেকে মহাকাশে যেতে হবে। বেলুন-প্লেনে চেপে আকাশের অনেকটা ওপরে যাওয়াই যায়, কিন্তু মহাকাশে যাওয়া যায় না। বিশেষ করে যদি তাতে মানুষ থাকে, আর সেই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এর জন্য চাই শক্তিশালী রকেট। অবশ্য শুধু হাউই বা মিসাইলের মত রকেট হলেই হবে না, সবকিছু দেখেশুনে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নইলে মহাকাশচারীদের নামের সামনে চন্দ্রবিন্দু বসবে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়তে পারলেই কেল্লা ফতে তাও নয়, ঠিকঠাক পথ বরাবর গিয়ে চাঁদের মাটিতে খুব আলতো করে নামতে হবে। ঠিকঠাক পথও আবার পৃথিবীর আর চাঁদের মধ্যে সরলরেখা নয়, প্রথমে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে হবে কয়েকপাক, তারপর ঠিক সময়ে ইঞ্জিন চালিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে চাঁদের দিকে যেতে হবে, কিন্তু চাঁদের বুকে সোজাসুজি আছড়ে পড়লে ফের সেই আঁর্মস্ট্রং ইত্যাদি হয়ে যাবে, অতএব চাঁদের চারপাশে কক্ষপথে আলতো করে ঢুকতে হবে, চাঁদের আলতো করে নামতে হবে, ফের উঠে আসতে হবে কমান্ড মডিউলে, ফের পৃথিবীর দিকে ফিরে আসতে হবে ইত্যাদি। এইসব করতে নিউটন এবং আইনষ্টাইনের মাধ্যাকর্ষণ থিওরি ভাল করে বুঝতে হবে, এবং সেকেন্ডে সেকেন্ডে প্রচুর জটিল গণনা করে ফেলতে হবে। এ ছাড়াও অ্যাপলো ১১-র মধ্যে লাইফ সাপোর্ট অর্থাৎ অক্সিজেন জল খাবারদাবার তাপমাত্রা ইত্যাদি ঠিক রাখতে হবে। মহাকাশে অক্সিজেন বলে কিছু নেই, মহাকাশের তাপমাত্রাও খুব খুব কম, অতএব এইসব ঠিক না থাকলে…ঠিক ধরেছ, চন্দ্রবিন্দু।
এতকিছু মানুষের পক্ষে গণনা বা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। অতএব কম্পিউটার লাগবেই লাগবে। কিন্তু শুধু কম্পিউটার দিয়ে তো হবে না। কম্পিউটার যন্ত্র, তাকে ঠিকঠাক নির্দেশ দিলেই তবে সে ঠিকঠাক কাজ করবে। এই নির্দেশ দেওয়াকে বলে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, আর যারা এই কাজ করে তাদের বলা হয় প্রোগ্রামার। কম্পিউটারের দু’টি অংশ থাকে, এরা একে অপরের পরিপূরক। এক, হার্ডওয়্যার, যেমন ধর বাড়ির কম্পিউটের সিপিউ, কীবোর্ড, মাউস, মনিটর, প্রসেসর, র্যাম ইত্যাদি। দুই, সফটওয়্যার, যা আসলে কম্পিউটার চলার নির্দেশাবলি, প্রোগ্রামের সমষ্টি। সফটওয়্যার ঠিকঠাক না কাজ করলে কম্পিউটারও ঠিকঠাক কাজ করবে না, ফেল করবে। বাড়ির কম্পিউটার ফেল করলে তেমন কিছু হবে না বটে, কিন্তু অ্যাপলো ১১-র কম্পিউটার ফেল করলে তিনজন মানুষের প্রাণ যাবে। অতএব সফটওয়্যার ফেল করলে চলবে না। কোনভাবেই নয়।
(বাঁদিকে) অ্যাপলো ১১-র কমান্ড মডিউল 'কোলাম্বিয়া', ছবি তোলা ঈগলের ভেতর থেকে; (ডানদিকে) লুনার মডিউল 'ঈগল', ছবি তোলা হয়েছে কোলাম্বিয়ার ভেতর থেকে।
