সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
অ্যান্টিম্যাটার

অ্যান্টিম্যাটার পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পদার্থ

যদি তোমাদের জিজ্ঞেস করি পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পদার্থ কী, তাহলে তোমাদের মাথায় সবার প্রথমে নিশ্চয় সোনা অথবা হীরার নাম আসবে। কিন্তু জেনে অবাক হবে যে পৃথিবীতে এমনও জিনিস আছে যার মূল্যের কাছে সোনা বা হীরা এগুলোকে অনেক তুচ্ছ মনে হবে। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছ, অ্যান্টিম্যাটারই হলো সেই জিনিস যেটা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পদার্থ হিসেবে পরিচিত। অ্যান্টিম্যাটার কী, কেনই বা অ্যান্টিম্যাটার সবচেয়ে মূল্যবান পদার্থ, এটি নিয়েই আজকের এই লেখা।

সোনা বা হীরা নিঃসন্দেহে খুব মূল্যবান পদার্থ। প্রতি গ্রাম সোনার মূল্য প্রায় ৫০ ডলার এবং একটি উন্নত মানের হীরের মূল্য ক্যারাট প্রতি প্রায় ৬০০০০ ডলার। কিন্তু এসব কিছুর চেয়ে অনেক অনেক বেশি মূল্যবান পদার্থ হল অ্যান্টিম্যাটার যার প্রতি গ্রামের মূল্য প্রায় ৬০ ট্রিলিয়ন ডলার। বর্তমানে পৃথিবীর অর্থনৈতিক হিসাবে সকল দেশের মোট নোট ও কয়েনের পরিমাণ প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিতে এটিকে M-Zero(M0) বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত নোট ও কয়েন দিয়ে মাত্র ৮০ মিলিগ্রাম অ্যান্টিম্যাটার কেনা সম্ভব। এখন জানা যাক কী এই অ্যান্টিম্যাটার।

অ্যান্টিম্যাটার কী?

আমরা সকলেই পদার্থ কী সেটা মোটামুটি জানি।
চিরায়ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যা কিছু কোনও স্থান দখল করে এবং বল প্রয়োগ করলে স্থানচ্যূত হয়, জড়তা (বা ভর) ও মহাকর্ষ ধর্ম প্রদর্শন করে, তাকে Matter বা পদার্থ বলে ।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে অ্যান্টিম্যাটার হল ম্যাটার এর বিপরীত। 'অ্যান্টিম্যাটার'এই ধারণার পিছনে অনেক গাণিতিক হিসেব রয়েছে। x^2= 4 এই ইকুয়েশনের দুটো সমাধান আছে যেখানে x=2 অথবা x=-2. প্রখ্যাত বিজ্ঞানী পল ডিরাক সর্বপ্রথম তাঁর রিলেটিভিস্টিক শ্রডিঙ্গার ইকুয়েশনের সমাধানে এইরকম ব্যাপারটি লক্ষ করেন। এখানে যদি কোন পদার্থ x=2 হয় তাহলে নিশ্চয়ই নেগেটিভ 2 (-2) অর্থাৎ এমন কিছু যা পদার্থের ঠিক বিপরীত তাও সম্ভব। পদার্থবিজ্ঞানী একে অ্যান্টিম্যাটার নাম দেন।

অ্যান্টিম্যাটারপল ডিরাক

বিষয়টাকে একটু ব্যাখ্যা করা যাক। আমরা জানি যে কোন ম্যাটার বা পদার্থ অণু দিয়ে গঠিত আর এই অণুকে ভাঙলে পরমাণু পাওয়া যায়। সাধারণ ম্যাটার বা পদার্থের পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস যা প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে গঠিত এবং এর চার্জ পজিটিভ হয়। এই পজিটিভ চার্জের নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে নেগেটিভ চার্জ বিশিষ্ট ইলেকট্রন ঘুরতে থাকে। অ্যান্টিম্যাটারও অণু/পরমাণু নিয়ে গঠিত। কিন্তু পার্থক্য এই যে অ্যান্টিম্যাটারের পরমাণুর কেন্দ্রে প্রোটনের পরিবর্তে অ্যান্টিপ্রোটন থাকে যা নেগেটিভলি চার্জড আর সেই কারণে অ্যান্টিম্যাটারের নিউক্লিয়াসও নেগেটিভলি চার্জড। আর ইলেকট্রনের পরিবর্তে থাকে পজিট্রন যার চার্জ পজিটিভ এবং এটি নেগেটিভলি চার্জড নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে।

অ্যান্টিম্যাটারের কার্যক্ষমতা ও কেনই বা অ্যান্টিম্যাটার সবচেয়ে মূল্যবান পদার্থ?

