সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
(১)

-"না না না! আমি কিছুতেই ন্যাড়া হ'ব না কিছুতেই নাআআআ!"
রাগে দুমদুম করে পা ফেলে শোবার ঘরের দিকে চলে গেল রাণু। আর কচি কচি পায়ের নূপুরজোড়াও সাথে ঝমঝম করে বেজে উঠল। মেয়ের রাগ দেখে যথাসাধ্য কাঁচুমাঁচু মুখেই বসেছিলেন অর্ক আর পল্লবী। কিন্তু ওই দুমদুম-এর সাথে ঝমঝম-এর যুগলবন্দী কানে যেতেই ফিক্ করে হেসে ফেললেন দু'জনেই। আর রাণু ঠিক তখনই মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল। ব্যাস! আরও দ্বিগুণ বেগে দুমদুম-ঝমঝম।

শোওয়ার ঘরের বিছানায় পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে রাণু। ওর সাথেই কেন এমন হয়? সব সময় কিছু না কিছু খারাপ হবেই ওর সাথে। হয়ত নাদুকাকুর দোকানে দিনের পর দিন শোকেসে কোঁকড়াচুলো ডলটা দেখছে, ঘ্যানঘ্যান করে করে যেদিনই বাবাইকে রাজি করাবে, সেদিন বিকেলে দোকান গিয়ে শুনবে,
-"যাহ! রাণুদিদি ডলটা তো সকালেই বিক্রি হয়ে গেল। স্যার আপনি  বরং রাণুদিদিকে এটা কিনে দিন।"
এই বলে ওকে একটা পচা টেডি বেয়ার গছিয়ে দেবে নাদুকাকু, আর বাবাইও বোকার মত সেটা কিনে আনবে।

অবশ্য বাবাইকে যা খুশি বলে যে কেউ ভুলিয়ে দিতে পারে। তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রাণু ছাড়া আর কে? নইলে ওই বিচ্ছিরি স্কুলটায় ভর্তি করায় কখনও? স্কুল তো বলা যায়না ওটাকে, পাঠশালা বলতে হয়।

(২)

রাণুর বাবা উড়িষ্যার বর্ডার ঘেঁষা এই মফস্বল শহরটার সবেধন নীলমণি কলেজটির ইতিহাসের অধ্যাপক। কলেজের অধিকাংশ অধ্যাপকই স্থানীয় নন, হাওড়া কলকাতার ওদিক থেকে এসেছেন। একই পাড়াতে পাশাপাশি সব ভাড়াবাড়িতে সংসার পেতেছেন। তাঁদের যতজনের ছেলেমেয়ে আছে সবাই-ই প্রায় একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। হ্যাঁ, এই মফস্বলে একটা   ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলও আছে। কিন্তু রাণু! ঐ যে ওর কপালটাই খারাপ তাই বাবাই শেষ অব্দি মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল পাঠশালাটাতেই ভর্তি করল ওকে। তার কারণ হ'ল কী? ওই পাঠশালার মাষ্টারমশাইরা বাবাইয়ের খুব ভালো বন্ধু। ওখানে পড়লে রণিতা অনেক কিছু শিখবে, জানবে। মাষ্টারমশাইকাকুরা যত্ন করে শেখাবেন ওকে।

কী শিখবে কী জানবে সে তো ভগবানই জানেন, আপাতত ওই পাঠশালার কৃপায় রণিতা মানে রাণুকে নিজের চুলটাই খোয়াতে হচ্ছে। স্কুলের যত ছাত্রছাত্রী সব গরিব বাড়ির, নিচু জাতের, এমন কী অনেকজন সাঁওতালঘরের ছেলেমেয়েও আছে। তাদের পোশাক-আশাক যেমন বিদ্যে বুদ্ধির বহরও তেমন। প্রায়ই রাণুকে অঙ্ক কষে দিতে বলে ওরা। অথচ রাণুদের পাড়ার অন্য প্রফেসরেদের ছেলেমেয়েরা, মাম্পি, টুপাই, ঋতু, সব কেমন সুন্দর নীল সাদা স্কুলড্রেস পরে ভ্যানগাড়িতে চেপে স্কুলে যায়। আর রাণুকে যেতে হয় ওর পাঠশালারই মাষ্টারমশাইয়ের সাইকেলের কেরিয়ারে চেপে। রাণুর জন্য এটাও বাবাইয়ের স্পেশাল বন্দোবস্ত। রাণুর পাড়ার সব বন্ধুরা হাসাহাসি করে।

(৩)

কিন্তু এই বড়দের দুনিয়ায় ছোটোদের কথা কেই বা কবে শুনেছে! অগত্যা, এই রবিবারের সকালবেলায় বাবাইয়ের ছুটির দিনেও, সব হইহুল্লোড়, ভালোমন্দ খাওয়ারের হাতছানি, সমস্ত বিসর্জন দিয়ে রাণুকে যেতে হবে তারককাকুর সেলুনে। কী নিষ্ঠুর মানুষ সবাই। মা আবার রাণুর চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে চিবুক ধরে বলল,
-"সোনা মা আমার, লক্ষ্মী মা আমার। আর তো কোনও উপায় নেই বল মা? তোর হয়েছে, এবার তোর থেকে আমার হবে, বাবাইয়ের হবে। আমরা তো বড় মানুষ, আমরা তো চাইলেই ঝপ করে নেড়ু হ'তে পারব না তোর ম'ত তাই না? লোকে কী বলবে!"

