১ঃ স্বপ্ন
আন্টার্ক্টিকা - পৃথিবীর সপ্তম মহাদেশ যাকে মাবনবসভ্যতা প্রথম আবিষ্কার করেছিল ১৮০০ শতকে। যেহেতুএই মহাদেশ আবিষ্কারের গল্পটা অপেক্ষাকৃত নতুন, তাই সেই ইতিহাস বোঝা একটু সহজ। আন্টার্কটিকার ইতিহাসে, অন্যান্য মহাদেশের মত— যুদ্ধ, রাজা-রাজড়া, রাজ্যবিস্তার —এইসব নেই। আমি যখন ছোট ছিলাম, আর পরীক্ষার জন্য জোর করে অনেক ইতিহাস আর ভূগোল পড়তে হত, তখন আমার সবথেকে পছন্দের চ্যাপ্টার ছিল আন্টার্কটিকা। সেটা সবথেকে কম পড়তে হত যে! সেখানে গাছপালা নেই, মানুষ থাকে না, যুদ্ধ হয়নি, রাজধানী বা বড় শহর নেই, মানে সত্যি বলতে গেলে পরীক্ষার জন্য মুখস্থ করার মত কোনো বিষয়ই নেই!
সেই ছোট্টবেলায় আমি ভাবতাম, আন্টার্কটিকা হল একটা সাদা রঙের মহাদেশ, যেখানে বরফ ছাড়া আর কিছুই নেই। ক্রমে টেলেভিশনের নানা অনুষ্ঠানে এবং অনেক তথ্যচিত্র দেখে আমি জানতে পারলাম, আন্টার্কটিকায় গেলে দুর্দান্ত সব প্রাণীদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে; জানতে পারলাম কীভাবে তার প্রাকৃতিক ভারসাম্য দ্রুত বদলাচ্ছে। আমি বার বার ঘুরে ফিরে 'ফ্রোজেন প্ল্যানেট' সিরিজের অনুষ্ঠানগুলিকে দেখতাম। স্বাধীন প্রাণীদের আসাযাওয়া, নিস্তব্ধ আইস শেল্ফ্, সেইসব আইস শেল্ফ্-এ ফাটল ধরার কড়কড় আওয়াজ আ্রর ধারাভাষ্যকারদের গলায় চিন্তার সুর— দ্রুত বদলে যাচ্ছে এই মহাদেশ—এই সবকিছু আমার মনের মধ্যে গেঁথে রইল। আমি আন্টার্কটিকা বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। কিন্তু আন্টার্কটিকা যাওয়া অত সহজ নয় , অর্থ এবং সময়, যেদিক থেকেই দেখ না কেন। এই মহাদেশ এত দূরে যে, আমাদের সবথেকে আধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থার সাহায্য নিলেও, আন্টার্কটিকা যাচ্ছে এমন একটা জাহাজে চাপতেই তিন দিন সময়ে লেগে যাবে। আর খরচ? বেশ অনেক বছর ধরে কাজ করে, টাকা জমিয়ে জমিয়ে তবেই এই বেড়ানোর খরচ জুটিয়ে ওঠা সম্ভব।
২ঃ পরিকল্পনা
যাব বললেই তো আর যাওয়া হয়না।ঘরে বাইরে কাজ, এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে গুছিয়ে বসা, সংসার সামলাতেই সময় পেরিয়ে যায়, আমার আন্টার্কটিকা বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্ন এক কোণে পড়ে থাকে। অবশেষে, চল্লিশ বছর বয়সের কাছাকাছি এসে আমার এই রোজকার একঘেয়ে রুটিন ভেঙে ফেলার ইচ্ছেটা ক্রমশঃ জোরদার হতে শুরু করে। আমি ভাবতে থাকি, কোথায়, কীভাবে হারিয়ে যাওয়া যায়। এমনই এক দিনে, আমি যখন হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে মশগুল, আমার ছোট্ট মেয়ে আমার কাছে জানতে চায়, আমি এর আগে কোথায় কোথায় বেড়াতে গেছি। আমি কোথায় কোথায় গেছি, কী কী করেছি, কাদের সঙ্গে গেছি— ওর এইসব সরল প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমার খুব ভালো লাগছিল। আমি বুঝতে পারলাম, ওর মা একা একা এত দেশবিদেশ ঘুরে এসেছে , এটা জেনে আমার ছোট্ট মেয়েটা খুব গর্বিত; আমার উত্তরগুলি ওর মনেও স্বপ্নের বীজ পুঁতছে। মেয়ে আমার মধ্যে আবার বেড়াতে যাওয়ার উৎসাহটা জাগিয়ে দিল। আমি নতুন করে আবার আন্টার্কটিকা বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু করলাম।
প্রথমে যেটা নিয়ে ভাবতে হল সেটা হল খরচ। আন্টার্কটিকা বেড়াতে যাওয়ার খরচ অনেক। আমাদের যা সঞ্চয় আছে, তাতে মাত্র একজনই বেড়াতে যেতে পারবে। এই কথা জেনে আমার মেয়ের মনখারাপ হল খুব। কিন্তু ছোট্ট মানুষটা খুবই বুঝদার। সে জীবনের একটা বিরাট বড় শিক্ষা এই ছোট্টবেলাতেই পেল – জীবনের বড়বড় স্বপ্নপূরণ করতে গেলে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। সবদিক ভাবনাচিন্তা এবং আলোচনা করে, আমি একটু নিজের জন্য স্বার্থপরই হলাম, এবং একাই আন্টার্কটিকা বেড়াতে যাব, সিদ্ধান্ত নিলাম।
এরপর চিন্তার বিষয় হল, আমি যে প্রায় ২০ দিন থাকব না, তাহলে আমার পরিবারের মানুষদের এবং কাজের জায়গাতে অসুবিধা হবে না কি? এই নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম, আমরা সবাই নিজেদের যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, আসলে ততটা নই। আমরা মনে করি, আমরা শুধু নিজেদের না, অন্যদেরও জীবন নিয়ন্ত্রন করতে পারি। কিন্তু সত্যিটা একেবারেই উলটো। আসলে, আমরা কেউই তেমনভাবে জরুরী নই, আর সব মানুষ খুব সহজেই নতুন নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। আমার মেয়ে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এবং কাজের জায়গাতেও, সবাই কুড়ি দিনের জন্য আমাকে ছাড়াই থাকার সবরকমের পরিকল্পনা করে নিল।
৩ঃ আন্টার্কটিকা নিয়ে একটু পড়াশোনা
আন্টার্কটিকার ম্যাপ
এইবার আমি আন্টার্কটিকা বেড়াতে যাওয়া নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। প্রথম যে জরুরী কথাটা আমি জানতে পারলাম, সেটা এই যে, আন্টার্কটিকায় কোনো আলাদা দেশ নেই, তাই আন্টার্কটিকা মহাদেশে যেতে কোনো ভিসা লাগে না। দ্বিতীয় যেটা জানলাম সেটা এই যে, যদিও আন্টার্কটিকাতে মানুষ থাকে না এবং সেখানে কোনো যুদ্ধ-বিবাদ ও হয়নি, তবুও, আন্তর্জাতিকভাবে, আন্টার্কটিকা সবসময়ে আলোচনার মধ্যে থেকেছে। মানুষ কৃষিকাজ করতে শেখার পরে, তার মধ্যে জমির দখল নেওয়ার অফুরন্ত চাহিদা তৈরি হয়। অষ্টাদশ শতক শেষ হতে হতে, শিল্পের প্রয়োজনে খনিজ এবং অন্যান্য রসদের জন্য পৃথিবীর কোনো কোণ খুঁজতে বাকি রাখিনি আমরা।
ক্যাপ্টেন জেম্স্ কুক
প্রায় ৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে, যখন গ্রীক দার্শনিকেরা স্থির মতে আসেন যে পৃথিবী গোল, এবং এর উত্তর ও দক্ষিণ মেরু রয়েছে, সেই সময় থেকে এই মেরুদেশের সম্পর্কে মানুষের মনে কৌতূহল জন্মায়। উনিশ শতকের আগে চলে একাধিক অভিযান। ১৭৭২ সালে জেম্স্ কুক একটি অভিযান পরিচালনা করেন এবং ১৭৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে আন্টার্কটিক সার্কেল পেরোতে সক্ষম হন। তিনি মূল আন্টার্কটিকা মহাদেশের ৭৫ মাইল কাছ অবধি পৌঁছাতে পেরেছিলেন,যদিও তিনি সেটিকে দেখতে পান নি।
ওপরে বাঁদিক থেকে ডানদিকেঃ ফেবিয়ান গটলিয়েব, মিখাইল লাজারেভ, জেম্স্ ওয়েডেল
নীচে বাঁদিক থেকে ডানদিকেঃ জেম্স্ ক্লার্ক রস,কার্ল আন্তোন লারসেন, রোল্ড আমুন্ডসেন
অসংখ্য নাবিক এবং অভিযাত্রীদল নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বন্দরগুলি থেকে আন্টার্কটিকাকে প্রদক্ষিণ করার উদ্দেশ্যে বারে বারে অভিযান করেন। তাঁদের এই সমস্ত অভিযান এবং আবিষ্কারের ফলে আন্টার্কটিকার মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়, আইস শেল্ফ্ এবং দ্বীপগুলির নামকরণ করা সম্ভব হয়। সঙ্গে থেকে যায় সহ্যশক্তি আর সাহসে ভরার দুর্ধর্ষ সব অভিযাত্রীদের গল্প—রাশিয়ার অভিযাত্রী ফেবিয়ান গটলিয়েব ( Fabian Gottlieb von Bellingshausen) এবং মিখাইল লাজারেভ ( Mikhail Lazarev) – যাঁরা প্রথম আন্টার্ক্টিকাকে চোখে দেখেছিলেন এবং আবিষ্কার করেছিলেন; বৃটিশ নাবিক জেম্স্ ওয়েডেল (James Weddell), যিনি ওয়েডেল সাগর আবিষ্কার করেন; জেম্স্ ক্লার্ক রস (James Clark Ross), যিনি রস আইস শেলফ্, রস সাগর, মাউন্ট এরেবাস, মাউন্ট টেরর এবং ভিক্টোরিয়াল্যান্ড আবিষ্কার করেন; নরওয়ের নাবিক কার্ল আন্তোন লারসেন ( Carl Anton Larsen) যিনি প্রথম আন্টার্কটিকায় স্কি করেছিলেন,লারসেন আইস শেলফ এর ওপরে; এবং রোল্ড আমুন্ডসেন (Roald Amundsen), যিনি ১৯১১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর দক্ষিণ মেরুতে প্রথম পা রাখেন।
