সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

গোটু ঠাম্মার কাছে ভয়ের গল্প শুনত। কিছুদিন আগে তার ঠাম্মা মারা গেল। . এখন আর কারও মুখেই সে গল্প শুনতে পায়  না। বন্ধু, শৈল তার ঠাকুরদার কাছে কত সুন্দর সুন্দর গল্প শোনে ! গোটুর  ঠাকুরদা ভার-ভারিক্কি মানুষ।  তার কাছে গল্প শুনতে ইচ্ছে করে না গোটুর। সে মনে মনে ভাবে এত চুপচাপ থাকা লোক কি গল্প বলতে পারে ? গোটু জানে, ঠাম্মা মারা যাবার পরই ঠাকুরদার এই অবস্থা। তার মনে হল তা ঠিকতার ঠাকুরদা তো আগে এমনটা ছিল না ! বেশ হাসিখুশি ছিল, সব সময় ঠাম্মার আশপাশে ঘুরে বেড়াত।

গোটু  তার মাকে বলেছিল, "মা, ঠাকুর দা এত চুপচাপ কেন, মা ?"
মা বলেছে, "তোমার ঠাম্মা চলে যাবার পর ঠাকুর দা এমনটা হয়ে গেছে"
গোটু  আর কিছু জানতে চায়নি।  
সে দিন রাতে গোটুর ঘুম ভেঙে গেল। তার মনে হল পাশের ঘরে ঠাকুরদা কারও সঙ্গে কথা বলছে। কৌতূহলী হল গোটু। সে ধীরে ধীরে উঠে গেল ঠাকুরদার ঘরের দিকে। ঘরের দরজা ভেজানো থাকলেও কিছুটা ফাঁকা ছিল। ঠাকুর মা মারা যাবার পর ঠাকুরদা রাতে দরজা দেন না। গোটু দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারল। ঘরের আলো জ্বালা নেই, তবু ঘরে বেশ আলো আছে। গোটুর চোখের সামনেটা আরও পরিষ্কার হল।  আরে এ কী? ঠাকুর দাদা তা হলে কার সঙ্গে কথা বলছে ? ঠাম্মার আকৃতির একটা ছায়া ঠাকুরদার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে  ! কিছু সময় পরে আরও যেন স্পষ্ট হল ঠাকুমার আকৃতি। গোটু আর চুপ থাকতে পারলো না। সে ভয়ে, "ঠাম্মা", বলে চীৎকার করে উঠল। থরথর করে সে কাঁপছিল।
ঠাকুরদা,  মা, বাবা ছুটে এলো। ওরা দেখল, গোটু ভয়ে জড়সড় হয়ে দেওয়াল ঘেঁষে বসে আছে।  
"কী হল ? গোটু, কী হয়েছে, বাবা ?" ভয়ে ভয়ে মা প্রশ্ন করল।  
গোটু ভয়ে ভয়ে বলল, "আমি…", ওর মুখ দিয়ে কথা সরছিল না।  
ঠাকুর দা দাঁড়িয়েছিল, বলল, "ও ভয় পেয়েছে।"
 "কেন ? কেন ?" গোটুর বাবা জানতে চাইলো।
মা গোটুকে জড়িয়ে ধরল।  
"ওই ঘরে ঠাম্মা", গোটু বলল।
"ঠাম্মা !" মা তার শ্বশুর মশাইয়ের ঘরের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে বলল।  
গোটু বলল, " আমি ঠাম্মাকে দেখেছি।"
ঘটনাটা কারও বিশ্বাস হল না। ঠাকুর দা মুচকি হাসল, মুখে কিছুই বলল না। মা-বাবার অনেক বোঝানোতে গোটু চুপ মেরে গেল। তবে বারবার তার মনে হতে লাগলো, কিন্তু সে যে স্পষ্ট দেখেছে ঠাকুমাকে ! ঠাকুরদা কথা বলছিল ঠাম্মার সঙ্গে।  
এ ভাবে একটা মাস কেটে গেল। গোটু সে দিন ভয় পাবার পরে রাতে খুটখাট সামান্য শব্দে তার ঘুম
ভেঙে যায়। সে দিন পূর্ণিমা ছিল।  হঠাৎ গোটুর ঘুম ভেঙে গেল। সে কান পাতল। ঠাকুরদার ঘরে কথা শোনা যাচ্ছে না ? তখন কেন যেন ওর মনে আর ভয় ছিল না। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ঠাকুরদার ঘরের দরজার সামনে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতেই সেই সে দিনের দৃশ্য তার চোখের সামনে ফুটে উঠল। দেয়ালের মাথার উপর ঠাম্মার ফটো ফ্রেম ঝোলানো। আর তার ঠিক নিচেই একটা ছায়াঠিক যেন ঠাম্মার আকৃতির ছায়া। সেটা কখনও অস্পষ্ট আবার কখনও স্পষ্ট হচ্ছে। ঠাকুর দাদা তার সঙ্গে কথা বলে চলেছে।  
কিছু সময় দেখতে দেখতে গোটু দেখল, হ্যাঁ, ঠিক, ঠাকুমা নড়ছে। ঠাকুরদা সামান্য নড়েচড়ে কথা বলে যাচ্ছে। তারপর গোটুর মাথাটা দরজায় ঠেকে গেলো।  সামান্য শব্দ হল। আর গোটু দেখতে পেল,  তার ঠাকুরদা-ঠাকুমা যেন এক সঙ্গে তার দিকে এগিয়ে আসছে ! ব্যাস এই পর্যন্ত। তারপর গোটু একটা চীৎকার দিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
এরপর থেকে গোটু রোজ রাতে ভয় পেয়ে জেগে উঠছে। আর "ওই যে, ওই যে ঠাম্মা," বলে ভয়ে  নিজের চোখ মুখ ঢেকে নিচ্ছে। ওকে আর আলাদা ঘরে শুতে দেওয়া হচ্ছে না। ও ভয়ে বাবা-মার মাঝখানটায় শোয়।  তবু মাঝরাতে ও চীৎকার দিয়ে ওঠে, বলে, "ঠাম্মাওই যে ঠাম্মাআমার দিকেই এগিয়ে আসছে !"
শেষে গোটুকে মনের ডাক্তার, মনস্তাত্ত্বিকে দেখাতে হল।  সব ঘটনা শুনে তিনি ঘরে এলেন। গোটুদের ঘর তিনি ঘুরে ঘুরে দেখলেন। ওর ঠাকুরদার ঘরে ঢুকে তিনি দেওয়ালে টাঙানো ঠাম্মার  ফটো দেখতে পেলেন।  যে দেয়ালে ফটো তার ঠিক উল্টো দিকের দেওয়ালে বড় একটা জানালা আছে। জানালায় হালকা সাদা পর্দা লাগানো। তিনি পর্দা সরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। বেশ খোলামেলা, বেশ আলো ঘরে এসে পড়ছে। তিনি আকাশের দিকে একবার তাকালেন, বাহ, বেশ খোলা ও স্বচ্ছ      আকাশ ! ঘরের মধ্যে রোদ জালনার শিক ভেদ করে এসে পড়েছে।
মনের ডাক্তারের এবার ঘটনা সাজাবার পালা। গোটুর ভয়ের কারণ কি ? সে তার ঠাম্মাকে কি ভাবে দেখতে পায় ? ডাক্তার গোটুকে প্রশ্ন করেন"আচ্ছা, গোটু, তুমি
ঠাম্মা-দাদুর ঘরে কবে কবে গিয়েছিলে ?"
দিনগুলির কথা গোটু মনে করতে পারল না। তার মা চিন্তা করে ডাক্তার বাবুকে সেই দুটো দিনের কথা
বলল। মনস্তাত্ত্বিক আবার গোটুকে প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা তুমি ঠাম্মাকে ছায়ার মত দেখেছো তোপরিষ্কার দেখতে পাওনি তো ?"
"ঠাম্মাকে স্পষ্ট দেখিনি, তবে" গোটু একটু ভেবে নিলো, তারপর বলল, "হ্যাঁ,  ছায়া দেখেছি, তবে সে ছায়ার মধ্যে আমি সত্যি ঠাকুমাকে দেখতে পেয়েছি।"
এবার মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্ন করলেন, "তুমি কি ঠাম্মার কথা শুনতে পেয়েছ ?"
গোটু বলল, "না, শুধু ঠাকুরদার কথা শুনতে পেয়েছি।"
এবার মনের ডাক্তার গোটুর ঠাকুরদার সঙ্গে দু-একটা কথা বললেন। তারপর সে দিনের মত তিনি চলে
গেলেন।
 
