নমস্কার বন্ধুরা। আমি গেছোদিদি। আমার ভাইকে হয়ত তোমরা চেনো, সে যেখানে খুশি যেতে পারে। আর আমি? আমি যখন খুশি যেতে পারি। গত দু’কিস্তিতে আমরা কেটি বাউম্যানের কৃষ্ণগহ্বরের ছবি, রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনের ডিএনএ অণুর ছবি, আর মার্গারেট হ্যামিল্টনের অ্যাপলো ১১ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। জেনেছিলাম কীভাবে ছবিদুটো তোলা মোটেও সহজ ছিল না, প্রচুর মেহনত ও গণনা করেই ফল মিলেছিল। জেনেছিলাম কীভাবে হ্যামিল্টনের প্রায়রিটি ডিস্প্লে না থাকলে হয়ত আর্মস্ট্রং আর অল্ড্রিনের চাঁদে নামাই হত না। এই কিস্তিতেও ভাবলুম নতুন কিছু একটা জিনিস জানলে বেশ হয়। ভাবলুম, এবার কোথায় যাওয়া যায়? উনিশ শতকের হার্ভার্ড কম্পিউটার্স? নাকি আরও পিছিয়ে এডা লাভলেস? নাকি একেবারে পিছিয়ে গিয়ে অ্যাবাকাস? হুম হুম।
আমি এইসব চিন্তাভাবনা অনেকসময় বিমানবন্দরে বসে করি। তোমরা ফস করে জিজ্ঞেস করে বসবে, গেছোদিদি তোমার বিমানবন্দরে কী দরকার? তুমি তো যখন খুশি যেতে পারো, বিমান দিয়ে তোমার কী হবে? হক কথা। খুবই হক কথা। বিমানবন্দরে আমি আসি মানুষ দেখতে। লোকে হন্তদন্ত করে পড়ি-কি-মরি ছুটতে ছুটতে ঘেমেনেয়ে চেক-ইন অবধি এসে তারপর দু’ঘন্টা স্রেফ চুপচাপ বসে থাকে। মানুষ, মানুষের সমষ্টি, মানুষের সভ্যতা — এইসব বুঝতে বিমানবন্দর খুব ভাল জায়গা। রেলস্টেশনও, যদিও সেখানে বড় বেশি মানুষ। আমি মানুষ পছন্দ করি বটে, এক জায়গায় বড় বেশি মানুষ পছন্দ করি না একেবারেই। আগে ব্যবস্থা বেশ ভাল ছিল — লোকজন ছিল, কিন্তু কম, বুক ভরে নিঃশ্বাসটুকু নেওয়া যেত (যদিও, মানে, ইয়ে, আমার ফুসফুস বা নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন, কোনটাই নেই)। এখন সব রসাতলে গেছে। সুখের বিষয়, ভবিষ্যতে ব্যাপারস্যাপার ফের ভালর দিকে ফিরবে। আশা করি। ঠিক কোন ভবিষ্যতটায় গিয়ে পড়ব সেটা আমারও জানা নেই। ভাল ভবিষ্যৎ হলে ভাল। না হলে মুশকিল। দেখো তো বন্ধুগণ, ভাল ভবিষ্যতটায় যাওয়া যায় কিনা।
যাই হোক, এবার বসে ছিলাম কলকাতা বিমানবন্দরে। সিকিউরিটি চেক-ইন হয়ে গিয়ে যেখানে লোকে বসে গেটে ঢোকার জন্য, সেইখেনটায়। পাশে একজন বছর চল্লিশের মোটাসোটা চশমাপরা ভদ্রলোক মুঠোফোনে কী একটা দেখছিলেন। অনুষ্ঠানে শব্দ নেই নাকি? মুঠোফোনের পেছনে ইয়ারফোনের তারও গোঁজা নেই, অথচ…ওঃ হো, না না, ভদ্রলোক কানে ওই গুটলি পরে আছেন। ব্লুটুথ ইয়ারফোন, ব্লুটুথের মাধ্যমে প্রোগ্রামটা দেখছেন। কী দেখছেন যদিও? ভাল করে উঁকি মেরে দেখলাম, একটা অদ্ভুত জামাকাপড় পরা লোক এদিকওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে, তার পেছনে 'ছুটে' আসছে কিছু লবণদানি, লোকটা ছুটে একটা নীল রঙের দূরভাষ বাক্সের মধ্যে ঢুকে গেল — আরে! বাক্সটা বাইরে যত বড়, ভেতরে অনেক বেশি বড়! বেশ মজার ব্যাপার তো! অনুষ্ঠানটার নামটা জানার আগেই দেখলাম ভিডিও থেমে গেছে, ভদ্রলোক খানিকক্ষণ হাত-পা ছুঁড়ে 'এয়ারপোর্টের ওয়াই-ফাইটা জঘন্য' গোছের কিছু কথাবার্তা বলেকয়ে মুঠোফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে একটা বই বের করে পড়তে শুরু করেছেন। বইটার নামটাও টুক করে দেখে নিলাম — 'হেডি’জ ফলি', লেখক রিচার্ড রোডস।
হেডি! ইউরেকা! অবশ্যই! হেডি! ওয়াই-ফাই! ব্লুটুথ!!!
