স্মৃতির ড্রইং খাতা খানা বার করে দেখছি এটা বেশ পুরনো হয়ে গেছে। আঁকা গুলো ধূসর মোছা মোছা। স্পষ্ট করতে গেলে ইরেজ করা জায়গা গুলো রি-রাইট করতে হবে গাঢ় পেন্সিল দিয়ে। দেখাই যাক না-
তখন তো শুধু কল্পনার সময়। একটা নতুন বাসস্থানে নতুন করে গড়ে তোলা ছোট্ট জীবনটা। আমার শিশুকাল ঠাকুমা জেঠিমা জ্যাঠতুতো দাদা দিদি দের মধ্যেই কাটছিল যতটা ততটা ঠিক মা-বাবার সঙ্গে নয়। তবে বাবার কাজের খাতিরে দক্ষিণ কলকাতার ডোভার লেনে বাসা পরিবর্তনের ফলে শুরু হল শুধু বাবা-মা আর ছোট একটি বোনের সঙ্গ। আর মাঝেমধ্যে একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য গণের যাওয়া-আসা। তখন থেকেই নিজের মধ্যে একটা জগৎ তৈরি হয়েছিল। সেটা যে কেমন তা ঠিক বোঝানো যাবে না। তবে সবেতেই কৌতূহল, সবকিছুর অর্থাৎ ঘটনাক্রম গুলির খোঁজখবর করা, ফাঁকা জায়গা পেলেই ছুটতে ছুটতে অনেকদূর চলে যাওয়া। নতুন নতুন রাস্তা খোঁজা- এগুলোতেই যেন ভাললাগা গুলো আটকে থাকতো। বাড়িতে সবকিছু নিষেধ যত অর্থাৎ বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানো- আমার যেন ততই বাইরের যা কিছু তার ওপর বেশি ঝোঁক।
এখন বাচ্চাদের জন্য মায়েদের কাজের অন্ত নেই। তাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নানা রকম টিফিনের আয়োজন করা, হোম টাস্কের ওপর বিশেষভাবে নজর দেওয়া। ক্লাসে কী পড়ানো হয়েছে, কোন ছাত্র বেশি নম্বর পেয়েছে তাই আলোচনা করা। নিজের বাচ্চাকে আরো নম্বর পেতে উদ্বুদ্ধ করা- এইসব যেন এক ভীষণ ব্যাপার। আমার মনে পড়ে পাশের বাড়ির এক মহিলা তার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে যাচ্ছেন- আমি মাকে বললাম "পলির মা পলিকে স্কুলে ভর্তি করাতে যাচ্ছে, আমিও স্কুলে ভর্তি হব মা"। মা বাপি কে জিজ্ঞেস করলেন। তারপর আমার যে ক'টা বই আর স্লেট ছিল তাই নিয়ে পলির মায়ের সঙ্গে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়ে এলাম। সেটা ছিল প্রথম শ্রেণি। কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলতাম "ক্লাস ওয়ান"। টুনু ছিল পাড়ার একটি ছেলে। সেই টুনু আমার সঙ্গে একই স্কুলে আর একই ক্লাসে পড়ত। সে একদিন বলেছিল "কী রে তুই! কেউ জিগাইলে কইস্ যে কেলাস ওয়ানে পড়স্! লজ্জা লাগেনা? কইবি টু তে পড়স্, অত বড় মাইয়া..." -
খুব অবাক হয়েছিলাম। আমার যা বয়স তাতে ক্লাস ওয়ানে পড়াটা খুব একটা লজ্জার ছিল না। কিন্তু আমি শিখলাম মিথ্যে কথা বলা যায় নিজের কৃতিত্ব দেখানোর জন্য। এও একটা জগৎ চেনা বৈকি।
আমার স্কুলের কাছেই ছিল সিংহীদের বিশাল মাঠ। দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত সিংহী পার্কের দুর্গাপুজো এখন যেখানে হয়, ঠিক সেখানেই। সিংহীদের মাঠে ছিল বাদাম গাছ আরও সব নানারকম বড় বড় গাছ। স্কুলের স্পোর্টস হত সেখানে। আর সিংহীদের বাড়ির বাগানের শেষ প্রান্তটা ছিল ওই মাঠের শেষে। একটা মস্ত বড় লোহার গেট আর তার মধ্যে দিয়ে একটা ছোট যাওয়া আসার রাস্তা, মানে ছোট গেট। কৌতূহলবশে একদিন টিফিনের সময় কয়েকজন মিলে ওই ছোট গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলাম বড় একখানা দোলনা। এত যে ভালবাসতাম দোলনা চাপতে- কয়েকজন মিলে ওই দোলনায় চড়ে যেন আকাশের মত আনন্দ পেলাম। তারপরেই মনে হল স্কুলের ঘণ্টা পড়ে গেছে। "চল চল দিদিমণি বকবে"। ছুট্ ছুট। হ্যাঁ ক্লাস আরম্ভ হয়ে গেছে। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেছে আমার। প্রথম দিন টিচার কিছু বললেন না, শুধু সাবধান করে দিলেন আর যেন কখনও স্কুল চলাকালীন কোথাও না যাই। হায় হায়! ভাললাগার স্বাদ কি শাসনে আটকানো যায়? তখন যে বড্ডই ছোট।
একদিন একজন বলল- "আজ হাফ ছুটি, সিংহীদের বাড়িতে যাবি? ওদের বাগানে খুব ভাল করমচা হয়েছে, চল কেউ জানতে পারবে না। দারুণ খেতে রে"। আমি তখনও করমচা খাইনি কোনোদিন। ব্যাপারটা জানতেও বটে আর দোলনা চাপার লোভটাও আছে, চলে গেলাম। সেদিন কিন্তু ভাগ্যটা নেহাৎই খারাপ ছিল। গেট দিয়ে আমরা ক'টা ছেলেমেয়ে যেই না ঢুকেছি অমনি ওদের দারোয়ান এসে আমাদের সবাইকে ধরে নিয়ে একেবারে ওদের ঘরের মধ্যে আটকে রেখে দিল। আমাদের ভয় দেখিয়ে বলল- "তোদের পুলিশে দেব, রোজ রোজ বাগানে ঢুকে হল্লা মাচাস"। আমার বন্ধুরা সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিল। "ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও আর আসব না"। আমি কিন্তু কাঁদিনি। আমার ভয় করছিল খুব। কিন্তু পুলিশের নয়, বাড়িতে বকুনি মারের ভয়। আর আমার রাগ হচ্ছিল ওদের চাকর দারোয়ানরা আমাদের "তুই তুই" করে কথা বলছিল বলে। সত্যি কপালে দুঃখ ছিল সেদিন। ওরা আমাদের ছেড়ে দিল প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে। কিন্তু এমন গেট দিয়ে ছাড়ল যেখান থেকে বাড়ি আসার পথ চিনতে পারছিনা কিছুতেই। এখন বুঝতে পারি ওটা ছিল গরচা। ঐ সিংহী পার্কের পেছন দিকটায়। এখন যেখানটায় গড়িয়াহাট প্যান্টালুনস্ । তখন গরচা এখনকার মত নয়, সবে তৈরি হচ্ছে। কী করে যাব? কোথাও গর্ত করে চুণ গুলে চৌবাচ্চা করা, কোথাও স্টোন চিপসের পাহাড়, কোথাও পিচ গলানো হচ্ছে।
বন্ধুরা সব অন্য পথে যে যার বাড়ির দিকে চলে গেছে। আমি যাকে পাচ্ছি জিজ্ঞেস করছি- "থ্রি ডি ডোভার লেন কোথায় জানেন গো?" কেউ বলছে "জানিনা", কেউ বলছে "তুমি এখানে কী করে এলে?" কপাল জোরে এক দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক উনি বোধহয় ওখানকার সুপারভাইজার, হঠাৎ আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন- "তুমি কাকে খুঁজছ? কোথায় বাড়ি তোমার?" আমি যেই বলেছি- "থ্রি ডি গভর্মেন্ট কোয়ার্টার ডোভার লেন"- উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন- "আরে তুমি তো নীহার বাবুর মেয়ে! এখানে কী করে এলে?" বলতে তো পারব না সিংহীরা আটকে রেখে গরচার দিকের গেট দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। অনেক কথা এসে যাবে তাহলে। সেই ভদ্রলোক তখন আমাকে নিয়ে বাড়ির রাস্তায় দিয়ে আসতে লাগলেন। যেই চেনা পথের কাছাকাছি এসেছি অমনি আমি ওই ভদ্রলোককে বললাম- "এইবার আমি পারব", বলেই দে ছুট্। উনি বললেন- "তোমার বাবাকে বলো দাড়ি রায়কাকু তোমাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন"।
মা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন, মেয়ে কখন বাড়ি আসবে বলে। তখন আর মাকে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলার মত মনের বা শরীরের শক্তি নেই। মা তখন কিচ্ছু বলেননি। চান করিয়ে, ভাত খাইয়ে দিলেন মা। ভেতর থেকে অন্যায় বোধের জন্য কেমন কান্না আসছিল। সব কথা, স-ব কথা মাকে বললাম কাঁদতে কাঁদতে। মা শুধু বললেন- "সব সময় বন্ধুদের কথা শুনতে নেই। ওরা তো তোমাকে চুরি করার কথা বলেছিল, তাই দারোয়ান আটকে রেখেছিল"। সব কথা শিখিয়ে দিতে হয় না। মনে মনে শিখে নিলাম কারোর বাড়িতে লুকিয়ে ঢুকতে নেই।
কোথা দিয়ে যে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। মর্নিং স্কুল- সাড়ে ছ'টায় স্কুল শুরু। আমি জানতাম কী পড়ানো হবে। ক্লাসের ভয় অত ছিলনা। ঘড়ির জ্ঞানও ছিলনা। পথে যেতে যেতে কোন বাড়িতে কত সুন্দর ফুল ফুটেছে, কোনখানে চৌবাচ্চায় লাল নীল মাছ আছে, পুলিশ ব্যারাকে পুলিশরা কুস্তি করছে- সেই সব দেখতে দেখতে স্কুলে যেতাম। একদিন ফার্স্ট পিরিয়ড ওভার স্কুলে পৌঁছলাম। হ্যাঁ শাস্তি জুটেছিল ঘরে-বাইরে। ক্লাসে টিচার ঢুকতে দেননি আর বাড়িতে পলি নালিশ করে দিয়েছিল। সেই দিন মায়ের পিটুনি খেয়েছিলাম। আর একদিনও পলি নালিশ করেছিল। তখন আমার বাড়ি থেকে হাতে পয়সা দেওয়া হত না। প্রদীপ এসে বলল- "শোন্ এক আনার আলু কাবলি খাবি?" খুব ইচ্ছে করল, কিন্তু বললাম- "না রে ,আমার পয়সা নেই।" প্রদীপ বলল- "পয়সা লাগবে না, তুই তোর খাতা থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে দে, ও তোকে এক আনার আলু কাবলি দেবে"। সত্যি সত্যিই খাতার একটি পাতায় আমার এক আনার আলু কাবলি আজও যেন মুখে লেগে আছে। এইসব ছোট ছোট আনন্দ ভাললাগা কোথাও আর পাওয়া যায় না। তা পলি এসে আমার মা-বাপি সব্বাইকে নালিশ করেছিল। বাপি বলেছিলেন- "খাতার পাতা দিয়ে কিছু কিনে খাওয়া মানে তুমি ওটা বিক্রি করলে। বই খাতা যত্ন করে রাখতে হয়, সেটা দিয়ে কিছু কিনতে হয় না"। কেন জানিনা সেদিন এই শিক্ষাটা শুনলাম ঠিকই কিন্তু মানতে পারলাম না। গোঁজ হয়ে রইলাম। যদিও আর কোনোদিন ওই লোকটাকে দেখতে পাইনি যে আরও আলু কাবলি খাব খাতার পাতার বদলে।
আমাদের কোয়ার্টারের কাছে একটা বস্তি ছিল। তখনকার বস্তি এখনকার মত পাকা বাড়ি নয়। খাপরার চাল, বাঁশের বেড়া, মাটির দেওয়াল আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা যত হতভাগ্যের দল সেখানকার অধিবাসী। ওরাও আমার বন্ধু ছিল। মেয়েরা বেশিক্ষণ খেলতে পারত না ওরা কাজ করতে যেত। কিন্তু ছেলেরা ডাংগুলি খেলত, ঘুড়ি লুটত, কদম ফুল পাড়ত। ওরা সবাই আমার বন্ধু ছিল। সত্যেন বলে একটা ছেলের সঙ্গে কাটা ঘুড়ি লোটবার জন্য হই হই করে দৌড়তাম। একটা কালো রঙের ঘুড়িকে আমাদের থেকে লম্বা একটা লোক ধরে নিল। আমরা হতশ্বাস হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকটা বলল "কাকে দেব তোমাদের মধ্যে?" আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। লোকটা আমাকে ঘুড়িটা দিয়ে বলল "তুমিই নাও"। আমি ঘুড়িটা খুব খুশি হয়ে নিয়েছিলাম। তারপর সত্যেন কে দিয়েছিলাম। সত্যেন বলল- "ওটাতো তোকে দিল", আমি বললাম- "আমরা ছুটছিলাম দুজনেই, যদি লোকটা না থাকত তাহলে তো তুই পেতিস, তুই তো আমার থেকে লম্বা। তুই নে এটা।" সত্যেনের মুখটা আলোয় ভরে গেল যেন।
ছোটবেলাটা কেটে গেল, ছোটবেলা কাটল না মন থেকে। জীবনটা মহীরুহের মত গোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আনমনে ছোটবেলার দিকে- সবটা দেখতে পায় না- যে টুকু পায় সেটুকুই জীবনকে শক্ত করে গড়ে দেয়।
ছবিঃ আবির