পরদিন ডাক্তারের ফোন এলো। গোটুর মা তুলল।
ডাক্তার বললেন, "আগামী রবিবার রাতে আমি আসছি।"
গোটুর মা বলে ফেলল, "রাতে ?"
ডাক্তার বললেন, "হ্যাঁ, গোটুর ঠাম্মার আত্মাকে ধরতে মাঝরাতে আমায় থাকতে হবে যে ! তবে একটা কথা, এ ব্যাপারটা গোটুর ঠাকুর দা ও গোটু যেন একেবারেই জানতে না পারে।"
গোটুর মা বলল, "ঠিক আছে।"
এরপর রবিবার রাত এলো। রাত দশটার পরে ডাক্তার বাবু এলেন। গোটু তাঁকে দেখে অবাক হল।
ডাক্তারবাবু তাকে চুপ থাকতে বললেন। তারপর ঘরের সবার রাতের খাওয়া শেষ হল। গোটুর ঠাকুরদা খাওয়া-দাওয়া সেরে নিজের ঘরে ঢুকে গেছেন। বাইরে পূর্ণিমা রাতের চাঁদ উঠেছে মনে হল। সবাই যেন খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। গোটুও ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসলো।  সে স্পষ্ট শুনতে পেল, ঠাকুরদার ঘর থেকে কথার আওয়াজ আসছে। খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো গোটু। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠাকুরদার ঘরের দিকে।
ডাক্তারবাবু চুপিচুপি গোটুর পিছন নিলেন।  গোটু ঠাকুরদার ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে গেল। আর এমনি সময় ডাক্তারবাবু এসে সে দরজা ঠাস করে খুলে দিলেন। ঘটনাটা আচমকাই ঘটে গেল। গোটু চীৎকার দিয়ে উঠলো। আর ঠিক সে সময় তার মা, বাবা তাকে ধরে নিলো। ডাক্তারবাবু ছুটে গেলেন ঠাকুরদার ঘরের ভেতরে। ঠাকুরদা তখন ভয়ে, "কে ? কে ??" বলে চিৎকার দিয়ে উঠল।  
"আপনি কার সঙ্গে কথা বলছিলেন  ?" ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
বেশ কিছু সময় চুপ থেকে ঠাকুর দা মুখ খুলল, "ওই আমার স্ত্রীর সঙ্গে"
দেওয়ালে নিজের স্ত্রীর ফটোটা দেখিয়ে সে বলে উঠল।
"রোজই আপনি এমনি কথা বলেন ?" ডাক্তার প্রশ্ন করলেন।
"না, শুধু পূর্ণিমা রাতে", ঠাকুরদা বললেন।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, "কেন ? এমনটা কেন ?"
"আমার গুরুদেব বলেছেন—ঐ দিন না কি প্রিয়জনের আত্মারা জেগে উঠতে পারে", ঠাকুরদা এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, "আমি যে ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই"
ঘরে স্তব্ধতা নেমে এলো। গোটু, তার মা, বাবা সবাই রয়েছে এখানে। ডাক্তারবাবুর সন্দেহ ঠিক হল। তিনি ঘরের জানালার দিকে তাকালেন। জানালা খোলা, তার পর্দা সরানো, সেখান দিয়ে ধবধবে চাঁদের আলো ঘরে এসে ঢুকেছে। ডাক্তার বাবু গোটুকে কাছে ডাকলেন, বললেন, "এই দেখো, আমি তোমার ঠাম্মার ফটোর সামনে দাঁড়িয়েছি। আর ওই দেখো তোমার ঠাম্মার ছায়া পড়েছে দেওয়ালে।"
গোটু একটু ভয়ে ভয়ে সে দিকে তাকাল, বলল, "সত্যি তো ! কিন্তু এ তো তোমার ছায়া ?"

 
ডাক্তার বললেন, "তোমার ঠাকুরদা  এখানটায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। তুমি যা দেখছ তা ছিল তোমার ঠাকুরদার ছায়া। ঠাকুমার না।"
গোটুর মাথায় তক্ষনি কিছু ঢুকছিল না। তারপর হঠাৎ তার মনে হলহ্যাঁ, তাইত হবে। খানিক ভেবে নিয়ে সে জানালার দিকে তাকাল। সেখান থেকে চাঁদের আলো এসে ডাক্তার আঙ্কলের গায়ে পড়ছে।  আর তাই তার ছায়া এসে পড়ছে সামনের দেওয়ালে। আর ঠিক সেই ছায়া যেখানে শেষ হয়েছে তার ওপরেই দেওয়ালে গোটুর ঠাম্মার বেশ বড় ফটোফ্রেম ঝুলছে।
ডাক্তার বাবু এবার প্রশ্ন করলেন, "এবার বুঝলে তো ? তোমার ঠাম্মাকে তুমি কী ভাবে দেখতে      পেয়েছ ?"
ঘাড় নেড়ে স্বীকার করল গোটু। কিন্তু তবু সে প্রশ্ন করে বসল, "তবে মাঝে মাঝে ঠাম্মার ছায়াটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল কেন ?"
"সেটা তুমি অনেক সময় ধরে তাকিয়ে ছিলে বলে। তোমার মন আর দেখা এক হয়ে ছায়ায় ঠাম্মার চেহারা তৈরি হয়ে ছিল।"
"সেটা কী ভাবে ?" অবাক হয়ে গোটু প্রশ্ন করল।  
"আমরা যা দেখি তা মনের ভেতরের কল্পনা, ধারণা, যুক্তি এসবের সঙ্গে মিলেমিশে মস্তিষ্কে ক্রিয়া করে। আর এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে আমরা অনেক কিছু অলৌকিক ধারণা করে নিই। সে ধারণা গভীর হলে তা মনের অলীক ছায়াছবি হয়ে চোখে ধরা পড়ে। ও সব তুমি এখন বুঝবে না, গোটু।"  
ব্যাপারটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছিল গোটুর কাছে। ধীরে ধীরে মনের মধ্যে থেকে ভয় তার সরে যাচ্ছিল। তবে একটা জিনিস তার মনকে দুঃখ দিচ্ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল যে ঠাকুরদা সত্যিই ঠাকুমাকে খুব ভালোবাসতেন। 

ছবিঃ অঙ্কুশ চক্রবর্তী

তাপস কিরণ রায় অর্থশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কুলে শিক্ষকতা করেন বেশ কিছু বছর। পরে আয়কর বিভাগে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি মধ্য প্রদেশের জবলপুর শহরে বাস করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য লেখা তাঁর অনেকগুলি বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা