তুলি অবশ্য ওর গল্পটা পত্রিকায় প্রকাশ করেছে। গৌরীপুর গ্রাম আগে যেমন ছিল তেমনই আছে। তুলি, ঈশিতা, অরুণিমা ও রমা চায় আবার একটা রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে। এর মধ্যে অরুণিমা মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
এছাড়া মিতিনমাসি পড়ে ওদের খুব আগ্রহ জেগেছে। ওরা মিতিনমাসির ফ্যান ক্লাব তৈরি করেছে। মিতিনমাসি সম্পর্কে ওরা বিভিন্ন আলোচনা ও গল্প করে। ওরা মিতিনমাসির বাড়িতে যেতে চায়। কিন্তু এখনও হয়ে ওঠে নি।
আজ রবিবার। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। গাছপালা সবুজ হয়ে উঠেছে। যেন কেউ এসে সবুজ রং ঢেলে দিয়ে গেছে। তুলি ও অরুণিমা ছাতা মাথায় দিয়ে বাড়ি ফিরছিল হঠাৎ ওরা দেখল হরেন চ্যাটার্জীর বাড়ির সামনে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিমা বলল, ওখানে জটলা কেন? কী হয়েছে? চলতো গিয়ে দেখি, তুলি বলল। ওরা ভিড়ের মধ্যে ঢুকল। সেখানে ঈশিতা ও রমাও ছিল। তুলি কী হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে রমা বলল, খুব চোরের উপদ্রব বেড়েছে। কাল রাত্রে চোর এসেছিল কিন্তু কিছু নেয় নি। তবে রিম্পার পিসির ঘর থেকে একটা পুরোনো বাক্স পাওয়া গেছে। ঈশিতা বলল এখন বাড়ি যাই খুব জোর বৃষ্টি পড়ছে। ওরা বাড়ির দিকে চলল। পথে যেতে যেতে ওরা ঐ বাক্সটার মধ্যে কী আছে তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল। তুলি বলল সেটা জানার জন্য কাল সকালে রিম্পাদের বাড়ি যাবি? সবাই ঠিক করল কালকেই তারা রিম্পাদের বাড়ি যাবে। ইতিমধ্যে বৃষ্টি কমে গেছে। সবাই যে যার বাড়ি পৌঁছে গেল।
আজ সোমবার। অরুনিমা বলল, কি রে আজ রিম্পাদের বাড়িতে যাবি না? আগে রমা ও ঈশিতারা তো আসুক। এমন সময় গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। একটা বড় গাড়ি তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এল। বাইরে এসে দেখল রমা ও ঈশিতা দাঁড়িয়ে আছে। রমা বলল, হঠাৎ করে ঠিক হল, আমরা কুড়ি দিনের জন্য পুরী ও দিঘা বেড়াতে যাচ্ছি। এই বলে দুজনে গাড়িতে উঠে বসল। ওদের চোখের পলক পড়তে না পড়তে গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে চলে গেল। ঘরে এসে অরুণিমা বলল, এবার রিম্পার বাড়ি চল। ওরা রওনা দিল।
বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে। দুজনে বেরিয়ে পড়েছে। ওরা দেখল মাঠে বীজধান পোঁতা হচ্ছে। গাছপালায় নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। ওরা দেখল মৌমিতা ও সুদীপা মাছ ধরছে। তারপর ওরা রিম্পাদের বাড়িতে পৌঁছে গেল। তুলি ও অরুনিমা এখানে আসার সব কারণ রিম্পাকে খুলে বলল। রিম্পা বলল আমি এই কারণেই তোদের বাড়ি যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু তোরা নিজেরাই চলে এলি। চল, এবার পিসির ঘরে যাওয়া যাক। পিসির ঘরের দরজা খোলা ছিল। তাই ওরা সহজেই ঢুকে গেল।