এত এত অভিযানের কথা শুনে মনে হবেই, কেন এত সব শক্তিশালী দেশ একের পর এক আন্টার্কটিকাতে অভিযান চালাচ্ছিল? এর উত্তরে যা জানলাম সেটা মানুষ হিসাবে গর্বিত হওয়ার মত নয়। শুরুর দিকে সবার উদ্দেশ্য ছিল আন্টার্কটিকায় তিমি আর সীল শিকার। সেখানে সরু সরু খাঁড়িতে হোয়েলিং স্টেশন বা তিমি ধরার কারখানা বসানো হয়েছিল, যাতে তিমি মাছেরা সহজেই তাদের যান্ত্রিক ফাঁদে ধরা পড়ে। সেখানে মৃত তিমির শরীর থেকে তেল নিষ্কাশন করা হত। এখনও আন্টার্কটিকায় পরিত্যক্ত হোয়েলিং স্টেশন এবং আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা মৃত তিমিদের হাড় দেখতে পাওয়া যায়। এই তিমি শিকার ব্যবসার কারণে এক সময়ে তিমিরা প্রায় অবলুপ্তির পথে চলে গেছিল।
আন্টার্কটিকা সম্পর্কে উৎসাহ দ্বিতীয়বার জেগে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, শীতল যুদ্ধ চলাকালীন।আমেরিকা, চিলি, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, নরওয়ে, নিউ জিল্যান্ড এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন, সব দেশ চেষ্টা করছিল আন্টার্কটিকা মহাদেশের ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন -এর নেতৃত্বে আলাদা আলাদা দল করে প্রচুর চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছিল। শেষ অবধি, ১৯৫৯ সালে, বারোটি দেশ, যাদের আন্টার্কটিকা নিয়ে বেশি উৎসাহ ছিল, তারা নিজেদের মধ্যে আন্টার্কটিক চুক্তি (Antarctic Treaty System)স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির বলে, স্থির হয় যে আন্টার্কটিকতে শুধুই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরিক্ষার কাজ হবে, এবং সেখানে কোনোরকমের সামরিক কাজকর্ম হবে না। এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিটি ছিল শীতল যুদ্ধ চলাকালীন প্রথম এমন চুক্তি।
এই মূহুর্তে, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি শক্তিশালী দেশের রিসার্চ স্টেশন রয়েছে আন্টার্কটিকায়। এইসব গবেষণাগারে বৈজ্ঞানিকেরা পরিবেশের বদল এবং দ্রুত মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ার ফলে বাড়তে থাকা জলরাশি নিয়ে গবেষণা করেন। ভারতেরও আন্টার্কটিকাতে তিনটি রিসার্চ স্টেশন আছে - দক্ষিণ গঙ্গোত্রী, মৈত্রী আর ভারতী। ২০৪৮ সালে আন্টার্কটিক চুক্তি শেষ হবে। তারপরে নতুন করে আন্টার্কটিকার ভবিষ্যৎ কী হবে কে বলতে পারে!
আন্টার্কটিকা নিয়ে এইসব পড়াশোনা করতে করতে মনে হল, স্কুলে আমার পড়ার বইতে যদি এতসব কথা লেখা থাকত...তাহলে এত কিছু জানার জন্য আমাকে প্রায় চল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হত না। আর আন্টার্কটিকায় বেড়াতে গিয়ে বুঝলাম, যাওয়ার আগে এই পড়াশোনাটা করে ভালো করেছি, কারণ আমাদের যখন বিভিন্ন দ্বীপে,এবং ঐতিহাসিক পর্যটকদের আবিষ্কার করা নানা এলাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন এই সমস্ত গল্পগুলি আমার চোখের সামনে পুরো সিনেমার মত ভেসে উঠছিল, মনে হচ্ছিল আমি যেন সেইসব প্রাচীন নাবিকদের সঙ্গেই অভিযানে চলেছি।
(ক্রমশঃ)
মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদঃ মহাশ্বেতা রায়
সূত্র ছবিঃ কীর্তি রাঠী
অন্যান্য ঐতিহাসিক ছবিঃ উইকিপিডিয়া