সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

কয়েক মাস আগের কথা।

মোবাইলে টুং করে একটা শব্দ হলো।
ই-মেলে একটা মেসেজ এসেছে। মেসেজটা পাঠিয়েছে আমার স্কুলের বেস্টফ্রেন্ড ঋতুজা। বেশ অনেকদিন পর আমায় মেসেজ করেছে, তাই হড়বড় করে পড়তে শুরু করলাম।
ই-মেলটাতে লেখা ছিল --

' রজনী,
অনেকদিন পরে কথা বলছি তোর সাথে, তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে। তুই তো জানিস, আমি একজন সায়েন্টিস্ট, আমি অনেকদিন ধরে একটা রিসার্চে ব্যস্ত ছিলাম, আর সেই রিসার্চ থেকে এমন একটা জিনিস তৈরী করেছি যা আমি নিজেও কোনোদিনও ভাবতে পারিনি। তবে কী করেছি, সেটা সারপ্রাইজ। আর সেইটা দেখতে তোকে আমার বাড়িতে আসতে হবে। যদি আসিস তবে জানিয়ে দিস। আমি এখন থাকি আগরতলায়। আমার বাড়ি এয়ারপোর্টের কাছেই। তুই পৌঁছে একবার কল করিস, আমি তোকে ওখান থেকে পিক-আপ করে নেবো।'

বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার জন্য আমি সবসময়ে এক পা বাড়িয়ে রয়েছি। এবার ভালোই হলো। বাইরে কোথাও যাওয়াও হবে, আবার বন্ধুর সাথে দেখাও হয়ে যাবে। লিখে দিলাম --
'হ্যাঁ, আমি নিশ্চয়ই আসব। কাল টিকিট বুক করছি, পরশু পৌঁছবো, এক সপ্তাহ থাকব।'

পরদিন বাড়ির কাজ শেষ হলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। ভোর ভোর উঠতে হবে। সকাল ন'টায় ফ্লাইট। পরের দিন একটু আগেই, মানে ভোর চারটের সময় ঘুম ভেঙে গেল। তা ভালোই হলো, যাওয়ার আগে বেশ কিছু কাজ সেরে ফেলতে পারব।
সে যাই হোক, কাজ-টাজ সেরে নিয়ে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম এয়ারপোর্টের দিকে। সব চেকিং হয়ে গেলে ফ্লাইটে উঠলাম। বেশিক্ষণ লাগেনি আগরতলা পৌঁছাতে। ঋতুজা বলেছিল ওর বাড়ি এয়ারপোর্টের কাছাকাছি। একটা ফোন করলাম। ও বললো এয়ারপোর্টের তিন নম্বর গেটের কাছে দাঁড়াতে। ওর কথামতো ওখানে গিয়ে একটা চেয়ারে বসলাম। মোবাইল বার করে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে লাগলাম।

খেলায় এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে ঋতুজা যে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, আমি তা বুঝতেই পারিনি। অধিকাংশবার খেলায় হেরে গিয়ে হতাশ হয়ে যখন ফোনটা পকেটে ঢোকালাম, তখনই মাথায় কেউ টোকা দিল। খেলায় হারার রাগ তখনও থেকে গেছে, তার উপর আবার কেউ মাথায় মারছে, মাথা গরম করে বললাম, 'কী হয়েছে বলুন তো? ' এবার ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি পাশে ঋতুজা বসে। লজ্জায় পড়ে একটু হাসলাম। ঋতুজাও হেসে মাথা নাড়লো, তারপর বলল, 'চল, এবার দেরি হয়ে যাচ্ছে।' আমিও মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তারপর আমার সুটকেস আর ব্যাকপ্যাক কালেক্ট করে এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে ঋতুজার গাড়িতে উঠলাম। বেশি দেরি লাগলো না ঋতুজার বাড়ি পৌঁছোতে। জিনিসপত্র নিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ঋতুজাকে বললাম, 'এক কাপ কফি খাওয়াবি রে?'
-- হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তুই ততক্ষণ টিভি দেখ। আমিও পিৎজা অর্ডার দিচ্ছি, তোর তো ওটা ফেভারিট!
আমি ড্রয়িং রুমের সোফায় গিয়ে বসলাম। ঋতুজা টিভি খুলে দিয়ে পিৎজা অর্ডার দিতে গেল অন্য ঘরে। আমিও নিশ্চিন্তে বসে নিউজ দেখতে লাগলাম। আজকাল সাংঘাতিক কিছু কান্ড ঘটছে। তার মধ্যে একটা হলো কিডন্যাপ। কিডন্যাপাররা শান্ত-শুনশান জায়গায় এসে বাচ্চাদের মুখে ক্লোরোফর্ম যুক্ত রুমাল চাপা দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এর পর কী হচ্ছে তা শোনার জন্য অপেক্ষা না করেই টিভি অফ করে দিলাম। তারপর সোফায় বসে ভাবতে লাগলাম ঋতুজা আমায় কী দেখাতে পারে। ভাবতে ভাবতে ঋতুজা নিজেই এসে জিজ্ঞেস করলো, 'কী রে, টিভি অফ করে দিলি কেন?' উত্তরে আমি বললাম, ' না বাবা, টিভিতে ওরকম খবর দেখে ভয় পেয়ে কী লাভ? তার চেয়ে চল আমরা একটু গল্প করি।'
ঋতুজা একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, ' সেকী রে? কী এমন খবর দেখলি? আমি বললাম, ' আর বলিস না! যত সব ভয়ংকর খবরগুলো বেছে বেছে দেখায়। আজ আবার দেখাচ্ছে কিডন্যাপিং। আর পারা যায়না।' ঋতুজাও তাতে একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, 'সত্যিই তাই। ভালো খবর তো আজকাল কালে-ভদ্রে পাওয়া যায়।' একটু পরে পিৎজা এলো, মহানন্দে খেলাম। বাকী দিনটা ঋতুজার সাথে গল্প করে আর বই পড়ে কেটে গেল।

পরের দিন সকালে উঠে দেখি ঋতুজা আগেই উঠে ব্রেকফাস্ট বানাতে চলে গেছে। পরে বলেছিল ও রোজ ওই সময়েই ওঠে। বিছানা ছেড়ে বাথরুমে যাওয়ার সময় ঋতুজাকে দেখে গুড মর্নিং জানালাম। তার উত্তরে ঋতুজা হেসে বলল, 'গুড মর্নিং, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে চলে আয়, ব্রেকফাস্ট তৈরি।'

ব্রেকফাস্টের পর ঋতুজা আমায় এসে বলল, 'কী রে? তুই দেখবিনা আমি কী বানালাম? তারপর সেটা ট্রায়ালও করতে হবে।' আমি মাথা নাড়লাম, আর মনে মনে ভাবলাম, ' কী এমন দেখাবে?' আর তখনই ঋতুজা সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই চোখে পড়লো একটা ঘর। ঋতুজা সেটার তালা খুলে আমায় ঘরে আসতে বললো। আমিও ঘরে ঢুকলাম। বুঝতে পারলাম এটা ওর ল্যাবরেটরি। যদিও আগে কোনোদিন বিজ্ঞানীদের ল্যাব দেখিনি, তাও ইচ্ছে করল না চারপাশটার দিকে তাকাতে। আমার চোখ ঋতুজার দিকে স্থির ছিল। আমার একমাত্র আকর্ষণ ছিল ঋতুজা কী জিনিস দেখাবে তার উপর।

ঋতুজা নিজের হাতে একজোড়া গ্লাভস পরল আর আমাকেও একজোড়া পরতে দিল। এইসব হয়ে গেলে ও এগোলো ঘরের কোণে রাখা একটা স্টিলের লকারের দিকে। চাবি ঘুরিয়ে ভেতরে রাখা একটা বাক্স খুব যত্ন করে বার করল। তারপর সেটা এনে টেবিলে রাখল। এবার ও একটা চেয়ার আমার দিকে এগিয়ে দিল আর নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসলো। প্রথমে বলল ' খুব জেন্টলি হ্যান্ডেল করিস। পলকা জিনিস।' তারপর বাক্সটা আস্তে আস্তে খুললো। খুলে যা দেখলাম তাতে বেশ হতাশ হলাম। বাক্সতে পড়ে আছে একজোড়া কন্ট্যাক্ট লেন্স!

আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, ' তুই বলতে চাইছিস যে তুই এই কন্ট্যাক্ট লেন্সগুলো বানিয়েছিস!' ও একটু গর্বিতভাবে বললো, 'এ যে সে লেন্স নয় রে। এর মধ্যে ক্যামেরা ফিট করা আছে।দাঁড়া, আমি বোঝাচ্ছি তোকে। দেখ, প্রথমে এটা চোখে পরতে হবে। তারপর আমার কাছে একটা রিমোট আছে।' বলে একটা রিমোট বার করলো, সেটাতে বেশ কিছু বোতাম। তারপর আবার বলতে শুরু করলো, ' এটাতে ক্যামেরার অপশন আছে। নানারকম ফিল্টারও আছে, যেমন- কালার, ব্রাইটনেস, কনট্রাস্ট, বিউটিফিকেশন ইত্যাদি। এই লাল বোতামটা টিপলে কন্ট্যাক্ট লেন্সের ক্যামেরা আ্যক্টিভেট হবে। তারপর কোনও জিনিস, যেটার ছবি তুই তুলতে চাস সেটার দিকে ফোকাস করে, একটু চেপে চোখের পলক ফেলতে হবে। তাহলেই কন্ট্যাক্ট লেন্স সেই জিনিসটার ফোটো তুলে নেবে। বুঝলি?'
'আরিব্বাস! তোর তো নোবেল পুরষ্কার পাওয়া উচিত রে! দারুণ ব্যাপার তো!'

পরক্ষণেই আইডিয়া খেলে গেল মাথায়। বললাম, 'চল না, একটু পার্ক থেকে ঘুরে আসি। আসার সময়ে ট্যাক্সিতে দেখেছিলাম পার্কটা, কী সুন্দর, চারিদিকে গাছপালা! এখন নির্জন শুনশান আছে, কিছু ছবিও তুলে নেবো ট্রায়ালের জন্য।' ঋতুজারও আইডিয়া পছন্দ হলো, আর দুজনেই বেড়িয়ে পড়লাম। মাঝে একটা দোকান থেকে চা খেয়ে দুটো চিপসের প্যাকেট কিনে হাঁটা লাগালাম। খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম পার্কে।

এবার একটা সিটে বসে কন্ট্যাক্ট লেন্সগুলো পরলাম, তারপর বেশ কিছু ফুল ও পাখির ছবি তুললাম। তার মধ্যে দেখলাম একটা বাচ্চা মেয়ে, খুব সুন্দর দেখতে, সোপ বাবল ওড়াচ্ছে। ওর আয়া একটু দূরে হাঁটছে। আমি ওর কিছু ছবি তুলে নিলাম। ঠিক তখনই দেখলাম, একটা লোক এসে সাবান জলের কৌটোটা ঠেলে ফেলে দিল। আর আমিও না থেমে ছবি তুলতে থাকলাম। লোকটার মুখ পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। দেখলাম খুব তাড়াতাড়ি লোকটা মেয়েটার মুখে রুমাল চাপা দিল, মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেল, আর লোকটাও তাকে একটা গাড়ীতে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। চোখের সামনে এমন একটা ঘটনা দেখে আমরা আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তারপর ঠিক করলাম পুলিশে খবর দেব।

তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ঋতুজাকে বললাম ছবিগুলো লেন্স থেকে ডাউনলোড করে আমার ফোনে পাঠিয়ে দিতে, কিছুক্ষণ পর পেয়েও গেলাম। এবার একটা স্লাইডশো আ্যপ ডাউনলোড করলাম। ঋতুজাকে বোঝালাম, আমার প্ল্যানটা কী। আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, নিউজে যে কিডন্যাপের খবর দেখেছিলাম, সেটাই আমি পার্কে দেখে এলাম। পুলিশে তো খবর দেবোই। আর প্রমাণ সংগ্রহের জন্য আমি এই ছবিগুলো কন্টিনিউয়াস ভিডিওর মতো করে তুলে নিলাম। এবার স্লাইডশো আ্যপে এইগুলো দিয়ে একটা স্লো-মোশনের স্লাইডশো বানাবো, যাতে করে পুরো ঘটনাটা পুলিশের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। তারপর আসামীকে কীভাবে পুলিশ ধরবে সেটা পুলিশের ব্যাপার।
স্লাইডশো মেকার ডাউনলোড হয়ে যাওয়ার পর সবকটা ছবি সিকোয়েন্সে বসিয়ে, স্লো - মোশন এফেক্ট দিয়ে একটা সুন্দর ভিডিও দাঁড় করালাম। তারপর প্ল্যান মত ঋতুজার সাথে থানায় গিয়ে পুরো ঘটনাটা পুলিশকে বললাম এবং ভিডিওটা দেখালাম।

পরের এক মাসের মধ্যে কিডন্যাপার ও তার বস সহ পুরো গ্যাংকে খুঁজে পাওয়া গেল। মেয়েটিকেও উদ্ধার করা গেল। আমি ও ঋতুজা দুজনেই প্রচুর বাহবা পেয়েছিলাম। এমনকী কাগজেও আমাদের নাম ও ছবি ছাপা হয়েছিল। ঋতুজার আবিষ্কার যে এভাবে কাজে লেগে যাবে সেটা ও বা আমি, কেউই কখনো ভাবতে পারিনি।

গল্প লিখেছেঃ
আনন্দী ব্যানার্জী,
ষষ্ঠ শ্রেণি, ভারতীয় বিদ্যাভবন, সল্টলেক

ছবিঃ শিল্পী ঘোষ

 

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা