রামধনু থিম নিয়ে ইচ্ছামতীতে প্রকাশ করব একগুচ্ছ লেখা, তাই নানারকমের তথ্য পাওয়ার জন্য ইন্টারনেট তো একটু ঘাঁটতেই হয়। তা সেই রামধনু নিয়ে গুগ্ল্ - এ খানিক সার্চ করতে করতেই চোখের সামনে চলে এল এই দারুণ সুন্দর রঙিন একটা খবর। কেন রঙিন খবর বলছি সেটা ছবিটা দেখলেই বুঝতে পারবে।
কিন্তু খবরটা বলার আগে, তোমাকে 'গ্রাফিটি' সম্পর্কে খুব ছোট্ট করে একটু বলে নিই। 'গ্রাফিটি' কে বাংলা করলে বলা চলে 'দেওয়াল শিল্প' বা 'দেওয়াল লিখন'। গ্রাফিটি শিল্পীদের সম্পর্কে বলি, এঁরা একা অথবা দলবদ্ধ হয়ে কাজ করেন। কি কাজ ? নিজের শহরের যেকোন ফাঁকা, জরাজীর্ণ বা একেবারেই ঠিকঠাক দেওয়া্লে নানারকমের ছবি এবং/অথবা স্লোগান এঁকে/ লিখে এঁরা নিজেদের বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দিতে চান। সেই বার্তা হতে পারে কোন সমবেত প্রতিবাদ বা সমবেত চাহিদা, বা একেবারেই নিতান্তই সৌন্দর্যায়নের জন্য। অনেকে আবার নিছক মজা করার জন্যেও করে থাকেন। বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটা বড় শহরে এই ধরণের গ্রাফিটি ভরা দেওয়াল দেখা যায়। বিশ্বের অনেক গ্রাফিটি শিল্পীকে শিল্পরসিক মানুষেরা এক ডাকেই চেনেন। গ্রাফিটি শিল্পীরা বেশিরভাগ সময়ে ছদ্মনাম ব্যবহার করেন এবং নিজদের আসল পরিচয় কাউকে জানতে দিতে চান না, কারণ, তাঁদের কাজকর্ম অনেকেরই অপছন্দ হতে পারে, বিশেষ করে দেশের প্রশাসকদের। আবার কোথাও কোথাও এঁদের কাজের এতই কদর যে, আলাদা করে এঁদের কাজের প্রদর্শনীও হয়।
কলকাতা শহরে অবশ্য এই ধরণের বার্তাবহ বা শিল্পসম্মত দেওয়াল খুব একটা চোখে পড়ে না। কলকাতায় মূলতঃ নির্বাচনের আগে যত রাজ্যের দেওয়াল লিখনগুলিকেই এই নাম দেওয়া যায়। তবে তুমি যদি তোমার স্কুলের তরফ থেকে স্কুলের পাঁচিলের বাইরের দিকে ছবি এঁকে থাকো, যাতে পথচলতি মানুষেরা সেই দেওয়ালটাকে নোংরা না করতে পারে - তাহলে কিন্তু তুমিও একজন গ্রাফিটি শিল্পী হয়ে গেছ !
রামধনু রঙে রাঙানো মেক্সিকোর পামিটাস শহর
এইবার আসি আসল খবরে ।এই মাত্র কিছুদিন আগে, মেক্সিকো সরকার , 'জার্মান ক্রু' নামে পরিচিত এক গ্রাফিটি শিল্পী দলকে দায়িত্ব দেন, পামিটাস নামের একটা ছোট্ট শহরকে ( বা সেটাকে একটা বড় গ্রামও বলা যায়) ছবি এঁকে সাজিয়ে তুলতে। আর 'জার্মান ক্রু' নামের এই দলটি কি করেছেন জান? পুরো শহরের ২০৯টা বাড়িকে নিচ থেকে ছাদ অবধি রামধনু রঙে রাঙিয়ে দিয়েছেন। রাস্তাঘাটও বাদ যায়নি। এই কাজে তাঁরা শহরের বাসিন্দাদেরও যুক্ত করে নিয়েছিলেন। মোট ২১৫,০০০ স্কোয়ার ফুটের এই ঝলমলে রামধনু শহরের বাসিন্দারা এখন মহা খুশি। জানা যাচ্ছে যে, তাঁদের শহর এত সুন্দর এবং রঙিন হয়ে ওঠার ফলে তাঁদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে। শহরে নাকি অপরাধের মাত্রাও অনেক কমে গেছে। সঙ্গের ছবিটা দেখলেই অবশ্য বোঝা যায় সেটা - এত সুন্দর ঝলমলে একটা শহরে থাকলে এমনিতেই সবার মন ভাল হয়ে যাবে।
আরেকটু খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, এই রঙিন বুদ্ধিটা প্রথম আসে বছর দুয়েক আগে তুরস্কের ইস্তানবুল শহরের ৬৪ বছরের বাসিন্দা হুসেইন সেটিনেল এর মাথায়। পাহাড়ি উঁচু -নীচু এলাকায় ভরা নগর ইস্তানবুলে রয়েছে অনেক সিঁড়ি, যাতে শহরের বিভিন্ন এলাকাগুলিতে পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য পথচারীদের গাড়িতে ঠাসা প্রধাণ রাস্তাগুলিকে ব্যবহার না করতে হয়। হুসেইন সেটিনেল এর বাড়ির সামনে এইরকমই এক সিঁড়ি ছিল - একঘেয়ে ছাই ছাই রঙের ।তিনি 'ফিন্ডিকলি' নামে পরিচিত এই সিঁড়িটিকে রামধনুর সাত রঙে রাঙিয়ে দেন- যথেষ্ট অর্থব্যয় করে তিনি রঙ কেনেন, এবং চারদিন ধরে বাড়ির লোকেদের সাহায্যে সিঁড়িগুলিকে রাঙিয়ে দেন। তিনি কিন্তু এটা কোন প্রতিবাদ বা দাবীর জন্য করেন নি- তাঁর মনে হয়েছিল, সিঁড়িগুলো রঙিন হলে মানুষ খুশি হবে।
রামধনু সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার মজাই আলাদা
তা খুশি হলও সবাই। 'ফিন্ডিকলি' সিঁড়ির ছবি শেয়ার হতে থাকল সোশ্যাল মিডিয়াতে। তারপরেই হল এক কান্ড। কয়েকদিন পরে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সবাই দেখতে পেল, কারা যেন সেই রামধনু সিঁড়িটাকে আবার মনমরা ধূসর রঙের তলায় চাপা দিয়েছে। সবাই বুঝতে পারল এটা করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সাধারণ মানুষ খুবই বিরক্ত হলেন এবং ঠিক করলেন এর প্রতিবাদ করা উচিত। ভাল কাজের জন্য অনেক মানুষকে একত্রিত করতে যে ফেসবুক বা ট্যুইটারকে কত সফল ভাবে ব্যবহার করা যায়, তা আমরা গত কয়েক বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখেছি। তুরস্কেও তাই হল। সাধারণ মানুষ একত্রিত হলেন, এবং এবার শুধু ওই একটা সিঁড়ি নয়, ইস্তানবুল শহরের অন্যান্য সিঁড়িগুলোকেও রাঙিয়ে দিলেন রামধনুর সাত রঙে। তাঁদের কাজকে সমর্থন জানিয়ে তুরস্কের অন্যান্য শহরের বাসিন্দারাও একইভাবে রঙ করে ফেললেন তাঁদের নিজের নিজের শহরের অনেক সিঁড়ি এবং পথ। আর প্রশাসন ? তারা প্রথমে অস্বীকার করেছিল, পরে স্বীকার করে নেয় যে তারাই বিচ্ছিরি ছাই রঙে ঢেকে দিয়েছিল প্রথম রামধনু রঙ সিঁড়িটি, আর তারপরে এই কাজে সাধারণ মানুষের সাথে হাতও লাগায়।
সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখে দিয়েছে বিভিন্ন শহরের রামধনু রঙা পথ ও সিঁড়ির ছবি
তুরস্কের বাসিন্দাদের অনেকেই মনে করেছিলেন, দৈনন্দিন জীবনের নানা রকমের সমস্যার মধ্যে এইরকম রঙিন, সুন্দর পটভূমি সাধারণ মানুষের মন ভাল রাখতে সাহায্য করবে। মেক্সিকোর পামিটাসের বাসিন্দারাও তাই বলছেন। আমার ও তো সেইরকম মনে হচ্ছে। তোমার কি মত ? সুযোগ পেলে, কলকাতা শহরের কোন জায়গাটাকে এইরকম রামধনু রঙে ভরিয়ে দেওয়া যায় বলতো?
ছবিঃ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইট