(ছোটদের জন্য নাটক, তবে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যে ছোট হতেই হবে এমন কোন কথা নেই, শুধু ছোটরা, শুধু বড়রা, ছোট বড় মিলিয়েও করা যায়। গান হিসেবে যেগুলো লেখা আছে, সেগুলো ছড়ার মত করেও বলা যায়।সূত্রধার ১ ও সূত্রধার ২-এর নামে সংলাপ লেখা হয়েছে – কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশী সূত্রধার থাকলেও ক্ষতি নেই – কথা ভাগাভাগি করে নিলেই হল। আবার লোক কম পড়লে সূত্রধার দু'জনই বাবা, মা, হীরুকাকু এই পার্টগুলো করে ফেলতে পারে। স্টেজে সকলে সবসময় থাকতে পারে – তাই নেহাত দরকার ছাড়া চরিত্রদের ঢোকা-বেরোনোর কথা কোথাও দেওয়া হয় নি। সিন চেঞ্জ-ও সেভাবে নেই - মোটকথা, সব রকম দরজা খোলা আছে, যারা নাটক করবে, তারা গল্প/কথা খুব ওলট-পালট না করেও নিজেদের মত যেন সাজিয়ে নিতে পারে।)
ওই কার খাড়া নাক
চুরুটের ধোঁয়া কার
ঘন হয়ে উঠছে?
সাহারায়, লন্ডনে
হিমালয় পাহাড়ে
মগজের রেলগাড়ি
ঝিকঝিক ছুটছে!
চটপটে ঝকঝকে
বুদ্ধিতে থইথই
যাদের গল্প নিয়ে
ফুরোয় না হইচই -
সূত্রধার ১- বলত কারা তারা???
কোরাস- ডিটেকটিভ/শার্লক/ফেলুদা ইত্যাদি।
সূত্রধার ২- ঠিক, ঠিক!
তাদের মতন হতে
ইচ্ছে আমার খুব
রহস্য খুঁজি আর
দেই তাতে এক ডুব!
সূত্রধার ১- ফেলুদা -
কোরাস- তোপসে!
সূত্রধার ২- কাকাবাবু –
কোরাস- সন্তু!
সূত্রধার ১- ব্যোমকেশ –
কোরাস- অজিত!
সূত্রধার ২- শার্লক
কোরাস- ওয়াটসন!
সূত্রধার ১- টিনটিন
কোরাস- ক্যাপ্টেন!
সূত্রধার ২- বুঝতেই পারছ, ডিটেকটিভ-ই বলো, কঠিন করে ‘সত্যান্বেষী'ই বল, বা অ্যাডভেঞ্চারার, এইসব সেরা সেরা লোকেদের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট, বা একজন এমন বন্ধু থাকতেই হবে, যাকে ছাড়া চলে না।
সূত্রধার ১- আর এইখানেই ফুলকলির সমস্যা। আসলে ফুলকলির জীবনে এখন দুটো প্রধান সমস্যা।
সূত্রধার ২- এক নম্বর সমস্যা, নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর খেলার মাঠের নতুন বন্ধুরা সবাই তার ডাকনামটা জেনে গেছে। কারণ একদিন সে নিচে যখন খেলছিল, তখন মাসিমনি এসেছিল আর সঙ্গে ফুলকলির ফেভারিট শিঙাড়া এনেছিল।
সূত্রধার ১- তাই মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে ফুলকলিইইইই... ফুলকলিইইইই... বলে ডাকছিল। তারপর থেকে বাকি খেলুড়েরা তাকে প্রায়ই ফুলকপিইই আর ফুলকো লুচিইইই বলে ডাকছে।
সূত্রধার ২- ফুলকলি ঠিক তোমার সেই বন্ধুটার মত, সেই যে গো, যাকে একটু রাগালেই চোখে জল এসে যায় –
সূত্রধার ১- কিন্তু নতুন বন্ধুরা তো সেটা জানে না এখনো... তাই, এইটা একটা বড় সমস্যা!