চললাম হলিউড, চল্লিশের দশকে। ভদ্রলোক অবাক হয়ে দেখলেন পাশে বসা মধ্যবয়সী চশমাপরা গোলগাল হাসিমুখ ভদ্রমহিলা হঠাৎ করে চাঁদের বুড়ির মতই টপ করে উবে গেলেন।
হলিউড। চল্লিশের দশক। সিনেমার স্বর্ণযুগ, একাংশের মতে। ক্যাথেরিন হেপবার্ন, ক্লার্ক গেবল, ভিভিয়ান লি, গ্রেগরি পেক, কেরি গ্রান্ট, ইনগ্রিড বার্গম্যান, হাম্ফ্রি বোগার্ট, জুডি গারল্যান্ড, রিটা হেওয়ার্থ…হেডি লামার। রুপোলি পর্দা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এইসব নায়ক-নায়িকারা। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে বার্গম্যান আর বোগার্ট অভিনীত 'কাসাব্লাঙ্কা' সিনেমা আশি বছর পরেও জনপ্রিয় থাকবে। এই চাঁদের হাটের মধ্যে জ্বলজ্বল করছেন অস্ট্রিয়া দেশের হেডউইগ ইভা মারিয়া ক্যিসলার (Hedwig Eva Maria Kiesler), রুপোলি পর্দায় যাঁর নাম হেডি লামার (Hedy Lamarr), the world's most beautiful woman (বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মহিলা)। হলিউডের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা।
যাই হোক, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ততদিনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪০ সাল। গ্রীষ্মের শেষের দিক। মিত্রশক্তির সেনারা ফ্রান্সের ডানকার্ক থেকে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে কোনওমতে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে, ইওরোপ অনেকটাই জার্মানির দখলে, ব্যাটল অফ ব্রিটেন শুরু হব হব করছে। অতলান্তিক মহাসাগরের অন্যদিকে মার্কিন মুলুকে জীবন মোটামুটি একইরকম আছে, যুদ্ধ তখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীরে এসে পৌঁছয়নি, পার্ল হারবার হতে বছরখানেক দেরি। হলিউড হলিউডের মতই চলছে, রুপোলি পর্দায় সোনালি স্বপ্ন বেচে তখনকার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নাম-যশ-খ্যাতি এবং ধন কুড়োচ্ছেন। হেডি লামারও তাদের মধ্যে অন্যতম, কিন্তু তাতে তিনি একদমই খুশি নন। কিছু একটা করতে হবে, এই প্রতিজ্ঞা করে লামার গেলেন বন্ধু জর্জ অ্যান্টাইলের (George Antheil) কাছে। অ্যান্টাইল সুরকার ও পিয়ানো বাজানোতে সুদক্ষ, লামারের মাথায় যে পরিকল্পনাটা এসেছে তা বাস্তবায়িত করতে অ্যান্টাইল একদম ঠিক লোক। ওই দেখ, ওঁরা অ্যান্টাইলের স্টুডিওতে ঢুকছেন। চল দেখি, ওদের সঙ্গে সঙ্গে নিঃশব্দে চুপচাপ ঢুকে ওরা কী আলোচনা করছেন শোনা যাক।
(বাঁদিকে) হলিউড নায়িকা এবং আবিষ্কারক হেডি লামার (১৯১৪-২০০০); (ডানদিকে) সুরকার, পিয়ানোবাদক, ও প্লেয়ার পিয়ানো বিশেষজ্ঞ জর্জ অ্যান্টাইল (১৯০০-১৯৫৯)
হেডি লামারঃ স্টুডিওটা খারাপ না।
জর্জ অ্যান্টাইলঃ হেহে ধন্যবাদ ধন্যবাদ। নিতান্তই গরীবঘর হেহে।
হেলাঃ গরীবঘরই বটে। প্লেয়ার পিয়ানোটা কই?
