আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদিম অধিবাসী জনজাতিগুলির একাংশ 'গ্রেট আন্দামানিজ 'নামে পরিচিত। এই গ্রেট আন্দামানিজদের দশটি গোষ্ঠীর মধ্যে একটি গোষ্ঠী হল 'বো' । এই 'বো' গোষ্ঠীর শেষ জীবিত মানুষ ছিলেন বোয়া সোয়ার ( ওপরের ছবিতে তাঁকে দেখা যাচ্ছে)। ২০১০ সালে তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় 'বো' ভাষা। সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় এই ভাষার যত গান, যত শব্দ, যত গল্প, যত কল্পকথা। হারিয়ে যায় একটা সময়ের যত গল্প, একটা গোটা মানবগোষ্ঠীর ইতিহাস এবং সংস্কৃতি।
ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৭০০০টি ভাষা ব্যবহার করা হয়। সারা পৃথিবীর ৯০টি দেশজুড়ে বসবাস করেন প্রায় ৫০০০ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ৩৭০ মিলিয়ন মানুষ। এইসব জনগোষ্ঠীর ব্যবহার করা ভাষাগুলির মধ্যে ২৬৮০টি ভাষা আজ বিপন্ন, সেগুলি হারিয়ে যাচ্ছে, বা বলা ভালো, মরে যাচ্ছে। অথচ বিভিন্ন প্রাচীন জনজাতির ভাষার মধ্যে লুকিয়ে আছে কতশত প্রাচীন জ্ঞান। সেইসব জ্ঞানের অনেকটাই আজও আমাদের জীবনে প্রয়োজনীয়। যেমন ধরো, কেরালার ৭৫ বছর বয়সী দিদিমা লক্ষ্মীকুট্টি। তিনি প্রায় ৫০০ ধরনের ভেষজ ওষুধ তৈরির প্রণালী জানেন; এবং সমস্তটাই তাঁর মাথায় আছে। কোনো বই দেখে দেখে নয়, শুধুমাত্র স্মৃতি থেকেই তৈরি করেন সব কিছু। লক্ষ্মীকুট্টির মা পেশায় ছিলেন 'মিডওয়াইফ' বা 'ধাইমা', আর তাঁর মুখ থেকে শুনে শুনেই সব ওষুধ তৈরির প্রণালী শিখেছিলেন লক্ষ্মীকুট্টি। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ গভীর জঙ্গলে তাঁর ছোট্ট কুটিরে গিয়ে দেখা করেন, মূলতঃ নানা বিষক্রিয়ার বিরুদ্ধে ওষুধ নেওয়ার জন্য। কিন্তু লক্ষ্মীকুট্টি যখন আর অসুস্থের চিকিৎসা করতে পারবেন না, তখন আমরা তাঁর মাথার ভেতরে থাকা ওষুধগুলির বিষয়ে জানব কেমন করে? এই ভাবনা থেকেই, কেরালার বনদপ্তর ঠিক করেছে যে লক্ষ্মীকুট্টি দিদিমার জানা সমস্ত রকম ওষুধ তৈরির প্রণালী একত্রিত করে বই হিসাবে লিখে রাখবে, যাতে ভবিষ্যতের মানুষ ও এই জ্ঞানের ভাগ পেতে পারে।
কিন্তু বোয়া সোয়ার অত ভাগ্যবতী ছিলেন না। তিনি ছিলেন 'বো' ভাষা বলা গোষ্ঠীর শেষ মানুষ। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে, ব্রিটিশরা যখন আন্দামানে বসতি স্থাপন করা শুরু করে, তখন, সেখানে গ্রেট আন্দামানিজদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষদের সংখ্যা ২০০-৫০০ এর মধ্যে ছিল, এবং সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০০ এর কাছাকাছি ছিল। এই সমস্ত মানুষেরা প্রায় ৬৫,০০০ বছর আগে থেকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাস করছিলেন। বলা যেতে পারে, এঁরা হলে পৃথিবীর আদিমতম মানব- সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। ব্রিটিশরা দ্বীপপুঞ্জে বসতি স্থাপনের পরে, বহু বহু বছর ধরে তাদের সঙ্গে অসম যুদ্ধে কিংবা তাদের বয়ে আনা রোগের শিকার হয়ে এই সমস্ত গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা ক্রমশঃ কমতে থাকে। ১৯৯৪ সালের জনগণনার সময়ে, 'বো' গোষ্ঠীর মাত্র ১৫ জন মানুষ জীবিত ছিলেন। বোয়া সোয়ারের ভাষার লিপি কোনোদিন তৈরি হয়নি।আমাদের সরকারের তরফ থেকে সেই ভাষাকে সংরক্ষণ করার যথেষ্ট আগ্রহ দেখানো হয়নি। তাই তাঁর সঙ্গেই হারিয়ে গেল না জানি কত প্রাচীন ওষুধের হদিশ, কিংবা সমুদ্রের নানার অজানা তথ্য, কিংবা একেবারেই অজানা লোককথার সম্ভার।
নিচের ভিডিও ক্লিপে শোনা যাবে বোয়া সোয়ারের গাওয়া গান
সারা পৃথিবী জুড়ে এইরকম হারিয়ে যাওয়া, মরে যাওয়া ভাষার, একা হয়ে যাওয়া মানুষদের গল্প ছড়িয়ে আছে। সব মানুষ মারী উইলকক্সের মত উদ্যোগী হতে পারেন না, বা সাহায্য পান না। মারী উইল্কক্স যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর ভাষায় কথা বলার মানুষের সংখ্যা কমে আসছে, তখন তিনি নিজের ভাষার অভিধান লিখতে শুরু করেন। ইচ্ছামতীতে মারী উইলকক্সের গল্প আমরা আগেই বলেছি। বিষয়টা শুধু ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার নয়। ভাষাটার সঙ্গে তো জড়িয়ে আছেন একজন বা অনেকজন মানুষও। আমরা একে অপরের ভাষা বুঝতে পারছি না বলে একে অপরকে নিজেদের সমস্যার কথা বলতে পারছি না, একে অপরকে সাহায্য করতে পারছি না, এক সঙ্গে বসে কোনো একটা সমস্যার সমাধান করতে পারছি না। এই পৃথিবীজুড়ে বেশিরভাগ প্রান্তিক মানুষজন, বিশেষ করে জঙ্গলের গভীরে থাকা, শহুরে জীবন থেকে অনেক দূরে থাকা মানুষজন বারবার এই ফারাকের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, হয়েই চলেছেন।
এইসব মানুষদের কথা ভেবেই, ২০১৯ সালকে ইউনেস্কোর তরফে 'ইন্টারন্যাশ্নাল ইয়ার অফ ইন্ডিজেনাজ ল্যাঙ্গুয়েজেস' ( International Year of Indegenous Languages) হিসাবে ঘোষণা কর হয়েছে। বাংলা করলে বলতে পারি আন্তর্জাতিক দেশীয় ভাষা বর্ষ । ইউনেস্কোর এই বছরের কর্মকান্ডের মূল ভাবনা হল ' জ্ঞান এবং সাংকৃতিক বৈচিত্রের আদান প্রদান, শান্তি বজায় রাখা এবং সবার মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য, সৌভ্রাতৃত্ববোধ ও উন্নয়নে বিভিন্ন দেশীয় ভাষার অবদান'।
আমাদের সবার চেনা এক আদিম জনজাতি গোষ্ঠীর মেয়ে হল 'মোয়ানা', যাকে নিয়ে ২০১৬ সালে তৈরি হয়েছিল একই নামের ডিজনির জনপ্রিয় অ্যানিমেটেড ছবিটি। এই ছবিতে কিশোরী মোয়ানা সমুদ্রে পাড়ি দেয় জীবনের দেবী তে ফিতি-র হৃদয় উদ্ধার করে আনতে, যা কিনা উপদেবতা মাউই চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। এমন জমজমাট রহস্য- রোমাঞ্চ ভরা ছবি কি আমরা দেখতে পেতাম, বা তে-ফিতি কিংবা মাউইকে চিনতে পারতাম, কিংবা পলিনেশিয়ার জনজাতি, লোককথা, জীবনযাত্রা নিয়ে আমাদের আগ্রহ জন্মাতো, যদি না আমাদের মোয়ানার সঙ্গে পরিচয় হত? পলিনেশিয়ার মানুষেরাও উপনিবেশকারীদের সঙ্গে যুদ্ধে কম ক্ষতিগ্রস্ত হন নি। কিন্তু বিভিন্ন ভাবে তাঁদের প্রাচীন জ্ঞানভান্ডার উদ্ধার করা হয়েছে, লেখা হয়েছে, সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। তাই আমরাও আরও একটা নতুন গল্প উপভোগ করতে পারলাম।
কে জানে, শুধুমাত্র ভাষার দূরত্বের কারণে কিংবা ভাষাটা হারিয়ে গেল বলে, আরও কত কত মোয়ানা সঙ্গে আমাদের আর আলাপই হল না!
তথ্যসূত্র ও ছবিঃ
ইউনেস্কো
সারভাইভাল ইন্টারন্যাশ্নাল
দ্যনিউজমিনিট
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ যুধাজিৎ সরকার