তোমাদের যদি জিজ্ঞাসা করি ক’দিনে সপ্তাহ হয়? আমি জানি সকলেই বলে দিতে পারবে— সাত দিনে। দিনগুলির নাম জিজ্ঞাসা করলেও তোমরা গড়গড় করে বলে দেবে রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি। কিন্তু বলতে পারবে কি এই নামগুলি এল কীভাবে? যাদের জানা নেই জেনে নেও। কোনো কিছুর পরিমাপ (দৈর্ঘ্য, আয়তন, ওজন ইত্যাদি) করতে হলে এককের দরকার হয়। সময় ছাড়া বাকি সবকিছু মাপার জন্য একক বাছার স্বাধীনতা মানুষের হাতে থাকলেও সময় মাপার জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় প্রকৃতির উপর। এক সূর্যোদয় থেকে আর এক সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় কে আমরা বলি একদিন। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে চাঁদ যে সময় নেয় তা হল এক মাস। আর সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর একবার ঘুরে আসার সময়কে বলা হয় এক বছর। মানুষ সময় মাপার কথা কবে প্রথম ভেবেছিল সে কথা সঠিকভাবে জানা না থাকলেও গ্রিকদের রচনা থেকে অনুমান করা হয় যে মিশরীয়রাই প্রথম বছরের কল্পনা করেছিল। আর সেই ভাবনা থেকেই তৈরি হয়েছিল ‘ক্যালেন্ডার’।
মাস ও বছরের সঙ্গে মানুষের পরিচয় ছিল বহুদিন আগে থেকে। সপ্তাহের ধারণা তখন ছিল না। তাই প্রথম দিকে সময়ের হিসেবে করতে মানুষ বছর, মাস ও দিনের হিসেব করত। সপ্তাহ এসেছে অনেক পরে। মাস ও বছরের সঙ্গে প্রাকৃতিক ঘটনার একটা সম্পর্ক থাকলেও সপ্তাহের সঙ্গে কিন্তু সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই।
সপ্তাহ হল সাতদিনের একটা ছোট্ট চক্র। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে সপ্তাহের এই নিয়ম মেনেই ক্যালেন্ডার তৈরি হয়। তবে আমেরিকায় মাইয়া সভ্যতায় তেরো দিনের চক্র চালু ছিল। ফরাসি বিপ্লবের পর সেদেশে চালু হয়েছিল দশ দিনের চক্র। রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত দেশে চালু হয়েছিল পাঁচ বা ছয় দিনের চক্র। তবে সেগুলো বেশিদিন চলেনি। অনুমান করা হয় যে আমাদের দেশে সপ্তাহ চালু হয়েছিল আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পর থেকে। এমনকী সাতটি বারের নামও এসেছে ওই গ্রীকদের কাছ থেকে। তবে তখন এর ব্যবহার ছিল খুবই সীমিত। ইংরেজরা আসার পর এর বহুল ব্যবহার শুরু হয়। সপ্তাহের ধারণা ইংরেজরা পায় সম্ভবত খ্রীষ্ট ধর্মগ্রন্থ বাইবেল থেকে। সেখানে বলা হয়েছে যে ঈশ্বর বিশ্ব সৃষ্টির জন্য ছয় দিন ব্যস্ত থাকার পর সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন। ইহুদিদের পুরাণেও এই একই কথা লেখা আছে। সেখানে শনিবারকে বলা হয়েছে সপ্তাহের শেষ দিন। অতীতে চাঁদ ও সূর্যকে গ্রহ বলে মনে করা হত। তাই চাঁদ ও সূর্য সহ যে সাতটা গ্রহকে খালি চোখে দেখা যায় তাদের নামানুসারেই গ্রিক জ্যোতির্বিদরা সপ্তাহের প্রতিটি দিনের নামকরণ করেছিলেন। এই নামগুলি হল যথাক্রমে, দিয়েস্ সোলিস, দিয়েস্ লুনায়ে, দিয়েস্ মার্তিস, দিয়েস্ মের্কুরি, দিয়েস্ ইয়োউইস, দিয়েস্ ভেনেরিস, ও দিয়েস্ সাতুর্নি। ‘দিয়েস্’ কথার অর্থ হল দিন।গ্রীকরা এই সাতটি গ্রহকে (সূর্য ও চাঁদ সহ) সাতদিনের অধিষ্ঠাতা দেবতা বলেও মনে করত। বাংলা ভাষাতে সপ্তাহের সাতটি দিনের নামগুলি হল— রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার। সপ্তাহের প্রথম দিনটিকে উৎসর্গ করা হয়েছে সূর্যের নামে। তাই এই দিনটিকে বলা হয় সূর্যের অর্থাৎ রবির দিন। দ্বিতীয় দিনটি রাখা হয়েছে চাঁদের নামে। চাঁদের আরেক নাম সোমনাথ বা সোমেশ্বর। এই নাম থেকেই 'সোম' নামটি এসেছে। পরের দিনগুলি হল যথাক্রমে মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র এবং শনি গ্রহগুলির নামে।
বর্তমানে ইংরেজিতে সপ্তাহের সাতটা দিনের নাম অতীতের প্রচলিত নামানুসারে নেই। রবিবার, সোমবার ও শনিবারকে বাদ দিলে বাকি চারটি নাম কিন্তু গ্রহদের নামে নেই। মঙ্গলবারকে বর্তমানে ইংরেজিতে বলা হয় টুইস্ডে। টুইস্ডে কথাটা এসেছে 'টির' নাম থেকে। নরওয়ের পুরাণে টির হল যুদ্ধের দেবতা। সেরকম ওয়েডনেস্ডে, থার্সডে এবং ফ্রাইডেও এসেছে নরওয়ের দেবতাদের নামানুসারে। জার্মান এবং স্ক্যান্ডিনেভিয় ভাষাতেও মোটামুটি একই রকম ব্যাপার দেখা গেলেও শুধু বুধবারের ক্ষেত্রে জার্মান ভাষাতে বলা হয় মিটওখ অর্থাৎ, সপ্তাহের মাঝের দিন। স্পেনের লোকেরা শনিবারকে বলে 'সাবাদো'। কথাটা এসেছে ইহুদিদের 'শাবাত' থেকে। শাবাত কথার অর্থ হল বিশ্রামের দিন। শনিবারকে ইতালিতে বলা হয় সাবাতো, আর ফরাসিতে সাম্দি। রবিবারকে ফরাসিতে বলে দিমশ্, স্পেন এবং ইতালির লোকেরা বলে যথাক্রমে দোমিঙ্গ ও দোমেনিকা— অর্থাৎ প্রভুর দিন। পোর্তুগিজ ভাষায় রবিবার ও শনিবারকে বাদ দিলে বাকি দিনগুলি হল দ্বিতীয় হাটবার, তৃতীয় হাটবার ইত্যাদি।
আগেই বলেছি যে প্রাচীনকালের ক্যালেন্ডারগুলিতে সপ্তাহের কোনো ধারণা ছিল না। পরবর্তীকালে নানারকম সামাজিক কাজকর্মের সুবিধার জন্য মাসের ব্যবধানকে ছোট করার প্রয়োজন হয়েছিল। সব দেশের মানুষই নিজেদের প্রয়োজনে মাসের চেয়ে ছোট মাপের একটি সময় চক্র তৈরি করেছিল। এখন মনে হতে পারে ক্যালেন্ডারে সপ্তাহের ধারণা আসার আগে বিভিন্ন দেশের মানুষেরা কোনো একটা মাসের বিভিন্ন দিনগুলিকে কীভাবে চিহ্নিত করত? জুলিয় ক্যালেন্ডারে দেখা যায় মাসের মধ্যে কয়েকটা দিনকে নির্দিষ্ট করে রাখা হত। বাকি দিনগুলি এই নির্দিষ্ট দিন ক'টির সাহায্যে চিহ্নিত করা হত। মাসের প্রথম দিনটিকে বলা হত কালেন্দায়ে। মাসের মাঝখানের দিনটিকে বলা হত ইদেস্। ইদেস্-এর ন'দিন আগের দিনটিকে বলা হত নোনায়ে। বাকি দিনগুলিকে চিহ্নিত করা হত অমুক মাসের ইদেস্-এর চার দিন আগে বা অমুক মাসের কালেন্দায়ে-এর দু'দিন পরে— এইভাবে।
ছবিঃ ঐন্দ্রিলা মুখার্জি