জ্যাঃ প্লেয়ার পি…মানে যে পিয়ানো নিজে নিজেই সঙ্গীত বাজাতে পারে, মানুষ লাগে না?
হেলাঃ জর্জ, ভাইটি, প্লেয়ার পিয়ানো কাকে বলে তুমি খুব ভাল করে জানো। এক্সপার্ট বললেও তোমায় কম বলা হয়।
জ্যাঃ হেহে এভাবে লজ্জা দিও না হে, আমি সাধারণ মানুষ।
হেলাঃ তা তো বটেই তা তো বটেই, তা বলি আমার প্ল্যানটা পড়লে?
জ্যাঃ প্ল্যানটা? হে তুমি আমায় প্ল্যান পাঠাবে আর আমি পড়ব না, আমার কি প্রাণের মায়া নেই? পড়েছি, দু’বার পড়েছি, তিনবার পড়েছি, সাড়ে পৌনে সাতান্নবার পড়ে…
হেলাঃ উফফ, বাবাগো, মাতা কারাপ করে দিলে মাইরি। পড়েচিস কিনা বল।
জ্যাঃ হেহে পড়েছি হেডি পড়েছি। ইশ হে রেগে গেলে তোমার অস্ট্রীয় অ্যাক্সেন্টটা বেরিয়ে আসে হেহে।
হেলাঃ আমরা অস্ট্রীয়রা কুবই…থুড়ি খুবই শান্তিপূর্ণ জাতি, অন্তত লোকে তাই ভাবে।
জ্যাঃ (ত্রস্ত হয়ে) না না মানে পড়েছি তো বটেই। খুব ভাল প্ল্যান। জার্মানরা যাতে আমাদের, মানে মার্কিনদের ছোঁড়া টর্পিডোগুলোর মাথা গুলিয়ে না দিতে পারে…
হেলাঃ রেডিও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত টর্পিডো, জর্জ। ডুবোজাহাজ জাহাজ প্লেন ইত্যাদি তো এতদিন এমনি টর্পিডো ছুঁড়েই এসেছে, ক’টা গিয়ে ঠিকঠাক জায়গা বুম-বড়াম হয়? ইদানীং রেডিও সঙ্কেত দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন টর্পিডো তৈরি হচ্ছে, তাতে টর্পিডোকে ঠিকঠাক বেছেবুছে ওই জার্মান জাহাজের একদম পেটের কাছে গিয়ে…
বুম! বড়াম!
হেলাঃ (চমকে উঠে) কী হল? কী হল?
জ্যাঃ (পর্দা সরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে) কিছুই না একটা গাড়ি ব্যাকফায়ার করল। কী যেন বলছিলে…ও হ্যাঁ, রেডিওচালিত টর্পিডো! জানতাম না তো। দারুণ ব্যাপার তো!