অ্যান্টিম্যাটারের বিশেষত্ব এই যে অ্যান্টিম্যাটার যখন সাধারণ ম্যাটারের সংস্পর্শে আসে তখন এরা একে অপরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ১০০% শক্তি বা এনার্জিতে পরিবর্তিত হয়।

পারমাণবিক বোমা বা অন্যান্য পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র সর্বোচ্চ ৭ থেকে ১০ শতাংশ পদার্থকে শক্তিতে পরিণত করতে পারে। হিরোশিমাতে ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট যে পারমানবিক বোমা ফেলা হয়েছিল তার নাম ছিল Little Boy যার ওজন ছিল ৪৪০০ কেজি যার মধ্যে ইউরেনিয়াম-২৩৫ ছিল ৬৪ কেজি। আর আশ্চর্যের বিষয় এই ৬৪ কেজির মধ্যে ১ কেজিরও কম পদার্থ Neuclear Fission ঘটায় আর মাত্র ৬০০ মিলিগ্রাম পদার্থ শক্তিতে পরিবর্তিত হয়।

একটি পেপার ক্লিপের ওজনও প্রায় ৬০০ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ একটি পেপার ক্লিপের ওজনের অ্যান্টিম্যাটারকে ম্যাটারের সংস্পর্শে আনলে তা হিরোশিমা বিস্ফোরণের মতো বিস্ফোরণ করতে সক্ষম। অ্যান্টিম্যাটার দিয়ে বোমা বানানো ছাড়াও তাকে বুলেটে ব্যবহার করা যেতে পারে, যেখানে কোন সাধারণ বুলেটের অগ্রভাগে রাখা হবে ১ গ্রামের ১০০ কোটি ভাগের একভাগ ওজনের পজিট্রনকে। এই বুলেট এতটাই শক্তিশালী যে রাইফেল থেকে নির্গত হয়ে এটি একটি বাড়ি, ট্যাঙ্ক বা অনুরূপ আকারের বস্তুকে নিমেষে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।

এগুলো অবশ্য ভবিষ্যতের ব্যাপার। কারণ উপরোক্ত প্রয়োগের জন্য যে পরিমাণ স্থায়ী অ্যান্টিম্যাটার লাগে তা তৈরি করা এখন অবধি নিতান্তই অসম্ভব।

তবে অস্থায়ী অ্যান্টিম্যাটারকে ইতিমধ্যেই মেডিকাল ডায়গনোসিসের কাজে প্রয়োগ করা হয়েছে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এমন তত্ত্ব উঠে এসেছে যে অ্যান্টিইলেকট্রন অর্থাৎ পজিট্রনকে শরীরে ইঞ্জেকশনের মারফত ঢুকিয়ে দিলে তা গতিপথে ইলেকট্রনের সাথে যুক্ত হয়ে গামা রে তৈরি করে। এই গামা রে'র সাহায্যে গৃহীত শরীরের ভেতরের চিত্র পজিট্রন এমিশন টমোগ্রাফি বা PET স্ক্যান আজকাল ক্যান্সার নির্ণয়ে ব্যাপক ব্যবহার করা হচ্ছে। অ্যান্টিপ্রোটন ব্যাবহার করে ক্যান্সারের চিকিৎসা করাও সম্ভব।

খুব সামান্য পরিমাণ অ্যান্টিম্যাটার বিপুল শক্তি সরবরাহ করে আর এই কারণে ইন্টারস্টেলার ট্রাভেল অর্থাৎ সৌরমণ্ডল থেকে অন্য নক্ষত্রমণ্ডলে যাবার জন্য যে রকেট পাঠানো হয় তার জ্বালানী হিসাবেও ভবিষ্যতে অ্যান্টিম্যাটারকে ব্যবহার করা যেতে পারে। বৈজ্ঞানিক হিসেবনিকেশ থেকে দেখা যায় অ্যান্টিম্যাটারকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে প্রায় আলোর অর্ধেক গতিসম্পন্ন রকেট বানানো সম্ভব। আর এই রকেট যদি সত্যি বাস্তবায়িত হয় তাহলে সূর্যের নিকটবর্তী নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টোরির কাছাকাছি পৌছতে মাত্র ৮ বছরের কিছু বেশি সময় লাগবে। আর এত বিশাল গতির রকেট বানানো সম্ভব হলে মানুষ যে ভবিষ্যতে অন্য নক্ষত্রলোকে পাড়ি দিতে পারবে তা বলাই বাহুল্য।

কিন্তু এখানে বলে রাখি অ্যান্টিম্যাটারের এত উল্লেখযোগ্য ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত মাত্র ১৮ ন্যানো গ্রাম স্থায়ী অ্যান্টিম্যাটার বানানো সম্ভব হয়েছে। আর এই ১৮ ন্যানো গ্রাম অ্যান্টিম্যাটার থেকে যে শক্তি উৎপন্ন করা যাবে তা দিয়ে একটি লাইট বাল্বকে মাত্র ৮ ঘণ্টা জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব -- মাত্র ৮ ঘণ্টা! এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ঠিক কী কারণে আমরা অধিক পরিমাণ স্থায়ী অ্যান্টিম্যাটার উৎপন্ন করতে পারছি না? আসলে স্থায়ী অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করা যতটা কঠিন ঠিক ততটাই খরচ সাপেক্ষ। কীভাবে অ্যান্টিম্যাটার তৈরি হয় সেটা বলি।

কীভাবে অ্যান্টিম্যাটার তৈরি হয়?

ইউরোপীয় নিউক্লীয় গবেষণা সংস্থা সার্ন (CERN) দ্বারা ১৯৯৯ এবং ২০০৮ সালের মধ্যে ১০,০০০ এরও বেশি বিজ্ঞানী এবং শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরীক্ষাগার, পাশাপাশি ১০০টিরও বেশি দেশের সহযোগিতায় নির্মিত হয়েছিল লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (LHC) আর এটি হলো এখন পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম সর্বোচ্চ-শক্তির কণা সংঘর্ষক (ত্বরক) এবং বিশ্বের বৃহত্তম মেশিন।

অ্যান্টিম্যাটারলার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার

আর এই লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের মধ্যে দিয়ে যখন প্রোটন কণাকে চালনা করা হয়, তখন হাইড্রোজেন অ্যান্টিহাইড্রোজেনে পরিণত হয়। তবে এই অ্যান্টিম্যাটারের বেগ অত্যন্ত হওয়ায় তা দ্রুত ম্যাটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। তাই অপেক্ষাকৃত স্থায়ী অ্যান্টিম্যাটার করতে হলে ব্যবহার করা হয় অ্যান্টিপ্রোটন ডিসিলারেটর (মন্দক), যা অ্যান্টিম্যাটারের বেগ কমিয়ে তাকে সংরক্ষণ করার সুযোগ করে দেয়।

কীভাবে এই অ্যান্টিহাইড্রোজেনকে সংরক্ষন করা হয়?

এখানে প্রশ্ন আসে কীভাবে এই অ্যান্টিহাইড্রোজেনকে সংরক্ষন করা হয়, কেননা অ্যান্টিম্যাটার যে কোনো পদার্থের সংস্পর্শে এলেই শক্তি নির্গত করে সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়। আর তাই এই অ্যান্টিহাইড্রোজেনকে কোনভাবে কোন কিছুর সংস্পর্শে রাখা যাবে না। জল, বাতাস এমন কি কোন পাত্রের সংস্পর্শেও আনা যাবে না।

CERN এর বিজ্ঞানী ডঃ বার্চ এবং তাঁর টীম ম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করে অ্যান্টিহাইড্রোজেনকে সংরক্ষণ করতে সমর্থ হন। এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিটেক্টর অনেকটা potential well এর মতো বা বলা যেতে পারে বাথটাবের মতো, যার মধ্যে ম্যাগনেটিক ফিল্ড অ্যান্টি হাইড্রোজেনকে কোনভাবে পদার্থের সংস্পর্শ থেকে আলাদা করে সংরক্ষন করে রাখে। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় 'পেনিং মালবেরি ট্র্যাপ (Penning–Malmberg trap)'।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৯৩৯ সালে 'ম্যানহাটন প্রজেক্ট' অর্থাৎ যে প্রজেক্টে পৃথিবীর প্রথম অ্যাটম বোম তৈরি করা হয় তা তৈরি করতে ব্যয় হয় ২ বিলিয়ন ডলার যা বর্তমান অর্থবাজারের হিসাবে ২৪ বিলিয়ন ডলার! বর্তমানে অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করার পন্থা নিয়ে গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা যদি বিপুল পরিমাণে অ্যান্টিম্যাটার তৈরি ও সংরক্ষণ করার উপায় বের করতে পারেন তাহলে যেমন বিজ্ঞান জগতে একটি নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হবে তেমন তৈরি হবে পারমাণবিক গণ মারণাস্ত্র, যার কুপ্রভাবে ভুগতে হবে বিশ্ববাসীকেই!

( লেখক মাইজদী,নোয়াখালী,বাংলাদেশের নোয়াখালী জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র)

গ্রাফিকঃ মিতিল
অন্যান্য ছবিঃ সার্ন ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া

বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ অনিরুদ্ধ সেন

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা