৭ঃ অবশেষে, চোখের সামনে
সাউথ শেটল্যান্ড দ্বীপে জাহাজ নোঙর করার মত অবস্থা ছিল না। আবহাওয়া খারাপ ছিল। তাই আমাদের জাহাজ গিয়ে ভিড়ল ডিসেপশন আইল্যান্ড-এ। কেউ যদি আন্টার্কটিকার বিবরণ তোমাকে খুব সহজে বলে দেয়, তাহলে বুঝে নিতে হবে, সেই মানুষটা বোধ হয় সেখানে কখনও যায়নি। আমাদের চারদিকে ঘিরে ছিল এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতা। বাতাসের আওয়াজ নেই, পাখির ডাক নেই, গাছপালা, মানুষের চিহ্ন নেই। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম, তিন দিকেউঁচু বরফঢাকা পাহাড়, আর অনুভব করলাম সেই অসাধারণ স্তব্ধ পরিবেশ - ঠিক যেন শীতের রাতের গরম কম্বলের মত ঘিরে রেখেছে চারদিক। সাদা বরফের স্তর যেন সেই স্তব্ধতারই রং, আর মাঝেমধ্যে কালো রং যেন সেই সাদা রং কে আরও উজ্জ্বল করে তুলছে।
ডিসেপ্শন আইল্যান্ডে যাওয়ার পথে, নেপচুন্স্ বেলোজ খাঁড়িপথ
ডিসেপশন আইল্যান্ড বা , বাংলায় বললে 'প্রতারণা দ্বীপ' কেপ্রথম আবিষ্কার করেন আমেরিকার নাবিক ন্যাথানিয়েল পামার। এই বিরাট অশ্বক্ষুরাকৃতি দ্বীপটি আসলে একটি আগ্নেয়গিরির মুখের চারপাশে জমে থাকা লাভায় তৈরি। মধ্যেখানে আগ্নেয়গিরির মুখ যেটি, সেখানে জল জমে তৈরি হয়েছে এক বিশাল হ্রদ। এই হ্রদে প্রবেশ করতে হয় একটি সরু খাঁড়ি দিয়ে, যার নাম নেপচুন্স্ বেলোজ। এই খাঁড়ির নাম রোমান সমুদ্র দেবতা নেপচুনের নামে। কিন্তু দূর থেকে এত কিছু বোঝা যায় না, দেখে মনে হয় এটি একটি সাধারণ দ্বীপ। তাই পামার এই দ্বীপের নাম দেন ডিসেপশন আইল্যান্ড বা প্রতারণা দ্বীপ।
ডিসেপ্শন আইল্যান্ড/ প্রতারণা দ্বীপ-এর এক অংশ
এক সময়ে যখন সাউথ শেটল্যান্ড দ্বীপের আশেপাশে সীল শিকারের রমরমা ছিল, তখন ডিসেপশন আইল্যান্ড এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল। এখানে সীল বেশি ছিল না, কিন্তু এটি ছিল এক খুব ভালো প্রাকৃতিক বন্দর। সীল শিকারিরা এখানে নিশ্চিন্তে জানাজ নোঙর করত। কিন্তু ফার সীলদের অত্যন্ত বেশি শিকার করার কারণে তারা প্রায় অবলুপ্ত হওয়ার অবস্থা হলে, এই কাজ বন্ধ হয় এবং ডিসেপশন আইল্যান্ড আবার ফাঁকা হয়ে যায়, ১৮২৫ সাল নাগাদ।
এই দ্বীপ দ্বিতীয়বারের জন্য জমজমাট হয়ে ওঠে যখন তিমি শিকারের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে। তিমি শিকার করা হত তাদের মাংস এবং ব্লাবারেরজন্য। ব্লাবার থেকে তেল নিষ্কাশন করা হত, শিল্প বিপ্লব চলাকালীন যে তেলের প্রচুর চাহিদা ছিল। উত্তরের ভূখন্ডগুলি থেকে এগোতে এগোতে শিকারিরা সাউথ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের কাছে চলে আসে। সেখানে তীরে কারখানা স্থাপন করার মত পরিস্থিতি ছিল না। তারা শিকার করা তিমিগুলিকে নিয়ে মাংস এবং তেল- নিষ্কাশন করার জন্য নিয়ে যেতে হত জাহাজে। এই ধরনের কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল এমন জায়গার যেখানে নিরাপদে জাহাজ নোঙর করা যায়, আর পরিষ্কার জলের যোগান থাকে। এর ফলে ডিসেপ্শন আইল্যান্ডে এক সময়ে রেডিও স্টেশন বসানো হয় এবং আন্টার্কটিকার সবথেকে বড় কবরখানা স্থাপিত হয়। যেমন হয়েছিল সীল ব্যবসার ক্ষেত্রে, তেমনই, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি তিমি শিকারের ফলে এক সময়ে বেশি পরিমাণে যোগানের ফলে তিমির দাম কমে যায়, এবং এই ব্যবসা ও ধীরে ধীরে গুটিয়ে আসে।
এর পরে ডিসেপ্শন আইল্যান্ড কিছুদিন ফাঁকা থাকে। তারপরেই আবার ব্রিটেন, চিলি এবং আর্জেন্তিনার সেনাবাহিনী এখানে নিজেদের মিলিটারি বেস প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে।কিন্তু সেই প্রচেষ্টাগুলি পরপর দুইবার অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বিফল হয়। এখন এখানে রয়েছে শুধু মাত্র সেই প্রাচীন তিমি শিকার ব্যবসার কিছু জং ধরা, ভেঙে পড়া ভগ্নাবশেষ, আর গোটা দুই দেশের সামার বেস।
কিন্তু ডিসেপশন আইল্যান্ড এখন পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এই দ্বীপে রয়েছে চীন্স্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনদের অনেক কলোনি, আর বেশ কিছু প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রস্রবণ, যেখানে পর্যটকেরা স্নান করতে পারেন।
৯ঃ আন্টার্কটিকায় পা রাখার প্রস্তুতি
এইবার আমরা প্রথম আন্টাকটিকার মাটিতে পা রাখব। আমরা নামব আন্টার্কটিক পেনিন্সুলা বা আন্টার্কটিক উপদ্বীপে। আমাদের আগেই জামাকাপড় পরার এবং নিরাপত্তা বজায় রাখার নিয়ম গুলি নিয়ে 'মক সেশন'হয়ে গেছে, তাই সবাই খুবই উত্তেজিত হয়ে ছিলাম। এখন, আন্টার্কটিকার আবহাওয়া বুঝে পোষাক পরাটা বেশ একটা কঠিন কাজ। আমাদের অভিযানের দলনেতা বলেছিলেন, জাহাজ থেকে নামার আগে ডেকে গিয়ে আবহাওয়া বুঝে এই অনুযায়ী পোষাক পরতে। আমি যখন ডেকে গিয়ে দাঁড়ালাম, দেখলাম বেশ আরামদায়ক দিন, খুব ঠান্ডা একদমই নয়। কিন্তু আমি তো মনে মনে -১০ ডিগ্রি তাপমাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি। আমার কেমন মনে হল, এই যে যথেষ্ট ঠান্ডা লাগছে না, এটা আসলে ঠিক নয়, নীচে নামলে নির্ঘাৎ আমার খুব , খুব ঠান্ডা লাগবে, আর তখন আমি সেটা সহ্য করতে পারব না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম একটু বেশিই জামাকাপড় পরে বেরোব।
আন্টার্কটিকায় জামাকাপড় পরা মানে হল পরতের পরে পরত দিয়ে নিজের শরীরকে ঢাকা। প্রথমে পরো উলের জাম্পার, আর এক বা দুই স্তরে মোটা থার্মাল জামা। পায়েও পরো তেমন পোষাক। তার ওপরে পরো ওয়াটারপ্রুফ জামা-প্যান্ট , কারণ, আন্টার্কটিকায় জাহাজ থেকে জমিতে নামা মানে হচ্ছে মাঝেমধ্যেই অল্প জলেরমধ্যে দিয়ে হাঁটতে হবে। এর সঙ্গে যোগ করো উলের দস্তানা, টুপি, মোজা, এবং সেগুলির সবগুলিরই রয়েছে জলের থেকে বাঁচার জন্য ওয়াটারপ্রুফ লেয়ার। এতসব পরে তো মনে হবে যেন প্রায় মহাকাশচারীদের মত সাজগোজ হয়ে গেল। কিন্তু না, এখানেই শেষ নয়। এরপরে পরে নিতে হবে রাবারের বুট আর সবশেষে লাইফ জ্যাকেট। এইবারে ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগে ক্যামেরা ভরে, চোখে রোদচশ্মা এঁটে তুমি একেবারে তৈরি হয়ে গেলে আন্টার্কটিকার মাটিতে পা রাখার জন্য। এইসব সাজগোজ করে বেরিয়ে অন্যদের দেখে আমার মনে হল, আমাদের একেকজনের লাইফ জ্যাকেট একেক রকম রঙের হলে বেশ হত। কিন্তু না, আমরা সবাই একই রকম হুরতিরুতেন কোম্পানির লাল রঙের জ্যাকেট পরে ছিলাম। ফ্যাশন ডিজাইন করেন যাঁরা, তাঁরা অভিযাত্রীদের জন্য নানা রঙের লাইফ জ্যাকেট বানানোর কথা ভাবেন না কেন কে জানে!