-"আর আমায় বুঝি কিছু বলবে না সবাই। আজ বিকেলে নাচের স্কুলে গেলেই তো মাম্পি ঋতু সব্বাই আমাকে 'ন্যাড়া ন্যাড়া' বলে রাগাবে। তার বেলা? আমি কিছুতেই নাচের স্কুল যাবনা যতদিন না আমার ফের চুল হচ্ছে।"

-"আচ্ছা ঠিক আছে সে নয় যেতে হবে না আজ নাচের স্কুলে। এখন তো বাবাই এর সাথে সেলুনে যা। আজ না গেলে আবার সারা সপ্তাহ বাবার সময় হবে না।"

গজগজ করতে করতে, ভিজে চোখে বাবাইয়ের হাত ধরে শেষ অব্দি তারককাকুর 'মডার্ণ হেয়ার কাটিং সেলুন'-এর চেয়ারে গিয়ে বসে রাণু। চেয়ারে তো ঠিক নয়, চেয়ারের ওপর একটা জলচৌকি রেখে তার ওপর বসানো হয় রাণুকে, একটা ফুটোওয়ালা সবুজ কাপড় মাথা দিয়ে গলিয়ে পরিয়ে দেয় তারককাকু। ঘাড় তুলে আয়নার ভেতর দিয়ে বাবাইকে দেখে রাণু, কেমন নিশ্চিন্ত হয়ে খবরের কাগজ মুখে দিয়ে পেছনের বেঞ্চে বসে রয়েছে! ততক্ষণে ওর মাথায় কচ কচাৎ, শন শনাৎ, সররর সররর, করে  ক্ষুর আর কাঁচির যুগপৎ নৃত্য শুরু হয়ে গেছে। অনন্তকাল ধরে এই নির্মম অত্যাচারের পর আয়নার দিকে চোখ তুলে চায় রাণু। সবুজ কাপড়ের ভেতর দিয়ে ওটা কার মুণ্ডু বেরিয়ে! গোল একটা ছোটো ফুটবলের মত। চোখ ফেটে কান্না আসে রাণুর, দোকানে এত লোকের মাঝে সেটাও শান্তিতে করতে পারে না। বাবাইয়ের দিকে চোখ যায়, খবরের কাগজটা সরিয়ে রাণুকেই দেখছে। ও কী! ও কী! বাবাইয়ের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি!
নাহ্ রাণুকে কেউ ভালোবাসে না, মা-ও না, বাবাই-ও না। সবাই নিজের নিজের মাথা বাঁচাতেই ব্যস্ত।

(৪)

যা আশঙ্কা করছিল সেটাই সত্যি হ'ল। সকালে এই চরম অবিচারের পরেও সামান্য একটা ক্যাডবেরি ঘুষ দিয়ে মা রাণুকে জোর করে নাচের স্কুলে নিয়ে গেল।
ইসস্ কী লজ্জা! কী লজ্জা!
সবক'টা বন্ধু মিলে কী পেছনেই না লাগল রাণুর।
-"এ মা রণিতা তোর পাঠশালায় ভর্তি হ'লে বুঝি ন্যাড়া হ'তে হয়?", বলে ওঠে মাম্পি।

ঋতুও ওমনি বলে,
-"এ বাবা মাম্পি তুই জানিস না? রাণুর তো মাথায় উকুন হয়েছিল। ওদের পাঠশালার সব ছেলেমেয়েদের দেখিস না কেমন উলো ঝুলো জামাকাপড়, চুলে শ্যাম্পু করেনা রোজ। ওদের মাথায় তো রাজ্যের উকুন। রাণুকে তাই থেকে গোটাকয় গিফট দিয়েছে!"

আঁতকে উঠে বলে মাম্পি,
-"এএএ মাআআআ! রাণু তুই একদম আমাদের সাথে মিশবি না, খেলবি না। তাহ'লে আমাদেরও মাথায় ওই বিশ্রি উকুন হবে, তখন ন্যাড়ামুণ্ডু হতে হবে তোর ম'ত। ম্যা গো!"

ঋতু হেসে বলে,
-"একটা পরচুলা কেন রাণু! নেড়ুমাথায় নাচলে স্টেজে লোকে হাসবে তো!"

রাণুর মনটা বড্ড খারাপ লাগে। মনে মনে অনেক কিছু ভাবলেও, বরাবরই মা বাবাইয়ের কাছে কোনও কিছু নালিশ করে উঠতে পারে না রাণু। খুব কষ্ট লাগছে, রাগের থেকে বেশি কান্না পাচ্ছে। কোনওমতে নাচের ক্লাসটা শেষ হ'তে না হ'তেই ছুটে বাইরের বারান্দায় আসে। মা আর অন্য কাকিমারা সব গল্প করছিল ওখানে বসে। রাণু মায়ের হাত ধরে টুকটুক করে রিকশায় এসে ওঠে। মনটা এত খারাপ ছিল যে ও লক্ষ্যই করেনি,  তারা আর ফুলকি নাচের দিদিমণির ক্লাসরুমের জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল।

তারা আর ফুলকি রাণুর ক্লাসেই পড়ে, পাঠশালায়। ওদের মা রাণুর নাচের দিদিমণির বাড়িতে রান্নার কাজ করে। মাঝে মাঝে তারা আর ফুলকিও ওদের মায়ের সাথে আসে। যে ঘরে দিদিমণি নাচ শেখায়, তার জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে রাণুদের নাচ প্র্যাকটিস দেখে। কোনও কোনও দিন রাণু একটা দুটো কথা বলে ওদের সাথে। পাঠশালাতেও ওরা বাকিদের বলে,
-"জানিস তো সোবাই! রাণু না কী সুন্দোর লাচে ! টি. ভি. তে সব বই হয়নি? তার হিরোইনের ম'ত লাগে পুরা।"
রাণুর মন্দ লাগে না ওদের এই সরল প্রশংসাগুলো। ক্লাসের সকলের চেয়ে ও যেহেতু অনেক 'বড়' বাড়ির মেয়ে তাই ওকে খুব সম্মান করে চলে সবাই।

কিন্তু আজ আর ফুলকি আর তারাকে খেয়ালই করল না রাণু।

(৫)

সোমবার সকালে ভীষণ রকম তিক্ত মেজাজ নিয়ে মাষ্টারমশাইকাকুর সাইকেলের কেরিয়ারে বসল রাণু। জানে, 'স্কুলে যাবনা' বলে কোনও লাভ হবে না। আজ না হ'লে কাল, যেতে তো হবেই। সারা রাস্তা মাষ্টারমশাইকাকু কত কী বলার চেষ্টা করলেন রাণুকে, একটা হাঁদাভোঁদার বইও দিলেন। রাণু 'হুঁ' 'হাঁ' ছাড়া বিশেষ উত্তর করল না। পিচঢালা রাস্তা ছেড়ে ডাঁয়ে মোরাম বিছানো রাস্তা ধরে খানিকটা গেলেই রাণুদের স্কুল। ইউক্যালিপটাস, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া গাছ দিয়ে ঘেরা গোটা পাঁচ-ছয়েক মাটির ঘর, খড়ের ছাউনি, এটাই ওদের স্কুল... মানে পাঠশালা। সামনের মাঠে একটা টিউবওয়েল, তেষ্টা ওখানেই মেটে, আর একটু দূরে একটা বাথরুমঘর। আগে নাকি সেটাও ছিল না, মাঠেই যেতে হ'ত ছেলে মেয়ে মাষ্টারমশাই সকলকে। মিড-ডে মিলের রান্নাবান্না এখানে হয় না, বদলে চাল দিয়ে দেওয়া হয়। মফস্বল থেকেও প্রায় মাইল দুয়েক দূরে প্রত্যন্ত গ্রামে এই পাঠশালা, ছাত্র ছাত্রীরা দরিদ্র নিম্নবর্ণ, রাণুর মত ছাত্রী মনে হয় এই প্রথম এখানে।

নিজের ক্লাসরুমে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে গেল রাণু। সারা ক্লাসের সব ছেলেমেয়ের মাথা ন্যাড়া। কেউ কেউ মনে হচ্ছে নিজে হাতেই খাবলে খুবলে চুল কেটে যতটা ন্যাড়া হওয়া যায় চেষ্টা চালিয়েছে। রাণু হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না।
সামনের বেঞ্চে ন্যাড়ামুণ্ডু তারা আর ফুলকি বসে, একগাল হেসে ওরা রাণুকে বসতে ডাকে,
-"রাণু শুন শুন, আয় এধারে। দ্যাখ, আমরাও ন্যাড়া হইছি। তাইলে তোর আর উকুনও হবেনি, আর মনও খারাপ করবেনি।"

কাল সারাদিনের মন খারাপটা একটু করে যেন ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। রাণু অবাক চোখে 'বন্ধু'দের দেখে, তারপর এগিয়ে গিয়ে ওদের মাঝে বসে।

ছবিঃ শাশ্বত ও সুশ্রুত

একটি আড়াই বছরের সন্তানের জননী। স্বামীর কর্মসূত্রে বর্তমানে আমেরিকায় থাকেন, দেশের ঠিকানা হাওড়া। বছর তিন আগে কলকাতার সাহা ইনস্টিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেছেন। শিশু-কিশোর সাহিত্য পড়তে ও লিখতে ভালবাসেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা