কী লিখব, কোথা থেকে শুরু করব ভাবছি। গত ২০ তারিখ, ভীষণ রাগী 'আম্ফান' সাইক্লোন দক্ষিণবঙ্গের ওপর দিয়ে তান্ডব চালিয়ে যাওয়ার পরে, সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছিল।জল নেই, বিদ্যুৎ নেই; ফোন,টিভি,ইন্টারনেট সব বন্ধ। আত্মীয়-বন্ধু কারোর খোঁজ নিতে পারছি্লাম না। সারা শহরের কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। কলকাতার আশেপাশের জেলাগুলির কী অবস্থা, জানতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে যেন বদ্ধ কারাগারে ঢুকে পড়েছি।
পরের দিন সকালের আলোয় দেখলাম, আমাদের বাড়ির সামনের অমলতাস গাছটা, যেটা ক্রমে ক্রমে হলুদ ঝুরঝুরে ফুলে ভরে উঠছিল, সেটার মাথা ভেঙে পড়ে গেছে। তার পাশের বাদাম গাছের ও একই অবস্থা। এপাশের জোরা দেবদারু, তাদের ও মাথা ভাঙা। আর এইদিকের ফলসা গাছটা, যেটাতে ছোট্ট ছোট্ট কাঁচা-পাকা ফলসা ধরতে শুরু করেছিল, সে বেচারা একেবারেই উলটে পড়ে গেছে, গোড়া থেকে। একটু দূরে, পূবের দিকে, বিরাট শিরীষ গাছের একদিকের ডালপালা সব ভেঙে গেছে। ওই গাছে কত টিয়াপাখি থাকে। তারা সব কোথায় গেল কে জানে? মাছরাঙা, ফিঙে আর বসন্তবৌরিগুলোই বা গেল কোথায়? এসব ভাবতে ভাবতেই আমাদের বারান্দার টবের লতাগুলির অবস্থা দেখছিলাম। ঝড়ে তাদের ডাল ছিঁড়ে গেছে, পাতাগুলি ছিন্নভিন্ন। আমাদের জানলার কাঁচ ভেঙেছে, ছাদের পুরনো কাঠের দরজা ভেঙেছে...সারা কলকাতায় আর কলকাতার আশেপাশে, সবাই আছে কেমন?
ধীরে ধীরে একটু একটু করে খবর পেতে থাকলাম। সে খবর সহ্য করা যায়না। ভেসে গেছে দক্ষিণবঙ্গের গ্রামের পর গ্রাম; নষ্ট হয়েছে চাষের ফসল; পুকুরের জলে মিশে গেছে সমুদ্রের জল; লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে না আছে মাথার ওপর ছাদ, না আছে খাবার জিনিষ বা পরিষ্কার খাবার জল। এমন খারাপ পরিস্থিতি আমাদের অভিজ্ঞতায় বহুদিন নেই। চারদিক থেকে বন্ধুরা মেসেজ পাঠাচ্ছেন - মানুষের খাবার চাই, পরনের কাপড় চাই, ওষুধ চাই, মাথার ওপর ছাদ চাই। যে যেমন পারো, যতটা পারো, সাহায্য করো। ইচ্ছামতী আর আমিও অল্প কিছু সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। তুমিও করেছ কি? তোমার এবং বাড়ির অন্যদের পুরনো কিন্তু আস্ত জামা, চাদর, শুকনো খাবার, জরুরী ওষুধ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার --- এই সব কিছু কিন্তু তুমি দিতে পারো ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য। তাঁদের কাছে এইসব দরকারী জিনিষ পৌঁছে দিচ্ছেন অনেক অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। পুরনো জিনিষ যদি দাও,মনে রেখো,সেগুলি যেন ছেঁড়া-ফাটা না হয়। ভাল করে ধুয়ে, গুছিয়ে পাট করে তবেই দেওয়া উচিত। এসবের সঙ্গে বা এসবের বদলে তোমার অভিভাবকেরা নিজেদের সাধ্যমত টাকাও পাঠাতে পারেন সরকারী এবং বেসরকারী নানা ফান্ডে।
সঙ্গে তো রয়েই গেছে 'কোভিড -১৯'-এর ভয় আর 'লকডাউন'। আগামি কিছুদিনের মধ্যে বড়দের অফিস খুললেও ছোটদের স্কুল খুলতে অনেক দেরী। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা নেই, স্কুলে যাওয়া নেই,হুটোপুটি করে খেলা নেই, প্রিয় ম্যাম বা স্যারের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ নেই... এমন আর ক'দিন? তুমি কি অনলাইন ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছ? আমাদের বেশিরভাগ বন্ধু কিন্তু এই সুযোগ পাচ্ছে না। অনলাইন ক্লাসের সুযোগ পায় এই দেশের খুব ,খুব কম সংখ্যক ছোটরা। আর এই ঝড়ের পরবর্তী সময়ে, যখন রাজধানী কলকাতাতেই আজ বারো দিন পরেও ঠিক ভাবে ব্রডব্যান্ড পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে শহরতলীতে বা জেলাগুলিতে কী খারাপ অবস্থা হয়ে আছে, আমরা সহজেই আন্দাজ করতে পারি।
সব মিলিয়ে, খুব, খুব মনখারাপ আমাদের --- আমার, ইচ্ছামতীর...আমি জানি তোমারও। কিন্তু মনখারাপ করে বসে থাকলে তো চলবে না। খুব অসুবিধার মধ্যেও মন ভালো রাখতে পারার উপায় আমাদের সবার শেখা দরকার। আর সেটা করার সহজ উপায় হল, নিজের ইচ্ছেমতন সুন্দর, ভালো কিছু একটা গড়ে তোলা, তৈরি করা। এমন ভাবনা নিয়েই আমরা এই মাসের শুরুতে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম - 'সূত্র ধরে গল্প লেখো'। সেই 'ছবিসূত্র ১' এর থেকে, নানা সূত্র বেছে নিয়ে, আমাদের চারটে দারুণ গল্প লিখে পাঠিয়েছে চারজন বন্ধু। মজার কথা হল, তার মধ্যে তিনটে গল্পই হল বন্ধুত্বের গল্প। কথা ছিল, সঠিক সময়সীমার মধ্যে গল্প পাঠালে, এই মাসের শেষে গল্পগুলি ইচ্ছামতীতে প্রকাশিত হবে। এই চারটে গল্প আর সঙ্গে আরও কিছু বন্ধুর আঁকা, লেখা, ছবি দিয়ে সাজালাম ইচ্ছামতীর এই কিস্তি। ইন্টারনেট কানেকশনের অবস্থা খুবই খারাপ, এর মধ্যেও আমাদের কথা রাখতে পেরে আমরা খুশি।
গত রবিবার পালিত হয়েছে ঈদ-উল-ফিত্র্। তার মাত্র তিন দিন আগেই তো এসেছিল 'আম্ফান'। তাই অনেক অনেক বন্ধুরা এবারে হয়ত সেভাবে ঈদ পালন করতেই পারেনি।আমরাও সবাইকে সেদিন 'ঈদ মুবারক' বলতে পারিনি। কিন্তু শুভেচ্ছা তো আর একদিনের জন্য হয়না, প্রত্যেকের জন্য শুভকামনা আমরা বছরের প্রতিটা দিনই করতে পারি। তাই আজকেই বলি, আমাদের সবার আগামি দিনগুলি নিরাপদ হোক, ভালোবাসায়, বন্ধুত্বে ভরা হোক।
ভালো থেকো, সুস্থ থেকো।
( সূত্র ছবিটি শিল্পীজুটি শাশ্বত ও সুশ্রুত নির্মিত ছোট্ট অ্যানিমেশন 'আফটার আম্ফান' থেকে নেওয়া। ইচ্ছামতীকে ছবিটি ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। পুরো অ্যানিমেশন ছবিটি দেখা যাবে এই লিংকে।)