সূত্রধার ২- দু নম্বর সমস্যা এই, যে ফুলকলির কোন অ্যাসিস্ট্যান্ট নেই।
সূত্রধার ১- ফুলকলি তো ঠিক করেই নিয়েছে, যে সে ডিটেকটিভ হবে, কিন্তু অ্যাসিস্ট্যান্ট ছাড়া কি ডিটেকটিভ হয়!
সূত্রধার ২- ডিটেকটিভ হওয়ার জন্য কি কি করেছে ফুলকলি? চল তো জিজ্ঞেস করি!
সকলে- ফুলকলিইই –
ফুলকলি- আমি সব কটা ফেলুদার বই, সবকটা টিনটিনের বই, সব কটা কাকাবাবুর বই পড়ে ফেলেছি। শার্লকের গল্প দাদা শুনিয়েছে। ব্যোমকেশের গল্প মা শুনিয়েছে। আমি সব অ্যাডভেঞ্চারের কথা জানি!
সকলে- আর আর?
ফুলকলি- আমি সাঁতার শিখি – যদি কোন দ্বীপে সাঁতরে পৌঁছোতে হয়, আমি পারব! আর ক্যারাটেও শিখি। গরগনজোলা কে ঠাঁই ঠাঁই করে মারব। আমার অনেক সাহস!
সকলে- আর?
ফুলকলি- আমার ভিজিটিং কার্ড-ও আছে!
সকলে- সত্যি! কি করে?
ফুলকলি- আমি মা-কে বললাম – মা, আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হচ্ছি, আমায় ভিজিটিং কার্ড ছেপে দাও!
মা- অত ছোটদের যে কার্ড ছেপে দেওয়া হয় না?
ফুলকলি- তাহলে কি হবে?
মা- হুমম... কি করা যায়?
সকলে- কি করা যায়?
মা- এক কাজ কর, আমার আর বাবার কার্ড গুলোর এক পিঠ তো ফাঁকা, ওইদিকে ছাপার মত সুন্দর হাতের লেখা করে লিখে ফেল। কী লিখবে?
সূত্রধার ১- মিস ফুলকলি –
ফুলকলি- না না! মিস দীপশিখা দাস।
সূত্রধার ২- প্রাইভেট ডিটেকটিভ
ফুলকলি- প্রাইভেট ডিটেকটিভ-
মা- বানানটা দেখে নিও কিন্তু!
ফুলকলি- হ্যাঁ হ্যাঁ –
সূত্রধার ১- অ্যাড্রেস!
সূত্রধার ২- ফোন নাম্বার!
ফুলকলি- মা'র ফোন নাম্বার!
সূত্রধার ১- ব্যাস! কার্ড তৈরি!
সূত্রধার ২- আরও আছে –
ফুলকলি- কোট!
সূত্রধার ১- দাদা যখন ছোট ছিল, ফুলকলি যখন ছিল না, তখন বাবা আর মা আর দাদা কাশ্মীর বলে একটা জায়গায় বেড়াতে গেছিল আর দাদার জন্য এই কোটটা এনেছিল। এমনই খারাপ, যে ফুলকলির জন্য কিছুই আনে নি। তাই এই কোটটা ফুলকলি নিয়ে রেখেছে!
ফুলকলি- কেমন ডিটেকটিভের মতন দেখতে না, বল?
সূত্রধার ১- বাইনোকুলার!
ফুলকলি- সত্যিকারের, দাদু এটা দিয়ে পাখি দেখত।
সূত্রধার ২- পিঠের ব্যাগ!
ফুলকলি- দাদার পুরনো স্কুল-ব্যাগটা নিয়েছি। এতে আছে ঝুরিভাজা, চিঁড়ে-ভাজা, বিস্কুট, জলের বোতল আর জলজিরা আর তোয়ালে – দূরে যেতে হলে কাজে লাগবে।
সূত্রধার ২- সাইড ব্যাগ!
ফুলকলি- এইটা আমায় মাসিমনি দিয়েছে।
সূত্রধার ১- এতে থাকবে ভিজিটিং কার্ড, সমস্ত তথ্য প্রমাণ আর আরও অনেক কিছু গোপন জিনিস, সব তো আর তোমাদের বলা যাবে না-
সূত্রধার ১- তাহলে, প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিস দীপশিখা দাস রেডি তো?
ফুলকলি- কই আর রেডি? অ্যাসিস্ট্যান্ট-ই তো নেই!
সকলে- সত্যিই তো!
সূত্রধার ২- বাবা বলেছে-
বাবা- লেগে পর ফুলকলি, দেরি করিস না! অ্যাসিস্ট্যান্ট শুরুর দিকে নাই থাকতে পারে, সে জন্য রহস্যের সমাধান তো বন্ধ থাকবে না।
সূত্রধার ১- কীন্তু...
কোরাস-
ক্যাপ্টেন ছাড়া নেই মার্লিনস্পাইক
গল্প কোথায় যদি নাই লেখে তোপসে?
ওয়াটসন, অজিত আর সন্তুর জন্য
আমাদের মন তাই খচখচ করছে।
(ফুলকলি এসে পার্কের বেঞ্চে বসে, একটা কুকুর এসে তার আশেপাশে ঘোরে – তার নাম ভুলিয়া। ফুলকলি তাকে বিস্কুট খাওয়ায়)
সূত্রধার ২- ফুলকলি তো আগে কলকাতায় থাকত, এখন তারা থাকতে এসেছে হলদিয়া বলে একটা জায়গায়। এখানে নতুন পাড়া, নতুন স্কুল। ফুলকলি আবার স্কুলে যেতে তেমন ভালোবাসে না।
ফুলকলি- তোদের পাড়াটা যে কী পচা ভুলিয়া। এখানে কেউ চারটের আগে খেলতে আসে না। আমরা তিনটে থেকে খেলতাম!
ভুলিয়া- ভৌ!
ফুলকলি- আর খালি চিকলেট খেলে। আর কুমির ডাঙ্গা খেলে। বিচ্ছিরি।
ভুলিয়া- ভৌ ভৌ!
সূত্রধার ২- ফুলকলির ফেভারিট খেলা হল বেড়ানো বেড়ানো খেলা – সেটা এখানে কেউ খেলতে রাজিই হয় না। তাই এখনো বেশী বন্ধুবান্ধব হয় নি তার।
সূত্রধার ১- এদিকে দাদা কীন্তু রোজ বিকেলে ক্রিকেট খেলতে ছুটছে। তাই দাদার অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার সময় নেই। এখন কোথায় অ্যাসিস্ট্যান্ট পাওয়া যায়?এইসব আকাশ পাতাল ভাবছে ফুলকলি, এমন সময়-
(ফুলকলির পাশে এসে বসে একজন লোক – তার ধবধবে সাদা চুল আর গোঁফ, পরনে কালো কোট, কালো প্যান্ট, চোখে কালো চশমা, হাতে কালো অ্যাটাচি কেস। লোকটা বাঁ পকেট থেকে রুমাল বার করে ঝেড়েঝুড়ে আবার ডান পকেটের ঢুকিয়ে রাখল। একটা চিরুনি বার করে গোঁফটা একটু আঁচরে নিল। তারপর পকেট থেকে একটা ফোন বার করে, তাতে ডায়াল করল।)
লোক- হ্যাঁ! হ্যালো? সব ঠিকঠাক তো? কাঁদছে? হুম্মম। আচ্ছা। আমি একটু পরে আবার খবর নেব।
(চিন্তায় পরে গেল)
সুত্রধার ২- বুঝতেই পারছ, ফুলকলির মন সন্দেহে ভরে উঠেছে। ভালো লোকেরা যে কখনো কালো জামা কালো প্যান্ট, কালো চশমা, কালো অ্যাটাচি নিয়ে ঘোরে না, এ কথা কে না জানে? তারপর আবার বাঁ পকেট থেকে রুমাল বার করে ডান পকেটে রাখা- এটা নিশ্চয়ই কোন সিগন্যাল!