পিসির ঘরের চারিদিকে ধুলো। মাকড়সার জালে ভর্তি। দেওয়ালে প্রচুর প্রাকৃতিক দৃশ্য ও লেখকদের ছবি ছেঁড়া অবস্থায় রয়েছে। রিম্পা খাটের নীচ থেকে একটা বাক্স বের করল। তার ওপর লাল কাপড় দেওয়া। তালাটায় মরচে ধরে গেছে। ঘরে একটা লাঠি ছিল। অরুনিমা লাঠিটা দিয়ে তালাটা ভাঙল।বাক্সটার ভিতরে একটা কাগজ মোড়া আছে। অরুনিমা তাড়াতাড়ি কাগজটা খুলল। কাগজে লেখা আছে ‘অতিদর্পে হত লঙ্কা’। ও লক্ষ্য করল বাক্সের একধারে গোল পাথরের মতন কী পড়ে আছে। কেউ কিছু নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাই এই চিঠিটা ও জিনিসটা সাংকেতিক চিহ্ন হিসেবে রেখে গেছে। যাতে কেউ জিনিসটা উদ্ধার করে। তারপর তুলি বলল, চল বাড়ি যাই। পরে আবার আসব। দুজনে বাড়ি চলে গেল।
অরুনিমা পড়া থেকে বাড়ি ফিরছিল। সামনের মাসেই টেস্ট পরীক্ষা। ইতিমধ্যে লোডশেডিং হয়ে গেছে। অরুনিমা টর্চ জ্বালিয়ে যাচ্ছে। দেখল কেউ যেন পিছনে হাঁটছে। পিছন ফিরে তাকাল। কেউ নেই। হঠাৎ টর্চের আলোয় দেখতে পেল,কেউ যেন লাঠি দিয়ে মারবে বলে আসছে। অরুনিমা ক্যারাটে শেখে। তাই ও আচমকা প্রচন্ড জোরে একটা লাথি কষাল। লোকটা একটু দূরে ছিটকে পড়ল। তারপর লোকটা মারতে আসায় অরুনিমা আবার একটা লাথি কষাল। লোকটা তাড়াতাড়ি দৌড়ে পালাল। বাড়ি ফিরে তুলিকে সব বলল। লোকটা যে মারামারিতে ভালো নয় তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। কারণ সামনে কয়েকটা পাথর ছিল। লোকটা এমন ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে সেই ভয়ে কিছুই করতে পারেনি। লোকটার মুখটা দেখা যায়নি। কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। শুধু চোখদুটো দেখা যাচ্ছিল। চাঁদের আলোয় দেখা গেল, লোকটা কালচে কালারের জামা পড়ে ছিল। একটা চোখের দৃষ্টি একটু কঠিন লাগল। খাওয়াদাওয়ার পর, তুলি বলল, চোরটাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কারণ চোরটা যদি পাইপ বেয়ে না ঢুকত, তাহলে হয়তো বাক্সটা খুঁজে পাওয়া যেত না। লোকের কুসংস্কারে ওই ঘরে ভূতই থেকে যেত।এরপর দুজনে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।
আজ রবিবার। সকাল ছ’টা বাজে। তুলি ও অরুনিমা দুজনে পড়ার জন্য বাইরে বেরোল। বাইরে এখন বৃষ্টি থেমেছে। কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। এইসময় ওরা দেখল রিম্পা দৌড়োতে দৌড়োতে আসছে। রিম্পা ওদের দেখে বলল, কাল রাতে পিসির ঘরে কেউ একজন ঢুকেছিল। আমি যখন জল খেতে যাচ্ছিলাম, তখন দেখেছিলাম। তাছাড়া লোকটার গায়ে কালচে রঙের জামা ছিল। তারপর লোকটা হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়ল।লোকটার একটা চোখ কেমন লাগল।তুলি বলল, তোকে দেখতে পায়নি? না, আমি সরে দাঁড়িয়েছিলাম। অরুনিমা বলল, আজকে পড়তে গিয়ে কোনো কাজ নেই। চল, বাড়ি যাই। তারপর অরুনিমা রিম্পাকে বলল, তুই বাড়ির প্রত্যেকের ওপর নজর রাখবি। আর তাছাড়া পিসির কে ছিল? রিম্পা বলল, পিসির দুই যমজ ছেলে ছিল। খুবই বাজে ছিল। মন দিয়ে পড়াশুনা শেখেনি।সবসময় বাড়ির বাইরে ঘুরে বেড়াত।
দুজনে বাড়ি পৌঁছে গেল। তুলি বলল, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এই লোকটা আর ওই লোকটা সমান। এখন সকাল হয়ে গিয়েছে। দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। এবাড়িতে কেউ আটটার আগে ওঠে না। এখন সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিট। এখন বেশ খানিকটা রোদ উঠে গেছে। অনেক বাড়িতে কাজ শুরু হয়ে গেছে। তুলি বলল, আচ্ছা এটা পিসির ছেলে কিছু করেনি তো? অরুনিমা বলল,রিম্পার কথায় বুঝলি না, পিসির ছেলে মরে গেছে। তুই একটা আস্ত বোকা। সে এখন ভূত হয়ে এসে ওই ঘরে ঢুকবে আর আমাদের মারতে আসবে?
সকাল আটটা বাজে। বাড়ির সবাই উঠে পড়েছে। তুলি ও অরুনিমা বাড়িতে বলেছে, আজ পড়ার ছুটি দিয়েছে। এখন দুজনে খাচ্ছে। হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। তুলি গিয়ে ফোনটা ধরল। ফোনের ওপাশ থেকে রিম্পার গলা ভেসে উঠল।আমাদের ভাড়াটেরও একটা চোখ পাথরের। রিম্পা লোকটা ফোনটা ছেড়ে দিল। তারপর তুলি অরুনিমাকে সব কথা বলল। তারপর অরুনিমা বলল, চল এখন রিম্পাদের বাড়িতে যাওয়া যাক। এখন রিম্পাদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা লোকে ভরে গেছে। ওরা দেখল, রিম্পা পাশের বাড়িতে ফুল তুলছে। তুলি বলল, চল ওকে ডেকে নিয়ে যাই। তার উত্তরে ও বলল, এখন ডাকাডাকি করার প্রয়োজন নেই। আমরা গিয়ে দেখে আসি। রিম্পাদের বাড়ি দুজনে পৌঁছে গেল। অরুনিমা রিম্পার পিসির ঘরে ঢুকল। ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বাইরে তুলিকে পাহারায় রেখে দিল। অরুনিমা হঠাৎ লক্ষ করল, ঘরের এককোণে একটা ডাইরি পড়ে আছে। অরুনিমা ডাইরিটা নাড়াচাড়া করে দেখল। ডাইরিটা প্যান্টের পকেটে ঢোকাল। তারপর তুলিকে নিয়ে অরুনিমা বাড়ি ফিরে এল। বাড়ি ফিরে অরুনিমা ডাইরিটা পড়তে বসল। সেই যে পড়তে বসল আর উঠছে না। তুলি মাঝপথে কথা বলতে গিয়েছিল, কিন্তু অরুনিমা যে কে সেই!
ডায়েরিটা খানিকটা পড়া শেষ করে, অরুনিমা রিম্পাকে ফোন করল। বলল, রহস্য অর্ধেক প্রায় সমাধান হয়ে গেছে। আমি তোদের বাড়ি আরেকবার যাব। তুই পিসির ছেলেদের ফোটো জোগাড় করে রাখবি। রিম্পা বলল, আমাদের বাড়ির উলটো দিকের গলিতে একটা লোক বাড়ি কিনেছে। ওই লোকটা সরকারের বড় অফিসে কাজ করে। আমি অনেকসময় দেখেছি, লোকটা আমাদের বাড়ির চারপাশে ঘোরে। অরুনিমা ফোনটা ছেড়ে দিল। তুলি ওকে জিজ্ঞেস করল, ডাইরিতে কী লেখা আছে? তার উওরে অরুনিমা বলল, এখন তো সবে কুঁড়ি ফুটেছে। ফুল ফুটলে তবে তো বোঝা যাবে গন্ধটা কেমন! মাঝে মাঝে কীসব কথা যে বলে দিদি!
গভীর রাত। বাড়ির সবাই অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। তুলি ও অরুনিমা নিজেদের ঘরে ঘুমোচ্ছে। বাড়ির পাশের গাছে পেঁচা ডাকছে। বৃষ্টি হওয়ার জন্য হালকা ঠান্ডা পড়েছে। হঠাৎ একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। অরুনিমার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। অরুনিমা উঠে দরজাটা খুলল। সে তুলির দিকে তাকিয়ে ভাবল, এখন আমাকে একাই যেতে হবে। স্বয়ং ভগবানও এসে তুলিকে জাগাতে পারবে না। এইজন্যই তো বাড়ির সবাই ওকে কুম্ভকর্ণ বলে।হালকা ঠান্ডার জন্য ও গায়ে চাদর জড়িয়ে নিল। সাথে একটা টর্চ নিল। অরুনিমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বাড়ি থেকে ওর সাইকেল নিয়ে এল। গাড়িটা স্টার্ট দিল। সরকারের বড় লোকটার বাড়ির সামনে গাড়িটা থামল। লোকটা গাড়িতে উঠল। গাড়িটা প্রচন্ড জোরে চলছে। অরুনিমার সাইকেলটা প্রচন্ড জোরে চলছে। চলছে বলার চেয়ে ছুটছে বলাটাই ভাল। গাড়িটা থামল। অরুনিমার সাইকেলও থামল। এতক্ষণ অরুনিমা জোরে চালাচ্ছিল না, বরং ওর সাইকেলটাই নিজে চলছিল।
গাড়িটা একটা বড়ো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। অরুনিমা গাছের পিছনে সাইকেলটা রেখে দিল, যাতে কেউ দেখতে না পারে। লোকগুলো বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। গেটটা ভেজানো ছিল। তাই সহজেই ঢুকে অরুনিমা আস্তে আস্তে বারান্দার সিঁড়ির ওপরে উঠল।বাঁদিকের একটা ঘরে ওরা ঢুকেছে। আস্তে আস্তে দরজাটা ফাঁক করল।ওই লোকগুলো ওই ঘরেই ঢুকেছে। ঘরটা পরিষ্কার আছে। অর্থাৎ লোকগুলো প্রায় ঢোকে। লোকগুলো ঘরের মধ্যে তাস খেলছে। কিছুক্ষণ পর একটা লোক বলে উঠল, এবার আমাদের খুঁজতেই হবে। সেদিন লোকগুলো উঠে পড়ায় পালাতে হল। যে লোকটা মাঝখানে বসে ছিল সেই লোকটা বলে উঠল, সব তো তোর জন্যই হল। ঘরেতো এত জিনিস ছিল, তার পিছনে লুকোনো যেত না? একটা বোকার মতো পালিয়ে এলি। তুই হলি এক নম্বরের গাধা। যে লোকটা প্রথমে কথা বলেছিল, সেই লোকটা আবার বলল, তুই হলি এক নম্বরের মোষ। এবার সরকারের বড় লোকটা বলে উঠল, তোরা কি থামবি এবার? কিছুক্ষণ কথা বলার পর লোকগুলো বেরিয়ে পড়ল।
লোকগুলো চলো যাওয়ার পর, অরুনিমা জানালাটার মধ্যে দিয়ে ঘরের মধ্যে চলে গেল। কারণ জানালায় তিনটে শিক নেই।সহজেই ঢুকে গেল। লাইটটা জ্বালাল। যে মাদুরটার ওপর ওরা বসেছিল, সেটা একপাশে জড়ো করা। অরুনিমা লক্ষ করল, একটা কার্ড টেবিলের ওপর পড়ে আছে। হয়তো ভুল করে ফেলে গেছে।কাছে যেতেই দেখল, কার্ডটা আসলে পাসপোর্ট। আর কোথাও কিছু পেল না।লাইটটা নিভিয়ে দিল। তারপর জানালাটা বন্ধ করে বেরিয়ে এল। সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরে এল। ভোর হয়ে গেছে। ও স্কুল ব্যাগের মধ্যে পাসপোটর্টা ঢুকিয়ে দিল। তারপর আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল। ঘুম আসছে না। খানিকক্ষণ পর, ও উঠে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল।
সূর্য পূর্ব দিকে উঠছে। ভোরের রঙের আভাস এত সুন্দর যে, মুগ্ধ হয়ে অরুনিমা দাঁড়িয়ে দেখছিল। ভোরের মৃদু আলোতে চারিদিক সুন্দর হয়ে উঠেছে। পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ ও ব্যালকনি থেকে ঘরে চলে এল। দরজা খুলে ও নীচে ডাইনিং রুমে বেসিনের পাশে এল। বেসিনের পাশে পুরোনো কাগজ ডাঁই করা থাকে। কিছুক্ষণ কাগজ ঘাঁটাঘাঁটির পর, ওপরে চলে গেল। এরমধ্যে তুলি উঠে পড়েছে। ঘরে এসে ও কাল রাতের কথা ও তুলিকে সব বলল। তা শুনে তুলি বলল, বাট্ তুই এই কাগজটা নিয়ে এলি কেন? কিছুদিন আগে কাগজে প্রশান্ত দত্ত বলে একজনের কথা বেরিয়েছিল। খুব ছোটো খবর। কাকে যেন একটা খুন করেছিল। একবার জেলে গেছে, তারপর আর ধরা যাচ্ছে না। পাসপোর্ট-এ সরকারের বড় লোকটার ছবি আছে। কাগজে একই লোকের ছবি আছে।–তার মানে দুজনে একই লোক।–সম্ভবত। তখন অতটা খেয়াল করিনি। আজ স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে ছুটি। চল, একবার ঢাকুরিয়ায় মিতিনমাসির বাড়ি যাই। তুলিও বলল, চল আজই যাওয়া যাক।
সকাল এগারোটা বাজে। শিয়ালদা গিয়ে অটো ধরে ঢাকুরিয়ায় নেমে পড়েছে তুলি ও অরুনিমা। ঢাকুরিয়ায় এমন কোনো মানুষ নেই যে প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জির নাম শোনেনি। ফ্ল্যাটে বেল বাজাতেই একটা মেয়ে এসে দরজা খুলল। বলল, কাকে চাই? অরুনিমা তার উওরে বলল, এটা কি প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জির বাড়ি? তিনি কি এখন বাড়িতে আছেন? মেয়েটি উওরে বলল, হ্যাঁ, আছে। বসো। এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি। পার্থমোসো জিজ্ঞেস করল, ওরা কারা? মেয়েটি বলল, ওরা দিদির সাথে দেখা করতে এসেছে। মিতিনমাসি এসে সোফায় বসল। বলল, তোমাদের কী চাই? অরুনিমা বলল, আমি হচ্ছি অরুনিমা। এ হচ্ছে আমার বোন তুলি। মিতিনমাসি বলল, আমি হচ্ছি প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি। এ হচ্ছে আমার বোনঝি টুপুর এবং অ্যাসিট্যান্টও। অরুনিমা বলল, আপনি কাজের মানুষ। আপনার সময় নষ্ট না করে কথা বলতে শুরু করি। মিতিনমাসি সব কিছু শুনল। পাসপোর্টটা অরুনিমা মিতিনমাসিকে দেখাল।মিতিনমাসি বলল, তুমি আমার কার্ডটা নাও। আমি তোমাকে ফোন করে জানিয়ে দেবো। এছাড়া এই কাজটাতে হয়তো টুপুর তোমাদের সাহায্য করতে পারে। পার্থমেসো বলল, কীরে টুপুর, তুই তোর মাসির মতো কেস পেয়ে গেলি রে! তাহলে এক্ষুনি তোর কাজটা শুরু করে দে। এছাড়া মিতিনমাসি বলল, পরশু টুপুর তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছে। একটু পরে দুজনে বেরিয়ে পড়ল।
ওদের যাওয়ার পর পরশু দিন টুপুর চলে এল। ওদের বাড়িতেই একটা ঘরে থাকে। পরিচয় দিয়েছে একজন ফোটোগ্রাফার হিসেবে। স্কুলের ম্যাগাজিনে গ্রামের ছবি দেওয়ার জন্য এসেছে। সত্যি বললে হয়ত ওদের খুব বকা খেতে হত। তবে তুলির খুব রাগ হয়েছে ওদের ওপর। কথাবার্তা নেই, ওকে ছাড়াই , দুজনে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর ফিরছে রাত্রিবেলা। হঠাৎ অরুনিমা বলল, রহস্য অনেকটা মিলে গেছে। তুলি বলল, খুব ভাল। তোরা যখন আমাকে ছাড়া রহস্য বার করছিস, বাকিটাও করে দে। অরুনিমা বলল, তুই শুধু শুধু রাগ করছিস। ওই পাসপোর্টটা আসলে নকল। লোকটাকে একবার ওর সহকারীরা দত্তদা বলে ডেকেছিল। এইটা মনে পড়ায় রহস্যটা আরো সহজ হয়ে গেল। প্রশান্ত দত্তের কথাটা মিতিনমাসিকে বলেছিলাম। মিতিনমাসি খোঁজখবর নিয়ে বলেছিলো, লোকটা অনেক বড় স্মাগলার। জেলে গেছে একবার। এখন আর ধরা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গুপ্তধনটা কোথায়? দ্বিতীয়ত,এছাড়া আমার মাথায় রিম্পাদের বাড়ির ভাড়াটে মারতে এসেছিল।–তুই কীভাবে জানলি?-সেটা পরে বলব।- এছাড়া গুপ্তধনটা কোথায় রয়েছে? একটু পরে তুলি শুয়ে পড়ল। কিন্তু অরুনিমা সেই ডাইরিটা আবার পড়তে শুরু করল।
গভীর রাত। চারিদিকে শুনশান। জ্যোৎস্নার আলোয় চারিদিক মায়াময়। অরুনিমা ডায়েরিটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ অরুনিমার ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখল কয়েকটা লোক কোথায় যাচ্ছে। হাতে টর্চ। তুলিকে এখন হাজার বার ডাকলেও উঠবে না। টুপুরকে ডাকল। দুজনে মিলে লোকগুলোর পিছনে যেতে লাগল। লোকগুলো রিম্পার বাড়ির দিকে যেতে লাগল। ওদের বাড়িতে যে ভাড়াটে থাকে, সেই লোকটা বেরিয়ে এল। লোকগুলো সকলে মিলে পাইপ বেয়ে রিম্পার পিসির ঘরে ঢুকল। ওরা দুজনে পাইপ বেয়ে ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। শুধুমাত্র টুপুর একটু দেখতে পেল লোকগুলো ঘরটাকে ওলটপালট করছে, যেন কিছু খুঁজছে। হঠাৎ লোকগুলো খোঁজা বন্ধ করে দিয়ে নীচে নেমে এল। তারপর লোকগুলো সরকারের বড় লোকটার বাড়িতে ঢুকে গেল।
