বিমল ঘটক তথা কিপ্টে জ্যেঠু থাকেন কলকাতার একটি বিলাসবহুল হাউসিং কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাটে, যেটি তাঁর আমেরিকাবাসী ছেলে কিনে দিয়েছে। এত টাকা খরচা করে ফ্ল্যাট কেনাতে প্রথমে বিমলবাবু রেগে গেলেও, এখন তাঁর বেশ লাগে ওখানে থাকতে। এহেন বিমলবাবুর আজকে শীতের সকালে মনটা খুব খুশি, গতকাল রাতে নাগপুরের পিসির বাড়ি থেকে এক বাক্স কমলালেবু এসেছে পার্সেল হয়ে। ব্রেকফাস্টে যখন দুটো টোস্ট খেয়ে সবে একটা কমলালেবু নিয়ে খেতে যাবেন ঠিক সেই সময়ে কলিং বেল বেজে উঠলো। বিরক্তি সহকারে উঠে গিয়ে দরজা খুলে খুব অবাক হয়ে গেলেন, ঠিক দেখছেন তো ! অনেক বছর বাদে দেখলেও চিনতে পারলেন, শক্তিদা - শক্তিপদ খাঁড়া, লম্বা রোগা চেহারা, এক মুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ, তফাত বলতে চুল দাড়ি আগে কালো ছিল, এখন বেশির ভাগই পাকা। "কিরে বিল্লু, খুব অবাক হয়ে গেছিস মনে হচ্ছে, আমাকে দেখে?" গলার স্বরটা খালি একটু আলাদা মনে হল, হয়তো, বয়সের কারণে এরকম শোনাচ্ছে। “আর কতক্ষন দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি?” চকিতে নিজেকে সামলে নিয়ে বিমলবাবু, শক্তি দা কে আপ্যায়ন করে ঘরে এনে বসালেন।
"কেমন আছিস বল?" সোফায় হেলান দিয়ে জানতে চাইলেন শক্তিদা।
"আমি ভালো আছি, তোমার কি খবর শক্তিদা?"
"খবর তো তোর নেই ভাই, আমি তো ভাবলাম আমাকে দেওয়া কথার মতো, তুই আমাকেও ভুলে গেছিস।”
তখনও বিমলবাবু মহেশগঞ্জে বাবার সঙ্গে থাকতেন। শক্তিদা ছিলেন পাড়াতুতো দাদা। একবার এক বন্ধুর সঙ্গে পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে বিমলবাবু জলে পরে যান, সেই সময় শক্তিদা ওনাকে বাঁচান। পাড়াগাঁয়ের ছেলে হলেও বিমলবাবু সাঁতার জানতেননা, কারণ ওঁর জন্মের পর এক সাধুবাবা বলেছিলেন জলেতে ফাঁড়া আছে, তাই কেউ ওঁকে জলের ধারেকাছে যেতে দিতোনা। সেবারেও বাবাকে লুকিয়ে বন্ধুর সঙ্গে গিয়ে এই বিপত্তি ঘটান।
বিমলবাবুর বাবা রঞ্জিত বাবু, শক্তিদাকে নিজের ছেলের প্রাণের বিনিময়ে কিছু দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শক্তিদা শত অনুরোধেও কিছু সাহায্য নিতে রাজি হননি। রঞ্জিতবাবু খালি বলতেন, “কারো ঋণ বাকি রাখতে নেই, একমাত্র মাতৃঋণ ছাড়া।” ঋণ বাকি রাখলে নাকি পরজন্মে যার কাছে ঋণ ছিল তার ক্রীতদাস হয়ে জন্মাতে হয়। মৃত্যুশয্যায় তাই তিনি ছেলেকে দিয়ে কথা দিইয়েছিলেন, যেন বিমলবাবু শক্তিদার ওই ঋণ অবশ্যই শোধ করে দেন, যেভাবেই হোক। বাবা মারা যাবার পর যখন বিমলবাবু পাকাপাকিভাবে নাগপুরে পিসির বাড়ি চলে যাচ্ছিলেন, তখন শক্তিদাকে, ঋণ কী করে শোধ করবেন জিজ্ঞেস করাতে উনি হেসে বলেন, "ভাই বিল্লু, নাগপুরে খাসা কমলালেবু পাওয়া যায়, তুই আমাকে কয়েকটা কমলালেবু শীতকালে পাঠিয়ে দিস, তাতেই তোর ঋণ শোধ হয়ে যাবে, আর কাকার আত্মাও শান্তি পাবে। তা সে যে কারণেই হোক, কমলালেবু আর পাঠানো হয়ে ওঠেনি বিমলবাবুর।
"না না তুমি কী যে বলো, তোমাকে কখনো ভুলতে পারি?" বিমলবাবু বলে উঠলেন।
"সেই তো, তা এখন তুই তোর কথা রাখবি তো? তোর বাড়িতে তো এক বাক্স কমলালেবু এসেছে, আমিও এসেছি, তাহলে বাধাটা কোথায় ? কী বলিস?"
একথা শুনে, বিমলবাবু হতবাক হয়ে গেলেন, কমলালেবুর কথা শক্তিদা জানলেন কোথা থেকে ! বিমলবাবুকে আরো অবাক করে শক্তিদা জানালেন যে, তিনি নাকি কমলালেবুর গন্ধ শুঁকেই ওখানে এসেছেন, তাঁর পাওনা আদায় করতে। কী বলছেন, শক্তিদা? কমলালেবুর গন্ধ শুঁকে সেই সুদূর মহেশগঞ্জ থেকে এখানে এসেছেন, পাগল হয়ে গেছেন নাকি! কমলালেবুর কথা তো শক্তিদার জানার কথা নয়, আর তাছাড়া কমলালেবুর মিষ্টি গন্ধে সারা ঘর ম ম করছে ঠিক-ই, কিন্তু সেই গন্ধ মহেশগঞ্জ অব্দি পৌঁছচ্ছে, এটা তো বিশ্বাসের অযোগ্য ! শক্তিদা বললেন, "আমাকে বাক্স টা তাড়াতাড়ি দিয়ে দে, অনেক দূর ফিরতে হবে তো আবার আমাকে।"
"পুরো বাক্সটা !" বিমলবাবুর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো।
"হ্যাঁ রে, এতগুলো বছরে সুদসমেত যা হয়, তার কাছে তো এক বাক্স কিছুই নয়, কাকার আত্মাও এতবছর বাদে শান্তি পাবে, তুই আর বেশি ভাবিস না, আমাকে দিয়ে দে, আমি রওনা হই।"
মন্ত্রমুগ্ধের মতো কমলালেবুর বাক্সটা এনে শক্তিদা কে দিয়ে দিলেন বিমলবাবু, বাবাকে দেওয়া কথাটা তো রাখতে হবে। শক্তিদাও বাক্সটা হাতে নিয়ে "তোকে ঋণমুক্ত করলাম" বলে বিদায় নিলেন।
বিমলবাবু কিছুক্ষন বসে রইলেন বসার ঘরে, কী যে হলো, ভেবে কিছু কুলকিনারা করতে পারলেননা। আজ অব্দি তাঁর থেকে এক টাকাও কেউ আদায় করতে পারেনি, আর তিনি কিনা একবাক্স কমলালেবু দিয়ে দিলেন ! সবচেয়ে বড়ো কথা, কমলালেবুর কথা শক্তিদা জানলেন কী করে ! তবে এটা ভেবে নিশ্চিন্ত হলেন যে, পরজন্মে শক্তিদার ক্রীতদাস হয়ে জন্মাতে হবেনা, আর বাবাও নিশ্চই এখন খুশি হয়ে বিমলবাবুকে আশীর্ব্বাদ করছেন। এমন সময় ছোটবেলার বন্ধু গিরিশের ফোন এলো। কথায় কথায় শক্তিদার আসার ব্যাপারে জানালে গিরিশ খুব অবাক হয়ে গিয়ে বললেন, "এ কী করে সম্ভব? একমাস আগে শক্তিদা ঋদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।" বিমলবাবু শুনে চমকে উঠলেন, একটু আগেই তো এই সোফাটায় বসেছিলেন, কিন্তু গিরিশ কিছুতেই মানতে চাইলেননা। ফোনটা রেখে দেবার পর বিমলবাবুর হাড়হিম হয়ে গেল। তিনি যেমন বসেছিলেন, সেরকমই বসে রইলেন সোফায়।
ওদিকে শক্তিদা কমলার বাক্সটা নিয়ে কিছুদুরের পার্কটাতে যখন পৌঁছলেন, তখন একঝাঁক কচি ছেলেমেয়ের দল তাঁকে এসে ঘিরে ফেললো। শক্তিদা সবাইকে শান্ত হতে বলে একটা ফাঁকা জায়গা খুঁজে একটা বেঞ্চে বসে পরলেন। পার্কে সেই সময় খুব বেশি লোকজন ছিলোনা। এবার আস্তে আস্তে তিনি পরচুল আর দাড়িটাকেও টেনে খুলে ফেললেন। তখন বাবলু জিজ্ঞেস করলো, "বলো না বান্টিদা, কি হলো?" বিজয়ীর হাসি হেসে টিনার পিসতুতো দাদা শক্তিরূপী বান্টি বললো, "রেজাল্ট তো তোদের সামনেই আছে, এই যে একবাক্স কমলালেবু।"
"যাক তবে এতদিনে কিপ্টে জ্যেঠুকে জব্দ করা গেছে।" বলে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো সানি।
"কিন্তু কি করে এ অসম্ভব সম্ভব হলো, সেটা তো বলো বান্টিদা?" জানতে চাইলো রিঙ্কি।
"তবে, আমার দাদা বলে কথা" টিনা বেশ গর্বের সঙ্গে বললো।
"বলছি বলছি, আমার জ্যেঠু ছিলেন শ্রী শক্তিপদ খাঁড়া, আমি তাঁর মুখে বহুবার শুনেছি এই বিমলবাবু মানে তোদের কিপ্টে জ্যেঠুর কথা। গতমাসে যখন জ্যেঠু মারা গেলেন, তখন পাড়ার কাকাজ্যেঠাদের আলোচনায় একবার শুনেছিলাম, যে বিমলবাবু নাকি এখানে থাকেন। তারপর মামারবাড়িতে এসে একদিন বিকেলে তোদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম যে, তোরা ওনাকে জব্দ করার ফন্দি আঁটছিস। তখনি দুয়ে দুয়ে চার করে তোদের এসে বললাম যে, আমি জব্দ করবো। তার আগেই অবশ্য আমি হাউসিং কমপ্লেক্সের দারোয়ানটার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম যে, তোদের কিপ্টে জ্যেঠুই আমাদের বিমলবাবু। ছোটবেলা থেকেই আমাকে আমার জ্যেঠুর জেরক্স কপি বলতো সবাই, তাই ভোল বদলাতেও অসুবিধা হলোনা।” এই বলে বিমলবাবুর বাড়িতে কি কি ঘটেছিলো তা সবিস্তারে বাচ্চাদের জানালো বান্টি।
"সবই তো বুঝলাম, কিন্তু তুমি কি করে জানলে যে পার্সেল টা এসে গেছে আর ওতে কি আছে?" রনি জিজ্ঞেস করলো।
“আরে, ওই দারোয়ানটাই আমাকে বলেছিলো যে, কিপ্টেজ্যেঠু ওকে একবাক্স কমলালেবুর পার্সেল আসার কথা জানিয়ে রেখেছিল। তখনি আমার জ্যেঠুর কথা মনে পরে গেল, আর আমিও রেডি হয়ে গেলাম। দারোয়ান ওই পার্সেল এসে যাবার খবরটা আমাকে জানাতেই আজকে সকালে এখানে এসে হাজির হলাম।”
"ও তাই তুমি বাবার নাটকের দাড়িগোঁফ আর পরচুল আমাকে লুকিয়ে এনে দিতে বলেছিলে !" টিনা বললো।
বান্টি ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বাক্সটা খুলে ফেললো, আর অমনি সবাই মিলে বাক্সের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
ছবিঃ শিল্পী ঘোষ