সূত্রধার ১- ফুলকলি স্পষ্ট বুঝতে পারল যে লোকটা ছেলেধরা। ফোনে যার সাথে কথা বলল, সে ওর শাগরেদ, তার কাছে রেখে এসেছে যে বাচ্চাটাকে চুরি করে, সেই কাঁদছে। সেইজন্যই লোকটা এখন চিন্তায় পরে গেছে, ওর অ্যাটাচি ভর্তি বন্দুক, টাকা, চোরাই জিনিসপত্র আর যাদের ধরবে, সেই বাচ্চাদের ছবি।
(লোকটা গলা খাঁকারি দেয়, সবাই চমকে ওঠে।) লোক- তুমি কী এই কমপ্লেক্স-এ থাকো নাকী খুকী? ফুলকলি- (ভয়ভয়) কেন? লোক- স্কুলে যাও নি? ফুলকলি- না- লোক- তুমি চকোলেট ভালোবাসো তো? এই নাও! (ফুলকলি হাত বাড়িয়ে চকোলেট নেয়) লোক- দেখা হবে, বাই বাই! সি ইউ!
(লোকটা উঠে চলে যায়, ফুলকলি চকলেটের কাগজ ছাড়িয়ে গন্ধ শুঁকে, পাশে ফেলে দেয়।)
ফুলকলি- অচেনা লোকের দেওয়া চকোলেট খেতে নেই, জানো তো? তার উপর এ ছেলেধরা। ওই চকোলেটে ঘুমের ওষুধ মেশানো আছে।
(এদিক ওদিক দেখে, এই সময় ভুলিয়া চকোলেটটা খেয়ে নেয় এবং আরাম করে শুয়ে ঘুমিয়ে পরে-)
ও তো গেটের দিকে যায় নি, মানে এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে, আমি চকোলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেই ধরে নিয়ে যেত। আমি... এই লোকটাকে ফলো করি। (ফুলকলি বাইনোকুলার বের করে গলায় পরে নেয়)
সূত্রধার ১- ও কোথায় থাকে আগে খুঁজে বার করতে হবে।
সূত্রধার ২- তারপর প্রমাণ করতে হবে যে ও ছেলেধরা। নইলে পুলিশ তো বিশ্বাস করবে না –
ফুলকলি- ঠিক! আচ্ছা – আমি চকোলেটটা বরং তুলে রাখি – ওটা ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করলেই বোঝা যাবে যে ওর মধ্যে ঘুমের ওষুধ- (বলতে বলতে ফিরে দেখে ভুলিয়া ঘুমাচ্ছে, আর চকোলেট নেই। ফুলকলি চেঁচিয়ে ওঠে-)
ভুলিয়া!
(ভুলিয়া নড়ে না। একটা ছেলে ঢোকে। ফুলকলিরই বয়সী।)
ও ভুলিয়া!
ছেলে- অ্যাই!
ফুলকলি- জল আনো, জল –
ছেলে- কেন?
ফুলকলি- ভুলিয়ার মাথায় জল দিতে হবে, ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে -
ছেলে- ধুর পাগল – ভুলিয়া ভীষণ হাবলা। ও তো সব সময় ঘুমায়। ডাকলেও ওঠে না।
ফুলকলি- হতেই পারে না। কুকুরের ঘুম খুব পাতলা হয়। শব্দ শুনলেই উঠে পড়ে।
ছেলে- আরে ভুলিয়া ওরম কুকুর নয়- ও অন্যরকম। ভীষণ অলস-
ফুলকলি- তুমি ঠিক জানো?
ছেলে- তুমি আজও স্কুলে যাও নি কেন? উইন্টার ভ্যাকেশানের আগেরদিন কেউ স্কুল মিস করে? মিস খুব রাগ করছিল-
ফুলকলি- আমার পেটে ব্যথা ছিল।
ছেলে- তাই জন্য বুঝি চকোলেট খাচ্ছ?
ফুলকলি- আমি চকোলেট খাচ্ছি না। কেস সল্ভ করছি। ছেলে- কেস?
(ফুলকলি ব্যাগ থেকে কার্ড বার করে ছেলেটাকে দেয়)
ছেলে- প্রাইভে-ট ডিটেক্টি-ভ মিস দীপশিখা দাস!?
সুত্রধার- এই ছেলেটার নাম নাসির। ফুলকলি আগে দেখেছে। ওদের ক্লাসেই পড়ে।
ফুলকলি- তুমি কি এইখানে থাকো?
নাসির- এই তো- এইখানে-
ফুলকলি- তুমি তো খেলতে আসো না?
নাসির- আমার খেলতে ভালো লাগে না। আমি গল্পের বই পড়ি। ওই দেখ, ভুলিয়া আবার জেগে গেছে।
ফুলকলি- যাক বাবা! (ভুলিয়া-কে আদর করে) কিন্তু লোকটা কোথায় গেল দেখতে তো পেলাম না-
নাসির- কে লোক?
ফুলকলি- (একটু চুপ করে ভাবে একে বিশ্বাস করা যায় কিনা – তারপর বলে) একটা ছেলেধরা!
নাসির- ছেলেধরা! কোথায়? তুমি জানলে কী করে?
সূত্রধার ১- ফুলকলি তাড়াতাড়ি বুঝিয়ে বলে, ছেলেধরার পকেট থেকে কেমন বেঁটে বন্দুক উঁকি দিচ্ছিল।
সূত্রধার ২- আর তার ব্রিফকেসের মধ্যে থেকে কেমন সন্দেহজনক শব্দ আসছিল।
নাসির- কিন্তু অচেনা লোককে তো হীরু কাকু ঢুকতেই দেবে না –
ফুলকলি- হীরুকাকু?
নাসির- হীরুকাকু রে, যে পাহারা দেয়! চেনা কারোর নাম না বললে বাইরের লোককে ঢুকতে দেয় না তো!
ফুলকলি- একটা চেনা লোকের নাম বার করা আর এমন কী ব্যাপার?
নাসির- হীরুকাকু নিশ্চয়ই কিছু না কিছু খবর দিতে পারবে।
ফুলকলি- হীরুকাকু নিশ্চয়ই ঘুমচ্ছিল। তখন লোকটা চুপিচুপি ঢুকে পড়েছে- ভুলিয়া এই চকলেটের র্যাপারটা শুঁকে শুঁকে বার করে দেবে। (ভুলিয়ার নাকের সামনে কাগজ ধরে, ভুলিয়া কাগজটা চেটে দেয়।)
গো ভুলিয়া, গো- (ভুলিয়ার কোথাও যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই)
দূর বাবা! সত্যি হাবলা ভুলিয়াটা-
(ফুলকলি র্যাপারটা মুছে যত্ন করে ব্যাগে তুলে রাখে। তারপর ব্যাগটা বেঞ্চে নামিয়ে রাখে)
নাসির- একবার হীরু কাকুকে জিজ্ঞেস করে দেখি চল।
ফুলকলি- আচ্ছা বেশ।হীরু কাকু!
হীরু- কী হয়েছে? চ্যাঁচাচ্ছ কেন?
নাসির- হীরু কাকু, তুমি যখন ঘুমাচ্ছিলে তখন একটা কালো জামা পড়া লোক চুপিচুপি ঢুকে পরেছে, জানো?
হীরু- আঁহাঁহাঁ! কে বলে আমি ঘুমুচ্ছিলুম!?
নাসির- ঘুমাচ্ছিলে না, তাহলে লোকটাকে ঢুকতে দিলে কেন?
হীরু- কোন লোক বা?
ফুলকলি- কালো কোট, কালো প্যান্ট, কালো চশমা পরা। সাদা চুল, সাদা গোঁফ।
হীরু- ওহো! উনি তো জানা-বাবু!
নাসির- তোমার চেনা?
হীরু- আরে না না, টাইটেল আছে জানা। নতুন এসেছে – ফ্ল্যাট বি থ্রি – চারতলায়-
নাসির- ওই ফ্ল্যাট-টা!
ফুলকলি- সঙ্গে বুঝি অনেক বড় বড় বাক্স এনেছিল-
হীরু- হাঁ, তা বা এনেছিল। শিফটিং-এর সময় বাক্স আনবে না! অনেক ভারিভারি – তুলতে জান বেরিয়ে গেল-
(নাসির আর ফুলকলি মুখ চাওয়াচাওয়ি করে)
কেন? তোমাদের জানা-বাবুর সাথে কী বা দরকার?
ফুলকলি- থ্যাঙ্ক ইউ হীরু কাকু।
(দুজনে ছুট লাগায়, ফুলকলির ব্যাগটা কীন্তু নেওয়া হয় না।)
হীরু- আরে শুনো! আরে আরে শুনো!
(দূরে গিয়ে)
ফুলকলি- মানে এ জানাবাবু নাম নিয়ে এইখানেই থাকতে এসেছে, ছদ্মবেশে।
নাসির- ওই ভারি ভারি বাক্সগুলোয় কী আছে?
ফুলকলি- তাই তো আমি ভাবছি – নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কীছু-
নাসির- আচ্ছা, ও কোন বাচ্চাকে এই ফ্ল্যাটে আটকে রাখে নি তো?
ফুলকলি- হতেই পারে। আমাদের ওর ফ্ল্যাটের উপর নজর রেখে ব্যাপারটা বুঝতে হবে আগে।
নাসির- কী করে নজর রাখব!
ফুলকলি- থ্রি বি-র চারতলার ফ্ল্যাট মানে আমাদের ফ্ল্যাটের থেকে দেখা যাবে – আমাদের ওই বিল্ডিংটা
নাসির- ওখান থেকে দেখা যাবে কী করে? দূর তো! মাঝখানে তো মাঠ!
ফুলকলি- আমার যে সত্যিকারের বাইনোকুলার আছে!
(দুজনে আবার ছুট লাগায়)
সূত্রধার ১- ছুটছুটছুট দিয়ে দুজন মিলে ফুলকলিদের ফ্ল্যাটে। অবশ্য নাসির একবার নিজের বাড়িতে বলে গেল-
সূত্রধার- আগে তো সে কখনো ফুলকলির বাড়ি যায় নি, মা-বাবা শুধু শুধু চিন্তা করবে-
সূত্রধার- মাঠের দিকের বারান্দায় বসে, দু'জনে বাইনোকুলার তাক করল জানা-বাবুর ফ্ল্যাটের দিকে।
সূত্রধার ২- ওয়াচ করতে বসলে তো বারবার ওঠা মুস্কীল, তাই ঝুরিভাজা, বিস্কুট, চিঁড়ে ভাজা, জলের বোতল, জলজিরা এইসব ভর্তি ফুলকলির পিঠের ব্যাগটাও নেওয়া হল।
সুত্রধার- দূরবীনটা সত্যিকারের হলেও, পুরনো তো, কাঁচটা ঘষা মতন হয়ে গেছে – খুব বেশী দেখা যাচ্ছে না-
সূত্রধার ১- একঘন্টা, দু'ঘন্টা কেটে গেল। শীতের বেলা, একটু অন্ধকার হতেই থ্রিবি-র চারতলায়, জানা-বাবুর ফ্ল্যাটে আলোটা স্পষ্ট দেখা গেল। তাতে জানা-বাবু ছাড়াও কারা যেন সব নড়ছে চড়ছে, কখনো মনে হল শুধু ছেলেধরা নয়, জানাবাবুর হয়ত পেঙ্গুইনের-ও ব্যাবসা আছে-
নাসির- পেঙ্গুইন-রা তো এন্ডেঞ্জারড স্পিশিস, ওদের হয়ত বে-আইনি ভাবে ধরে আনে।
ফুলকলি- কীন্তু পেঙ্গুইন রাখতে তো বরফ লাগবে-
নাসির- ওই ভারি ভারি বাকশে হয়ত বরফ ছিল-
ফুলকলি- হতে পারে – শীতকাল তো, তাই আস্তে আস্তে গলছে। তাহলে হয়ত স্নো লেপার্ড-ও আছে-
নাসির- থাকতেই পারে-
ফুলকলি- বুঝতে পেরেছি! ফোনে যে বলছিল কাঁদছে, সে হয়ত স্নো-লেপার্ডের বাচ্চা-
নাসির- নিশ্চয়ই তাই!
সূত্রধার- রহস্য আরও সাংঘাতিক হয়ে উঠছে – একসময় যেন মনে হল ওই ফ্ল্যাট থেকে কেউ বেরিয়ে গেল –আলোও বন্ধ হয়ে গেল। সাড়ে পাঁচটার কার্টুন শুরু হয়ে গেল, ফুলকলি আর নাসির তবু ঠায় বসে রইল, যদি আর কিছু দেখা যায়!
মা- ফুলকলিইইইইই!
ফুলকলি- হ্যাঁ মা!
মা- আর বারান্দায় বসে ঠাণ্ডা লাগিও না- তোমার বন্ধুকে নিয়ে এদিকে এস, দেখ কে এসেছেন-
ফুলকলি- আমরা ওয়াচ করছি মা-
বাবা- আচ্ছা আবার পরে করবে, এখন এদিকে এস তো!
সূত্রধার- ইচ্ছে তো নেই, তবু নাসির আর ফুলকলি ওঠে। আর বসার ঘরে গিয়ে দেখে...
জানা-বাবু- কী? মিস দীপশিখা দাস?
ফুলকলি- ছেলেধরা! ছেলেধরা!
(জানাবাবু দুহাত তুলে হ্যান্ডস আপ করেন)
বাবা- ও আবার কী কথা! আপনি আবার কী করছেন!
জানাবাবু- তুমি বরং আমায় একটু জেরা করে নাও, তাহলে আর দূরবীন নিয়ে বারান্দায় বসে থাকতে হবে না!
মা- ছিছি, দূরবীন দিয়ে কী আপনাকেই ওয়াচ করছিল নাকী!
ফুলকলি- তুমি কে? তুমি আমার নাম জানলে কী করে?
বাবা- আরে, উনি আমার বহুদিনের চেনা। আমার মত ওনারও এইখানে বদলি হয়েছে-
নাসির- তবে স্নো লেপার্ড-
বাবা- কী বলছ?
ফুলকলি- ছেলেধরা না হলে ফোনে কে কাঁদছিল?
মা- কে আবার কাঁদছিল?
জানাবাবু- আমি যখন তোমার পাশে পার্কে বসেছিলাম, তখন ফোনে আমার বাড়িতে কথা বলছিলাম – যে কাঁদছিল, সে আমার নাতনি। তোমার থেকেও ছোট!
বাবা- ডিটেকটিভ ডিটেকটিভ করে মাথাটা গেছে মেয়েটার!
নাসির- আর তোমার বাক্সে কী ছিল? বরফ নয়?
মা- বরফ?
ফুলকলি- শীতকাল তো, তাই আস্তে আস্তে গলছে।
জানাবাবু- অত আস্তেও গলে না- অত বরফ থাকলে এতক্ষনে ঘর ভেসে যেত। আমার বাক্সে বই-খাতা ছিল, তাই ভারি।
মা- উনি কলেজে পড়ান।
ফুলকলি- তুমি জানলে কী করে আমরা তোমায় ওয়াচ করছি?
জানাবাবু- আসতেই তোমার বাবা মা বললেন – আর আমি দুইয়ে দুইয়ে চার করলাম-
নাসির- আরেকটা দুই কী?
জানাবাবু- এইটা! (হাতে ফুলকলির সাইড ব্যাগ!) এর মধ্যেই তোমার কার্ড পেলাম। ব্যাগটা এদিক ওদিক ফেলে এলে চলবে মিস ডিটেকটিভ! কেয়ারফুল হতে হবে না!
(ফুলকলি ছুট্টে বেড়িয়ে যায়)
সকলে- ফুলকলি- আরে ফুলকলি-
সূত্রধার- প্রথমে কী বলেছিলাম মনে আছে, কেউ একটু কীছু বললেই ফুলকলি- না, না, তা বলে আর কারো সামনে কাঁদে না-
কোরাস- এ বাবা! এই? এটা কী বাজে গল্প! সত্যিকারের রহস্য নেই, আর ফুলকলিও কান্নাকাটি করছে।
সূত্রধার- ব্যাস, ব্যাস, ঠিক আছে- আমরা কী কখনো ওরম পচা গল্প বলি নাকী, কক্ষনো না। এখনো তো বাকী আছে!
সূত্রধার- একটুক্ষণের মধ্যেই চকোলেট খেয়ে ফুলকলির মন ভালো হয়ে গেল! জানাবাবুর ভালোনাম হল মহিনদাদু। মহিনদাদু কত ভালো ভালো গল্প জানে! স্নো-লেপার্ড আর পেঙ্গুইনের সত্যি গল্প! ডিটেকটিভদের গল্প! যতক্ষণ না নাসিরের বাড়ি থেকে ডাকতে এল, ততক্ষন নাসির আর ফুলকলি বসে সেইসব গল্প শুনল।
ফুলকলি- তুমি আর কালো জামা কালো প্যান্ট পরো না মহিনদাদু- তাহলে তোমায় দেখে সবাই খারাপ লোক ভাববে-
মহিনদাদু- ভাবলেই হল? আমি পরেরদিন তোমাদের কালো জামা পরা ভালো লোকদের গল্প শোনাবো!
সূত্রধার- কিন্তু শুধু গল্প শুনেই কী খুশি থাকবে ডিটেক্টিভ মিস দীপশিখা দাস? সারা পৃথিবীর কত রহস্য অপেক্ষা করে আছে, সল্ভ করতে হবে না?
সূত্রধার- কীন্তু আবার তো ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান! রহস্য নেই, অ্যাসিস্ট্যান্ট-ও নেই!
নাসির- রং! অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। আমি যে খেলতে যাই না, শুধু গল্পের বই পড়ি তা কেন জানো? আমি বড় হয়ে রাইটার হব বলে। আমি তোপসের মত ফুলকলির সব অ্যাডভেঞ্চার গুলো লিখে ফেলব!
ফুলকলি- ফুলকলি নয়, দীপশিখা দাস!
মহিনদাদু- দূর – ফেলুদাকে আর ক'জন প্রদোষ মিত্তির বলে ডাকে? ফুলকলি নামটাই ভালো!
নাসির- হ্যাঁ ফুলকলিই ভালো!
ফুলকলি- (মহিনদাদুকে) আর তুমি, তুমি কী হবে? লালমোহনবাবু?
নাসির- না না, তুমি তো প্রোফেসর, তুমি প্রোফেসর ক্যালকুলাস!
মহিনদাদু- বেশ, বেশ, তাই হবে!
নাসির- আমাদের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার গল্প এইখানেই শেষ!
সূত্রধার- রহস্যটা একটু কেঁচে গেছে বটে – কিন্তু অ্যাসিস্ট্যান্ট তো পাওয়া গেছে!
মহিনদাদু- রহস্য তো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে, একটা গেলে আরেকটা পাওয়া যাবে – টীমটাই তো আসল!
ফুলকলি- দাঁড়াও, দাঁড়াও! দূরবীন দিয়ে কী যেন দেখা যাচ্ছে – একটা ম্যামথের মত!
কোরাস-
কলকাতা-হলদিয়া-মঙ্গল-চাঁদে
কতশত রহস্য একা বসে কাঁদে
কে তাদের ভালোবেসে ঘুম থেকে তুলে
মুখ মুছে দেবে খুব আলতো আঙুলে!
কোন খানে রোজ রোজ রামধনু ওঠে
কোন মাঠে উটপাখি পাঁইপাঁই ছোটে
কারা করে ছোটদের হাসিমুখ চুরি
কোন খানে ঘর বাঁধে থুরথুরে বুড়ী?
ফাঁকা বুকে ফুলে ওঠে আশার ফানুশ
হঠাত বন্ধু হয় অচেনা মানুষ!
বোমা বন্দুক রোজ গর্জন করে
বড় যারা তারা বুঝি ভয়েতেই মরে
আমরা তো ছোট আছি, এইটুকখানি
ভয় তো শিখি নি শুধু রহস্য জানি
খুঁজতে বেরব আর ঠিক খুঁজে পাব
যত দূর যেতে হয়, তত দূর যাব!
ছবিঃ বৃষ্টি প্রামাণিক