আন্টার্কটিকার পরিবেশ যাতে দূষিত না হয়, তাই আন্টার্কটিক চুক্তিতে বেশ কিছু কঠোর নিয়ম বলা আছে। আমাদের ক্র্যুইজ পরিচালনার দায়িত্বে যে সংস্থা, হুরতিরুতেন, তাদের কড়াকড়ি আরও বেশি। নামার আগে আমাদের সমস্ত বাইরের পরিধানগুলি বায়ো-স্ক্রিনিং করা হল, যাতে এটা নিশ্চিত করা যায় যে আমরা বাইরের কোনো জীবাণু নিয়ে সেখানে পা দিচ্ছি না। প্রতিবার নামার আগে আমাদের বুটগুলোকে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা হত। বলা ছিল যে ওখানে পশুপাখিদের দেখলে কী কী করা যাবে বা যাবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, এটা ওদের বাসস্থান আর আমরা এখানে ওদের অতিথি মাত্র। আমরা যেন এই কথাটা ভুলে না যাই।
আমাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে নেওয়া হল, আর প্রতিটা দলের একটা করে নাম ও হল। আমাদের নয় নম্বর গ্রুপের নাম হল লাইট ম্যান্ট্ল্ড সুটি অ্যালবাট্রস ( Light Mantled Sooty Albatross)। এক এক করে দলের নাম সাউন্ড সিস্টেমে ঘোষণা করা হচ্ছিল, আর প্রতিটা কেবিনে এবং অন্যান্য জায়গাতে টেলেভিশন স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছিল। আমি তো নামার জন্য এতই উত্তেজিত ছিলাম যে তাড়াহুড়ো করে অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়ে বসে রইলাম, আর অত জামাকাপড় পরে অপেক্ষা করতে করতে ঘেমেও গেলাম।
জোডিয়াক চেপে মাটিতে পা রাখার উদ্দেশ্যে যাত্রা
অবশেষে, আমাদের দলের নাম ঘোষণা হল, আর আমরা জোডিয়াকে গিয়ে বসলাম। জোডিয়াক হল একধরনের ছোট রাবারের ভেলা, যাতে চেপে আমরা জাহাজ থেকে পাড় অবধি পৌঁছালাম। আমি তো আমার ক্যামেরার জুম লেস বাগিয়ে বসে আছি -পেঙ্গুইন দেখব আর খচাখচ ছবি তুলব। কিন্তু আমার এত উত্তেজনা একটু পরেই দমে গেল। প্রথমতঃ এই বছরে আন্টার্কটিকায় বহু বহু বছর পরে, খুব বেশি গরম পড়েছিল। এই গ্রীষ্মে আন্টার্কটিকার তাপমাত্রা হয়ে গেছিল প্রায় ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এর ফলে বরফের পরিমাণ অনেক কম ছিল, আর হ্যাঁ, আমি একটু বেশিই জামাকাপড় পরে ফেলেছিলাম। তাই যতক্ষণে আমি গিয়ে সত্যি আন্টার্কটিকার মাটিতে পা দিলাম, ততক্ষণে আমি গরমে হাঁপাচ্ছি। তখন আমার মনে হচ্ছে, কয়েক পরত জামা খুলে ফেলে একটু প্রাণ ভরে ঠান্ডা হাওয়া খাই। আমাদের সঙ্গে কিছু পর্যটক ছিলেন, যাঁরা আন্টার্কটিক সাগরে সাঁতার কাটবেন বলে আগে থেকেই নাম লিখিয়েছিলেন, তাঁদের দেখে আমার মনে মনে খুব হিংসে হল । আর এইখানেই হল আমার প্রথম বাস্তব অভিজ্ঞতা। আন্টার্কটিকা বদলে যাচ্ছে , আর সেই তুষার ধবল মহাদেশ নিয়ে আমার যত স্বপ্ন, সেগুলিও কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
দলনেতার সঙ্গে জরুরী কথাবার্তা
পেঙ্গুইন কোভ, যেখানে আমরা প্রথম আন্টার্কটিকার মাটিতে পা রাখলাম
আমি প্রবল আশায় পেঙ্গুইনদের কলোনি খুঁজতে লাগলাম - সেইরকম্ বড় বড় কলোনি যা ফ্রোজেন প্ল্যানেটে অনুষ্ঠানে দেখতে পেতাম। কিন্তু সেখানেও আমাকে নিরাশ হতে হল। এইবছর পেঙ্গুইনরা অনেক আগেই মূল ভূখন্ড ছেড়ে চলে গেছে দুটো কারণে- বেশি গরম আর সময়ের আগেই তিমি মাছেদের আগমন। পিছল বরফ আর জমা ঘোলা জল কাটিয়ে এঁকেবেকে হাঁটতে হাঁটতে, আমার খুব মন খারাপ হল। আমার স্বপ্নের তুষার ধবল মহাদেশের গায়ে বরফের পরতের বদলে কালো পাথরের ওপরে দেখা যাচ্ছে সবুজ মস। গ্রীষ্মে যে অল্প কিছু সবুজ জন্মায় এখানে, সেগুলি এখন বেড়ে উঠছে। জোডিয়াক চেপে জাহাজে ফেরার সময়ে আমি মুখ ভার করেই বসে রইলাম।কিন্তু আমাদের ক্র্যুইজের কর্মীরা বেশ ভালো মেজাজেই ছিলেন। তাঁরা বললেন, কথা দিয়েছি বরফ দেখাব, কথা দিয়েছি পেঙ্গুইন দেখাব, কথা দিয়েছি তিমি দেখাব, আর কথা যখন দিয়েছি, তখন দেখাবই। শুনে আমার একদমই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু ওঁদের বিশ্বাস না করে উপায়ই বা কী?
১০ঃ পেঙ্গুইন! পেঙ্গুইন !
জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু সময় আসে, যখন মনে হয় যেন নিঃশ্বাস-প্রঃশ্বাস ও থেমে গেছে। না, কোনো বিপদের কথা বলছি না,মাঝে মাঝে খুব অবাক হলেও এমন বোধ হয় তো!। প্রাচীন যুগে যে সব অভিযাত্রীরা বারে বারে নানা অভিযানে গেছেন, তাঁরা নিশ্চয় এইরকম সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন বারে বারে হয়েছেন। কিন্তু আজকের দিনে, আমরা যেন তেমন ভাবে অবাক হতেও ভুলে গেছি। আমাদের চোখের সামনে এত বেশি তথ্য সব সময়ে ঘুরছে, যে আমরা আর নতুন করে আবিষ্কারের আনন্দ অনুভব করিনা। পরের দিন সকালে আমার ঘুম ভাঙালো সাউন্ড সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে আসা এক উত্তেজিত কন্ঠস্বর। আমি জানতে পারলাম আমাদের জাহাজের পাশে পাশেই নাকি একদল তিমি সাঁতার কেটে যাচ্ছে, আর এমন দৃশ্য আমাদের কোনোভাবেই না দেখে থাকা উচিত নয়। কিন্তু আমি যতক্ষণে ডেকে গিয়ে পৌঁছালাম, সেই তিমিরা ততক্ষণে আর আশেপাশে নেই। আমি দেখলাম আমাদের জাহান ড্যান্কো দ্বীপে নোঙর ফেলেছে। চারদিকে বরফ ঢাকা পাহাড় চূড়া। সাদা পাহাড়ের মাঝে মাঝে কালো পাথরগুলো যেন সাদার মধ্যে কালো রঙের ছোপের মত, কিন্তু তাতে পুরো ছবিটা আরও সুন্দর হয়েছে। এই তো আমার স্বপ্নের আন্টার্কটিকা! আমার মনটা অদ্ভূত এক আনন্দে ভরে গেল। আমি ঝটপট জলখাবার খেয়ে নিলাম, আর যেই আমার দলের ডাক পড়ল, প্রায় এক লাফে গিয়ে জোডিয়াকে বসে পড়লাম। মাথার ওপর আকাশে সূর্য ঝলমল করছিল, সঙ্গে শীতল হাওয়া ঝাপটা দিচ্ছিল। কিন্তু এইদিনে আমি একেবারে ঠিকঠাক পোষাক পরেই বেরিয়েছিলাম।
জেন্টু পেঙ্গুইন
আমাদের প্রথমে স্বাগত জানাল জেন্টু পেঙ্গুইনদের একটি কলোনি বা দল। এরাই তো আন্টার্কটিকার আদত বাসিন্দা। পেঙ্গুইন যেহেতু উড়তে পারেনা, বরং তাদের ছোট্ট দুটো পায়ের ওপর ভর দিয়ে হাঁটে, তাই মনে একবার হবেই - এরা কি সত্যিই পাখি? আন্টার্কটিকা হল একটি বাদে বাকি সমস্ত পেঙ্গুইন প্রজাতির বাসভূমি। এম্পারার পেঙ্গুইনরা আকারে সবথেকে বড় হয় আর লিট্ল্ ব্লু পেঙ্গুইনরা সবথেকে ছোট। পেঙ্গুইনরা আন্টার্কটিকা মহাদেশে এবং আশেপাশে সারাবছরই থাকে। গ্রীষ্মকালে এরা মূল ভূখন্ডে ডিম পাড়তে আসে। আর শীতে সেখান থেকে দূরে চলে গিয়ে সমুদ্রে ভাসমান আইস শেল্ফ্গুলিতে আশ্রয় নেয়।
চীন্স্ট্র্যাপ পেঙ্গুইন
পেঙ্গুইনরা সাধারণতঃ বড় বড় কলোনিতে এক সঙ্গে ডিম পাড়ে। এইরকম বড় দল গুলিতে এক সঙ্গে একশো জোড়া থেকে কয়েক হাজার জোড়া পেঙ্গুইন থাকতে পারে। আর একসঙ্গে এতজন থাকলে তারা খুবই সামাজিক হবে, একে অপরের সঙ্গে নানা কথা বলবে। এই পুরো দৃশ্যটা দেখতে অদ্ভূত লাগে। তবে এই দৃশ্যের সঙ্গে যোগ করতে হবে তাদের সমবেত কথাবার্তার আওয়াজ আর তাদের পরিত্যক্ত বিষ্ঠা, যাকে বলে গুয়ানো, তার দুর্গন্ধ।
অ্যাডেলি পেঙ্গুইন
পেঙ্গুইনরা প্রতিবছর একই সঙ্গীর সঙ্গে জোড় বেঁধে সন্তানের জন্ম দেয়। পুরনো সঙ্গীকে না খুঁজে পেলে অবশ্য নতুন সঙ্গী জুটিয়ে নেয়। বেশিরভাগ প্রজাতির পেঙ্গুইন একটাই ডিম পাড়ে। তবে কিছু প্রজাতি দুটো করেও ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার পরে সেই ডিমকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেয় পুরুষ পেঙ্গুইন। আর তার খাবারের যোগানের ব্যবস্থা করে স্ত্রী পেঙ্গুইন।যখন পাহাড়ের মাথায় বরফ সবথেকে আগে গলতে শুরু করে, তখন পেঙ্গুইনরা ছোট ছোট পায়ের সাহায্যে হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের ওপরের দিকে বাসা বানায়। কাজটা খুব সহজ নয়। একবারে একটা করে নুড়ি বা ছোট পাথর মুখে তুলে একই পথ ধরে বার বার পাহাড়ের ওপরের দিকে নিরাপদ জায়গাতে গিয়ে তুলে বাসা বানায় তারা। জলের থেকে দূরে বাসা বানাতে পারলে সীল এবং স্কুয়াদের থেকে তারা তাদের ছানাকে রক্ষা করতে পারবে। একই পথে সারে সারে পেঙ্গুইনেরা বার বার যাওয়া-আসা করছে, এই দৃশ্যকে নাম দেওয় হয়েছে 'পেঙ্গুইন হাইওয়ে'।
আন্টার্কটি ফার সীল, পেঙ্গুইনদের তুলনায় এরা খুবই অলস
অনেকের মতে,পেঙ্গুইনরা নাকি মানুষকে ভয় পায় না।আমার দেখে মনে হল, ভয়-টয় তো দূর, আসলে মানুষদের দিকে নজর দেওয়ার মত সময়ই নেই পেঙ্গুইনদের কাছে। ওই যেমন মা দেখেছেন তুমি মাটিতে বই-খাতা ছড়িয়ে রেখেছ, কিন্তু দেখেও কিছু বকাবকি করছে না, কারণ মা অন্য জরুরী কাজে খুব ব্যস্ত, ব্যাপারটা সেইরকম। এই যে আমরা এতদূর থেকে ওদের দেখতে এসেছি, দারুণ সব ছবি তোলার চেষ্টা করছি, তাতে পেঙ্গুইনদের ভারি বয়েই গেছে। আমরা নেহাৎই অবাঞ্ছিত অতিথি সব। তাদের অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তো নাকি ? - যেমন নিজেদের মধ্যে বকবক করা, দৌড়াদৌড়ি করা, জলে ঝাঁপ দেওয়া, সাঁতার কাটা।
স্কুয়া, এই বিরাট পাখিগুলি পেঙ্গুইন ছানাদের শিকার করে
বেশিরভাগ পেঙ্গুইন প্রজাতি বছরে একবার করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডিম পাড়া এবং বাচ্চা জন্মানোর পরে, নিজেদের সমস্ত পুরোনো পালক খসিয়ে ফেলে। তারপরে তাদের গায়ে নতুন পালক গজায়। এই পদ্ধতিকে বলে 'মোল্টিং'। আমরা বেশ কিছু পেঙ্গুইনকে দেখলাম যারা এই মোল্টিং পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই সময়টা ওদের কাছে খুব কষ্টকর কারণ এই সময়ে ওদের খুব গা চুলকায়। আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল আমরা যেন এই সমস্ত পেঙ্গুইনদের থেকে সসম্মানে দূরত্ব বজায় রাখি। প্রকৃতি নিজের ভারসাম্য এক অদ্ভুত উপায়ে বজায় রেখেছে। পেঙ্গুইনরা যদি নির্ভয়ে ডিম পেড়ে যেতে পারত, তাহলে পৃথিবী একদিন পেঙ্গুইনেই ভরে যেত। তাই প্রকৃতি তার ভ্রসাম্য বজায় রাখার জন্যই সৃষ্টি করেছে বিশাল আকৃতির পাখি স্কুয়া, সীল এবং কিলার হোয়েল বা অর্কা । আমরা নিজেদের চোখের সামনেই দেখলাম এক সীল কীভাবে পেঙ্গুইন শিকার করল। কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। পেঙ্গুইনরা জলে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলে, তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে কিলার হোয়েলরা একা নয়, বরং দল বেঁধে শিকার করে।
ক্র্যাব ইটার সীল
এই পেঙ্গুইনদের সঙ্গে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে, কাজ থেকে দেখে, আমি অভিভূত হয়ে গেছিলাম। আমি শহরের মানুষ, বেশিরভাগ জিনিষ একটা মাউজ ক্লিকে বা বোতাম টিপে হাতের কাছে পেয়ে যাই। কিন্তু এই পেঙ্গুইনদের রাজত্বে, প্রতিটা জিনিষের জন্য কত কষ্ট করতে হয়। কেউ একফোঁটা বেশি নেয়না, কেউ একফোঁটা বেশি দেয়না। প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পরিস্থিতি হলে,প্রকৃতিই সেটাকে সামলে নেয়। আমরা মানুষেরা অতি দ্রুত হারে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে গেছি, আমাদের গড় আয়ু অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এর মানে কি এই যে প্রকৃতি আমাদের এই বাড়বৃদ্ধি চুপচাপ মেনে নেবে? নাকি কোনোভাবে আমাদেরকেও নিয়ন্ত্রন করবে? প্রাকৃতিক নিয়মের মূলমন্ত্রই তো হল ভারসাম্য বজায় রাখা, তাই হিসেবমত আমাদের ও ছাড়া পাওয়ার কথা নয়। যত এই কথা ভাবতে লাগলাম, তত সর্বশ্রেষ্ঠ জীব --- মানুষ---হিসাবে আমার যত গর্ব ছিল,সব চুরমার হতে লাগল। নিজেকে খুব খুব ক্ষুদ্র মনে করতে করতে আমি সেই রাতে জাহাজে ফিরে এলাম।
(ক্রমশঃ)
মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদঃ মহাশ্বেতা রায়
ছবিঃ কীর্তি রাঠী, ডেভিড কাত্জ্ , সেবাস্তিয়েন প্যানাতিয়ের