হেলাঃ হুঁ। কিন্তু দেয়ার ইজ আ বাট। টর্পিডো রেডিওচালিত হতে হলে একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে তাকে চালনা করতে হবে। মুশকিল হল, শত্রু দেশও যদি একই সময়ে সেই একই কম্পাঙ্কে রেডিও তরঙ্গ পাঠায়, তাহলে টর্পিডোকে আর ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, সে এদিক-ওদিক চলে যাবে।
জ্যাঃ খুবই মুশকিল। কিন্তু হেডি, শুধু কি টর্পিডো? ধর অতলান্তিকের অপর পারে চা-রসিক ভাইবোনেদের কিছু একটা বেতার বার্তা পাঠাচ্ছি আমরা, হয়ত গুপ্ত কোন তথ্য প্রেরণ করছি, সেটা যদি ওই হাইলহিটলার লোকগুলো শুনে ফেলে তবেও তো চিত্তির। মানে কেস যাকে বলে কলেরা।
হেলাঃ হুম। তাও বটে তাও বটে। মানে ধর আমাদের, মানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টমশাই ইংল্যান্ডের চার্চিলস্যারকে বলতে চাইছেন 'হিটলারের পো আজ ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রিতে বোমারু বিমান পাঠাবে।' ধর সেটা পাঠানো হল এক্স মেগাহার্ৎজ কম্পাঙ্কে। এবার জার্মানরা যদি এই এক্সটা কোনওমতে জেনে ফেলে, তাহলে তারাও একই সময়ে ওই এক্স কম্পাঙ্কেই কিছু একটা চিঁচিঁ বার্তা পাঠাল, ফলত চার্চিল শুনলেন 'হিটচিঁচিঁ আচিঁচিঁ চিঁচিঁল্যান্ডচিঁচিঁচিঁচিঁ বোমচিঁচিঁচিঁচিঁ পাঠাবে।'
জ্যাঃ অতএব কেস কলেরা।
হেলাঃ অতএব কেস কলেরা।
জ্যাঃ কিন্তু হেডি, ধর আমরা যদি কম্পাঙ্কটাই পালটে ফেলি? অন্য একটা ক্যারিয়ার ফ্রিকোয়েন্সিতে বার্তা পাঠালেই কেল্লা ইজ ফতে!
হেলাঃ হ্যাঁ কিন্তু সেটা লন্ডনকে বা টর্পিডোকে জানাব কী করে? একই তো মুশকিল। জানাতে হলে তো সেই বেতার ব্যবহার করেই জানাতে হবে। চ্যানেল পাল্টাতে হবে সেটা জানাতে হবে পুরনো চ্যানেলেই, আর পুরনো চ্যানেল মানেই…
জ্যাঃ চিঁচিঁ।
হেলাঃ ঠিক তাই!
লামার আর অ্যান্টাইল চা খাচ্ছেন আর বিরতি নিচ্ছেন। এই সুযোগে ওরা ঠিক কী বলার চেষ্টা করছেন সেটা আমি, গেছোদিদি, একটু বোঝানোর চেষ্টা করি। ধর তোমাদের পাড়ায় আর কয়েকদিন বাদেই নির্বাচন। ব্যালটবাক্সে রয়েছেন চার রাজনৈতিক দলের চার প্রার্থী, ধরা যাক তাঁদের নাম জয়, পরাজয়, দয়, আর নির্দয়। শ্রীজয় নিশ্চিত জয় তাঁরই হবে, তাই তাঁর দলের ছেলেরা পাড়ায় এসে আমজাদ সাইকেল শপের পাশের ইলেক্ট্রিকের পোলে একটা বড় মাইক লাগিয়ে শ্রীজয়ের জয় কেন নিশ্চিত সেই নিয়ে প্রচুর ক্যাঁচকোঁচ করছে। শ্রীপরাজয় এদিকে নিজের নাম নিয়ে বড়ই ক্ষুণ্ণ, আর নামকরণের সার্থকতাতেও মাধ্যমিকে শূন্য পেয়েছেন, তাই তিনিও তাঁর দলের মেয়েদের বললেন আমজাদ সাইকেল শপের উল্টোদিকে পাটিল ঝাড়ু এম্পোরিয়মের পাশের ল্যাম্পপোস্টে দু’টো মাইক লাগিয়ে দ্বিগুণ ক্যাঁচকোঁচ শুরু করতে। ঝামেলা দেখে আমজাদ আর পাটিল দোকান বন্ধ করে উস্তি গেছেন বিয়ে করে ঘর পালাতে। এদিকে শ্রীদয় আর শ্রীনির্দয়ও কম যান না, তাঁরা আমজাদের দোকানের পাশে সঞ্জীব হস্তবিশারদের দোকানের মাথার ওপর কাঁঠালগাছটার গায়ে তিনটে মাইক, আর পাটিলের দোকানের পাশে বীরেন্দ্র ক্যারাটে সেন্টারের দরজার গায়ে চারটে মাইক লাগিয়ে বসে আছেন। সুখের বিষয় সবক’টা মাইক ঠিকঠাক কাজ করছে না। দুঃখের বিষয় সবক’টা মাইক ঠিকঠাক কাজ করছে না। শুধু ক্যাঁচকোঁচ ফীডব্যাকই শোনা যাচ্ছে। আর যখন ক্যাঁচকোঁচ কমছে, তখন তেড়েমেড়ে চারজনই এমনভাবে 'জয়পরাজয়দয়নির্দয়কে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করুন' শুরু করছে যে পাড়ার বাকি লোক কিছুই না বুঝে মনে দুঃখে কানের পর্দায় মার্কিউরোক্রোম লাগাচ্ছে।
খুবই গোলমাল হচ্ছে, বুঝতেই পারছ। অ্যান্টাইলের ভাষায় 'কেস কলেরা' বলাই চলে। এর প্রতিকার কী? প্রার্থী শ্রীজয় মাধ্যমিকে নামকরণের সার্থকতায় ফুল মার্ক্স যে পেয়েছিলেন, সেটা কেন দেখা যাক।
মাইকের কাঁইক্যাঁচড়ের মধ্যেই দেখা গেল গুটিগুটি পায়ে শ্রীজয় নিজে হাজির। সঙ্গে পিতৃদত্ত একপিস মই। দলের ছেলেগুলোকে মইটি ধরতে বলে শ্রীজয় ধুতি এঁটে তরতর করে উঠে গিয়ে নিজের মাইকটা নামিয়ে এনে মাতৃদত্ত কুকুর মোরেনের পিঠে বেঁধে দিলেন, দিয়ে একটা স্কুটারে চেপে স্কুটারের পেছনে স্পেয়ার টায়ারটার সঙ্গে একটা বিশাল সাইজের হাড় কষে বেঁধে বোঁ করে বেরিয়ে গেলেন। মোরেন হাড়টার পেছন পেছন তাড়া করল, শ্রীজয়ও স্কুটারে চড়ে এদিকওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, মাইক এবং শ্রীজয়ের নির্বাচনী বকবকও বাকি প্রার্থীদের ক্যাঁচরম্যাচর কাটিয়ে দিব্যি সমস্ত ভোটারের কানে পৌঁছে গেল।
যাঃ, উত্তরটা আগেভাগেই দিয়ে দিলাম নাকি। স্পয়লার হয়ে যাওয়ার আগেই ফের হেডি আর জর্জের কাছে ফেরত যাওয়া যাক। চা খাও…ও, থুড়ি কফি খাওয়া শেষ।
হেলাঃ কফিটা বেশ ছিল জ্যা। মাথাটা খুলছে মনে হচ্ছে। প্লেয়ার পিয়ানোটা কই?
জ্যাঃ ফের সেই প্লেয়ার পিয়ানো?
হেলাঃ আঃ কোথায় আছে বল না। দরকার আছে।
জ্যাঃ তুমি এতক্ষণ প্লেয়ার পিয়ানোটার ওপরেই বসে আছো। চোখে চশমা লাগাও।
হেলাঃ চোখে চশমা দিলে হলিউডে আমার জারিজুরি শেষ। অবশ্য…(ভেবে)…এমনিতেও ওখানে পাতি হাবাগোবার মতই পোজ দিতে হয়। কেমন নিজেকে ছাগল ছাগল মনে হয়। তার চেয়ে রাজধানীকে গিয়ে ইনভেন্টার্স কাউন্সিলে যোগ দিলে কাজ দেবে বেশি। অন্তত মেকাপ করতে হবে না।
জ্যাঃ প্লেয়ার পিয়ানো হে ছাগল!
হেলাঃ ইয়া! প্লেয়ার পিয়ানো কীভাবে কাজ করে?