এই ২০২২ সালের পৃথিবীতে বসে আমরা নিজেদের স্মার্টফোনে একই সঙ্গে ফোন মেসেজ ভিডিও কল গেমিং ইত্যাদি করতে পারি। একইসঙ্গে। বছর দশেক আগেও এটা সম্ভব হত না, এখন হয়েছে কেননা ফোনের হার্ডওয়্যার উন্নতি করেছে, আর একইসঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নতি হয়েছে সফটওয়্যারও। আধুনিক মানুষের পক্ষে পঞ্চাশ বছর আগেকার অ্যাপলোর কম্পিউটারের সামর্থ্য কল্পনা করা খুবই মুশকিল। ষাটের দশকের বেশিরভাগ কম্পিউটারের একসঙ্গে একটার বেশি কাজ করার ক্ষমতা ছিল না বললেই চলে। ধর তোমায় বলা হল, বাজারে গিয়ে নুন, ডিম, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, তেল ইত্যাদি কিনে এনে ডিমের অমলেট বানিয়ে খেতে। তুমি একা মানুষ, তুমি বাজারে যাবে, পরপর বিভিন্ন দোকানে যাবে, প্রয়োজনীয় রসদ কিনে বাড়ি ফিরে সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে (কোভিড তো ২০২২ সালেও সম্পূর্ণ বিদায় নেয়নি) রান্নাঘরে ঢুকবে। ডিম ভেঙে ফেটাবে, পেঁয়াজ লঙ্কা কুচোবে, সব একসঙ্গে মিশিয়ে নুন দেবে, সসপ্যান গরম করে তেল দেবে, তেল গরম হলে ডিমের মিশ্রণ ঢালবে ইত্যাদি। তুমি একা মানুষ, তাই এই প্রত্যেকটা স্টেপ তোমায় এক এক করে একটা বিশেষ ক্রমে করতে হবে। সবকিছু হয়েটয়ে গেলে তবেই না অমলেট খেতে পারবে। ডিম না ভেঙেই তেলে দিয়ে দিলে সব চৌপাট, বা অমলেট বানানো হয়ে গেলে তারপর বাজার গিয়ে নুনের সন্ধান করলে অমলেটটাই ঠান্ডা হয়ে যাবে। অতএব ক্রমানুসারে সব কাজ করতে হবে। ষাটের দশকের কম্পিউটার অনেকটা এইভাবে কাজ করত।
এবার ধর তোমার ইচ্ছে হল অমলেট খাবার, কিন্তু একইসঙ্গে তোমায় অঙ্কের হোমওয়ার্ক করেও জমা দিতে হবে। দু’টো কাজ যে পরপর করবে তার উপায় বা সময় নেই, কিন্তু একটু অমলেট না হলে ঠিক চলছে না। কী করবে তখন? চল মার্গারেট হ্যামিল্টনকে জিজ্ঞেস করা যাক।
কমান্ড মডিউলের মধ্যে বসে অ্যাপলো ১১ প্রজেক্টের প্রধান সফটওয়্যার ডিজাইনার মার্গারেট হ্যামিল্টন
— নমস্কার মার্গারেট। আমি গেছোদিদি।
— হ্যালো গেছোদিদি। একটু ব্যস্ত আছি, অ্যাপলোর কমান্ড মডিউলে কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট…
— কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে আমার কয়েকটা প্রশ্ন ছিল।
— আরে বলবেন তো। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে আলোচনা করতে আমি সদা প্রস্তুত।
— ওই যে, অমলেট আর হোমওয়ার্ক…
— ও হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা কেক আর হোমওয়ার্ক বলি। একই ব্যাপার। অমলেট দিয়েই হোক। কয়েকজন বন্ধু লাগবে।
— বন্ধু?
— হ্যাঁ, পাড়ার বন্ধু হলেই চলবে। আরে বাবা পাড়ায় তো সকলেই বেরোয়, বন্ধু জোগাড় করাটা কী এমন শক্ত কাজ?
— না মানে ২০২০ সালে কোভিড হয়ে…যাক গে, বন্ধুর ব্যাপারে কী বলছিলেন?
— কোভিড? সেটা কী? আর ২০২০ মানে?
— কিছু না কিছু না, মজা করছিলাম। বন্ধু?
— হ্যাঁ। কয়েকজন বন্ধু লাগবে। কয়েকজন বাজারে যাবে, তারা নুন ডিম ইত্যাদি রসদ একই সময়ে কিনবে, তাতে সময় বাঁচবে। তারা ফিরে এলে একজন প্যানে তেল দিয়ে সেটা গরম করবে, একজন পেঁয়াজ কাটবে, একজন লঙ্কা, একজন ডিম ফেটাবে। সবার হয়ে গেলে মিশ্রণটা প্যানে দিলেই হল।
— কিন্তু হোমওয়ার্ক?
— হোমওয়ার্ক আপনি করছেন বসে বসে। অমলেট যতক্ষণ না হচ্ছে আপনার অর্ধেক হোমওয়ার্ক শেষ, বাকিটা গরমাগরম অমলেট খেতে খেতে করলেই হল। আর সুবিধা হল, ক্রমানুসারে কাজগুলো করার কোন দরকার নেই। একই সঙ্গে সব কাজ করা যায়। পেঁয়াজ কাটার আগেই তেল গরম হয়ে গেছে? অসুবিধে নেই। তেল গরম রাখবে তেলবন্ধু, ততক্ষণে পেঁয়াজবন্ধু ডিমফেটানোবন্ধু এদের সবার কাজ হয়ে যাবে। এই পুরো ব্যাপারটাকে অ্যাসিঙ্ক্রোনাস প্রোগ্রামিং (asynchronous programming) বলা হয়ে থাকে। অবশ্য শুধু এটা হলে চলবে না, প্রায়রিটি শেডিউলিং (priority scheduling) আর এন্ড-টু-এন্ড টেস্টিং (end-to-end testing) করতে হবে।
— ওরে বাবা, সেসব কী?
— ধরুন আপনি পাড়ায় খুব একটা জনপ্রিয় নন, আপনার মাত্র তিনজন বন্ধু আছে। আপনি হোমওয়ার্ক করছেন, সেটা আপনি ছাড়া কেউ করলে হবে না। আপনার বন্ধুরা বাজারে গিয়ে একজন ডিম কিনল, একজন নুন আর তেল, আর একজন পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা। তারপর বাড়ি ফিরে একজন ডিম ফেটাল, একজন পেঁয়াজ কাটল, একজন লঙ্কা। ডিম ফেটাতে সময় সবচেয়ে কম লাগে, তাই ডিমফেটানবন্ধু প্যানে তেল দিয়ে গরম করল, ততক্ষণে পেঁয়াজ-লঙ্কা রেডি, এবার অমলেট করলেই হল। সময়ও বাঁচল, মাত্র তিন বন্ধুকে দিয়ে কাজটাও হয়ে গেল। এইযে কোন কাজটা কোনটার আগে করতে হবে, এই ব্যাপারটাকে বলে প্রায়রিটি শেডিউলিং।
— বুঝলাম। আর এন্ড-টু-এন্ড টেস্টিং?
— এই যে আপনি একা, বা বন্ধুরা থাকলে বন্ধুরা মিলে অমলেট বানালেন, সেটা খাওয়ার যোগ্য হল কিনা সেটা তো আগে টেস্ট (test) করে দেখতে হবে, তাই নয় কী?
— তা ঠিক, যদিও এই ক্ষেত্রে বোধহয় টেস্ট (taste) করলেই হবে।
মার্গারেট হেসে ফেললেন। বললেন, “হ্যাঁ, তা অবশ্যই হবে। তবে আপনার অমলেট বন্ধুরা খেয়ে নিলে আপনি কী খাবেন? আপনি তো এখানে ক্লায়েন্ট বা ইউজার, আর বন্ধুরা আপনার কম্পিউটার সিস্টেম। অতএব আপনার অমলেট খাওয়ার ইচ্ছে হবার আগেই আপনার বন্ধুদের কাজ হবে আগাপাশতলা পরীক্ষা করে দেখা, সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা। নুন ঠিক পড়েছে কিনা, ডিম পচা কিনা, পেঁয়াজলঙ্কায় পোকা আছে কিনা, তেল ঠিকমত গরম হয়েছে কিনা। এতসব আগেভাগে করে রাখলে যখনই আপনার অমলেট খাওয়ার ইচ্ছে হবে, আপনার সামনে কম-সে-কম সময়ের মধ্যে অমলেট হাজির হবে।”
অ্যাসিঙ্ক্রোনাস প্রোগ্রামিং (asynchronous programming), প্রায়রিটি শেডিউলিং (priority scheduling) আর এন্ড-টু-এন্ড টেস্টিং (end-to-end testing) — নির্ভরযোগ্য সফটওয়্যার ডিজাইনের চারটি স্তম্ভের তিনটি। কম্পিউটার ঠিকঠাক তার কাজ করছে কিনা সেটা এই তিন স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তিনটিই মার্গারেটের মস্তিষ্কপ্রসূত। “সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং” কথাটাই তো মার্গারেট হ্যামিল্টনই প্রথম ব্যবহার করেন। এই তিন স্তম্ভ আর্মস্ট্রং, অল্ড্রিন, এবং কলিন্সকে চাঁদে নিয়ে যেতে সাহায্য করে, আর প্রথম দু’জনকে চাঁদের মাটির নামতে এবং ফের বেঁচে বহাল তবিয়তে ফিরতে সাহায্য করে। অবশ্য চতুর্থ স্তম্ভটা না থাকলে “one small step…” ব্যাপারটা ঘটতই না। এর নাম ম্যান-ইন-দ্য-লুপ ডিসিশান কেপেবিলিটি (man-in-the-loop decision capability), যেটা অ্যাপলো প্রোগ্রামে প্রায়রিটি ডিস্প্লে (priority display) হিসাবে ব্যবহার হয়েছিল।
ফিরে যাওয়া যাক…না, এগিয়ে যাওয়া যাক ২০শে জুলাই ১৯৬৯ সালে। আর্মস্ট্রং ও অল্ড্রিন লুনার মডিউলে, চাঁদের মাটিতে ল্যান্ড করতে আর মিনিট তিনেক। সব ঠিকঠাকই চলছে, অন্তত সবাই ভাবছেন সব ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু একটা সামান্য ভুল হয়েছে বটে। ঈগলের একটা রেডার (radar) বন্ধ থাকা উচিত ছিল, সেটা চালু ছিল। দোষটা কার সেটা নিয়ে তর্কবিতর্ক পরে হয়েছে, কিন্তু সেটা জরুরি নয়। ঈগলের সমস্ত সিস্টেমই যেহেতু কম্পিউটারচালিত, আর ষাটের দশকে কম্পিউটারের সামর্থ্যও অতটাও নয় (বন্ধুসংখ্যা কম), তাই কম্পিউটার সব কাজ একসঙ্গে করতে পারে না, তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনটা আগে করতে হবে, কোনটা পরে। প্রায়রিটি শেডিউলিং আর কী। কিন্তু মুশকিল হল, তিন মিনিটের মধ্যে চাঁদের মাটিতে ঈগল নামবে, তখন হঠাৎ করে কম্পিউটার যদি বলে “ইয়ে মানে স্যার রেডারটা চালু আছে আমি বাকি সব কাজ থামিয়ে ওটাকে আগে বন্ধ করব” তাহলে সব গুবলেট। ধর অমলেট বানাতে গিয়ে হঠাৎ বাড়ি বেল বাজল, দরজা খুলে দেখলে পাশের পাড়ার পাঁচুগোপাল সরস্বতীপুজোর চাঁদা নিতে এসেছে। চাঁদা হয়ত তোমার দেওয়ার ইচ্ছে আছে, কিন্তু এক্ষুণি এক্ষুণি দিতে গেলে অমলেট লেট ওরফে গত হবে। এইখানে তোমার বন্ধুরা তোমায় জিজ্ঞেস করবে, অমলেট না চাঁদা? এতক্ষণ সবকিছু বন্ধুরা নিয়ন্ত্রণ করছিল, এখন তোমার হাতে ফের নিয়ন্ত্রণ, তোমায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চাঁদা দিতে গেলে টাকা বের করতে হবে, রসিদ নিতে হবে, পাঁচুগোপালের সঙ্গে গত শনিবারের ক্রিকেট আর গত রোব্বারের ফুটবল ম্যাচের ফলাফল নিয়ে গপ্প করতে হবে — মোটকথা অমলেট আর হবে না। এখানে তুমি হলে গিয়ে ম্যান-ইন-দ্য-লুপ (man-in-the-loop), আর তোমায়, অর্থাৎ পুরো অ্যাপলোর টিমকে কম্পিউটার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা (decision capability) দিয়েছে — অমলেট, না চাঁদা? চাঁদ, না রেডার? এইরকম ঘটনা যে ঘটতে পারে, সেটা মার্গারেট আগেই আশঙ্কা করেছিলেন, এবং তাই ডিজাইন করেছিলেন প্রায়রিটি ডিস্প্লে, যাতে ভেসে উঠেছে গো/নো-গো (go/no-go) প্রশ্ন। নামা হবে, নাকি বাড়ি ফেরত? অমলেট, না চাঁদা? অ্যাপলো টিমের কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার জ্যাক গারম্যান প্রায়রিটি ডিস্প্লে দেখে সমস্যাটা বুঝে ফেললেন, চেঁচিয়ে বললেন, “গো! গো!” রেডিও মারফত সেই বার্তা এক সেকেন্ডের একটু বেশি সময়ের মধ্যে আর্মস্ট্রং ও অল্ড্রিনের কাছে পৌঁছে গেল, মানুষও চাঁদের বুকে পা রাখতে পারল।
অ্যাপলো ১১ মিশনের জন্য সমস্ত সফটওয়্যারের স্তুপের পাশে দাঁড়িয়ে মার্গারেট। বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক কাজ যে কতটা শ্রমসাধ্য, সেটা ডানদিকের ছবিটা দেখলে বেশ বোঝা যায়।
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিঙের জননী ও অ্যাপলো ১১ প্রজেক্টের প্রধান সফটওয়্যার ডিজাইনার মার্গারেট হ্যামিল্টনকে পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা, এই যে মানুষ চাঁদের বুকে পা রাখল, এর পেছনে তো বিশাল ভূমিকা এক নারীর। চাঁদের বুকে পা রেখেছেন মোট ১২জন মহাকাশচারী, এদের মধ্যে আর্মস্ট্রং এবং অল্ড্রিন ছাড়া বাকিদের নাম সাধারণ জনতা প্রায় জানেই না বলতে গেলে। সবাই পুরুষ। আপনার ভূমিকার জন্য আপনার কি মনে হয় না আপনার না…”
মার্গারেট এইখানে আমায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আমি কিন্তু ঠিকই আছি ভাই। এই দেখ না, ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা আমায় প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অফ ফ্রীডম দিলেন। স্বীকৃতি পাইনি তো বলতে পারব না। সেই তো ১৯৮৬ সালেই অগাস্টা আডা লাভলেস পুরস্কার পেলাম, সেটা আমার জীবনের অন্যতম গর্বের পুরস্কার। পুরস্কার পেয়েছি, স্বীকৃতিও পেয়েছি, এই দিক থেকে আমি যথেষ্ট ভাগ্যবতী। কিন্তু আমার মত হয়ত অনেকেই যথাযথ স্বীকৃতি পাননি। পাওয়া উচিত ছিল। আশা করি ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই পাবেন। আমি নিশ্চিত পাবেন।”
“হ্যাঁ, কিন্তু man-in-the-loop কেন? Human-in-the-loop নয় কেন? One small step for a man. One giant step for Mankind। খালি man আসছে তো, human হলে ভাল হত না?” মার্গারেটকে জিজ্ঞেস করলাম। মার্গারেট স্মিত হাসলেন। সত্যিই তো, এর উত্তর ওনার কাছে জানতে চেয়ে কী হবে? এর উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ তোমরা।
ছবিসূত্রঃ উইকিপিডিয়া