পরের দিন সকাল। তিনজনে মিলে রিম্পাদের বাড়িতে গেল। টুপুরের সাথে রিম্পার পরিচয় করিয়ে দিল। অরুনিমা রিম্পার পিসির ঘরে গেল। তিনজনকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে গেল। হঠাৎ অরুনিমা দেখতে পেল, খাটের তলায় একটা চাবির গোছা পড়ে আছে। খুব নোংরা। দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন হাত পড়ে না। গোছাটা ও হাতে নিল। হঠাৎ ও ম্যাগনিফায়িং গ্লাস বের করে দেখল, আয়নার ড্রয়ারের গায়ে খুব সূক্ষ্ম ভাবে খোদাই করা 1b । হঠাৎ ও দেখল, খাচের তলায় একটা চাবির গোছা পড়ে আছে।সেটা হাতে নিয়ে দেখল,একটা চাবির গায়ে খোদাই করা 1। ড্রয়ারটা খুলল। ড্রয়ারের ভিতর একটা চাবি লাগানোর জায়গা ছিল। সেখানে ও চাবিটা লাগাল। অরুনিমা বাক্সটা খুলল। বাক্সের মধ্যে থরে থরে গোল পাথর। অরুনিমা চাবিটা লাগিয়ে সবকিছু বন্ধ করে। কয়েকটা পাথর পকেটে নিল। দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে হুররে বলে চেঁচিয়ে উঠল। বলল, রহস্য সমাধান হয়ে গেছে। তুই বাড়ির সবাইকে পরশু রাতে জড়ো হতে বলবি। এমনকি ভাড়াটেকাকুকে জড়ো হতে বলবি। আর বাবাকে সব কথা বলবি। পুলিশ যেন পুরো বাড়িটা ঘিরে থাকে। এমনকি সরকারের বড় লোকটাকে থাকতে বলবি। কথায় আছে না ,ওস্তাদের মার শেষ রাতে!
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজে। সবাই রিম্পাদের বাড়ির ড্রয়িং রুমে জড়ো হয়েছে। অরুনিমা আসেনি, কিন্তু তুলি ও টুপুর এসে গেছে। আটটা বাজার দশ মিনিট আগে, আগে অরুনিমা আসল। বলল, একটু দেরী হয়ে গেল। এখানে যারা উপস্থিত আছেন সকলেই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কেন আমি সবাইকে এখানে ডেকেছি। এবার আমি বলতে শুরু করছি। প্রথমত এই বাড়িতে নাকি চোর ঢুকেছিল। কিন্তু কিছুই চুরি যায়নি। চোর রিম্পার পিসির ঘরে ঢুকেছিল। একটা বাক্স পাওয়া গেছে ঘরে। আমার সন্দেহ হয়েছিল, একটা চোর কেন বাক্স নিতে আসবে? সবাই ভেবেছিল, ওই বাক্সটাতে আর কী থাকবে? তাই যথারীতি ওটা কেউ খোলার চেষ্টা করেনি। বাক্সটার তালায় মরচে পড়ে ছিল। আমি লাঠি দিয়ে তালাটা ভাঙি। ওতে আমি একটা গোল পাথর পাই। একটা কাগজে লেখা ছিল, ‘অতিদর্পে হত লঙ্কা’। অর্থাৎ কেউ কিছুর ওপর লোভ করেছিল। কিন্তু কে? কেন লিখেছিল?তারপর আমি একটা ডায়েরি পাই।সম্ভবত রিম্পার পিসির। ডায়েরিতে লেখা ছিল, পিসির দুই যমজ ছেলে ছিল। রিম্পাও আমাকে সেকথা বলেছিল।এছাড়া অমূল্য সম্পদের কথা লেখা ছিল।প্রথমে সেটা বুঝতে পারিনি।দুজনের তার ওপর লোভ ছিল। এক যমজ ভাই দুর্ঘটনায় মারা যায়। অন্যজন চুরি করে ধরা পড়ে যায়। সে মারামারিতে একটুও ভালো ছিল না।তারপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরমধ্যে উনি কতজন লোক নিয়ে একটা বাড়িতে ঢোকেন। সবাই সরকারের বড় লোকটার দিকে তাকাল। তিনি বলে উঠলেন, মিথ্যে কথা। অরুনিমা বলল, মিথ্যে কথা বললে হবে না। কারণ পুলিশের কাছে সব প্রমাণ আছে। ওনাদের পিছু করে চলতে লাগলাম।ওনারা বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকি। একটা পাসপোর্ট পাই। পাসপোর্টে ওনার ছবি ছিল। এছাড়া অনেকদিন আগে এনার ছবি কাগজে বেরিয়েছিল।উনি বলেছেন ওনার নাম সমীর রায়। আসল নাম প্রশান্ত দত্ত। তখনও উনি এখানে বাড়ি কেনেননি। আমি পাসপোটর্টা নিয়ে টুপুরের মাসির কাছে গিয়েছিলাম। এছাড়া ওনার কথা বলেছিলাম। পাসপোর্টটা আসলে নকল। এছাড়া উনি অনেক বড় স্মাগলার। এরমধ্যে কেউ একজন আমাকে মারতে আসে। তার একটা চোখের দৃষ্টি কেমন ছিল। পরে মনে হল পাথরের।আরেক রাতে উনি ভাড়াটেকাকুকে নিয়ে পিসির ঘরে ঢুকেছিল। যেন কিছু খুঁজছে। তাহলে এর আগে উনিই পিসির ঘরে ঢুকেছিল। আমার প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, যে ওনারা বাইরের লোক, ওনারা কী করে জানবেন এই বাড়িতে কী মূল্য সম্পদ আছে? রিম্পা আমাকে ওর পিসির ছেলের ফোটো দিয়েছিল। এনার দাড়ি গোঁফ খুললে পিসির ছেলের মতো দোখায়। উনি এখানে ভাড়াটে সেজে থাকছিলেন। কারণ তার মা বেঁচে থাকতে তাকে এই গুপ্তধনটা পেতে দেবে না। তাই পালিয়ে গেছিল। অনেকদিন পর শোনে তার মা মারা গেছে। ততদিনে উনি এনার দলে চলে গেছে। তারপর উনি এখানে বাড়ি কেনেন। ছোটো ভাইটি আমাকে মারতে এসেছিলেন। আমাকে যে মারতে আসে তার চোখও পাথরের ছিল। ভাড়াটেকাকুরও একটা চোখ পাথরের। এরফলে আরও সহজে বোঝা গেল। তারপর আমি রিম্পার পিসির খাটের নীচে থেকে একটা চাবির গোছা পেয়েছিলাম। এছাড়া ড্রয়ারের গায়ে ছোট্ট করে লেখা ছিল 1b । একটা চাবির গায়ে খোদাই করা ছিল 1 । ড্রয়ারের ভিতর চাবি লাগানোর ছোট্ট জায়গা ছিল। চাবিটা লাগাতেই একটা ছোটো বাক্স বেরিয়ে এল। তাতে থরে থরে গোল পাথর ছিল। আমি দুটো পাথর নিয়ে মিতিনমাসির কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, এগুলো না পালিশ করা হিরে।
প্রশান্ত দত্তের দলবলকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। রিম্পাদের বাড়ির সবাই অরুনিমাকে ধন্যবাদ জানাল। অরুনিমা টুপুরকে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। এখানে এসে সাহায্য করার জন্য। টুপুর বলল, আমার খুব ভালো লেগেছে এখানে এসে। প্রশান্ত দত্তের বাড়ি থেকে অনেক পশুর চামড়া পাওয়া গেছে। যেগুলিকে উনি বিক্রি করতেন। তুলি ভাবছিল, ওই লোকটার জন্য কত পশুকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ও নিজে একটা পৃথিবী গড়ে তুলবে যেখানে সব ভালমানুষ থাকবে। আর সুন্দর সুন্দর পশু থাকবে। এই ভেবে সে পশ্চিম দিকে ঢলে পড়া সূর্যের দিকে তাকাল।
গল্প লিখেছেঃ
তনুশ্রী দাস,
সপ্তম শ্রেণি, বারাসাত কালীকৃষ্ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়
ছবিঃ মিতিল এবং পিক্সাবে