জ্যাঃ ক্লাস নিতে হলে আইসক্রিম খাওয়াতে হবে।
হেলাঃ ডান। ভ্যানিলা-স্ট্রবেরি টু-ইন-ওয়ান?
(বাঁদিকে) স্টাইনওয়ে প্লেয়ার পিয়ানো; (ডানদিকে) পিয়ানো রোল, ফুটোগুলো ট্র্যাকার বারে পড়লে সেইমত সুর বেরোবে প্লেয়ার পিয়ানো থেকে। পাশে গানের শব্দগুলোও দেখা যাচ্ছে।
জ্যাঃ (খুশি হয়ে) প্লেয়ার পিয়ানোর ব্যাপারটা, মানে থিওরিটা খুব সহজ। পাতি পিয়ানো, শুধু ভেতরে একটা নাটাই গোছের জিনিস আছে, তাতে কাগজ জড়ানো। এই কাগজ হল পিয়ানো রোল, এতে কিছু ফুটো করা আছে। নাটাইটাকে চালিয়ে দিলে ঘুরতে থাকবে, পাকানো কাগজটাও ঘুরবে, এদিকে একটা লম্বাটে ট্র্যাকার বার (tracker bar) আছে, ফুটোগুলো এই ট্র্যাকার বারে পড়লে ফুটো অনুযায়ী পিয়ানোর চাবি বাজবে।
হেলাঃ পিয়ানো রোল কীভাবে তৈরি হবে?
জ্যাঃ খুব সহজ। পিয়ানোবাদক একটা সুর বাজাবেন, সেইমত পিয়ানো রোলে ফুটো তৈরি হবে, তারপর সেই রোল বাজারে বিক্রী হবে, লোকে সেটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে প্লেয়ার পিয়ানোতে বাজালেই মনে হবে যেন পিয়ানোবাদক বাড়িতে বসেই পিয়ানো বাজাচ্ছেন।
হেলাঃ অনেকটা গ্রামাফোন রেকর্ডের মত, তাই না?
ডিডাঃ বা ক্যাসেট টেপের মত।
হেলা, জ্যাঃ (চমকে উঠে) এটা কে বলল?
এহে, থুড়ি, টাইমলাইনটা গোলমাল হয়ে গেছে। লন্ডনের বিবিসির রেডিওফোনিক ওয়ার্কশপের ডিলিয়া ডার্বিশায়ারকে নিয়ে এসেছি একটু আগেই। মাপ করবে বন্ধুগণ। একটু রিওয়াইন্ড করে ফের হেলা আর জ্যা’র কথা শোনা যাক।
হেলাঃ অনেকটা গ্রামাফোন রেকর্ডের মত, তাই না?
জ্যাঃ বা ক্যাসেট টেপের মত, যদি সেটা কী জিনিস জানি না। যাই হোক, প্লেয়ার পিয়ানো তো বুঝলে, কিন্তু এ দিয়ে কী হবে হে?
হেলাঃ জয় হবে। দেখ জর্জ, আমাদের আসল সমস্যাটা ঠিক কোথায়? আমরা যে কম্পাঙ্কে সিগনাল পাঠাচ্ছি — সে যে সিগনালই হোক, টর্পিডোকে নির্দেশ বা চার্চিলকে সাবধানবাণী — সেই কম্পাঙ্কে জার্মানরা চিঁচিঁ পাঠালেই আমাদের দফা রফা। আবার কম্পাঙ্ক পাল্টালেও টর্পিডো বা লন্ডনকে জানাতে হবে কোন কম্পাঙ্কে পাল্টালাম। ঠিক তো?
জ্যাঃ তাহলে উপায়?
হেলাঃ উপায় হল এই — প্রেরক ও গ্রাহক দু’জনের কাছেই একটা কম্পাঙ্কের তালিকা থাকবে, ঠিকঠাক সময় মত তালিকা মিলিয়ে দু’জনেই একইসঙ্গে তাদের বেতার কম্পাঙ্ক পাল্টাবে, এবং এ’রকম করতেই থাকবে।
জ্যাঃ তালিকাটা কি আগে থেকে দু’পক্ষের কাছে থাকবে?
হেলাঃ থাকবে বৈকি। তালিকা অনুযায়ী কম্পাঙ্ক পাল্টালে শত্রুপক্ষের পক্ষে ধরে ফেলা খুব মুশকিল। তবে ঠিকঠাক সময়ে কম্পাঙ্ক না পাল্টালে বার্তার কিছু অংশ শোনা যাবে না অবশ্য।
জ্যাঃ বাবারে, ২৪ ঘন্টা ৩৬৫ দিন এ’কাজ করা তো প্রায় তো অসম্ভব।
হেলাঃ মানুষের পক্ষে অবশ্যই অসম্ভব। কম্পাঙ্ক যদি মিনিটে মিনিটে সেকেন্ডে সেকেন্ডে পাল্টানোর পরিকল্পনা থাকে তাহলে মানুষের পক্ষে করা অসম্ভব। কিন্তু ভাই জর্জ, তোমার প্লেয়ার পিয়ানোর রোলের মত দু’টো রোল যদি দু’পক্ষের কাছে থাকে, আর কম্পাঙ্কগুলো যদি সেই রোলে হুবহু একভাবে ফুটো সহকারে ‘লেখা’ থাকে, তাহলেই ট্রালালালা। মানুষ লাগবে না, শুধু প্লেয়ার পিয়ানোর মত একটা যান্ত্রিক ব্যবস্থা করতে হবে, করে সেই পিয়ানো রোলের সঙ্গে বেতারযন্ত্রের টিউনারটা যোগ করে ফেলতে পারলে ৮৮টা বিভিন্ন কম্পাঙ্ক পাওয়া যাবে…
জ্যাঃ কেননা পিয়ানোতে ৮৮টা চাবি থাকে! অতএব কলেরা কিওর্ড!
হেডি লামার ও জর্জ অ্যান্টাইলের ফ্রিকোয়েন্সি হপিং যন্ত্রের নকশা
বেতার কম্পাঙ্ক এক কম্পাঙ্ক থেকে আরেক কম্পাঙ্কে এই লাফিয়ে বেড়ানোটার কথা শুনলেই ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। সেও রাণাঘাট তিব্বত ডায়মন্ডহারবার লাফালাফি বা hopping করে বিখ্যাত। ১৯৪২ সালের ১১ অগাস্ট হেডি লামার আর জর্জ অ্যান্টাইল এই 'ফ্রিকোয়েন্সি হপিং' (frequency hopping) বা 'ফ্রিকোয়েন্সি হপিং স্প্রেড স্পেক্ট্রাম' (frequency hopping spread spectrum, FHSS) প্রযুক্তির জন্য পেটেন্ট পেয়েছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করা কঠিন হবে বলে পেটেন্ট পেলেও প্রযুক্তিটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার হয়নি। পরে ‘৬২ সালে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের সময় প্রথম এই প্রযুক্তির বাস্তব ব্যবহার দেখা যায়। পরের ষাট সালে এই প্রযুক্তি বহুব্যবহৃত হয়, প্রথমে যুদ্ধক্ষেত্রে, তারপর বেসামরিক বিশ্বে।
এয়ারপোর্টে ফিরে আসি। ওয়াই-ফাই খুব সম্ভবত ফিরে এসেছে, সেই ভদ্রলোক ফের দেখি সেই নীলবাক্স ডাক্তারের অনুষ্ঠান দেখছেন। উনি একা নন, এদিকে আরেকজন গুঁফো চশমাপরা ভদ্রলোক মন দিয়ে আইপিএল দেখছেন, অন্যদিকে আরেকজন বেঁটেমতন বাচ্চা বাচ্চা দেখতে মহিলা সুপারগার্ল দেখছেন, ওনার পাশে বসে বছর চল্লিশেক এক মহিলা কানে ব্লুটুথ হেডসেটে শ্রুতিনাটক শুনছেন।
একইসঙ্গে এত লোক এক সঙ্গে ওয়াই-ফাই ব্যবহার করছেন, ব্লুটুথ ব্যবহার করছেন, অথচ আমজাদ সাইকেল শপের মত প্রলয়ঙ্কর ঘটনা ঘটছে না। শ্রুতিনাটকের হেডসেটে নীলবাক্স চলে আসছে না, বা সুপারগার্লের বদলে ছক্কার শব্দ ভেসে আসছে না। এত লোক একই সঙ্গে বেতার ব্যবহার করছেন, কিন্তু একে অপরের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে না। ব্লুটুথ বা ওয়াই-ফাই দু’টোই রেডিও ব্যান্ডে চলে, আল্ট্রা হাই আর সুপার হাই ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে, তা সত্ত্বেও…
ওহ হো! তাই তো! ফ্রিকোয়েন্সি হপিং হচ্ছে। FHSS! বা একইরকম একটা প্রযুক্তি। শত্রুপক্ষে নেই বটে, কিন্তু ক্যালরব্যালর এড়াতেও ফ্রিকোয়েন্সি হপিং করা যায়ই তো! শ্রীজয় আর মোরেনের মত এদিক-ওদিক কম্পাঙ্ক পাল্টাতে থাকলেই হল। নো মোর ক্যালরব্যালর, সকলে শান্তিতে নিজের মত করে নিজের জিনিস শুনতেই পারবে।
তার মানে কি হেডি লামারই ব্লুটুথ এবং ওয়াই-ফাইয়ের জননী?
না, অবশ্যই নয়। লামার আর অ্যান্টাইলের আবিষ্কৃত প্রযুক্তি ব্লুটুথ বা ওয়াই-ফাইতে ব্যবহার হয়, এবং এই প্রযুক্তি না থাকলে প্রথমদিকের ব্লুটুথ বা ওয়াই-ফাই ব্যবহার করা খুবই কঠিন হত। প্রথমদিকের বলছি কেননা আজকাল ফ্রিকোয়েন্সি হপিঙের বদলে ব্লুটুথ বা ওয়াই-ফাইতে 'ডিরেক্ট সিকোয়েন্স স্প্রেড স্প্রেক্ট্রাম' (direct sequence spread spectrum, DHSS) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে অবশ্য নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের বদলে আজকাল আইনষ্টাইনের তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তাও নিউটন পাওনীয়ার, অগ্রণী। ঠিক যেমন হেডি লামার অগ্রণী।
এতকিছু বললাম, একটা কথা বলা হয়নি। লামারের এই আবিষ্কারের কথা পড়লে মনে হয় উনি নিশ্চয়ই কখনও না কখনও প্রযুক্তিগত শিক্ষা পেয়েছিলেন। মনে হলে ভুল হবে যদিও। ইচ্ছা থাকলেও লামারের ছাত্রাবস্থায়, অর্থাৎ বিশের দশক ও তিরিশের দশকের প্রথম দিকে মহিলাদের এইরকম উচ্চশিক্ষা পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। সুখের বিষয় দুইঃ এক, এখন ব্যাপারস্যাপার অনেকটাই পাল্টেছে। দুই, প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা না থাকলেও হেডি লামার ফ্রিকোয়েন্সি হপিং আবিষ্কার করেছিলেন। আর করেছিলেন বলেই আজকাল মানুষে ব্লুটুথ এবং ওয়াই-ফাই ব্যবহার করতে পারছি। হেডউইগ ইভা মারিয়া ক্যিসলার। মানবসভ্যতার পক্ষ হতে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
বাই দ্য রাস্তা, ভোটের ফলাফল এসে গেছে। খবরে প্রকাশ, ভোটে শ্রীপরাজয় হেরে ভূত হয়েছেন, তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। শ্রীদয় আর শ্রীনির্দয় ১টা করে ভোট পেয়েছেন, পরে জানা গেছে তাঁরা একে অপরকে ভোট দিয়েছেন, শোনা যায় শিগগিরি বিয়ে করবেন। ভোটে দ্বিতীয় স্থানে এসেছেন শ্রীজয়, মাত্র ১ ভোটে হেরেছেন ভোটের ৫ম প্রার্থী শ্রীমোরেনের কাছে। এইজন্যই বোধহয় বলে মানুষই কুকুরের শ্রেষ্ঠ মিত্র।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট